ধৈর্য আর চেষ্টা নরমাল ডেলিভারিতে সাফল্য এনে দিতে পারে
ছোট থেকেই হাড্ডি মন্ত্রী নামে ডেকে বেড়াতো সবাই। অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে যাওয়া,খাওয়াতে রুচি না থাকা, দূর্বলতা সবকিছু নিয়েই আমার বেড়ে উঠা।কলেজ লাইফে এসে পিরিয়ড জনিত বিভিন্ন সমস্যা এবং শেষে PCOS নিয়ে নতুন জার্নি শুরু হয় আমার। ভয়াবহ পিরিয়ড পেইন আর নিজের অন্যান্য সব সমস্যা নিয়ে আর সাথে মানুষের বলা বিভিন্ন কথা “কেন এত শুকনা”, “মা খাওয়া দেয় না নাকি” ইত্যাদি সবকিছুই জীবনকে অনেক কঠিন করে তুলেছিলো।
PCOS নিয়ে কয়েক বছর যখন কাটিয়ে ফেললাম সাথে আল্লাহর অশেষ রহমতে যখন বিয়ে হলো তখন একটা অজানা ভয় মনে এসে গেঁথে গেলো আর সেটা হচ্ছে যদি আমার বাচ্চা না হয়? অনেকের এই সমস্যায় বাচ্চা হয়না শুনার পর এই ভয়টা আরো দ্বিগুন হয়ে গিয়েছিলো। আল্লাহর কাছে দুয়া করে যেতাম নেক সন্তানের জন্যে।হঠাৎ একদিন ভয়াবহ পিরিয়ড পেইন নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আল্ট্রা দিলে সেটা করে দেখি অকল্পনীয় ভাবে আমার PCOS ভালো হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। এটা আমার কাছে খুব অবাক করার ছিলো কেননা কয়েক মাস আগের রিপোর্টও অন্যরকম ছিলো।
আলহামদুলিল্লাহ এরপর থেকে পিরিয়ড এর সেই ভয়াবহ পেইন কেটে যায়। এরপর আসলো জীবনের নতুন অধ্যায়। তখনো জানি না আমি মা হতে চলছি। ননদের বিয়ে ছিলো,বাসায় অনেক গেস্ট ছিলো সব মিলিয়ে খেয়াল হয়নি অনেক কিছুই।সব ঝামেলা শেষ করে একদিন সকালে কি মনে করে যেন টেস্ট করালাম আর দেখি আমি প্রেগন্যান্ট আলহামদুলিল্লাহ। আমার সেই অজানা ভয় যখন আল্লাহ দূর করে আমাকে সন্তান দিলেন তখন শুকরিয়াতে সিজদায় পড়ে ছিলাম।
শুকনা হওয়ার কারনে সবাই আমাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করতো। হাজবেন্ডের কাজের কারনে নিজের আপন সবাই চিটাগাং থাকলেও আমাকে থাকতে হয়েছিলো ঢাকাতে। একা একা পুরো সময়টা কাটাতে খুব ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম।প্রচন্ড মুড সুইং,প্রচন্ড রাগ সব মিলিয়ে নিজেকে বুঝতে আমার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কি করবো। এর মাঝে হঠাৎ আমার খুব কাছের একজন আপু আমাকে Prenatal Course টা প্রেগন্যান্সি গিফট হিসেবে দেয়। আমি খুব খুশি মনে কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই আলহামদুলিল্লাহ।
এই কোর্স আমার জন্যে ছিলো লাইফের অন্যতম একটা ব্লেসিং। শরীরের যে কষ্টগুলো নিয়ে পেরেশান ছিলাম, যে মুড সুইং আমাকে তাড়া করে বেড়াতো, প্রথম তিনমাসে যে খেতে পারতাম না, তীব্র ব্যাকপেইন সবকিছুই যে স্বাভাবিক এবং এগুলোর সাথে চাইলে তাল মিলিয়ে চলা যায় এগুলো সব আমাকে এই কোর্সের আপুরা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। মোটামুটি এরপরে আমার অনেক খারাপ লাগলেও নিজেকে বুঝাতে অনেকটা সুবিধা হতো আলহামদুলিল্লাহ।
আমি যখন প্রেগন্যান্সি শুরু করি তখন আমার ওজন ছিলো ৪৬। আমার হাইট ৫’৩” তাই হাইট অনু্যায়ী ওয়েট ছিলো কম। প্রথম তিনমাসে ওজন কমে ৪৫ হয়ে যায়। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি।কিন্ত ক্লাস করে জানতে পারি প্রথম তিনমাসে ওজন কমাটা স্বাভাবিক। তখন একটু হালকা লাগে। আমার ডাক্তারও আমাকে ভরসা দেয় এগুলো নরমাল। বাবু ভালো আছে।
সবসময় খাবারে অরুচি আর নিজের চেষ্টার কমতির কারনে রোগা হয়ে থাকতে হত আমাকে। বুঝতাম খেতে হবে কিন্তু পারতাম না। প্রিন্যাটাল কোর্সের প্রমা আপুর খাবারের ক্লাস করার পর যখন জানতে পারি দৈনিক কত ক্যালরী খেতে হবে। কতটুকু প্রোটিন, কতটুকু ক্যালসিয়াম মাস্ট ইনটেক করতে হবে তখন খুব আগ্রহ জন্মায় খাবারের প্রতি। গ্রুপে সবাইকে খাবারের চার্ট শেয়ার করতে দেখে আমার খুব ইচ্ছা হলো ক্যালরী মেপে খাওয়া শুরু করতে। আলহামদুলিল্লাহ প্রতিদিন ৬০গ্রাম প্রোটিন আর ১০০০ মি.গ্রা ক্যালসিয়াম ইনটেক এর জন্যে খুব উঠে পড়ে লাগতাম আর গ্রুপে চার্ট শেয়ার করার পর রাবেয়া আপু যখন মা শা আল্লাহ বলতো তখন আরো বেশি অনুপ্রেরণা কাজ করতো আলহামদুলিল্লাহ। আমি যে মানুষটা সেভাবে খেতে পারতাম না সেই মানুষটা আস্তে আস্তে কষ্ট হলেও খাওয়ার চেষ্টা করেছি শুধুমাত্র আল্লাহর করুণাতে এই কোর্সের কারনে।
এবার সময় ঘনিয়ে আসলো বাবু দুনিয়াতে আসার। হসপিটাল ব্যাগ গুছিয়ে রেডি আমি। ফলস পেইন আসা শুরু হলো।কোর্স না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না এটাই যে ফলস পেইন। যেদিন বাবু হবে তার দুইদিন আগে থেকে পেট শক্ত হয়ে হয়ে ছেড়ে দিচ্ছিলো। কন্ট্রাকশন আসছিলো বারবার।ববারবার চেক করছিলাম মিউকাস প্লাগ যাচ্ছে কিনা। বুঝতে পারছিলাম লেবার ঘনিয়ে আসছে। রাবেয়া আপুর শেখানো এক্সারসাইজগুলো টুকটাক চালিয়ে যাই। হাঁটা বাড়িয়ে দেওয়া শুরু করি। সিঁড়ি বেয়ে কয়েকবার উঠানামা করি, স্কোয়াটিং করি।
ফলস পেইনের দুইদিন এর মাথায় ১৭ই অক্টোবর ভোর ৪ টার দিকে ভয়াবহ ব্যাথা যেটা আমার PCOS থাকাকালীন ছিলো সেরকম কিছুটা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভেংগে যায়। অনেকদিন পিরিয়ড এর সেই ভয়াবহ ব্যাথা থেকে দূরে থাকার কারনে খুব ভয় পেয়ে যাই আমি। আমি বুঝে যাই লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। আপুদের কথাগুলো মাথায় ছিলো যে লেবারের সাথে তাল মিলাতে হবে। খুব রিল্যাক্সে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, অযু করে নামাজ পড়লাম আর খুব দুয়া করলাম আমার আল্লাহর কাছে। ক্লাসে একবার রাবেয়া আপু মনে হয় বলেছিলেন খেয়ে নিতে কিছু যেন এনার্জি থাকে। আমি আম্মুকে বলি ভাত খাইয়ে দিতে। আলহামদুলিল্লাহ খেয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আলহামদুলিল্লাহ আমার ডাক্তার অনেক ভালো ছিলেন সাথে তার টিম। আপুদের গাইডলাইন আর সাথে টিম মেম্বারদের সাপোর্টে ১৪ ঘন্টার লেবার পেইন সহ্য করার পর নরমালে আমার মেয়ে নুসাইবা আমার কোল জুড়ে আসলো আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। একদম লাস্ট মুহূর্তেও মনে হয়েছিলো আমি হয়ত আর পারবো না কিন্তু বারবার মাথায় আপুদের ঐ কথাগুলোই আসছিলো যে এখানে ধৈর্য্য আর চেষ্টাই সাফল্য এনে দিতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ।
নুসাইবাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। ডা. নাঈমা আপুর ক্লাসগুলো এবার ম্যাজিকের মত মনে হলো। নিজেই অনেককিছু বুঝতে পারছিলাম। কিভাবে বাবুর টেক কেয়ার করা যায়,কিভাবে নিজের কেয়ার করা যায় আরো অনেক কিছু। বাচ্চাদের Sudden Unexpected Death বলতে যে একটা জিনিস আছে সেটা হয়ত আমি কোর্স না করলে জানতেই পারতাম না। র্যাপিং করার পার্টটা ছিলো অনেক মজার। নুসাইবাকে র্যাপ করে বুকে নিলে ও খুব আরামে ঘুমিয়ে যেত আলহামদুলিল্লাহ।
এবার আসি পোস্ট পার্টাম পার্টে। খুব কঠিন টাইম কাটাচ্ছি এখন আমি। ঘুম ঠিকভাবে যেতে পারি না, অযথা কান্না পায়, রাগ হয় আবার ভালো লাগে। খুব কাছের মানুষদেরকেও সহ্য হয় না। নিজেকে খুব খারাপ মনে হয় কিন্তু আমি জানি হরমোনের এদিক সেদিকের কারনে এগুলো হচ্ছে। ইন শা আল্লাহ এই পার্টটাও আল্লাহর রহমতে কাটিয়ে উঠবো ইন শা আল্লাহ।
আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া সাথে আমার হুমাইরা আপুকে যে কিনা আমাকে এই কোর্সটা গিফট করেছিলো আর সাথে কোর্সের সাথে জড়িত সবাইকে। আল্লাহ সবাইকে জাযায়ে খয়ের দান করুক। একা একা নিজের আপনজনদের থেকে দূরে থেকে প্রেগ্ন্যান্সির মত এত বড় জার্নি পাড়ি দেওয়ার জন্যে যারা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন তাদের সবাইকেই আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করুক।
সবশেষে এটাই বলবো ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে বলা হয়েছিলো কুরআনের সেই আয়াত ” যে জানে আর যে জানে না উভয় কি সমান”? এই আয়াত টাকে বাস্তব রূপ দিতে পেরেছে এই কোর্স।সত্যি এই কোর্স করার আগের আপনি আর পরের আপনিতে অনেক অনেক তফাৎ থাকবে ইন শা আল্লাহ।
প্রেগ্ন্যান্সির এই সময়ে যারাই বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে কি করবেন, মোটকথা প্রত্যেক প্রেগন্যান্ট মেয়েদের জন্যে এটা একটা পরিপূর্ণ গাইডলাইন ইন শা আল্লাহ।
লিখেছেন-
উম্ম নুসাইবা,
রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ ৮