লেবারের জন্য অপেক্ষা ও আর্লি লেবার- কি করবেন, কি করবেন না? (পর্ব-৪)
অনেকেই চিন্তিত থাকেন ব্যাথা উঠবে কিনা বা কী করলে স্বাভাবিকভাবে ব্যাথা উঠবে ও বাড়বে কিংবা ব্যাথা উঠলে ঠিক কী করা উচিত। ব্যাথা না উঠা কিংবা ব্যাথা না বাড়া, জরায়ুমুখ পুরোপুরি না খোলা কিংবা ব্যাথা সহ্য করতে না পারা এই ৪ কারণে সিজার এখন কমন হয়ে গেছে। অথচ সিজার একটি জীবন রক্ষাকারী অপারেশন যার উদ্দেশ্য মা ও শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধ করা। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি কিছু সিচুয়েশনে (যা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় না) সিজার করা একান্ত প্রয়োজন। World Health Organization(WHO) এর রিকমেন্ডেশন অনুযায়ী সি সেকশন রেট শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ধরা হয়, অথচ বাংলাদেশের সি সেকশন রেট প্রায় শতকরা ৪০ ভাগের কাছাকাছি!!
আগেই বলেছি সব ঠিক থাকলে লেবার অবশ্যই শুরু হবে ইনশাআল্লাহ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোবে, প্রয়োজন সঠিক প্রস্তুতির, শারীরিক ও মানসিক।
স্বাভাবিকভাবে ব্যাথা উঠার জন্য কী কী করা যায়:
প্রেগন্যান্সির টাইমে নানান রকমের অসুস্থতা, খারাপ লাগা, ব্যাথা-বেদনার ভীড়ে অনেকে ব্যায়াম করতে চান না। তাই শুরুতেই বলে রাখি পুরো প্রেগন্যান্সি জুড়ে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মের মধ্যেই একেকটা ব্যায়ামের প্র্যাক্টিস করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ শেষদিকে এসে অল্প ব্যায়ামেই হাপিয়ে উঠবেন না।
লেবারের জন্য অপেক্ষার দিনগুলোতে যা করবেনঃ
*প্রচুর হাটা সকাল-বিকাল (প্রচুর মানে প্রচুর, সকালে ১ ঘন্টা, বিকেলে ১ ঘন্টা ম্যাক্সিমাম)
*নিচে বসা, যেমন লো কমোডে বসা, খাওয়ার সময় বা বিভিন্ন সময় এই পজিশনে বসে থাকা (স্কোয়াট)
*উঁচু হয়ে সিজদা দেয়ার মত করা
*ঘর মোছার মত প্র্যাক্টিস করা (ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে নিচে বসে বা গ্রামে ঘরের মেঝে লেপার মত করে)
*নিচে বসে কাপড় কাচা/রুটি বেলা
*সিড়ি বেয়ে রেগুলার সকাল বিকাল উঠানামা করা
*খেজুর খাওয়া ডেইলি ৭/৮ টা করে, জরায়ুমুখ নরম হয়
*শারীরিক সম্পর্ক করা। সম্ভব হলে লেবারের জন্য অপেক্ষার সময় প্রতিদিন, এমনকি লেবার শুরু হয়ে গেলেও (বেড রেস্ট বা হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি বাদে)
লেবারের আগে ও আর্লি লেবারে শারীরিক সম্পর্ক:
এর মূল উপকারিতা হল শারীরিক সম্পর্ক করলে আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ হয় আর লেবারের জন্য শরীরে সবচেয়ে বেশি এই হরমোনই প্রয়োজন। এছাড়া বীর্য বা সিমেন এর মধ্যে এক ধরনের হরমোনের মত পদার্থ থাকে যার নাম প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন। এই প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন জরায়ুমুখকে নরম করতে সাহায্য করে।
তবে খেয়াল রাখতে হবে যেকোনো অবস্থাতেই চিত হয়ে শোয়া মা ও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। শারীরিক সম্পর্কের সময়ও চিত না হয়ে অন্য কোন পজিশনে ট্রাই করার পরামর্শ রইল। কখনো যদি শুনে থাকেন আপনার জরায়ুমুখ টাইট হয়ে আছে/ খুলছে না/ ২ সে.মি. খুলেছে কিন্তু সময়ের সাথে আগাচ্ছে না, অবশ্যই শারীরিক সম্পর্ক ট্রাই করে দেখার অনুরোধ রইল।
এই বিষয়ে অনেকেই ভয় পান, অনেকেই জানতে চান যে এতে পানি ভেঙে যাবে কিংবা বাচ্চার মাথায় আঘাত লাগবে কিনা। বাচ্চার মাথায় আঘাত লাগার প্রশ্নই আসে না কারণ বাচ্চার মাথা জরায়ুমুখের ভেতরে সুরক্ষিত থাকে ও ভ্যাজাইনা/মাসিকের রাস্তা থেকে জরায়ুমুখের দূরত্ব ভালই। আর পানি কী কারণে ভাঙে তা আগেই আলোচনা করেছি।
আর্লি লেবারে কী করবেন:
-প্রচুর হাটাচলা করা, বারবার পজিশন চেইঞ্জ করা ও সাথে রেস্টও নেয়া।
– উপরোল্লিখিত ব্যায়ামগুলো শুধু যে ব্যাথা উঠানোর জন্যই কার্যকর তা না বরং ব্যাথা উঠে গেলে ব্যাথা বাড়ানোর জন্যও কার্যকর ইনশাআল্লাহ। মূলত আমাদের হিপ বা মাজার হাড্ডি যেটাকে পেলভিস বলছি এটা আমরা যত হাটাচলা/মুভমেন্ট করি তত বাচ্চার জন্য জায়গা করে দেয় যাতে বাচ্চা ভেতরে ঢুকে ও বার্থ ক্যানালের দিকে নেমে আসতে পারে। তাই লেবারের প্রাথমিক অবস্থায় যত বেশি এক্টিভ থাকা যায় ততই ভাল।
এখানে একটা বিষয় বলে রাখি প্রতিটি কন্ট্রাকশনের সাথে আমাদের জরায়ু সামনের দিকে ঝুঁকে আসে এবং বাচ্চা তার সর্বশক্তি দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। অতএব এখানে দুই ধরনের বল কাজ করছে, সামনের দিকে ধাক্কা ও নিচের দিকে অভিকর্ষজ বলের প্রয়োগ। অতএব upright position বা leaning forward যেকোনো পজিশনে ব্যাথা কম অনুভূত হয়, চুপচাপ শুয়ে থাকার চেয়ে।
তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে, আর্লি লেবারেই সব এনার্জি খরচ করে ফেললে চলবে না বরং মূল লেবারের জন্য এনার্জি জমাও রাখতে হবে। তাই স্বাভাবিক কাজকর্মের পাশাপাশি ছোট ছোট ন্যাপ নেয়ার চেষ্টা করা যায় বা শুয়ে/বসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নেয়া যায়। এখানেই রিলাক্সেশনের কথা চলে আসে।
রিলাক্সেশন করা:
বিভিন্নভাবে কোমর, ঘাড়, বা কাত হয়ে শুয়ে শরীর ম্যাসাজ করানো (অবশ্যই কারো হেল্প নিয়ে) লেবার শুরুর আগে থেকেই রেগুলার প্র্যাক্টিস করা উচিত। নাহলে ব্যাথা উঠে গেলে অস্থিরতা কাজ করে ও অনেক কিছুই মাথায় আসে না। এছাড়া ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস বা ডিপ ব্রিদিং বিশেষ করে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়া এরও রেগুলার প্র্যাক্টিস করা খুব জরুরি। কারণ জিহবা যত রিলাক্স থাকবে শরীরের অন্যান্য জায়গাও কিন্তু রিলাক্স থাকবে আর জরায়ুমুখ বা সারভিক্সও কিন্তু তত রিলাক্স থাকবে। তাই ব্যাথা উঠে গেলে নিজেকে রিলাক্স করতে রিলাক্সেশন এর বিকল্প নেই।
গোসল:
ব্যাথা উঠে গেলে ধীরে সুস্থে, সময় নিয়ে একবার গোসল সেরে নিন। যদি ফলস পেইন হয় ব্যাথা কমে আসবে। সত্যিই লেবার হলে গোসলের দ্বারা শরীর রিলাক্স হবে ও ব্যাথা বাড়বে ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া বলা যায় না আগামীতে কত বছরে আবার এমন অবসর আসবে ধীরে সুস্থে গোসল করার আল্লাহই জানেন।
স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করা:
কারণ আপনার শরীরে প্রচুর শক্তি থাকতে হবে। অনেকের টেনশনে রুচি চলে যায়। তাই হাতের কাছে যেসব খাবারে অল্পতেই পুষ্টি ও শক্তি বেশি তা রাখতে পারেন। এক নাম্বারে আসে খেজুরের কথা। স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে লেবার চলাকালীন মারইয়াম আঃ কে খেজুর খেতে ও পানি পান করতে আদেশ করেছেন। এছাড়াও ফ্রেশ ফলমূল কিংবা বাদাম, স্যুপ বা জুস, গরম দুধ এবং প্রচুর প্রচুর পানি পান করতে থাকবেন।
লেবার পেইনের কথা ভুলে থাকেন ও মন অন্যদিকে সরিয়ে রাখেন:
হ্যাঁ ভুলে যান আপনার লেবার শুরু হয়েছে। নিজেকে প্রচুর ব্যস্ত রাখেন। হাটতে যান বা কিছু একটা গুছাতে শুরু করেন, কিছু রান্না শুরু করেন বা কারো সাথে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিয়ে নেন। দেখবেন ব্যাথার কথা ভুলে গেছেন। চিন্তার কারণ নাই ব্যাথা একসময় এতটাই তীব্র হয়ে আসবে যে আপনার শরীরই আপনাকে সিগ্ন্যাল দিবে যে আমার দিকে মনোযোগ দাও।
নামাজ, দুয়া ও আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ:
লেবার শুরু হয়ে গেলে শুরুতেই দুই রাকাত সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে সহজতা ও কল্যাণের দুয়া করে নিতে পারেন। প্রতি কয়েক ঘন্টা পর পর যখনই টেনশন বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তখনই একাজ করতে পারেন। তাছাড়া কন্ট্রাকশনের সময় আল্লাহর বিভিন্ন নাম ধরে ধরে তার কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। আর মুখস্থ কুরআনের বিভিন্ন অংশ তিলাওয়াত করতে পারেন, বা বিশেষ কোন আয়াত/দুয়া অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে পারেন। প্রকৃতপক্ষে লেবার আমাদের জন্য এক বিশেষ মূহুর্ত যেসময় আমরা আল্লাহর সাহায্যের অত্যন্ত মুখাপেক্ষী ও আল্লাহর অনেক নিকটে থাকি। যেহেতু দূর্বল ও রুগ্ন ব্যাক্তির দুয়া আল্লাহর কাছে দ্রুত পৌঁছায় এই সুযোগে নিজের ও সন্তানের জন্য ও নিজের জীবনে যত মুশকিল আছে সব সহজ করার জন্য দুয়া করে যাবেন।
কন্ট্রাকশন কত লম্বা ও কতক্ষণ পরপর আসছে:
ঘড়ি ধরে মাঝেমধ্যে দেখে নিন, কয় সেকেন্ড বা কয় মিনিট লম্বা সময় ধরে একেকটা কন্ট্রাকশন হচ্ছে ও কত সময় পরপর হচ্ছে। কোন প্যাটার্ন আছে কিনা। তবে কন্ট্রাকশন মাপার বিষয়ে বেশি ফোকাস করার দরকার নাই। দীর্ঘক্ষণ কন্ট্রাকশন পাত্তা না দেয়ার পর যখন দেখবেন আর পারছেন না, প্রতিটি কন্ট্রাকশন আপনাকে বাধ্য করছে মনোযোগ দিতে তখন আবার মাপতে শুরু করুন।
হসপিটালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন:
ব্যাগ গুছিয়ে রাখুন। গাড়ি বলে রাখুন যদি এমন কোথাও থাকেন যেখানে গাড়ি পাওয়াই মুশকিল। কন্ট্রাকশন যথেষ্ট জোরালো হলে ও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ফলো করে আসতে শুরু করলে হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবুন যদি অন্য সব বিষয় নরমাল থাকে।
আল্লাহ প্রত্যেক মায়ের জন্য লেবারের সময়কে সহজ করুন। বিশেষ করে যাদের প্রথম প্রেগন্যান্সি তাদের জরায়ুর মুখ খুলতে বেশ অনেক সময় লেগে যায় ও তাদের জন্য আর্লি লেবারের সময়টা পার করাটাই কঠিন। সর্বোপরি, এসব বিষয়ে এত এত ইনফরমেশন জানার আছে যে অল্প কিছু পোস্টে সব বলা সম্ভব না। রৌদ্রময়ী স্কুল থেকে যে প্রিন্যাটাল কোর্স করানো ssহয় করে ফেললে অনেক বিস্তারিত জানা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর শুধু কোর্স করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করলেই সম্ভব সচেতনভাবে নিজের সিদ্ধান্তগুলো জেনে বুঝে নেয়া ও সুন্দর একটি বার্থ এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া বি ইয নিল্লাহ।
আয়েশা সিদ্দিকা হোমায়রা,
দৌলা ইন্টার্ন, রৌদ্রময়ী স্কুল