লেবারের জন্য অপেক্ষা ও আর্লি লেবার- কি করবেন, কি করবেন না? (পর্ব-৩)
লেবার শুরু হওয়ার কিছু পূর্বলক্ষণ আগে থেকে জেনে রাখা জরুরি। সংক্ষেপে বলতে গেলে বাদামী স্রাব, হালকা গোলাপি, হালকা খয়েরী, এমনকি খয়েরী স্রাবও অনেকে দেখে থাকেন। এ-সবই নরমাল এবং লেবার শুরু হওয়ার চিহ্ন।
তবে মনে রাখবেন টকটকে লাল/তাজা রক্ত বা চাকা চাকা রক্ত অনবরত যেতে থাকা বিপদ চিহ্ন ও সাথে সাথে আপনার ডাক্তারকে জানাতে হবে।
পানি ভেঙে যাওয়াও লেবার শুরু হবার একটি লক্ষণ। সাধারণত পানি ভাঙার ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে পেইন শুরু হয়। তবে পানি কখন, কী পরিমাণ ভেঙেছে ও তার রঙ কী তা লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। ৩৭ সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পর বাচ্চাকে ম্যাচিউর ধরা হয় ও এর পর লেবারের লক্ষণ দেখা দেয়া স্বাভাবিক। পানির রঙ সাদা, গন্ধহীন ও অল্প অল্প করে ভাঙতে থাকলে সেটা খুব বেশি চিন্তার বিষয় না। এসময় চলাফেরার মধ্যে থাকলে বা লেবারের জন্য উপযোগী পজিশনে থাকলে সাধারণত নিজে থেকেই পেইন শুরু হয়। তবে আপনার লাস্ট আল্ট্রাসাউন্ডে পানির পরিমাণ কত ছিল এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে চলাফেরা করা ও লেবারের জন্য অপেক্ষা করার ক্ষেত্রে।
তবে একবারে অনেক পানি পড়ে গেলে কিংবা পানির রঙ সাদা না হয়ে সবুজ, হলুদ, বা কালো হয়ে গেলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও পানি ভাঙার পর বা লেবার শুরু হলে যদি প্রেগন্যান্ট মা অত্যধিক জ্বরে আক্রান্ত হন তাহলেও সেটা বিপদচিহ্ন। কারণ জ্বর সাধারণত কোন ইনফেকশনের চিহ্ন হয়ে থাকে।
এছাড়াও অনেকের রক্ত/পানি দেখা দেয়া ছাড়াই তলপেট কামড় দিয়ে ব্যাথা শুরু হওয়ার দ্বারা লেবার শুরু হয়। এই ব্যাথা কিছুটা মাসিকের আগে তলপেটে যেভাবে ব্যাথা হয় কিংবা আমাশয় হলে যেরকম ব্যাথা অনুভূত হয় তেমন হয়। ব্যাথার সাথে পেট শক্ত হয়ে আসে ও সময়ের সাথে সাথে ব্যাথা বাড়তে থাকে।
কখন বুঝবেন সত্যি সত্যি লেবার কিনা?
অনেকের তলপেটে ব্যাথা ও তার সাথে পেট শক্ত হয়ে আসা ৩২/৩৩ সপ্তাহ থেকেও মাঝেমধ্যে অনুভব হয়ে থাকে। প্রেগন্যান্সির শেষদিকে এসে এটা খুব স্বাভাবিক কারণ জরায়ু এসময় তার সামনে যে বড় ইভেন্ট অর্থাৎ লেবারের প্রস্তুতি স্বরূপ সংকোচিত ও প্রসারিত হয়ে থাকে। এটাকে প্র্যাক্টিস কন্ট্রাকশন বা ফলস পেইনও বলা হয়।
যেকোনো ধরনের ব্যাথা অনুভূত হলেই তাকে লেবার মনে করে অস্থির হবার কিছু নেই। কখনো যদি সন্দেহ হয় লেবার পেইন কিনা তাহলে কিছু বিষয় ট্রাই করে দেখতে পারেনঃ
*যে পজিশনে বসে বা শুয়ে ছিলেন তা চেইঞ্জ করে ফেলা/ উঠে পড়া
*হাটাহাটি করা
*গোসল করা
*এককাপ গরম দুধ বা চা খাওয়া
এসব করার পরও অনবরত একটার পর একটা কন্ট্রাকশন আসছে ও সময়ের সাথে কন্ট্রাকশন জোরালো হচ্ছে, কন্ট্রাকশনের সাথে পেট শক্ত হচ্ছে সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় লেবার শুরু হয়েছে। সময়ের সাথে কন্ট্রাকশন জোরালো হওয়া/নির্দিষ্ট গ্যাপে আসতে থাকার বিষয়টা এমন যেমন সকাল থেকে কারো হালকা হালকা পেইন আসছে, সে হাটাচলা ও অন্যান্য কাজকর্ম করছে, এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর, বিকেল হয়ে যাচ্ছে ও তার ব্যাথাগুলো ধীরে ধীরে আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক ও শক্তিশালী হচ্ছে।
এই সময়টা সাধারণত লেবারের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় হয়ে থাকে ও একেই লেবারের লেটেন্ট ফেইজ, আর্লি লেবার বা লেবারের প্রাথমিক অবস্থা বলা হয়।
আমরা এখন আর্লি লেবারে যে ভুলগুলো করা উচিত না তা নিয়ে আলোচনা করব।
ভয় পেয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা শুরু করা বা প্যানিক করা:
এটা কক্ষনোই করা যাবে না। কারণ এতে করে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করে ও শরীরে অক্সিজেন কম প্রবেশ করতে পারে যা মূলত বাচ্চার জন্য অক্সিজেন সাপ্লাইয়ে বিঘ্ন ঘটায় ও কার্বন ডাই অক্সাইড এর লেভেলকে বিপদজনক সীমায় নিয়ে যায় ও বাচ্চা “Fetal distress” এ পড়ে যায়। পুরো লেবারেই মনে রাখবেন ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া ও মানসিক চাপ অত্যন্ত ক্ষতিকর।
যেকোনো মানসিক দুশ্চিন্তা, ভয়, স্ট্রেস বা রাগ আমাদের শরীরে এড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটায় যা মূলত ব্লাড প্রেশারকে বাড়িয়ে দেয়, আমাদের পেশীগুলোকে টাইট করে দেয়/ক্লোজ করে দিতে থাকে এমনকি জরায়ুমুখকে প্রসারিত হতে বাধা দেয় এবং ব্রেনকে সিগ্ন্যাল দিতে থাকে যে কোন বিপদ এসেছে। অথচ দেখুন এর কোনটাই কিন্তু লেবারের সময় কাম্য না!! আমরা চাচ্ছি আমাদের শরীরের পেশীগুলো যেন রিলাক্স থেকে যতটা সম্ভব ওপেন হয়, আমরা চাচ্ছি জরায়ুমুখ যেন খুলে যায় ও বাচ্চা যেন নেমে আসে অথচ ভয় বা দুশ্চিন্তা কিন্তু ঠিক উল্টো কাজ করছে!
চিৎকার, কান্নাকাটি করা, ব্যাথা চেপে রাখা:
এটা আরেকটা ভুল। ব্যাথার সময় চিৎকার করলে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললে, দাঁতে দাঁত চেপে ধরলে শরীরের পেশিগুলি সংকুচিত ও টাইট হয়ে থাকে ও ব্যাথা আরও বেশি অনুভূত হয়। বরং এসময় খেয়াল রাখা যেন হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল ও জিহবা সম্পূর্ণ রিলাক্স থাকে।
অপরিচিত, অচেনা পরিবেশে / তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে চলে যাওয়া:
হ্যাঁ, বুঝতেই পারছেন লেবারের প্রাথমিক অবস্থায় এমনকি কোন অবস্থাতেই আমরা এড্রেনালিন হরমোন চাই না। আমরা চাই অক্সিটোসিন হরমোন বা লাভ হরমোন যা শরীরকে রিলাক্স করবে ও সঠিকভাবে তার কাজ করতে সাহায্য করবে। অথচ আমরা যে ভুলটা করি তা হল কখনো ফলস পেইন নিয়েই হাসপাতালে চলে যাই আর কখনো খুব প্রাথমিক সময়ে হাসপাতালে চলে যাই। অচেনা পরিবেশে ও আশেপাশে গম্ভীরমুখো সব মানুষজন, নানান কিসিমের রোগী দেখে নিশ্চয়ই লাভ হরমোন নিঃসরণ হবে না! তাছাড়া হাসপাতাল মানে নিশ্চয়ই বাসার মত আরাম, যখন যেভাবে খুশি বসা, শোয়া, খাওয়া, নিজের টয়লেট ইউজ করার মত বিষয়গুলো মিসিং থাকে, বরং সম্ভাবনা বেশি যে আপনি অধৈর্য্য হয়ে যাবেন যে কখন বাবু হবে আর বাসায় যাব, এমনকি সম্পূর্ণ নির্ঘুম সময়ও কাটতে পারে অস্থিরতায়। এতে করে এত এনার্জি লস হয়ে যায় ও হবু মা শারীরিক ও মানসিকভাবে এত ক্লান্ত হয়ে যান যে যখন সত্যিকারের এনার্জির প্রয়োজন অর্থাৎ এক্টিভ লেবার ও পুশিং স্টেজে তখন নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকেন ও হাল ছেড়ে দেন (যদি লেবার তূলনামূলক লম্বা হয় তাহলে তো কথাই নাই)।
এখানে বলে রাখা ভাল যে জরায়ুমুখ ৬ সে.মি. খোলা হলে তাকে এক্টিভ লেবার বলা হয়। এসময় খুব কম সময়ের গ্যাপে কন্ট্রাকশন আসতে থাকে ও প্রতিটি কন্ট্রাকশন বেশ কঠিন থাকে। এসময় শারীরিক ও মানসিকভাবে এনার্জেটিক থাকা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রচুর উৎসাহ ও সাপোর্ট খুব দরকার। তবে ইতিবাচক বিষয় হল লেবারের এই কঠিন সময়টা বেশী দীর্ঘ হয়না এবং ১০ সেমি ডাইলেশনের পর যখন পুশ করার সময় আসে সেই সময়টাও খুব অল্প সময় থাকে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তায়া’লা কত সুনিপুণভাবে আমাদের জন্য সহজ করেছেন সিস্টেমটা! প্রতিটি কন্ট্রাকশনের পর কিছুক্ষণ রিলাক্স করার সময়ও পাওয়া যায়।
গবেষণায় দেখা যায় ৪ সে.মি. থেকে ৬ সে.মি. হতেই সবচেয়ে বেশি সময় নেয় এবং এজন্য মায়ের যেমন ধৈর্য্য প্রয়োজন তার আশেপাশের ফ্যামিলি ও প্রফেশনাল মেডিক্যাল সাপোর্টেরও অনেক বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন। জরায়ুমুখ খোলা থেকে শুরু করে এক্টিভ লেবারে আসার আগের সময়টা মায়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম, চলাফেরা, আপনজন, নিজের বাসায় থাকাই সবচেয়ে ভাল।
পাড়া–পড়শী, আত্মীয়–স্বজনকে জানিয়ে দেয়া:
এটা আরেকটা বিশাল ভুল যা অনেকেই করে থাকেন। মনে রাখবেন বাচ্চা কন্সিভ করার মূহুর্তটা যেমন আপনার ও আপনার সঙ্গীর একান্ত ও আন্তরিক একটা মূহুর্ত ছিল, লেবারের সময়টাও ঠিক তাই। এটা এমন কোন “খবর” নয় যা প্রচার করতে হবে, বরং বাচ্চা হলে সবাই জেনেই যাবে। কখনো কোন গরু, ছাগল বা অন্য কোন প্রাণীকে বাচ্চা জন্ম দিতে দেখেছেন? জগতের সকল প্রাণীকেই কিন্তু আল্লাহ এই বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে রেখেছেন যে তারা খুব গোপনে বা একাকী বাচ্চা জন্ম দিতে পছন্দ করে। আপনার শরীরকেও কিন্তু আল্লাহ সেভাবেই এই জ্ঞান দিয়ে রেখেছেন ও সে জানে কিভাবে সে সন্তান জন্ম দিবে।
আমাদের ব্রেইনের একটা অংশ হল instinctual brain/emotional brain আর এর কাজ হল যখন যেটার প্রয়োজন তার যোগান দেয়া। আর সন্তান জন্ম দেয়া মূলত এই ব্রেইনের কাজ। আর তাই সন্তান জন্ম দেয়া জানার জন্য কারো উচ্চ শিক্ষিত হবার প্রয়োজন পড়েনা। অপরদিকে ব্রেইনের যে অংশ আমাদের সমস্যার সমাধান করতে, যুক্তি বুঝতে, ভাষা শিখতে, সমাজে চলতে ও জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করে তা হল যুক্তিবাদী ব্রেইন। যেহেতু সন্তান জন্ম দেয়া একটি instinctual act বা সহজাত আচরণ তাই লেবারের মূহুর্তে এমন কোন বিষয় যা মূলত যুক্তিবাদী ব্রেইনের কাজ তা সামনে আসলে লেবার বাধাগ্রস্ত হয়। যেমন লেবারের সময় আপনার বাসায় পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি বা এমন কেউ যার উপস্থিতি আপনাকে মেহমানদারী, আপ্যায়ন বা ভদ্র আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়, আপনার লেবারের স্বাভাবিক প্রগ্রেসকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কারণ লেবারের সময়টা কোন ভদ্রতা, সভ্যতা চিন্তা করার সময়ই না!!
আর্লি লেবারেই শুয়ে থাকা, এমনকি চিৎ হয়ে শোয়া:
চিৎ হয়ে শোয়ার অসংখ্য অপকারিতার একটি হল এতে করে আমাদের মেরুদন্ডের আশেপাশে যে রক্তনালীগুলো আছে তা ওজনদার জরায়ু (গর্ভস্থ শিশুসহ) ও পুরো শরীরের ভারে চাপা পড়ে যায়। এতে করে ব্লাড প্রেশার এলোমেলো হয়ে যায়, অক্সিজেন সাপ্লাই কমে যায় ও বাচ্চার হার্টবিট কমে আসে। হ্যাঁ ঠিক একারণেই লেবারের সময় অনেকেরই সুস্থ বাচ্চারও হার্টবিট কম পাওয়া যায়। তাই আর্লি লেবারে স্যালাইন লাগিয়ে ভদ্র রোগীর মত বিছানায় শুয়ে থাকা কখনোই উপকারী কোন বিষয় না। বরং এসময় হাটাচলা, স্বাভাবিক কাজকর্ম, স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া, রেস্ট নেয়া, সম্ভব হলে ঘুমানো খুবই প্রয়োজন।
নরমাল সাপোর্টিভ নন এমন কোন ডাক্তার /নার্স/আত্মীয় এর সাথে কথা বলা/পরামর্শ নেয়া:
মনে রাখবেন উক্ত ব্যক্তি আপনার পরিবারের অতি আপনজনও হতে পারেন! হ্যাঁ। লেবার শুরু হয়ে গেলে প্রতি মূহুর্তে আপনার নিজের শরীরকেই আপনার ম্যানেজ করতে হচ্ছে এমতাবস্থায় নন সাপোর্টিভ কারো সামান্য কোন ভীতিকর কথাও আপনার জন্য অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা তৈরি করে দিতে পারে। তাই কাউকে এই বিষয় শেয়ার করার আগে বুঝেশুনে করবেন। কারণ নন সাপোর্টিভ কারো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা অতীতের ট্রমা আপনার উপর আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ডিসিশন চাপিয়ে দিতে যথেষ্ট। এমনকি ডাক্তার/প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ পছন্দ করার সময় খেয়াল রাখবেন এমন কাউকেই বেছে নিতে যিনি শতভাগ শুভাকাঙ্ক্ষী, সৎ ও আপনাকে ১০০% অথেনটিক ইনফরমেশন দিয়ে থাকেন। অন্ততপক্ষে আর্লি লেবারে এমন কারো পরামর্শই নিবেন যিনি পুরোপুরি আপনার ইচ্ছা ও আপনার সিচুয়েশনের প্রতি সম্মান রেখে পরামর্শ দিবেন ও এবিষয়ে অভিজ্ঞ।
আয়েশা সিদ্দিকা হোমায়রা,
রৌদ্রময়ী দৌলা ইন্টার্ন