এনিমিয়া ও প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
এনিমিয়া এবং পোস্টপার্টাম হেমোরেজ বা প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, এই দুটোর মাঝে কি কোনো সম্পর্ক আছে? চলুন দেখা যাক।
এনিমিয়া বলতে আমরা কি বুঝি? WHO (World Health Organization) এর মতে, প্রেগ্ন্যাসিতে মায়েদের হিমোগ্লোবিন যদি ১১ g/dl এর কম থাকে, সেটাকে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা বলা হয়। এই রক্তস্বল্পতা প্রেগ্ন্যাসিতে মা এবং বাচ্চাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। এমনকি বাচ্চা প্রসবের পরে যে অতিরিক্ত রক্তপাত, যা মায়ের জীবনকে অনেক সময় ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেয়, এনিমিয়া এই ঝুঁকি কে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় মায়ের জীবন রক্ষা করার জন্য জরায়ু ফেলে দেয়ার মতো অপারেশনে যাওয়া ও লাগতে পারে।
সাধারণভাবে আমাদের মনে হতে পারে, শরীরে রক্ত কম থাকলে কম রক্তপাত হবে। কিন্তু উল্টো ঘটনাটি কেন ঘটে? আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, রক্তের হিমোগ্লোবিন এর সাথে অক্সিজেনের একটা সম্পর্ক আছে। আমরা নিঃশ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন নেই, সেটা রক্তের হিমোগ্লোবিন এর সাথে মিশে অক্সিহিমোগ্লোবিন নামে একটা যৌগ তৈরি করে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়, এবং প্রতিটা কোষে এই অক্সিজেন প্রবেশ করে। শরীরের প্রতিটা কোষের সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য এই অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের শরীরে যদি হিমোগ্লোবিন কম থাকে, তখন যেই অক্সিজেন আমরা গ্রহণ করি, সেটা শরীরের সব জায়গায় ঠিকমতো ছড়িয়ে পড়তে পারেনা। তখন শরীরের প্রতিটা কোষ ঠিক মতো কাজ করতে পারেনা। একইভাবে জরায়ুর মাংশপেশী, যা প্রাকৃতিকভাবে ডেলিভারির পর পর সংকুচিত হয়ে আসে, (অনেকটা বেলুনের ভেতর থেকে বাতাস বের করে ফেললে যেমন সাথে সাথে সংকুচিত হয়ে যায়, তেমন), সেই কোষ গুলোও পরিপূর্ণভাবে সংকুচিত হতে পারে না।
জরায়ুর পেশী আল্লাহ তায়ালার এক অপূর্ব সৃষ্টি। এই পেশির ফাইবার গুলো ক্রিস ক্রস প্যাটার্নে থাকে অর্থাৎ কাঁচি বা গূণ × চিহ্নের মতো। যখন ডেলিভারির পর পর জরায়ু সংকুচিত হয়ে যায়, তখন এই ক্রিস ক্রস প্যাটার্নের ফাইবারের মাঝে যে রক্তনালী গুলো থাকে, সেগুলো অটোমেটিক চাপা পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এর হাত থেকে মা রক্ষা পায়।
আমরা জানি যে ডেলিভারির পরে ব্লিডিং হয়, কিন্তু সেটা এভারেজ ব্লিডিং, অনেক বেশি রক্তপাত হতে থাকে, এমনটা না। ডেলিভারির পর জরায়ু সংকুচিত হয়ে শক্ত হয়ে যায়, এবং ব্লিডিং কমে যায়। কিন্তু রক্তস্বল্পতায় এই জিনিসটা হয়না, তখন জরায়ুটা খুব নরম হয়ে থাকে আর রক্ত নালী গুলো পুরো পুরি বন্ধ হতে না পারায় ব্লিডিং হতেই থাকে। আরেকটা ব্যাপার হলো, যেহেতু আগে থেকেই এই মায়েদের রক্ত কম থাকে, তাই অন্য মায়েরা যতটুকু ব্লিডিং সহ্য করতে পারেন, এই মায়েদের ক্ষেত্রে অল্প ব্লিডিংয়েই তাদের শরীর দূর্বল হয়ে যায়, ব্লাড প্রেসার কমে যায়, সমস্ত শরীরেই অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হয় এবং খুব অল্প সময়েই কলাপ্স করেন।
যদিও প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ অনেক কারণেই হয়, কিন্তু অন্তত এই একটি কারণ আমরা চাইলেই এড়াতে পারি, যদি প্রেগ্ন্যাসি পিরিয়ডে ডায়েট এবং সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন এর লেভেল ঠিক রাখার চেষ্টা করি। সিজারিয়ান বা নরমাল ডেলিভারি, দুই ক্ষেত্রেই এনিমিক মায়েদের ব্লিডিং বেশি হয়, কারণ তাদের জরায়ু সংকুচিত হতে পারেনা।
এই জটিলতা এড়ানোর জন্য প্রেগ্ন্যাসিতেই মায়েদের উচিত হিমোগ্লোবিন লেভেল অন্তত পক্ষে ১১ এর উপরে রাখার চেষ্টা করা, খুব ভালো হয় যদি ১২ বা ১২ এর উপরে রাখা যায়। এর জন্য নিয়মিত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, ১২ সপ্তাহের পর থেকেই আয়রন সাপ্লিমেন্ট নেয়া, রেগুলার হিমোগ্লোবিন চেক করা, খুব বেশি ঘাটতি হলে আয়রন ইঞ্জেকশন নেয়া, অথবা অনেক বেশি রক্ত স্বল্পতা হলে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন লেভেল বাড়ানো যেতে পারে।
ডাঃ ফাতেমা ইয়াসমিন,
প্রিনাটাল ইন্সট্রাক্টর, রৌদ্রময়ী স্কুল