নরমাল ডেলিভারির জন্য দৃঢ়সংকল্প ছিলাম
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Blog, Others
- Date January 9, 2024
- Comments 0 comment
আলহামদুলিল্লাহ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ রোজ বৃহস্পতিবার ভোর ৪:১০ মিনিটে আল্লাহ কন্যা সন্তানের মা হিসেবে কবুল করেছেন।
সোমবার ভোররাতে ঘুম ভাঙ্গার পর উঠে বসার সাথে সাথে হঠাৎ করে কিছু পানি বের হয়ে বিছানায়ও লেগে গেলো। তারপর ক্লিন করতে গিয়ে দেখলাম কাপড় খুব আঠালো, বুঝলাম মনে হয় মিউকাস প্লাগ ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। তারপরও খুবই আতঙ্কের মধ্যে পরে গেলাম না জানি পানি ভেঙ্গে যায় কিনা। অজু করে তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করছিলাম যে আল্লাহ তুমি তো আমার সিউচুয়েশন জানো, তুমি সব বিপদ থেকে রক্ষা করার মালিক, আল্লাহ তুমি আমার উত্তম অভিভাবক। সিজদায় যেয়ে খালি কান্না করছিলাম আর এটুকুই বলছিলাম আল্লাহ তুমি সাহায্য কর, উদ্ধার কর।
তারপর দেখি কিছু পানি বের হয়ে গেছে, এবার দেখি ব্লাডি শো হচ্ছে। আমি তো আরও আতংকিত হয়ে পড়লাম। তারপর শুয়ে পরলাম, ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু আতংকে পায়ের মাসল গুলো শক্ত হয়ে যাচ্ছে, ঘুমানোর পর ও বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিভিন্ন দোয়া পড়ছিলাম ফাঁকে ফাঁকে। তারপর সারাদিন দেখলাম একটু একটু করে হালকা লালচে পানি যাচ্ছে। সেদিন আতংকে একদম জরুরি প্রয়োজন এর কাজ ছাড়া আর কাজ করিনাই। কিন্তু ছেলের জন্য বারবার বিছানা থেকে উঠা লাগছিলো, ছেলের টেক কেয়ার করতে হচ্ছিলো। সন্ধ্যা নাগাদ দেখি যে ব্লাডি ওয়াটার যাচ্ছেই। আমার বোনকে আর্জেন্ট ফোন দিয়ে আনাই।
তারপর হসপিটালে যেয়ে আল্ট্রাসাউন্ড করাই এরপর সেখান থেকে সরকারি হসপিটালে ইমার্জেন্সিতে গেলে ওরা এডমিশন দিয়ে দেয়। এরমধ্যে অন্য একজন ডক্টর এসে পিভি করে, রিপোর্ট সব চেক করে বল্লেন যে তুমি তো লেবারে নেই, যেহেতু তোমার আগের সিজার তাই তুমি চাইলে একঘন্টার মধ্যে আমরা সিজার করে দিতে পারি অথবা চাইলে আগামীকাল সকালে বা বিকালে এসে সিজার করে ফেলতে পারো।
আমি যে ভিব্যাক করতে চাচ্ছি সেটা আর বলিনি, আমরা বাসায় চলে আসি। তারপর রাতে ঘুমানোর পর কয়েকবার কন্ট্রাকশন আসে খুব অল্প সময় এর জন্য তাই বুঝতে পারিনি লেবারে যে যাচ্ছি। এর মধ্যে দিনে বেশ কয়েকবার কন্ট্রাকশন আসে বাট আমি তখনও বুঝতে পারিনাই কন্ট্রাকশন যে হচ্ছে। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায় অনেকক্ষণ বেবির মুভমেন্ট টের পাচ্ছিলাম না, আবার দেখি যে অল্প একটু ব্লাড এর চাকা, আম্মুকে দেখালাম আম্মু বলল আচ্ছা এক কাজ করো অজু করে তাহাজ্জুদ পড়ো।
ফজর পড়ার পর ভালোই মুভমেন্ট টের পেলাম। ওই সময়টা আল্লাহর প্রতি এতো কৃতজ্ঞতা বোধ হচ্ছিল ভাবছিলাম আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলে আল্লাহ নিরাশ করেন না। তারপর সকাল থেকে কন্ট্রাকশান কিছুক্ষণ পরপর হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ মনে হলো আরে মেপে দেখি কতক্ষণ পরপর আসছে আর কতক্ষণ থাকছে। দেখলাম ১৫/২০ মিনিট পরপর আসছে, ৫/১০ সেকেন্ড এর মতো থাকছে।
যখনি ব্যাথা আসছিলো “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকিল” আর দোয়া ইউনুস পরছিলাম। ফাঁকে ফাঁকে শুয়ে থেকে ছিলাম, শর্ট ন্যাপ নিচ্ছিলাম। গোসল, খাওয়া, নামাজ, হাঁটাহাঁটি, ছেলেকে খাওয়ানো,গল্প করা, টুকিটাকি গোছানো সেরে নিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে আম্মু কোমড় মাসাজ করে দিচ্ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে ৫ মিনিট পরপর পেইন আসছিলো। আমার সহ্য করার ক্ষমতা মনে হচ্ছিলো হারিয়ে যাচ্ছিলো। আল্লাহকে বলছিলাম আল্লাহ আমার ধৈর্য শক্তি বাড়ায় দেও।
খেজুর, জমজম এর পানি বারবার খাচ্ছিলাম। গরম পানিতে নিতম্ব ডুবিয়ে বসে থাকছি কখনো গরম পানি কোমড়ে, পায়ে ঢালছি। এশার এর ফরজ পড়তে পড়তে তিনবার কনস্ট্রাকশান আসল, কোনরকম ব্যাথাটা হজম করে নামাজ শেষ করলাম।
হসপিটালে ১০ টায় ঢুকলাম। ফরমালিটিস শেষ করে ৫ তলা সিড়ি বেয়ে গাইনি ওয়ার্ড এ গেলাম। ডাক্তার পিভি করে বকাবকি শুরু করে দিছে। ৬ সেমি ডায়ালেশন, ফুল ইফেসমেন্ট, হেড এংগেজ। সব ডাক্তাররা বকাবকি করছে প্রিভিয়াস সিজার, এতো দেরি কেনো করেছি, এতো সাহস কেনো করেছি, যদি সেলাই ফেটে যায়। যে ডক্টর পিভি করেছেন তিনি বললেন এ মায়ের নরমাল হবে তবে আমি ওটি টেবিলে করাবো। তারপর স্যালাইনে এলজিন দিয়ে দিলো। সব মেডিসিন, সিজারের ইকুইপমেন্ট কিনালো বাচ্চার বাবাকে দিয়ে। তারপর ওটির ওয়েটিং রুমে পাঠালো।
রাত ১২ টার দিকে ওটিতে নিয়ে গেলো। ওটি টেবিলে আমাকে চিৎ করে শোয়ায় রাখা হলো। যেহেতু আমি নরমাল ডেলিভারি চেয়েছিলাম তাই ওরা আমাকে নানা রকম বকাবকি করছিলো। আমি পেইন ম্যানেজ দেওয়ার জন্য মোচড়ামোচড়ি করছিলাম, বসে যাচ্ছিলাম কখনো আবার দাড়িয়ে থাকছিলাম, তাই দেখে ডাক্তার বকাঝকা করছিলো।
তারপর যিনি বলেছিলো যে এই পেশেন্টের নরমাল ডেলিভারি হবে উনি আসার পর পিভি চেক করে বললেন, বাচ্চা হতে হতে তিনটা চারটা বাজবে যাও ওকে ওয়েটিং বেড এ স্কোয়াট করে বসিয়ে রাখ। আমি ওয়েটিং রুমে দাঁড়ায়ে বসে যেভাবে পারি পেইন ম্যানেজ দেয়ার চেষ্টা করছিলাম।
রাত দুইটার দিকে ডক্টর এসে আমার ফাইল নিয়ে গেলো আর যাওয়ার সময় বলে গেল স্কোয়াট করে বসে থাকো। চারটা পর্যন্ত এভাবে বসে ছিলাম। মাঝে মাঝে আম্মুকে নিয়ে ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলাম, অসহনীয় অবস্থা, যেহেতু আম্মুর কাঁধে ধরে ভর দিয়ে রাখছিলাম। আম্মু তো আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল,সারাক্ষণ কোমড় মেসেজ করতে ছিল। আমিও সারাক্ষণ “হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল” আর দোয়ায় ইউনুস পড়েই যাচ্ছিলাম। আয়া একটু পর পর এসে ওয়ার্নিং দিচ্ছিল, সিজার করলে বলেন, ডাক্তাররা কিন্তু সব চলে যাবে।
চারটার সময় এসে একজন ডক্টর আমার পিভি চেক করে চিতকার শুরু করছে যে রোগীর ডিপ মেকোনিয়াম (বাচ্চা পায়খানা করে দিয়েছে আগেই)। বাচ্চা তো মরেই যাবে। আমি বললাম তাহলে সিজার করান। বলল যে এখন কিভাবে সিজার করবো এখন তো বাচ্চার মাথা নিচে চলে আসছে। তারপর আমাকে ওটি রুমে নিয়ে গেল, যাওয়ার পর ডাক্তার চেক করে বল্লেন যে না আপু ডিপ ম্যাকোনিয়াম না নরমাল ডেলিভারি হবে ইনশাআল্লাহ।
ডাক্তার বলছিলো পেইন চলে যাচ্ছে, থাকছে না মনে হয়। পিটোসিন দেন ওকে, আস্তে আস্তে বাড়াতে বাড়াতে আড়াই দিল। আর ওদিকে অন্যরা বলে যাচ্ছিলো দম ছাড়বে না। এক পুশে বের করবে। এক ডাক্তার বললো আপু বাচ্চার ওয়েট ভালোই আছে তারপর উনি সাথে সাথে এপিসিওটমি করে দিল। তখন মনে হচ্ছিল আমার যা হয় হোক বাচ্চাকে যেভাবে হোক বের করতে হবে।
তারপর দম আটকে আর দোয়া পড়তে পড়তে পুশ দিলাম আলহামদুলিল্লাহ বাবু বের হয়ে গেল। আমার মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বের হয়েছিল “আল্লাহু আকবার”। বললাম বাবুকে আমার কাছে দেন। ৩৯ সপ্তাহ ৫ দিনে মেয়ে হলো আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথম সন্তান যখন সিজার হলো তখন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কারণ মন থেকে নরমাল ডেলিভারি খুব চেয়েছিলাম। তারপর থেকে স্টাডি করছিলাম, সংকল্প করছিলাম যে না আর কখনও সি-সেকশনে যাওয়া যাবো না। এরমধ্যে আল্লাহর রহমতে এক আপুর পোস্ট চোখে পরলো যার কিনা সি-সেকশনের পর ন্যাচারাল ডেলিভারি হয়েছে। ওনার লেখালেখি, রৌদ্রময়ীর লাইভ থেকে অনেক ইন্সপায়ার হলাম, আমানিবার্থ বই সম্পর্কে জানলাম।
রৌদ্রময়ী Mother and Child Care BD গ্রুপ থেকে অনেক ধারণা পেলাম। ছেলের ফিডিং বন্ধ করানোর পর থেকেই একজন নিউট্রিশনিস্ট থেকে ডায়েট প্লান নিয়ে নিউট্রিশন মেইনটেইন করার দিকে মনোযোগী হই যেহেতু আন্ডারওয়েট এ ছিলাম। বাবু কনসিভ হওয়ার পর খাওয়া দাওয়া একদম করতেই পারছিলামনা। ডক্টর মর্নিং সিকনেস ও বমির জন্য মেডিসিন দিলেন।
তারপর অশেষ আকাঙ্খিত আমানি বার্থ বইটি হাতে পেলাম। রৌদ্রময়ীর প্রিনাটাল রেকর্ড কোর্সও করলাম। নিজেকে প্রথম থেকেই অনেক বেশি একটিভ রাখার চেষ্টা করতাম। খাবারে প্রোটিন এর পরিমাণ বেশি রেখে মেইনটেইন করার চেষ্টা করছিলাম। যেহেতু আগেরবার পানি ভেঙ্গে গিয়েছিল তাই এই ভয়টা অনেক কাজ করত। আর যখনই দোয়া করতাম আল্লাহর কাছে সহজ প্রসব এর দোয়া করতাম, একেবারে ন্যাচারাল ডেলিভারি চেয়েছিলাম।
স্কোয়াট, টেইলর সিটিং হয়ে কাজ করা, ছেলেকে নিয়ে যেদিন সুযোগ হতো বাইরে থেকে দের/দুই কি.মি. হেটে আসা। যেহেতু চারতলায় বাসা বাইরে বের হলে সিড়ি দিয়ে ওঠানামা হয়েই যেত। আর সবসময় দোয়া করতে থাকা। দোয়া কবুলের মূহুর্তগুলোতে প্রচুর পরিমাণে দোয়া করতে থাকতাম।
৩৬ সপ্তাহের পর থেকে প্রতিদিন ৮/১০ টা করে খেজুর খেতাম, আনারস ও কয়েকবার খেয়েছি। প্রথম থেকেই লো কমোড ইউস করেছি। বাবু আসার আগের সপ্তাহটা রাতে ঘুম ভাঙ্গলেও উঠে স্কোয়াট, মাইসলস সার্কিট, পেলভিক রক দিতে থাকতাম। দোয়া কবুলের সময়গুলোতে সারাক্ষণ দোয়া করতাম।
সত্যিই, দুয়া মুমিনের অস্ত্র!
সুমাইয়া সুলতানা
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স, রেকর্ড ব্যাচ
Other post
You may also like
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ছোট বাবুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য – আসুন সচেতন হই
খাদিজা তার এক মাস বয়সী মেয়ে আমিনাকে কোলে নিয়ে ঘরের মৃদু আলোয় বসে ছিলেন। রাত বাজে আড়াইটা। জানালা ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো ঘুমের কুয়াশা ভেদ করে তার মুখে এসে পড়ল। হঠাৎ থেমে থেমে আমিনার কান্নার শব্দ বাড়ে এবং কমে। …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …