পোস্ট পার্টাম রেস্ট : বাহুল্য না, প্রয়োজন
সাম্প্রতিক সময়ে একটি মডেলিং পেইজ থেকে সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে মা হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই কাজে ফেরার বিষয়ে পোস্ট দেয়া হয়। তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কমেন্টই আসে। অনেকেই এই পদক্ষেপকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন, অনেকে সমালোচনা করছেন। আমি একজন চাইল্ডবার্থ এডুকেটর হিসেবে আজকের লেখায় তুলে ধরতে চাই প্রসব পরবর্তী বিশ্রাম প্রসংগে মাতৃ স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের অভিমত কী।
সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সামাজিকভাবে প্রেগন্যান্সির সময় মায়ের পর্যাপ্ত রেস্টের প্রতি আশপাশের মানুষ যথেষ্ট সচেতন থাকেন। কিছু ব্যাক্তিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু প্রায় বিপরীত চিত্র দেখতে পাওয়া যায় পোস্টপার্টাম, অর্থ্যাত প্রসব পরবর্তী সময়ে। এই সময়ে মায়ের বিশ্রামের প্রতি সকলেরই যেন অনীহা দেখা যায়।
এর পেছনে একটা কারণ থাকে এই যে প্রেগন্যান্সিতে সকলের ফোকাস থাকে মায়ের সুস্থতার দিকে, কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর সকলের ফোকাস চলে যায় নতুন বাচ্চার দিকে। সেই সাথে, এমনটাও মনে করা হয় যে এখন নতুন মায়ের দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছি, নবজাতক বাচ্চার দেখাশোনা তাকে করতে হবে। পাশাপাশি ঘরের কাজগুলোও সামলাতে হবে। আবার সিজারিয়ান ডেলিভারি না হয়ে নরমাল ডেলিভারি হলে মা পরদিন থেকেই সব কাজ করতে পারবেন এই ধরণের ভুল ধারণারও প্রচলন আছে আমাদের মাঝে। আর তাই আমাদের আগের প্রজন্মের ওপর নরমাল ডেলিভারির পর পরই সংসারের কাজে ফিরে যেতে শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ সৃষ্টি করার ঘটনার কথাও আমাদের অজানা না।
এই তো গেল যুগ যুগ ধরে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা। এর সাথে এখনকার সময়ে এসে যোগ হয়েছে ”নারী সব পারি” স্লোগানের কুপ্রভাব। এখনকার মায়েদের থেকে নরমাল বা সিজার যেটাই হোক আশা করা হচ্ছে যে তারা ডেলিভারির কয়েকদিনের মাঝেই আবার আগের মতো সবদিকে মনোযোগী হয়ে উঠবেন। প্রেগন্যান্সির বা ডেলিভারির আগের জীবনের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করে দিবেন।
নি:সন্দেহে এটি পশ্চিমা ধারণা। কিন্তু, এটি পশ্চিমা পুঁজিবাদী কন্সেপ্ট। পশ্চিমে মাতৃ স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছে তারা কী বলে জানেন?
তারা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারা প্রসবের পর পূর্ণ ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত নতুন মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দেয়। প্রসবের পর ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের নিজের বিশ্রাম ও নতুন শিশুর সাথে বন্ধন তৈরিতে কাটিয়ে দেয়া উচিত। এমনকি সেই মায়ের সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রসব বা ন্যাচারাল বার্থ হয়ে থাকলেও। এই সময় ঘরের কাজ, বড় বাচ্চাদের দেখাশোনা ইত্যাদি কাজের জন্য আগে থেকে কোন পরিকল্পনা করে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
পশ্চিমে যারা মাতৃ স্বাস্থ্য নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করেন তারা তাদের সমাজে একজন নতুন মায়ের পোস্টপার্টাম যত্নের ক্ষেত্রে যে শূণ্যতা বিরাজমান সেটা স্বীকার করে। তাদের সমাজে যে একজন নতুন মায়ের কাছ থেকে প্রসবের অল্প কিছুদিন পর থেকেই সে আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে এমনটা আশা করা হয়, তারা সেটার বিরুদ্ধে জোর দিয়ে কথা বলে। এই শূণ্যতা পূরণে তারা পোস্টপার্টাম কেয়ার নেয়ার জন্য পেশাদার পোস্টপার্টাম দৌলা কোর্স পর্যন্ত করায়। তারা স্বীকার করে যে প্রাচ্যের অনেক সমাজে প্রসবোত্তর সময়ে নতুন মাকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত যেভাবে পরিবারের মানুষরা যত্ন করে, তাকে সাংসারিক কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের বিশ্রাম ও নতুন শিশুকে নিয়ে থাকতে দেয়, সেই কেয়ার মডেল থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
তাই, আমাদের উচিত যে কোন বিষয়ে যারা এক্সপার্ট তাদের থেকে জানতে সচেষ্ট হওয়া। মিডিয়াতে যা কিছুই প্রচারিত হয় সব কিছুই একটা সমাজের মূল চিত্র প্রকাশ করে না। দু:খজনক হলেও সত্য, পশ্চিমের মিডিয়ার প্রভাব আমাদের সমাজেও এসে পৌঁছেছে এবং আমাদের মায়েরাও সন্তান প্রসবের কয়েকদিনের মাঝে পুনরায় আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মাঝে কৃতিত্ব দেখছেন।
মনে রাখবেন, আপনার সন্তান নবজাতক থাকবে খুব অল্প কিছু দিন। আপনিও খুব বেশি দিন প্রসূতি থাকবেন না। এই সময়টা আপনার সন্তানের আপনাকে খুব বেশি প্রয়োজন। ঠিক তেমনি এই সময়টায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম আপনাকে আগামী দিনগুলোতে শারীরিক ফিটনেস ফিরে পেতে সহায়তা দিবে। আরও মনে রাখবেন, পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশনেরও একটি গুরুতর কারণ হতে পারে। এই প্রথম ছয় সপ্তাহ পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেয়ার ফলে প্রসব পরবর্তী সময়ে শারীরিকভাবে সেরে উঠতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে এমন মায়েদের উদাহরণও আছে আমাদেরই চারপাশে।
ভেবে দেখুন, মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তা হচ্ছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। আমাদের মহান স্রষ্টা প্রসবোত্তর সময়ে মায়েদের শারীরিক, মানসিক অবস্থার কথা জানেন বলেই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি থেকে পর্যন্ত এই সময় মায়েদের অব্যাহতি দিয়েছেন। তাহলে বলুন তো, সালাতের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে যার জন্য আমাদের একটি মানব শিশু জন্ম দেয়ার পর রাতারাতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে?
”নারী সব পারি” জাতীয় স্লোগানের প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে প্রসব পরবর্তী সময়ে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের সাথে অন্যায় করবেন না। পোস্টপার্টাম কেয়ার ও রেস্ট পাওয়া আপনার অধিকার। সময়মতো নিজের যত্ন না নিলে এর জের বহুদিন পর্যন্ত আপনাকেই বয়ে বেড়াতে হবে।
– রাবেয়া রওশীন
প্রিনাটাল ইন্সট্রাক্টর ও ভার্চুয়াল দৌলা
রৌদ্রময়ী স্কুল