লেবারের জন্য অপেক্ষা ও আর্লি লেবার- কি করবেন, কি করবেন না? (পর্ব-১)
লেবার কী?
সোজা বাংলায় লেবার হল বাচ্চা হওয়ার জন্য যে ব্যাথা উঠে সেটাকে বলে।
Johns Hopkins Medicine নামক ওয়েবসাইটের Definition অনুযায়ী বললে লেবার হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে হতে থাকা জরায়ুর সংকোচন ও প্রসারণ। মূলত একারণেই ব্যাথা অনুভূত হয়।
লেবারের বৈশিষ্ট্য হল লেবার ধারাবাহিক/continuous হবে এবং সময়ের সাথে সাথে ব্যাথা বাড়বে/উন্নতি হবে (যেমন জরায়ুমুখ পাতলা হওয়া ইত্যাদি)।
লেবার পেইন কেন হয়?
লেবার পেইন ৩টা কাজ করেঃ
১/ এর ফলে জরায়ুমুখ পাতলা হয়ে যায় ও নরম হয়। এমনকি কাগজের মত পাতলা ও ঠোঁটের মত নরম হয়ে যায়। এটাকে effacement বলে। বলে রাখা ভাল পুরো প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে আল্লাহ তা’য়ালা ভেতরের বাচ্চাকে প্রটেক্ট করার জন্য জরায়ুমুখকে শক্ত করে বন্ধ করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এতটাই শক্ত যে আমাদের নাকের ডগার মত শক্ত এবং টাইট হয়ে জরায়ুমুখ আটকে থাকে।
আরেকটা ফ্যাক্ট বলে রাখি এই যে জরায়ুমুখ বা cervix এটার সাথে কিন্তু মাসিকের রাস্তা বা vagina এর ভালই দূরত্ব আছে। cervix আর vagina কিন্তু দুই জিনিস।
২/ এর পরই যেটা হয় সেটা হচ্ছে জরায়ুমুখ খুলতে থাকা। এটাকে বলে Dilation। জরায়ুমুখ এত নরম থাকে যে এক আঙুল ঢোকানো যায়, এরপর দুই আঙুলই ঢুকে যায়। এটাকেই বলে ২ সে.মি. খুলেছে। এভাবে আরও খুলতে থাকে ও এতটাই খোলা হয়ে যায় যে মনে হয় যেন পুরো হাতই ঢুকে যাবে। এমনকি বাচ্চার চুল ধরা যায়। এই অবস্থায় জরায়ুমুখ একটা ফর্মুলা দুধের কৌটার মুখের মত বড় হয়ে খুলে যায়। এটাই সর্বোচ্চ খুলে যাওয়া ও একে বলে ১০ সে.মি ডায়ালেশন।
৩/ আর যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে বাচ্চাকে বার্থ ক্যানাল দিয়ে নেমে আসতে সহায়তা করা। বার্থ ক্যানাল হল cervix (জরায়ুমুখ) থেকে vagina এর যে দূরত্ব। এই পেইনগুলো যেটা ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট গ্যাপে আসছে, এগুলো আপনার বাচ্চাকে জরায়ুমুখ দিয়ে বের হবার জন্য চাপ দিতে যেমন সাহায্য করে তেমনি জরায়ুমুখ/cervix দিয়ে বের হয়ে নিচে নেমে মাসিকের রাস্তার/vagina এর কাছে আসতে সাহায্য করে।
এই পেইন কখন শুরু হওয়া নরমাল?
এই পেইন ডিউ ডেইট এর ২ সপ্তাহ আগে থেকে ডেট এর ২ সপ্তাহ পর পর্যন্ত যেকোনো সময় আসতে পারে। এই বিষয়টা জানা ও বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অধিকাংশ মানুষ মনে করে ডেইটের আগেই বাচ্চা হয়ে যাবে/ডেইটের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চা হয়ে যাবে। ডেইট পার হবার পরেও যে ৮/১০ দিন এমনকি ১৪ দিন পরেও ব্যাথা আসা সম্পূর্ণ নরমাল এটা কেন যেন কেউ বুঝতে চায়না।
এবার আসি EDD বা Estimated Due Date নিয়ে কিছু কথায়।
EDD জানাটা বা এই হিসাব রাখাটা মূলত ডাক্তারদের জন্য দরকারী, কিন্তু আমাদের জন্য না। কারণ এটা প্রকৃতপক্ষে একটা imperfect science বা ভুলভাল বিজ্ঞান। একটা শুক্রাণু বা sperm কতদিন/কতক্ষণ সময় নিয়ে একটা ডিম্বাণুর কাছে গেল, কখন মিলিত হল, আবার নিষিক্ত হবার পর জরায়ুর দেয়ালে কখন রোপণ বা implantation হল এটা সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি। গবেষণায় দেখা যায় শুধুমাত্র ৫% বাচ্চা তাদের ডেটের দিন দুনিয়ায় আসে। মাত্র ৫%, চিন্তা করেছেন? আর শুধুমাত্র ৩৫% বাচ্চা তাদের ডেট যেই সপ্তাহে সেই সপ্তাহে হয়। তার মানে হল বাকি ৬৫% বাচ্চা ডেটের আরও পরে বা আরও আগে হয়।
২০১৫ সালে করা এক গবেষণায় দেখা যায় পেইন উঠার বিষয়টা যে জিনিসগুলোর উপর নির্ভর করে তার মাঝে এমন কিছু বিষয় হল sperm race – slow/fast হওয়া, genetics, space in the uterus (যেমন মায়ের লম্বা বা খাটো হওয়ার ফলে জরায়ুতে বাচ্চার জন্য জায়গা কম/বেশি থাকা, এর ফলেও বাচ্চা তাড়াতাড়ি/দেরীতে বের হবার জন্য ট্রিগার হয়। সাধারণত লম্বা মায়েদের পেইন দেরীতে ও খাটো মায়েদের পেইন দ্রুত উঠতে দেখা গেছে)।
তাছাড়া প্রতিটি বাচ্চাই একজন স্বতন্ত্র মানুষ। তার বয়স মায়ের গর্ভে ঠিক কতদিন হবে এটা একমাত্র আল্লাহই জানেন ও ঠিক করেন। তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। মায়ের গর্ভে সন্তান কতদিন থাকবে এই বয়সটাকে gestation length বলে। এই gestation length ক বাচ্চার হয়ত ২৮৫ দিন আর খ বাচ্চার ২৭৫ দিন। এটা আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন। এখন ক বাচ্চার জন্য এটাই সর্বোত্তম হবে যে সে ২৮৫ তম দিনে বের হবে। এখন আমরা যদি জোর করে তাকে ২৮০ তম দিনে বের করে আনি এটা অবশ্যই তার জন্য ভাল হবে না। এমনিভাবে খ বাচ্চা ঠিকই ২৭৫ তম দিনে বের হবে, সে মোটেই আর্লি না বা সময়ের আগে হয়ে গেছে বলা ভুল হবে। কারণ মায়ের গর্ভে তার রিজিক ছিল ২৭৫ দিন, সেই রিজিক পুরোপুরি সে এঞ্জয় করেই বের হয়েছে ও এটাই তার সময় ছিল।
আমাদের যে টপিক সেই বিষয়ে এবার আসছি।
লেবারের জন্য অপেক্ষার সময় কী করবেন, কী করবেন না।
লেবারের আগের সময়টা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি মায়ের জন্য অনেক কঠিন। যেহেতু শরীর ভারী হয়ে যায়, নতুন নতুন ব্যাথা, স্বাভাবিক লেবারের নানা উপসর্গ দেখা দেয়া আর সাথে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে পজিটিভ উৎসাহ না পেয়ে অনেক মা-ই খুব অস্থির একটা সময় পার করেন।
এই সময় বেশিরভাগ মা কিছু ভুল করেন যা আমি নিচে উল্লেখ করবঃ
১/অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা/অস্থির হয়ে যাওয়া বা ভয় পাওয়া শুরু করা
এতে করে যে হরমোন লেবারের জন্য সাহায্যকারী অর্থাৎ অক্সিটোসিন বা লাভ হরমোন তা নিঃসরণ না হয়ে স্ট্রেস হরমোন বা এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে স্বাভাবিক ভাবে পেইন উঠা বাধাগ্রস্ত হয়, দেরি হয়, এমনকি ব্যাথা উঠার পরেও ব্যাথা বাড়তে/লেবার প্রগ্রেস হতে বাধা পায়।
এখানে একটা বিষয় বলে নেই, আমাদের দুশ্চিন্তা থাকে বাবুর মাথা খুব বড় হল কিনা, বাবুর ওজন খুব বেশি হয়ে যায় কিনা – এব্যাপারে বলব বড় বাচ্চা বলে কিছু নাই। বাচ্চার মাথা ডেলিভারি হওয়াটা প্রধান বিষয়। মাথা বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সাধারণত বডি চলে আসে। এবার বলি মাথা কী আসলেই বড় হয় কিনা। প্রকৃতপক্ষে, আপনার পেলভিক বোন যেটা আমাদের হিপের যে হাড্ডিটা এই হাড্ডিটার মাঝখানে মাঝখানে কিছু জয়েন্ট আছে যেসব জয়েন্টে এটা প্রসারিত হয়। তার মানে হল আপনার পেলভিস যদি এখন ১০০° হয় তাহলে আপনার যখন পেইন উঠবে এটা প্রসারিত হয়ে ১২০ ডিগ্রি হয়ে যাবে যাতে বাচ্চার মাথা এটার ভেতর ভালভাবে ঢুকতে পারে। আবার বাচ্চার যে মাথা সেটাও কিন্তু লোহার কোন বল না। আপনারা নবজাতকের মাথা ধরে দেখতে পারেন হাড্ডিগুলো কত নরম। আর মাথার তালুতে ও পেছনে দুইটা নরম অংশ দেখতে পাবেন। এগুলো কী উদ্দেশ্যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন জানেন কি? বাচ্চার মাথা যেন ঐ পয়েন্টগুলোয় সংকুচিত হয়ে যায়, চেপে যায় যাতে মাথাটা ছোট হয়ে যায় লেবারের সময়।
আরেকভাবে মাথার ব্যাসার্ধ কমে যায় লেবারের সময়। আর তা হল বাচ্চার মাথা যখন পেলভিসে নিম্নচাপ দেয় তখন পেলভিক ফ্লোর পেশী বিপরীতমুখী চাপ দেয় ও এতে করে বাচ্চার মাথা নুয়ে গিয়ে জরায়ুমুখে সর্বনিম্ন ব্যাসার্ধে চলে আসে। আবার লেবার শুরু হলে বাচ্চার মাথা ঘুরে সর্বনিম্ন এংগেলে চলে আসে।
দ্বিতীয় ভুল আমরা করি আশেপাশের মানুষের সব কথা শুনি/সবার সব কথা নিয়েই চিন্তা করি। এই সময়ে কথা যত কম বলা যায় ও নিজে নিজে একাকী থাকা যায় তত রিলাক্স থাকা যায়। এমনকি আপনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও একটা ব্রেক নিয়ে দেখতে পারেন। তবে এর পাশাপাশি হেলথি লাইফ স্টাইল ও রুটিন খুব হেল্প করে। যেমন একবার হেটে আসা, কিছু ব্যায়াম করা, পারলে নিজের রান্না নিজেই করা বা টুকিটাকি কাজ করা। এতে মন ফ্রেশ থাকে।
লেবার পেইন নিয়েও অনেকের মধ্যে অনেক আতংক/ভয় কাজ করে। যদিও লেবার সত্যিই একটা কঠিন পরিশ্রম ও যন্ত্রণাদায়ক এক লম্বা সময়, স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে একে কষ্টের বলেছেন কিন্তু সঠিক জ্ঞান থাকলে অস্থির না হয়ে ডীপ ব্রিদিং ও অন্যান্য পেইন ম্যানেজ করার টেকনিক কাজে লাগিয়ে এই যন্ত্রণা জয় করা সম্ভব ইনশাআল্লাহ। আর যেকোন কঠিন সময়ের পরেই যে আল্লাহ স্বস্তির সময় দেন তা তো আল্লাহ কুরআনেই বলেছেন। দুনিয়ায় কেউ যদি স্বস্তি নাও পায় আল্লাহ তাকে অগণিত সাওয়াব ও জান্নাতে তার জন্য বিনিময় দিবেন বিইযনিল্লাহ।
অনেকে ভয় পান পানি ভেঙে যায় কিনা, এই ভয়ে হাটাচলা করেন না। সত্যি বলতে পানি বেশিরভাগ ভাঙে প্রোটিন পর্যাপ্ত না খেলে ও পর্যাপ্ত রেস্ট না নিয়ে অতিরিক্ত ভারি কাজ করলে। পুষ্টিকর খাবার ও কী খাচ্ছি তা খেয়াল রাখা এই সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক ৬০ থেকে ৭৫ গ্রাম প্রোটিন অবশ্যই খাওয়া উচিত। মাছ,মাংস, দুধ, দই, ডিম, ডাল, ছোলা এইধরনের খাবার রেগুলার পরিমাণের দ্বিগুণ বা তিনগুণ খাওয়া উচিত প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে। ধরা যাক, প্রতিবেলা কেউ এক টুকরা মাছ ও এক কাপ ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছে। তার উচিত এসময়ে ২ টুকরো করে মাছ, দুই বাটি ঘন ডাল এভাবে দ্বিগুণ করে খাওয়া। অথচ না জানার কারণে আমরা অধিকাংশই ভাত দ্বিগুণ খাই, মাছ, মাংস সামান্যই খেয়ে থাকি।
অনেকে দুশ্চিন্তায় থাকেন বাচ্চা পেটে পটি করে খেয়ে ফেলবে বেশিদিন অপেক্ষা করলে। মূলত বাচ্চা তখনই পটি করে যখন সে অতিরিক্ত চাপে বা অক্সিজেন স্বল্পতায় (fetal distress) পড়ে। মনে রাখবেন স্বাভাবিক গতিতে যখন লেবার আগায় কোন রকম স্যালাইন বা ব্যাথা উঠানোর মেডিসিন ছাড়াই, তখন যে চাপ বাচ্চা অনুভব করে সেটা আল্লাহ প্রদত্ত। এই চাপকে সামলানোর ক্ষমতা আল্লাহ বাচ্চাকে দিয়েই দেন। সমস্যা তখনই হয় যখন আমরা এই স্বাভাবিক চাপকে ব্যাথা বাড়ানোর নামে মেডিসিন ইউজ করে দ্বিগুণ বা তিন গুণ করে ফেলি। এত চাপ সহ্য করতে না পেরে বাচ্চা পটি করে দেয়। তবে লেবার চলাকালীন বা এক্টিভ লেবারে থাকা অবস্থায় বাচ্চা যদি পটি করে দেয়, এদিকে লেবার স্বাভাবিক নিয়মে আগাচ্ছে ও মা পুরোপুরি এক্টিভ আছে ও কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চা জন্ম নিয়ে নিবে তাহলে সেই পটি বাচ্চার খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা কম থাকে।
যদি পানি ভেঙে যায় ও পানির রঙ সবুজ থাকে তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চা পটি করে দিয়েছে। কিন্তু পটি বেশিক্ষণ আগে করেনি বা ফ্রেশ আছে। অন্যদিকে বাচ্চা পটি যদি কোন কারণে আগেই করে দেয় ও দুই তিন দিন ভেতরে রয়ে গেছে পটিসহ ও পটির বা পানির রঙ কালো হয়ে গেছে তাহলে তখন সত্যিই এটা রিস্কি। মূলকথা হল পটি বাচ্চারা স্বাভাবিক অবস্থায়/স্বাভাবিক লেবারে শুধুমাত্র ডেইট ওভার হয়ে গিয়েছে বলেই করবে না। অবশ্যই কোন কারণে চাপে পড়লেই করবে ও তখন ডাক্তারের হেল্প ও সাপোর্টই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এর পাশাপাশি প্রেগন্যান্সি, লেবার ও ব্রেস্টফিডিং নিয়ে কিছু পড়াশোনা নিয়মিত করা। কারণ লেবারের নরমাল সাইনগুলো জানা থাকলে খুব হেল্প হয়। যখন নিজের শরীরের পরিবর্তনগুলো অচেনা বা কনফিউজিং লাগতে থাকে তখন নলেজ খুব হেল্প করে। আর এই কাজের জন্য সবচেয়ে সহায়ক হল প্রিন্যাটাল কোর্স করে নেয়া। এতে করে এক চান্সেই জানা হয়ে যায় প্রেগন্যান্সি, লেবার, বাচ্চার জন্ম, ব্রেস্টফিডিং, পোস্টপার্টাম রিলেটেড সবকিছু।
আয়েশা সিদ্দিকা হোমায়রা,
রৌদ্রময়ী দৌলা ইন্টার্ন