লেবার পেইনের জন্য মেন্টালি প্রস্তুত ছিলাম
১ম পর্ব
প্রেগন্যান্সি কন্টিনিউ করা আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যেদিন আমি টেস্ট করে জানতে পারি সেদিন আমার জবে জয়েন করার একমাস ছিল। আর পরীক্ষার রুটিনও প্রায় চলে এসেছে। আম্মু টেনশন করছিল যে আমি সামলাতে পারবো কিনা… এদিকে দুজনই স্টুডেন্ট+জব করি। হাসবেন্ড সাপোর্ট করছে ১০০%। তারপরও নানা চড়াই উৎরাই দিয়ে পার করলাম।
মেন্টালি অনেক বেশি স্ট্রেসে থাকলেও শারিরীকভাবে আমি অনেক সুস্থ ছিলাম। জব করা, ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া, আল্লাহর রহমতে যত পিছুটান ছিল সবই করেছি।
পুরো প্রেগন্যান্সিতে আমি খাবার বেছেছি। পানির পরিমান ঠিক রাখতে ডেইলি স্যালাইন খেয়েছি ১টা করে
* প্রোটিন ইনটেক করেছি ৬০-৮০ গ্রাম ডেইলি।
* নিজের সব কাজ নিজে করেছি, টায়ার্ড লাগলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়েছি।
* প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ঘুমিয়েছি।
* নিয়মিত ওষুধ খেয়েছি, আয়রন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম
* এছাড়া নিজ থেকে বিভিন্ন রকম বাদাম, সীডস, আখরোট, কিসমিস আর ৬-৮ টা খেজুর খেয়েছি।
* আমি খাবার ও ব্যায়াম ট্র্যাক করার জন্য খাতায় লিখে নিয়েছিলাম যাতে কোনটা বাদ না পড়ে।
৬ মাসের পরই তীব্র রক্তের সমস্যা ছিল। শেষে আয়রন ইনজেকশন নিতে হয়েছে।
ফিজিক্যালি এক্টিভ থাকার জন্য হেটেছি প্রচুর। কোর্সের দেখানো ব্যায়ামগুলো করেছি। তবে টেইলর সিটিংটা কম করেছি কষ্ট হত বলে। ডেলিভারির সময় বুঝেছি যে এই ব্যায়ামটা প্রচুর করা দরকার ছিল!
পাগলের মত নরমাল ফ্রেন্ডলি ডাক্তার খুজেছি, কিন্তু মন মত পাইনি! যা পেয়েছি সেগুলো ছিল দূরে/লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাপার। সেই সময় যা বুঝলাম যে নরমাল ট্রায়ালের জন্য ডাক্তার না একজন এক্সপিরিয়েন্সড নার্সই যথেষ্ট।
আমার কনসার্ণ ছিল ডাক্তাররা আন্তরিকতার সাথে ট্রাই করে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ এ ব্যাপারে তাদের নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আর পিভি চেক, স্কিন টু স্কিন এসব ও বলে নিয়েছিলাম।
আমার ইডিডি ছিল জুলাই মাসের ৫ তারিখ। রেগুলার ডাক্তারের চেক আপে ছিলাম। জুন থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে যাওয়া হতো। যেহেতু আমার হিমোগ্লোবিন কম ছিল তাই ৩৬ সপ্তাহে একটা আয়রন ইনজেকশন নিয়েছি।
নরমাল ট্রায়াল দিবো এটা ডাক্তারকে বলে রেখেছি তাই তিনি ৫ তারিখ পর্যন্ত ওয়েট করতে বললেন।
প্রেগন্যান্সিতে খাবার খেতে পারিনি এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আগে একটা ডিএন্ডসি থাকার পরও আমার লো রিস্ক প্রেগন্যান্সি ছিল।
১ তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর টয়লেটে গেলে আমার পা গড়িয়ে পানি পরে। কম ছিল তবে ইউরিন নাকি অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বুঝতে অনেক টাইম লেগেছে। তখন থেকেই সতর্ক থাকি যে লেবার শুরু হবে। আম্মুকে বলেছি আর রাবেয়া আপুকে সাথে সাথে জানিয়েছি। যেহেতু আপুর সাথে আমার এ ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে তাকে রেগুলার আপডেট জানাতাম। আপু ইন্সট্রাকশন দিতে থাকে নিজেও মেন্টালি প্রিপারেশন নিতে থাকি। দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে গেলাম। পানির পরিমান ধরে রাখতে পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খেতে থাকি।
২ তারিখ সকালে একটু ব্লাড দেখি, সাথে কোমড় আর তল পেটের ব্যাথা বাড়তে থাকে। আমি বাসায় ওয়েট করতে থাকি পেইন উঠার জন্য। সাথে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও ব্যায়াম চালিয়ে যাই বিশেষ করে হাটা ও স্কোয়াট। হাটতে পেরেছি কারণ বেশি পানি ভাঙ্গেনি তখনও। বিকালে ব্যাথা আরো বাড়লে ম্যাটারনিটি সেন্টারে যাই। সেখানে ডেলিভারি করাবো বলে প্ল্যানিং ছিল আমাদের। বাসা থেকে ওয়াকিং ডিস্টেন্স থাকায় রাতে ৮টার দিকে যাই।
২য় পর্ব
মিডওয়াইফ আমার পিভি চেক করে বলল জরায়ু মাত্র খুলতে শুরু করেছে, বাসায় চলে যেতে। আমি বাসায় এসে রাতে ঘুমাবার আগে মাইলস সার্কিট ব্যায়ামটা করি। ব্যায়াম ২০ মিনিট করার আগেই আমার রেগুলার কনট্রাকশন শুরু হয়। কনট্রাকশন কাউন্টার দিয়ে হিসেব রাখি। রাত ১২টা থেকে আমার রেগুলার কনট্রাকশন শুরু হয় সারারাত পেইন হয়। সকালে মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে আবার যাই ১০ টার দিকে। আরেকজন মিডওয়াইফ চেক করে বলে খুলতেছে কিন্তু সময় লাগবে বাসায় চলে যেতে। এবার আমার মনে একটু খটকা লাগলো। সব সুন্দর মত প্রোগ্রেস করতেছে তবু কেন এমন বলল। তখন আমার ব্যাথার মাত্রা বেশ ভালো ছিল। আম্মু ফাইনালি এক্সপিরিয়েন্সড আর যার সাথে আমাদের রেগুলার কন্টাক্ট হতো তাকে বলে চেক করতে। উনি চেক করে বলে সব ঠিক আছে, আজই ডেলিভারি হবে। আমি ইফেসমেন্টের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে জরায়ু মুখ কাগজের মত পাতলা হয়ে গেছে।
দুপুরের খাবারের পরে আমাকে স্যালাইন দিতে বলে। আমরা সেখানে থেকে যাই। বিকাল ৩ টায় খুব স্লোলি পিটোসিন দেয়া হয়। যদিও আমি আনমেডিকেটেড চেয়েছিলাম, পিটোসিন নেয়ার ইচ্ছা ছিল না।
৫ টার দিকে আমার ব্যাথা একদমই নাই হয়ে গেছে! আমি খুব কম্ফোর্টেবল হয়ে গেলাম। এসব দেখে আবার চেক করে বলে যে কোনো প্রোগ্রেস নাই যা হয়েছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণ আমার কাছে অজানা!
রাত ১০ টায় আমার স্যালাইন বন্ধ করে দেওয়ার পর আস্তে আস্তে আমার আবার ব্যাথা বাড়তে থাকে। ব্যাথায় রাতে ঘুমাতে পারিনি। রেগুলার ছিল কিন্তু তীব্র ছিলনা। এবার একটু রাগই হলো নিজের উপর। ব্যাথা তীব্র না হলে ডেলিভারি হবেনা। রাতে আমি হাটলাম, সেন্টার প্রায় খালি ছিল। মাইলস সার্কিট করলাম, স্কোয়াট করলাম, যা যা করে আরাম লাগলো তাই করলাম, ব্যাথা বাড়তে থাকল। সকালে ৬ টায় পিভি চেক করে বলল খুলছে কিন্তু সময় লাগবে।
এবার তারা একটু রাফ বিহেভ করা শুরু করল। আমাদের চলে যেতে বলল। বলার ২টা কারণ ছিল। প্রথমত তাদের ম্যাডাম আসবে। তারা ১২ ঘন্টার বেশি পেশেন্ট অবজারভরশনে রাখে না। আমার প্রায় ২২ ঘন্টা হয়েছে! দ্বিতীয়ত তিনজন মিডওয়াইফের মধ্যে ২ জনই বলেছে বাসায় চলে যেতে। ১জনের কথায় থেকে যাওয়াতে তারা কিছুটা বিরক্ত হয়।
৪ জুলাই, সকাল ৮ টায় নানান দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসায় চলে আসি। ব্যাথা তখনও ছিল। শেষ পিভি চেকের পর ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল আমার!
বাসায় এসে গরম পানি দিয়ে গোসল করে, পেট ভরে খেয়ে ঘুমাতে বলে আম্মু। উনিও তাদের উপর খানিকটা বিরক্ত হয়। ব্যাথা নিয়েই ঘুমালাম। গত তিন রাত ঘুমাইনি। প্রায় ৩ ঘন্টার মত ঘুমিয়ে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে জেগে উঠি। ব্যাথা ধরনটা এমন ছিল যে প্রচন্ড টয়লেট পাচ্ছে। টয়লেটে যাবার পর সবুজ স্টেইনের ম্যাকোনিয়াম পাস হয়। এর পর আর বুঝার বাকি রইল না যে আমি পুশিং স্টেজে আছি! আমি আর আম্মু যাই সেন্টারে, তারা চেক করে স্যালাইন দেয়। ৩০ মিনিটের মধ্যেই ডেলিভারি হয়। বাবু বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকায় মাথায় ক্যাপুট হয়েছিল। আর আমার বার্থ ক্যানেল ছোট হওয়াতে এপিসিওটমি লাগে।
৪ জুলাই বিকাল ৪.৫৫ মিনিটে আমার আবদুল্লাহ দুনিয়াতে আসে। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৩ কেজি ২০০ গ্রাম। আজ তার বয়স ১মাস। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।
আমি মেন্টালি অনেক বেশি প্রিপেয়ার ছিলাম এই ব্যাথার জন্য। এজন্য ব্যাথা উঠার পর ঘাবড়ে যাইনি। আমার সাপোর্ট সিস্টেম এত স্ট্রং করেছি যে আলহামদুলিল্লাহ ডেলিভারি টাইম আল্লাহ অনেক সহজ করে দিয়েছে। স্ট্রং কনট্রাকশনগুলোর সময় সেজদার মত পজিশন খুব আরামদায়ক ছিল। আর গ্যাপ টাইমে হাটা/ ব্যায়াম করেছি।
প্রসবপরবর্তী সময়টাতে ডাক্তারের দেওয়া
মেডিসিনগুলো কন্টিনিউ করেছি। শেষের দিকে আয়রন ইনজেকশনটা খুব কাজে দিয়েছে, এতে ক্লান্ত হয়ে যাবার যে প্রবলেম ছিল কমে গিয়েছিল। এপিসিওটমির জন্য জায়গাটা সবসময় পরিষ্কার ও শুকনা রেখেছি। ৭ দিনে সেলাই কেটেছি। ১৪ দিনেই শুকিয়ে গিয়েছে। তবে ৪০ দিন খুব সাবধানে ছিলাম যাতে টান না লাগে।
আমি প্রেগন্যান্সিতে যতটা এলার্ট ছিলাম, ফিডিংএর ব্যাপারগুলোতে ততই অজ্ঞ ছিলাম। প্রিন্যাটাল কোর্সের ব্রেস্টফিডিং ক্লাস করেও আমার ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছে। যার জন্য আমার ব্রেস্টফিড জার্নিটা খুব খুব কষ্টদায়ক হয়েছে! নিপল ক্র্যাক নিয়ে এত কস্ট পেয়েছি যে আমি ১৫-১৬ দিন শুধু কান্না করেছি ব্রেষ্টফিড করাতে গিয়ে। পরে আস্তে আস্তে ফ্লো বেড়েছে, ব্যাথা কমেছে। এখন বাবুকে এক্সক্লুসিভলি ব্রেস্টফিড করাই।
আসলে সবাই যার যার এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলেছে নানা কিছু, তার মধ্যে অনেক অজ্ঞতা আর কুসংস্কার মিশ্রিত ছিল। আর প্রি নেটাল কোর্স করেছিলাম যাতে আমি সঠিক জ্ঞানটা অর্জন করেতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ এদিক থেকে নিজেকে খুব সচেতন আর ভাগ্যবান মনে হয়। আমার মায়ের ৪ টা আর শাশুড়ির ২টা নরমাল ডেলিভারি ছিল তবে তাদের নিজের শরীর এবং ডেলিভারি নিয়ে যা জানা ছিল সবটাই আন্দাজের উপর। কিছুই না জানার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তারা।
রৌদ্রময়ী স্কুল আয়োজিত প্রিনাটাল কোর্সের কথা আমি যত বলব ততই কম হবে, এটা ছিল একটা ব্লেসিং আমার জন্য। আমি কন্সিভের আগে অনেক অজ্ঞ ছিলাম এ ব্যাটারটা নিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ কোর্সটি আমার আত্নবিশ্বাস বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং আমার জানার ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করেছে। এই জ্ঞান না পেলে আজ আমি অযথা সিজারের কষ্ট পেতাম।
নাঈমা আপুর বলা একটা আয়াতের কথা খুব মনে হয়, “যে জানে আর যে জানে না তারা কখনই এক না।”
লেবার পেইনের সময় রাবেয়া আপুর বলা কোরআনের উক্তিটি শুধু মাথায় ঘুরছিল “নিশ্চয়ই কষ্টের পর স্বস্তি আছে।”
লেবার কষ্টের পরে আমার সন্তানের নিষ্পাপ চেহারাটা দেখা আমার জন্য স্বস্তি। তাই তখন কতটা কষ্ট হচ্ছে সেখানে ফোকাস না করে, বারবার স্বস্তি পাবো এই ভরসায় ছিলাম।
আর তীব্র ব্যাথার সময় মনে হচ্ছিল মহান আল্লাহ
তা’আলা সামান্য জ্বরে বান্দার ছোট ছোট গুনাহ গুলো মাফ করে দেন, আর এ তো জীবন মরণের সন্ধিক্ষণ। বার বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিলাম আর সন্তানের মুখ দেখার অধীর আগ্রহে ছিলাম।
প্রি নাটাল কোর্স থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং কোরআন এবং সুন্নাহের আলোকে সাজানো গাইডলাইন একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য আল্লাহ হতে প্রাপ্ত এই আপুদের উসিলায় সবচেয়ে সুন্দর উপহার। আল্লাহ তাদের বারাকাহ দিন। তাদের এই সৎকাজে আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন আমিন।
এত সব সিজারের ভিড়ে, নরমাল ডেলিভারি করাটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জের মত ছিল। আমি যদি নিজেকে এডুকেট না করতাম এই জার্নিটা এত সহজ হতো না!
I left no stone unturned. আলহামদুলিল্লাহ।
পরিশেষে একটা কথাই বলবো….
“definitely Allah help those who help themselves.”