দুইবার সিজারের পর আমার নরমাল ডেলিভারির গল্প
আগের ২ বেবি সিজারে হয়েছিলো। কোনো বারই ইচ্ছায় সিজার হোক চাইনি। সমস্যার কারণেই করতে হয়েছে। এবার প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকে আল্লাহর কাছে চাইতে থাকলাম যেনো নরমালেই বাচ্চাটা হয়। হাজবেন্ডকে ও শেয়ার করলাম।
প্রিনাটাল কোর্সে ভর্তি হলাম রৌদ্রময়ী স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখে। আমার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। আমার প্রেগনেন্সির শুরুতে ইবনে সিনাতে এক ভালো ডাক্তারের ফলো আপে ছিলাম। দুই সিজারের কথা শুনে নরমালের চিন্তা একদমই বাদ দিতে বললেন। তারপর vbac ডাক্তারের সন্ধানে গ্রুপে আবার পোস্ট করি। একজন ডাক্তার বিআরবিতে বসেন তাকে দেখাতে যাই। ডাক্তার আমাকে চেকআপ করে দেখলেন যে বাচ্চার হার্টবিট কম তাই আমাকে অক্সিজেন দিতে বললেন ও সিটিজি মেশিন দিয়ে আবার হার্টবিট চেক করলেন।
ওখানকার পরিবেশ ভালো লাগে এবং নরমাল সাপোর্টের অনেক ডাক্তারই আছেন কিন্তু খরচ টা একটু বেশি, বাসা থেকেও দূর। সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকি। অনেকে প্রশংসা করেছিলেন আদ-দ্বীনের। হাজবেন্ড ও আদ-দ্বীনের ভালো সুনাম শুনেছেন তাই বললাম যে গিয়ে দেখে আসি। বড় ডাক্তার যিনি সে আমার কথা শুনে আমাকে এ বিষয়ে কথা না বলতে বললেন। স্পষ্ট বলে দিলেন যে সিজারই করতে হবে।
একটি গ্রুপের অনেক বোনরা আমাকে আরেক ডাক্তার ম্যামকে সাজেস্ট করেন। আম্মুকে নিয়ে একদিন গেলাম আর তার কথায় আমি মুগ্ধ হলাম। সব কিছু দেখে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই করাবো।
প্রেগন্যান্সির ৩৮তম সপ্তাহে ১৮ ডিসেম্বর রাত থেকে তলপেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। দুপুরে ডাক্তারকে কল দেই এবং আমার অবস্থা জানাই। তিনি ভিজিট করতে বললেন। চেকআপ করে দেখলেন সব ঠিক আছে। ব্লাডি শো দেখা গেলো। বাসায় গিয়ে হাটাহাটি ব্যয়াম করতে বললেন। তাই করলাম। এই রাতেও কোনো ঘুম হলো না। সকালে ডাক্তারকে আপডেট জানাই। হাসপাতালে চলে যেতে বললেন আর ভর্তি হতে বললেন। ছোট ছেলেকে বোনের কাছে রেখে আম্মুকে আর বড় ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম।
ডাক্তার আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
পিভি করলেন, কিন্তু ২সেমি খুলেছে মাত্র। ভর্তি হতে বললেন। রেস্ট নিতে বললেন। কিন্তু একটু পর পর ব্যাথা আর প্রস্রাবের চাপে কী রেস্ট নিবো! ওদিকে ২ জনকে বাসায় রেখে এসেছি সে টেনশন। Blood গ্রুপের evidence ও বাসায়। তাই বোনকে ওগুলো সহ চলে আসতে বললাম।
সিস্টাররা জানালেন ব্লাড ডোনার লাগবে ।রেডি করে আনতে। হাজব্যান্ড ব্যবস্থা করে দিলেন বিদেশ থেকে। তার বন্ধুকে পাঠালেন ডোনারদেরকে নিয়ে। তারা ব্লাড জমা দিয়ে গেলেন। ওনার বন্ধু হাসপাতালের খরচ সংক্রান্ত সবকিছু বুঝে নিয়ে তাদের সাথে আলাপ করে আমার হাজব্যান্ডকে জানালেন। আর আমার ব্যাথা এমনই চলতে থাকে, ৪ ঘণ্টা পরপর পিভি চেক করতে আসে ডাক্তার। হার্টবিট চেক করে। কিন্তু অনেক স্লো প্রগ্রেসে সারভিক্স খুলছিল। পরের দিন ২০ তারিখ ভোরে বাচ্চার হার্টবিট কমে গেছিলো তাই আমাকে নিচে অবজারভেশন রুমে নিয়ে অক্সিজেন দেয়।
সকালে ডাক্তার ম্যাডাম এসে নিজে আবার পিভি ও হার্টবিট চেক করেন। আমাকে সাথে করে নিয়ে আমার কেবিন রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে সান্তনা দিলেন, খাওয়াদাওয়া বেশি করে করতে বললেন, হাটাহাটি, স্কোয়াট করতে বললেন বেশি বেশি। সাথে ইন্টার্নি স্টুডেন্ট ছিলেন তাকে বলে গেলেন আমাকে কিছুক্ষণ ব্যয়াম করতে হেল্প করতে। করলাম অনেকক্ষণ। এরপর আমি আরো হাটাহাটি ব্যয়াম (স্কোয়াটিং, পেলভিক রক, হিপ rotating) বাড়িয়ে দিলাম, খেজুর, জমজম এগুলো তো নিয়ত করে খাচ্ছি। আয়াতুল কুরসী, সূরা ফাতিহা, দুআ করছি, ইসতিগফার করছি।
আমার ব্যাথা আস্তে আস্তে আরো বাড়ছিল। কন্ট্রাকশনগুলো আরো ঘন হতে লাগলো। রাত ১২ টার পর অসহনীয় হয়ে গেলো। তাই ডাক্তার আমাকে অবজারভেশন রুমে নিয়ে রাখতে বললেন। আমি অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু ব্যথায় শুয়ে বসে থাকতে পারি নি। ব্যায়াম করতে থাকলাম।
কিছুক্ষন বালিশে মাথা দিয়ে যখন রেস্ট নিচ্ছিলাম দেখি পানিতে ভিজে গেছি। আম্মুকে বললাম ডাক্তারকে জানাতে। নার্স এসে ডেলিভারির জিনিসপত্রের লিস্ট নিয়ে ওগুলো কিনে এনে দিয়ে গেলেন। গরম দুধ খেতে বললেন। এদিকে আমার ব্যাথা তীব্র হতে লাগলো। ডাক্তার ম্যাডামকে কল দিলাম । ৩ টায় আসলেন। এসে পিভি চেক করলেন। প্রায় ৪ আঙ্গুল খুললো। ১ ঘণ্টা দেখার পর ওটিতে নিয়ে গেলেন।
স্যালাইন দিলেন, ব্যাথা আসলে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে পায়খানা করতে বললেন। প্রথম দিকে মুখ থেকে আওয়াজ করে ব্যাথা কাজে লাগাতে পারি নি। পরে বারবার বলার পর মুখ বন্ধ করে নিচে চাপ দিতে থাকলাম। যেহেতু আমাকে শুইয়ে দেয়া হয়েছিল। শুয়ে চাপ দিতে পারছিলাম না তাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে কতক্ষন চাপ দিলাম। তারপর আবার শুইয়ে দিল। ঘেমে টপ টপ করে পানি ঝরছিল। এটা নাকি ভালো লক্ষণ। বাচ্চা নিচে নামছিল আস্তে আস্তে তাই।
আমার ওটিতে থাকা পুরো সময় শুধু চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ডাক্তার নার্সরা হাসছিলেন আর বলছিলেন ঘুমালে কিভাবে হবে। বাবুকে তো বের করতে হবে শক্তি দিয়ে। আমাকে স্যুপ খাইয়ে দিলেন যেনো একটু শক্তি পাই। তারপর আবার শুরু হলো পুশিং। পাগুলো উপরে ছড়ানো ছিল আরো বুকের সাথে উঠিয়ে দিলেন। ওমন করে পুশিং করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। ডাক্তার আমাকে সান্তনা দিলেন আর একটু চেষ্টা করে পুশিং করতে বললেন। আমি কষ্টে বলতে চাচ্ছিলাম যে অন্য ব্যবস্থা করতে (সিজার) । আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত চলছিল। আয়াতগুলো অনুভব করতে থাকলাম অনেকটা শান্তি পেলাম। আবার পুশিং করতে করতে ৬:৫৫ তে শেষ হল। আল্লাহ আমাকে একটা কন্যা সন্তান উপহার দিলেন।
আলহামুলিল্লাহ! আল্লাহু আকবার পড়তে থাকলাম। এবার আসলো সেলাইয়ের ব্যাথা সহ্য করার পালা। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেয়ার পর অনেক টাইম পার হয়ে গেছিলো তাই ব্যাথা পাচ্ছিলাম, আবার দিয়ে সেলাই কন্টিনিউ করতে লাগলেন। ব্যথায় চিৎকার করছিলাম যখন, ডাক্তার বললেন আমাকে হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। মোবাইল এনে দেয়া হলো । সালাম দিয়ে আর কথা বলতে পারিনি। কান্না আসছিল। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বললাম। ডাক্তার বললেন যে আপনার তো মেয়ে হয়েছে মাশাআল্লাহ ২ জনই সুস্থ আছেন। তারপর আমাকে রুমে এনে স্যালাইন চললো, ব্লাড লাগলো। আমাকে স্যুপ, নাস্তা আস্তে খাওয়ালেন সবাই। হাজব্যান্ডের সাথে কথা বললাম। উনি আমাকে প্রশংসা করতে থাকলেন যে কিভাবে এত সাহস দেখিয়ে নরমালি তার বাচ্চাকে দুনিয়াতে আনলাম!!
তাই আমি মনে করি প্রত্যেক মায়ের এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া ও জ্ঞানার্জন করাটা অত্যাবশ্যকীয় যেনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে না পরে।
ধন্যবাদ রৌদ্রময়ী স্কুলকে, Mother & Child Care BD team কে এত সুন্দর প্ল্যাটফর্ম এর ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন। আরো বারাকাহ দান করুন।