Back
১)
প্রথম সন্তানের মা হওয়া সবার জন্য কতই আকাঙ্খিত। ৩৭ সপ্তাহ শেষে ইডিডির বেশ আগেই হঠাৎ পেইন উঠে নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছিল আমার মেয়ে। হাসপাতালে যখন যাই তখন ৩ সেমি জরায়ু মুখ খুলেছিল। তারপরও রুটিন অনুসারে সেলাইন, পিটোসিন, ডেলিভারির সময় এপিসিওটমি দেওয়া হয়েছিল৷
বাবু হওয়ার প্রায় আধা ঘন্টা পর তাকে একটু সময়ের জন্য আমার কাছে দেওয়া হয়। বাবুকে কাছে নেওয়ার তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্তেও প্রচন্ড ক্লান্তি এবং ব্যথা অনুভব করছিলাম৷ একটা সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ আমার বাবা মা ছিলেন পাশে৷ তারা দুইজন পালাক্রমে বাবুর কান্না থামাতে কোলে নিয়ে হাঁটছিলেন, যাতে আমি একটু বিশ্রাম নিতে পারি৷ আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুক।
পরদিন সকালে সারারাত জার্নি করে বাবুর বাবা এসেছিল। বাসায় যেয়ে আমি মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে ভালোই ছিলাম, এপিসিওটমির জন্য বসতে কষ্ট হচ্ছিল। একটা ফিডিং পিলো কাজে এসেছিল। তখন মনে হয় আসলেই হরমোনাল লেভেল ঠিক ছিল না৷ সবার প্রতি অনেক এক্সপেক্টেশন ছিল, ছোট খাট বিষয়ে রিয়েক্ট করে ফেলতাম। এখন মনে হচ্ছে ছোট খাট, তখন বড়ই মনে হত। আশেপাশে সবাই আন্তরিক ছিল, তবে বাবুকে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য কালো না ফরসা এসব শুনলে খুব কষ্ট পেতাম। বাবুর খাওয়া-ঘুম সব ঠিক থাকলেও টেনশন করতাম।
বাবুর চল্লিশ দিন হওয়ার পর প্রথম বাবুর বাবাকে নিয়ে কিছু সময়ের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল৷ সব করে ফেলবো, পারবো এইসব চিন্তা মাথায় ছিল, ৭ দিনের মাথায় বাচ্চাকে নিয়ে কেকও বানিয়েছিলাম। কিছু করতে না পারলেই মন খারাপ হত। আল্লাহর কাছে দোআ করতাম, নিজের পছন্দের কাজগুলো করার চেষ্টা করতাম৷ মাঝে এক কাপ চা নিয়ে বসতাম, ছাঁদে হাটতে যেতাম।
মেয়ে দিনে অনেকবার পটি করত, প্রায় প্রত্যেকবার দুধ খাওয়ার পর পরই। এটার জন্য অনেক কষ্টে ছিলাম, কান্না কাটিও করত। এত জ্বালাতো যে নিজে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ার সময়টা পেতাম না। শিশু ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, বলেছিলেন সব ঠিক আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে ছিলাম বলতে হয়। তবে ডেলিভারির ব্যাপারটা আমার কাছে কষ্টদায়ক স্মৃতি হিসাবে ছিল। আমি ব্যাথায় কাতরাচ্ছি, আশে পাশে কেউ নেই। এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য কষ্টকর ছিল। এই কষ্ট থেকে পরবর্তীতে আমানি বার্থের কোর্স করা, দৌলা প্রফেশনে আসা।
২)
এখন আসি আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরের গল্পে। এবার বাবু হল সম্পুর্ন ন্যাচরাল ভাবে, পাশে আমার হাসবেন্ড ছিল৷ কোন স্যালাইন, পিটোসিন দেওয়া হয়নি, এপিসিওটমিও না। হাসপাতালে যখন গিয়েছি জরায়ু মুখ প্রায় সম্পুর্ন খুলে গিয়েছিল৷ হালকা টিয়ার হয়েছিল যেটা স্টীচ করে দেওয়া হয়েছিল। বাবু হওয়ার পর স্কীন টু স্কীন কন্টাক্ট, ব্রেস্টফিডিং করা হয়েছিল৷ আমি মোটেও ক্লান্ত ছিলাম না। তবে ক্ষুধার্ত ছিলাম৷ অনেক কিছু খেয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর টের পেলাম আমার অনেক ব্লিডিং হচ্ছে, নিচের চাদর ভিজে যাচ্ছে। নার্সকে জানানোর পর উনি কিছু মেডিসিন দিলেন, এভাবে বোধহয় স্টীচ খুলে গিয়েছিল৷ পরবর্তীতে ব্লিডিং কমলেও ওইসময় ডাক্তার আবার স্টীচ দিয়েছিল। দ্বিতীয় বার স্টীচ দেওয়ার সময় খুব কষ্ট হয়েছিল।
এইসবের পরেও আমি মানসিকভাবে স্ট্রং এবং পজেটিভ ছিলাম। রাতে আমার সাথে আমার মা ছিলেন। বাবুকে আমার কাছে রেখেছিলাম। বেশ কয়েক বার ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণে আম্মুর খারাপ লাগছিল। পরে একজন নার্স আপুকে অনুরোধ করায় প্রেশার মেপে দেখা গেল ১০০/১৫০৷ আমি সবকিছু ম্যানেজ করলাম। আমার হাসবেন্ডকে ফোন দিলাম। সে এসে ওষুধের ব্যবস্থা করলো। ওই রাতে আমার আর বাবুর কোন রকম সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। বাবু একদম শান্ত ছিল,আমার কাছে নিয়ে ঘুমিয়েছি, দুধ খাইয়েছি।
আমানি বার্থ ট্রেনিং-এ শোনা কিছু কথা মাথায় ঘুরছিল। জন্মের পর বাচ্চার যে Golden Hour সেটা ওকে আমি দিতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ৷ ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় অবশ্য আয়ারা সাথে ছিলেন৷ আমি সাথে এডাল্ট ডায়পার নিয়েছিলাম। এটা আমার খুবই উপকারী লেগেছে, আলহামদুলিল্লাহ ।
এবার আমার মেয়ে আমাদের দেখতে এল। সে খুশী হয়েছিল, মায়ের সাথে অন্য একটা বাবুকে দেখে রেগে গিয়ে আমার ক্যানোলা টেনে খুলে ফেলেছিল৷ আমার এতদিনের মোটামুটি ম্যানেজেবল বাচ্চাটা হঠাৎ করে সেদিন থেকে দুষ্ট আর জেদী হয়ে গেল।
এবার আমি ৫ দিন বিছানায়, ৫ দিন রুমে, ৫ দিন বাসায় এই রুলস ফলো করে রেস্ট নিয়েছিলাম৷ বাসায় আমার মা, শাশুড়ী এবং সংসারে কাজে হেল্প করার জন্য মানুষ ছিল। কিন্তু রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না। যখনই বাবুকে খাওয়াতে উঠতাম আমার মেয়ে চীৎকার করে কান্না করত। ফেলে দাও! না না! খাওয়াবানা! বাবু লাগবে না!
কেউ থামাতে পারতো না। ওকে কাছে নিলে ওদিকে বাবু কান্না করত। মেয়েকে রাতে দাদী নানীর সাথে ঘুমাতে দেইনি সারা জীবনের জন্য হয়ত মনে দাগ কেটে যেতে পারে। এভাবে রাতে ৩-৪ বার উঠে দুইজনেই কান্না করত। বাচ্চাদের বাবা সাহায্য করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
দিনে কিছু সময় আমি রেস্ট নিয়েছি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করেছি৷ ঘরের কাজ থেকে ছুটি নিয়েছি। মেয়েকে কিছুদিন অন্য কেউ খাইয়ে দিয়েছে৷ এবার আর সব করে ফেলব এরকম চিন্তা করিনি। কেন যেন খুব শান্ত ছিলাম৷ মাঝে মাঝে হঠাৎ মেজাজ খারাপ হত, তবে সামলে নিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
আমার এখনও ভাবলে অবাক লাগে এই কঠিন সময়টা কিভাবে পার করেছিলাম। একজনের পর আরেকজন সন্তান হলে, একটা উপদেশ খুব বেশী শোনা যায়, বড়টাকে বেশী সময় দিতে৷ ছোটটা কিছু বোঝে না৷ আমি এই কথার সাথে একমত নই। আমার মনে হয়েছে, বড়টার ছোটবেলায় তো পুরো সময় ওকে দিয়েছি। ছোটটা তো এমনিতে ভাগে মা পেয়েছে, ওকে কেন বঞ্চিত করবো।
বাচ্চাদের সাথে বন্ডিং এর জন্য আমি কিছু কাজ রেগুলার করতাম। যেমন ছোটটাকে তেল দিয়ে ম্যাসাজ, এক্সারসাইজ করানো, গোসল করানো। বড়টাকে ১/২ বেলা খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, খেলা করা৷ সেই সাথে নিজের যত্ন, বিশ্রাম। আমি তো সুপার হিউম্যান না। সব সাধ্যের মধ্যেই করতাম, অতিরিক্ত চাপ নিতাম না।
সবকিছু সামলাতে পেরেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। স্টীচ দ্রুত শুকিয়েছিল। ১ মাস পর আমি সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে লং জার্নি করে বাবার বাসায় চলে গিয়েছিলাম। প্রায় ২ মাসেরও বেশী সময় পরে আমার মেয়ের এই রাতে উঠে কান্না করার সমস্যা কমেছিল। এর জন্য ওকে কখনও বকা দেইনি৷ ওকে সময় দিয়েছি, ওর সাথে খেলাধুলা করতাম, গল্প শুনিয়ে ভালো সময় কাটাতাম। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক দোআ করেছি।
বাবুর ১ মাস বয়স থেকে আমি দৌলা সার্ভিসও শুরু করে দিয়েছিলাম, এটা আমার খুব ভালো লাগা আর প্রশান্তির কাজ। মনে করতাম আমার গতানুগতিক কাজের ভীরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত একটা জায়গা। কাজটায় নিঃসন্দেহে অনেক বেশী ইমোশনাল এটাচমেন্ট এবং বারাকাহ থাকে।
আপনাদের একটা প্রশ্ন করি, আপুরা দুটো অভিজ্ঞতার মাঝে কি কি পার্থক্য দেখতে পেলেন?
প্রথমত আমার ক্ষেত্রেই বলবো ডেলিভারির অভিজ্ঞতা আমার পোস্ট পার্টামে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। দৌলা ট্রেনিংও আমার মধ্যে অনেক বড় পরিবর্তন এনেছে।
আর সর্বশেষে, প্রথম সন্তানের জন্মের সময় আমি আনাড়ি, অপরিপক্ক ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার জন্য আমি শিখেছি, দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর আরও কিছুটা অভিজ্ঞ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। নতুন মায়েরা এরকম কিছু হলে নিজেকে দোষী মনে করবেন না৷ এভাবেই, একজন মা অজ্ঞ থেকে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন।
অনেক কিছু আমাদের হাতে থাকে না। বিষয়গুলো সহজ ভাবে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যার থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য নিবেন। কারও থেকে সাহায্য নিলে কিছু বিষয় হজমও করতে হয়। নিজের এবং সন্তানের ভালোর কথা ভেবে এরকম পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন। সবকিছু আপনার অনুকূলে থাকবেনা, যে কোন পরিস্থিতিতে সাধ্যমত ও সংযত আচরণ করতে পারেন, সামলাতে পারেন সেটার চেষ্টা করে যেতে হবে। আমার পোস্টপার্টাম অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
পোস্টপার্টামে শোনা সবচেয়ে প্রশান্তিমুলক কথা ছিল, সময়টা খুব দ্রুত পার হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।
আপনার জন্য কোন কথাটা বেশী পজিটিভ মনে হয়েছিল?
 
ফারইয়াব হাসান
সার্টিফাইড চাইল্ডবার্থ এডুকেটর ও ট্রেইন্ড দৌলা, আমানি বার্থ
দৌলা, রৌদ্রময়ী স্কুল