এপিশিওটমির পরিচর্যা
এপিশিওটমি কি?
প্রাকৃতিকভাবে সন্তান প্রসবের সময় প্রসবের প্রক্রিয়াটিকে সহজ করার লক্ষ্যে যোনিপথ এবং পায়ুপথের মাঝামাঝি স্থানের মাংশপেশি বা পেরিনিয়ামে পরিকল্পিতভাবে কিছু অংশ কেটে দেয়ার পদ্ধতিকে এপিশিওটমি বলে।
আমাদের দেশে অনেকে এই প্রক্রিয়াকে ‘সাইড কাটা’ হিসেবে চিনে থাকবেন। বাচ্চা প্রসবের সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স বা মিডওয়াইফ প্রয়োজন বুঝে এপিশিওটমি করেন।
কখন এবং কিভাবে এপিশিওটমি দেয়া হয়?
বাচ্চা জন্মদানের পুশিং স্টেজে লোকাল এনেস্থিসিয়ার মাধ্যমে ওই জায়গাটুকু অবশ করে এপিশিওটমি দেয়া হয়। বাচ্চা এবং প্লাসেন্টা ডেলিভারি হওয়ার পরে কেটে দেয়া অংশটা পুনরায় সেলাই করে দেয়া হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেলাইয়ের জন্য শরীরের সাথে মিলিয়ে যায় এমন সুতা ব্যবহার করা হয়। তাই এই সেলাই পরবর্তীতে আর কেটে নিতে হয়না। ভেতরের সুতাগুলো মিলিয়ে যায় এবং বাইরের দিকের গুলো পরে যায়।
এপিশিওটমি কি বাধ্যতামূলক?
সন্তান জন্মদানের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এপিশিওটমির কোন প্রয়োজন থাকার কথা নয়। তাই এপিশিওটমি অবশ্যই বাধ্যতামূলক নয়। তবে কিছু কিছু কিছু বিশেষ কারণে এপিশিওটমি জরুরী হয়ে যায়। তখন ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে এপিশিওটমি করার অনুমতি চান। রোগী অনুমতি দিলে তবেই তিনি এপিশিওটমি করে থাকেন।
কখন এপিশিওটমি করতেই হবে?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এপিশিওটমি না দিলে প্রসব প্রক্রিয়া জটিল হয়ে যায়। যেমন-
• বাচ্চার মাথা অনেক বড় হলে
• যোনিপথের আশেপাশের মাংসপেশি লেবারের জন্য যথেষ্ট উপযোগী না হলে
• ডেলিভারির সময় ফরসেপ বা ভ্যাকুয়ামের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে
• যদি বাচ্চার কোন শারীরিক সমস্যা তৈরী হয় যার ফলে দ্রুত প্রসবের প্রয়োজন (অক্সিজেনের অভাব, দ্রুত হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া)
• বাচ্চার মাথার বদলে অন্য অংশ আগে বের হচ্ছে এরকম হলে
• দীর্ঘসময় নিয়ে চেষ্টার পর মা ক্লান্ত হয়ে গেলে
প্রয়োজন সত্ত্বেও এপিশিওটমি না করলে কি সমস্যা হতে পারে?
উপরোক্ত সমস্যা গুলো হওয়ার পরও যদি এপিশিওটমি না দেয়া হয়, তাহলে নানা জটিলতা হতে পারে যেমন-
- প্রসবের সময় যোনিপথ এবড়োখেবড়ো ভাবে ছিঁড়ে গিয়ে যোনিপথ এবং মলদ্বার একত্রিত হয়ে যেতে পারে। যার ফলে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পরে।
- দীর্ঘ সময় প্রসব প্রক্রিয়া চলার কারণে বাচ্চার মস্তিষ্ক বা শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে
- মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে
এপিশিওটমি দেয়ার পরে কি কি সমস্যা হতে পারে? কখন ডাক্তার দেখাবেন?
- যদি বেশিদিন ব্যথা থাকে
- কাটা জায়গা থেকে পুঁজ অথবা গন্ধযুক্ত কিছু বের হলে
- যদি কাটা জায়গার আশেপাশে লাল হয়ে ফুলে যায়
- জ্বর হলে
এগুলোর যেকোন একটি সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
সিজার ভালো? নাকি এপিশিওটমি?
- সিজারিয়ান সেকশন এবং এপিশিওটমি দুটো বিষয়ের আসলে তুলনা করাই চলে না। কারণ এপিশিওটমি একটি ছোট কাটা অংশ মাত্র। সামান্য পরিমাণ লোকাল এনেস্থিসিয়ার মাধ্যমে এটি করা হয়। অপরদিকে সিজার একটি বড় ধরনের অপারেশন। স্পাইনাল এনেস্থিসিয়ার মাধ্যমে শরীরের নিম্নভাগ অবশ করে দীর্ঘসময় নিয়ে পেটের একটা বড় অংশের ৭ টি স্তর কেটে সিজারিয়ান সেকশন করা হয়ে থাকে।
তাই কেউ যদি ভেবে থাকেন এপিশিওটমির তুলনায় সিজার ভালো বা কম কষ্ট হয় তাহলে তা নিতান্তই বোকামি হবে।
এপিশিওটমি নিয়ে অনেক নারীরই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে। যা অন্যদের জন্যও নরমাল ডেলিভারিতে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে অভিজ্ঞতা ভীতিকর হবে না, যদি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো যথাযথ ভাবে খেয়াল রাখা হয়।
১. অবশ্যই প্রতিবার টয়লেট থেকে বের হওয়ার আগে টিস্যু দিয়ে চেপে চেপে জায়গাটা শুকনো করতে হবে। অনেক টিস্যু লাগলেও ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন কৃপণতা চলবেনা।
২. জায়গাটা শুকনো করা হলে ডাক্তারের দেয়া অয়েন্টমেন্ট/ মলম টা লাগাতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ মত।
৩. ডাক্তারের দেয়া এন্টিবায়োটিক কোর্স সময় মেপে সঠিকভাবে খেতে হবে।
৪. ব্যথা থাকলে ব্যথার ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে। এটা ব্রেস্ট ফিডিং এর সময় নিরাপদ তাই প্রয়োজনে খেতে সমস্যা নেই। প্যারাসিটামলের এন্টি ইনফ্লামেটরি ইফেক্ট ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ রোধ করবে।
৫. প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খেতে হবে। লেবু, মালটা, আমড়ার পাশাপাশি ডাক্তারের দেয়া ভিটামিন সি ওষুধও অবশ্যই খেতে হবে। টক জাতীয় ফল খেলে সেলাই পেকে যায়- এই চরম ভুল ধারণাটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। বরং ভিটামিন সি জাতীয় টক ফল খেলে কাটাস্থান দ্রুত সেরে ওঠে।
৬. যেহেতু প্রসব পরবর্তী সময়ে রক্তপাত হয়, তাই জায়গাটা খুলে বাতাস লাগানো কষ্টকর। তবুও দিনে অল্প কিছু সময় হলেও টাওয়েল অথবা মোটা করে টিস্যু বিছিয়ে তার ওপর শুয়ে জায়গাটা খুলে বাতাস লাগানো যেতে পারে।
৭. দক্ষ ডাক্তার বা নার্স বাছাই করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়ে যথাযথভাবে এপিশিওটমি ও সেলাই দেয়া হলে এসময় তেমন কোন ব্যথা অনুভূত হয়না এবং সেলাই দ্রুত সেরে ওঠে।
৮. প্রসব পরবর্তী ৭-১৫ দিন বাথরুমে যাওয়া ছাড়া হাঁটাহাঁটি করা একদমই উচিত না। নড়াচড়া বেশি করলে সেলাইয়ে টান লেগে জোড়া দেয়া স্থানটা বারবার খুলে যায় এবং সারতে অনেক দেরী হয়। তাই এসময় রেস্ট নেয়াই উত্তম।
৯. প্রসবের পর অবশ্যই মল নরম রাখতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত পানি, ইসবগুলের ভূষি এবং আঁশজাতীয় খাবারগুলো প্রতিদিন খেতে হবে। অতিরিক্ত মশলাদার বা ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মল নরম হওয়ার ওষুধ খেতে হবে।
১০. প্রস্রাব এবং মলত্যাগের ব্যাপারে এসময় সতর্ক থাকতে হবে। কেটে যাওয়া অংশটি সবসময় এসব থেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কাটা অংশে সাবান ব্যবহার না করে পানির প্রবাহ দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
১১. এপিশিওটমির সেলাইয়ের সুতা না পরে যাওয়া পর্যন্ত দুই পা সবসময় চেপে বসতে হবে। টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাই কমোড বা চেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।
১২. এসময় বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর সময় নরম চেয়ারে বসে কোলে বালিশ নিয়ে খাওয়াতে হবে।
সঠিকভাবে যত্ন নিলে ৭-১০ দিনে সেলাই শুকিয়ে যায় এবং ১৫-২০দিনে সেলাই পরে যায়। শীতকালে কিছু টা বেশি সময় লাগতে পারে। এপিশিওটমি সেরে ওঠার পরে পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে এবং সহবাসে কোন অসুবিধা হয়না।
এপিশিওটমি নিয়ে অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটি শুধুমাত্র একটি কেটে দেওয়া অংশ। শরীরের অন্য কোথাও খানিকটা কেটে গেলে যেমন সেলাই দিলে ঠিক হয়ে যায়, এটাও ঠিক তেমনই। শুধুমাত্র স্পর্শকাতর জায়গায় কাটা হয় বলে এটার জন্য যত্ন একটু বেশি প্রয়োজন হয়।
(উপরের লিখাটির ক্ষেত্রে আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত পড়াশোনা আমাকে সাহায্য করেছে)
ডা. রুবাইয়া বিনতে রশীদ,
বিডিএস
প্রিন্যাটাল কোর্স পার্টিসিপ্যান্ট
৮ম ব্যাচ