আমার জীবন যখন আরেকজনের দখলে
আমার একজন দৌলা ক্লায়েন্ট, যিনি ১২তম রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্সে ছিলেন, মা হওয়ার পর একদিন মেসেজ করলেন। বললেন যে, উনার মাঝে বিষন্নতা কাজ করছে, মনে হচ্ছে উনার নিজের কোন লাইফ নেই!
আচ্ছা, মা হওয়ার পর কি সবাই বাবুর মুখ দেখে সব কষ্ট ভুলে যায়? সবাই কি খুশির বন্যায় ভাসে? কেউ যদি চোখের পানি ফেলে তার মানে কী মনে হয় আপনাদের?
মা হওয়া নারী জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি। একটি অসহায়, নাজুক জীবনের সর্বক্ষণের চাহিদা পূরণ করা কোন চাট্টিখানি কথা নয়। এসময় জীবনটা চোখের পলকে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। ২৪/৭ আরেকটি প্রাণের দেখভাল করলে “আমার নিজের কোন লাইফ নেই” এমনটা মনে হতেই পারে।
আমি যখন আপুটার সাথে কথা বলছিলাম উনি নিজেই তখন বললেন যে আমরা পোস্ট ডেলিভারি সময়টা নিয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই না যতটা লেবার-ডেলিভারি নিয়ে নেই। এই জায়গাটাতে আসলেই আমাদের নতুন দম্পতিরা অনেক সময় ভুল করেন।
নতুন বাবুর যত্ন নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে আমরা হয়ত অনেক কাঁথা, কাপড়, প্রসাধনী ইত্যাদি কিনি। কিন্তু আরো কিছু বিষয় থাকে যা নিয়ে আমাদের পূর্বপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
১। মা প্রসব পরবর্তী সময়ে কোথায় থাকবেন – এই বিষয়টা ঠিক করা উচিত প্রেগন্যান্সির সময়েই এবং সেটা হওয়া দরকার এমন কোথাও যেখানে মা নিজে সবচেয়ে কম্ফোর্টেবল থাকবেন। যে পরিবেশে মায়ের স্ট্রেস বেড়ে যায়, সে পরিবেশ কখনোই প্রসব পরবর্তী অন্তত প্রথম ছয় সপ্তাহের জন্য বেছে নেয়া ঠিক না। কারণ এতে শুধু যে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের দুধ নামতে অসুবিধা হয় তা-ই না, মায়ের ঘুমের সমস্যা হওয়া, খাবারে অসুবিধা থেকে দুধ উৎপাদনে বিঘ্নও ঘটে। পাশাপাশি মা মানসিকভাবে অনিরাপদ অনুভব করেন এবং ধীরে ধীরে বিষন্নতার দিকে চলে যান যা তাকে মাতৃত্বকে উপভোগ করার পরিবর্তে একে কষ্টকর বিষয় করে তোলে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বাচ্চার বাবা। কারণ হবু মায়ের কথা অনেক সময় যথাযথ গুরুত্বের সাথে শোনা হয় না। আর তাই তার স্বামীই পারেন এই ব্যাপারে মূখ্য ভূমিকা রাখতে। এজন্য প্রসব পরবর্তী সময়ে স্ত্রী কোথায় থাকতে চান এবং কেন উনার একটি মানসিকভাবে নির্ভরশীল স্থানে থাকা দরকার এটা স্বামীর জানা থাকা প্রয়োজন।
২। মায়ের পাশাপাশি বাবুকে দেখাশোনা আর কে কে করবেন – অনেক পরিবারে বাবুকে ঘুম পাড়ানো, কোলে নেয়া, গোসল দেয়ার জন্য ঘরে শক্ত সামর্থ্য কেউ থাকেন। আবার অনেক পরিবারে মাকে এগুলো একাই করতে হয়।
যেখানে ঘরে অনেকে থাকেন সেখানেও যিনি বা যারা দেখাশোনা করবেন তাদেরও নিজস্ব রুটিন থাকবে। তারা কি নিজের রুটিনের বাইরে এসেও বাবুর দেখাশোনা করবেন, যদি প্রয়োজন হয়? দিনে বাবুর সাথে থাকলেও তারা কি বাবু রাতে না ঘুমালে তখনো তার সাথে থাকবেন? মাকে রাতে বা দিনে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে দিবেন? আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তারা কি মায়ের প্রাইভেসির বিষয়টি বোঝেন? মা দুধ খাওয়ানোর সময় তার যে রিল্যাক্স থাকা, নিরিবিলি থাকার প্রয়োজন সেটা কি বোঝেন? নাকি বাবুর দেখাশোনা করার নামে মায়ের চারপাশে অনেকে মিলে সবসময় হৈ হট্টগোলের পরিবেশ তৈরি করে রাখেন? এই বিষয়গুলো নিয়ে আগে থেকেই হবু মা ও অবশ্যই বাবারও ভেবে রাখা উচিত। তা নাহলে মাতৃত্বের প্রথম দিনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কষ্টকর হয়ে ওঠে মা ও বাবা উভয়ের জন্যই।
আর যারা ঘরে একা থাকেন তারা ভেবে রাখবেন ২৪/৭ বাবুর যত্ন কিভাবে হবে। রান্না, ঘরের কাজগুলো স্বামী-স্ত্রী ভাগাভাগি করে কিভাবে করতে পারেন সেটা নিয়ে আলোচনা করে রাখবেন৷ কিভাবে সাংসারিক অন্যান্য কাজের চাপ কমানো যায় এই নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত প্রেগন্যান্সির সময় থেকেই। বাচ্চার বাবা অফিস থেকে সর্বোচ্চ কতদিন ছুটি নিতে পারবেন তার উপরও নির্ভর করবে অনেক কিছু। প্রথম ৬ সপ্তাহের জন্য যদি বাচ্চার বাবা যথেষ্ট সময় দিতে না পারেন তাহলে পরিবারের কেউ বা কোন খাদিমাকে যোগাড় করা সম্ভব কিনা এগুলো বিষয় আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে হবে। প্রেগন্যান্সির সময় থেকেই বাচ্চার বাবাকেও জানতে হবে কিভাবে একজন নবজাতকের বেসিক যত্নগুলো নিতে হয় যাতে মা ব্যাস্ত বা ক্লান্ত থাকলে তিনি কিছুটা সামলে নিতে পারেন। খাদিমা রাখলে প্রেগন্যান্সির সময় থেকেই তাকে নিজের কাছে এনে বাবুর ও ঘরের বিভিন্ন বিষয় শিখিয়ে নিলে এবং তার সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিলে ভালো হবে।
৩। দাম্পত্য সম্পর্ক কিভাবে মেইনটেইন করবেন – অনেকেই এই দিকটা বেমালুম ভুলে যান। অথচ দীর্ঘ সময় পরিচর্যা না করলে দাম্পত্য সম্পর্কে ভাটা পরতে পারে। বাবা-মা হওয়ার আগে আপনারা স্বামী-স্ত্রী এটা মনে রাখতে হবে। যতই নতুন বাবু নিয়ে ব্যাস্ততা থাকুক নিজেদের জন্য কিছুটা সময় আলাদা করে রাখতে হবে। একসাথে বসে না হয় নতুন বাবুর মায়াবী মুখটাই দেখলেন, সেই সাথে চলতে পারে নতুন জীবনে নিজেদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করার স্ট্রাগলের গল্পগুলো। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে বা কারো কোলে দিয়ে আধ ঘন্টা হয়ত একসাথে একটু হেটে আসলেন। আপনার বাবুটা শান্ত-শিষ্ট হলে তাকে সাথে নিয়েও একটু বের হতে পারেন। বাবু ঘুমালে স্ত্রী নিজেকে পরিপাটি করে রাখা, হালকা সাজা, স্বামী বাইরে থেকে আসলে ছোট কোন উপহার বা ফুল হাতে করে আনা নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্ককে সতেজ রাখতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে পরিবারের মানুষরা কে কিভাবে নিবে বিষয়গুলো সেটা দেখার দায়িত্বও স্বামীর।
৪। মায়ের মানসিক যত্নে কী কী করা হবে – নতুন বাবুটা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেশে সবার মনোযোগ চলে যায় বাবুর দিকে। অথচ তার প্রাথমিক দেখভালকারী যেই মা তারও যে যত্নের প্রয়োজন সেটা রয়ে যায় অবহেলিত। খাদ্য, ঘুমের মতো বিষয়গুলোতে যেমন মায়ের শারীরিক যত্ন প্রয়োজন তেমন নবজাতকের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ফলে সৃষ্ট মানসিক ক্লান্তি দূর করতে তার মনের যত্নেরও প্রয়োজন আছে। এই বিষয়টা যেমন নতুন মাকে বুঝতে হবে তেমনি বুঝতে হবে নতুন বাবাকেও।
নতুন মা হিসেবে নিজেকে সুপারমম মনে করে সব একাই সামলাতে যাবেন না। মাতৃত্ব একটি অত্যন্ত ডিমান্ডিং চাকরি। এখানে একটি নাজুক প্রাণের যত্ন নিতে হয় ২৪/৭। এবং এই দায়িত্ব আপনাকে পালন করতে হবে আজীবন। তাই নতুন বাবুকে বুঝতে ও নতুন দায়িত্বে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় দিন। কোন কিছুতে সাহায্যের প্রয়োজন হলে সেটা নিন, কোন ভুল হলে নিজেকে দোষারোপ করবেন না। সেটাকে শেখার সুযোগ মনে করুন। নিজেকে মিনিমাম যেটুকু পরিপাটি রাখা প্রয়োজন তা রাখুন। বেবি ব্লু, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে ধারণা রাখুন যেন সেগুলোর কোন লক্ষ্মণ দেখা দিলে আপনি বুঝতে পারেন নিজের ভেতর কোন সমস্যা হচ্ছে। যদি আপনার নতুন এই দায়িত্বে আপনি বিহ্বল বোধ করেন তাহলে অবশ্যই নিজের মনের অবস্থা আপনার স্বামী ও অভিজ্ঞ কোন মায়ের কাছে খুলে বলুন। যদি আপনার অকারণেই কান্না পায় এ সময় তাহলে জেনে রাখুন এটাও খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কান্না পেলে কাঁদবেন, এতে আপনি ভালো বোধ করবেন। লেখার শুরুতে আমার যে দৌলা ক্লায়েন্টের কথা বলেছিলাম, উনি কিন্তু একজন ডাক্তার। তারপরও উনি পোস্ট পার্টাম বিষয়ে আমাদের আরো সচেতনতা প্রয়োজন এটা উপলব্ধি করেছেন।
বাবুর বাবা এসময় মায়ের পাশে থাকতে চেষ্টা করবেন, তার মনের কথাগুলো শুনবেন, অসুবিধাগুলো বুঝতে চেষ্টা করবেন, তাকে বিষাদগ্রস্থ না হয়ে খুশি থাকতে সাহায্য করবেন। প্রসব পরবর্তী সময়টা একটি দম্পতির জন্য বেশ কঠিন সময় হতে পারে। এই সময়ে কী কী সমস্যা হতে পারে ও তা বাবা হিসেবে আপনি কিভাবে সামলাতে পারেন তা নিয়ে ধারণা রাখুন। মনে রাখবেন, এই সময়ে আপনার থেকে পাওয়া সহমর্মিতা বা কষ্টগুলো আপনার স্ত্রী সারাজীবন মনে রাখবেন।
জীবনের যে কোন বড় বিষয়ের মতো নতুন মা-বাবা হতে যাওয়াও একটি বড় বিষয়। রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স করা অনেক দম্পতিও প্রসব পরবর্তী এই সময়টাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে নেন না, যদিও এই নিয়ে মোট চারটি ক্লাস থাকে এই কোর্সে। তাই এই বিষয়ে পার্টিসিপ্যান্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এছাড়াও সাধারণভাবে আমাদের সকলের এই বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
রাবেয়া রওশীন,
প্রিনাটাল ইন্সট্রাক্টর ও ভার্চুয়াল দৌলা, রৌদ্রময়ী স্কুল
চাইল্ডবার্থ এডুকেটর,
এডভান্সড ভিব্যাক সার্টিফাইড দৌলা