আব্দুল্লাহ হওয়ার গল্প
১ম পর্ব
আমার খুব ইচ্ছা ছিল আল্লাহ আমাকে যখনই সন্তান দিবেন তখন যেন আমি সিলেটে বাবার বাড়ি থাকি। শ্বশুরবাড়ি যেহেতু গ্রামে তাই একটু ভয় লাগতো চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে।
অবশেষে আল্লাহর রহমতে সিলেট গেলাম। তখন শরীর দুর্বল, পায়ে ব্যথা, জ্বর, শেষে পিরিয়ড মিস হয়। ১ সপ্তাহ পরে যখন টেস্ট করি, আলহামদুলিল্লাহ রেজাল্ট পজিটিভ আসে।
আমি তো পজিটিভ দেখে খুশিতে আত্মহারা! সাথে সাথে হাজবেন্ডকে কল ও পরে মেসেজ দিয়ে রাখি। সে দেখে অনেক খুশি হয়। সেদিন ডাক্তার দেখাতে চাই কিন্ত যাকে দেখাতে চাই তিনি তখন সিলেটের বাইরে৷ পরে অনলাইনে দেখে অন্য একজনকে দেখাতে গেলাম।
আলট্রা করতে দিলো, বেবির তখনও হার্টবিট আসেনি।মেডিসিন দিলো, চলে আসলাম বাসায়। মাত্র ৯দিন পরে আমার ব্লাড যায়। ব্লাড দেখে ভয় পেয়ে যাই। ডাক্তারকে সব বললে তিনি বলেন একটা আল্ট্রা করিয়ে আনতে।
আমি হাজবেন্ডকে কল দিয়ে সব বলি, সে আমাকে সান্তনা দিতে থাকে। ম্যাম এসে টেস্ট করে বলেন, আপনার বেবির হার্টবিট আসছে। আলহামদুলিল্লাহ!!
পরে আমাকে ‘HPC Ds’ ইনজেকশন দেয়া হলো। যার ব্যথা মারাত্মক ছিল!! ব্লাড যাওয়া বন্ধ হলো। ঠিক ১মাস পর আমার পরিচিত ডাক্তারকে পেলাম এবং জানতে পারলাম তিনি নিয়মিত চেম্বারে বসবেন৷ এপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখলাম।
ঠিক ১মাস পরে আমার আবার ব্লাড যাওয়া শুরু হয়…
২য় পর্ব
১ মাস পরে আবার ব্লিডিং শুরু হলে নতুন ডাক্তারের কাছে যাই। যাওয়ার পরে প্রথম ট্রাইমেস্টারে যে কয়েকটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন সেগুলো করতে বলেন আর HPC ইনজেকশন চালিয়ে যেতে বলেন।
পরের রিপোর্ট সবগুলোই ভালো ছিল শুধু ডায়াবেটিস বর্ডার লাইনে ছিল। চিনি, কেক, মিষ্টি এসব এভয়েড করতে বললেন। তার ঠিক ৪ দিন পরে রাতের বেলা ব্লিডিং শুরু হয়। আমার তখন ১২ সপ্তাহ চলছিলো। সাথে সাথে আমার ডাক্তার বান্ধবীকে কল দিলাম, সে বললো দেরি না করে দ্রুত একটা আল্ট্রা করে ম্যামের ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে যেতে।
ছোট ভাইকে নিয়ে আগে গেলাম টেস্ট করতে। সনোলজিস্ট দেখে বললেন আমার বেবি এখনো ভালো আছে তবে আমার জরায়ুতে একটা ব্লাড ক্লট দেখা গেছে। ব্লাড যাওয়া অফ করতে হবে নাহলে বেবি নাও থাকতে পারে। গেলাম ডাক্তার ম্যামের ক্লিনিকে ভর্তি হতে।
সেখানকার ডাক্তার একজন এসে পিভি করলো। স্যালাইন দেয়া হলো এবং কোমড়ে দিলো HPC! ক্যানোলা দিয়ে আরও বিভিন্ন ইনজেকশন। ৪র্থ দিন আল্ট্রা করলাম। Subchorionic Hematoma ধরা পড়লো । এটা হচ্ছে, একটা ব্লাড ক্লট যেটা ভেঙে ভেঙে ব্লাড আসছিলো। ফুল বেড রেস্টে থাকতে বলা হলো।
বাসায় আসার ২/৩দিন পরেই আবার টেস্ট করতে হলো। ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়লো। এরপর টানা ১ মাস ব্লিডিং হলো। ১ মাস পরে অফ হলো কিন্ত আমাকে বলে দিয়েছিলো চেক করে দেখতে যে, ব্লাড ক্লট বড় হয় নাকি ছোট। টেস্ট করে দেখলাম অল্প কমছে, পরে আবার আল্ট্রা করেছিলাম, তখন বেড়েছিলো। একদম হাঁটাচলাও নিষেধ করেছিলো আমাকে।
২২ সপ্তাহে এনোমালি স্ক্যান করালাম যে বেবির সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানতে। আলহামদুলিল্লাহ!!
সব ভালো আসলো আর ব্লাড ক্লট “Maybe resolved” দেখালো।
ইনজেকশন তবুও চালিয়ে যেতে বললো ম্যাম। পরে আমার আবার সমস্যা দেখা দেয় তাই আল্ট্রা করি আর ইউরিন টেস্ট করে দেখাই ম্যামকে, ইনজেকশন অফ করা হয় তখন। ৩০ সপ্তাহের দিকে গেলাম Ultrasound, Urine, OGTT( Diabetis Test), Hemoglobin টেস্ট করাতে।
ধরা পড়লো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!
৩য় পর্ব
রিপোর্ট দেখালাম সেদিনই ডাক্তারকে, Subchorionic Hematoma আলহামদুলিল্লাহ একদম ভালো হয়ে গেছে।
কিন্ত গাইনী ডাক্তার ডায়াবেটিস ডাক্তারের কাছে রেফার করলেন। ইনসুলিন নিতে বললেন। ইনসুলিন না নিলে নাকি বেবির ক্ষতি হতে পারে কিন্তু কয়েকদিন ইনসুলিন নিয়ে আর হুট করে বেশি হাঁটাহাঁটি করে আমার মাথা ঘোরার সমস্যা শুরু হয়। ৩/৪ দিন ধরে আর কমেই না। পরে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করি, কিন্ত সেটা নরমাল ছিলো।
বান্ধবীর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে আসলাম যে আসলে ইনসুলিন নেয়ার কারনে আমার এমন হচ্ছে। তখন আমার ৩১ সপ্তাহ চলে। পরে বাদ দেই নেয়া।
আমার ৩৪ সপ্তাহ যখন চলে তখন হঠাৎ সকাল থেকেই আমার পানি ভাঙা শুরু হয়। সকাল থেকে দুইবার যায় অল্প করে পা গড়িয়ে গড়িয়ে, কোর্স থেকে শিখেছিলাম যে পানি গেলে তাকে চাইলেও আটকানো যাবেনা।
কোর্স করেছি দেখেই লেবার পেইন বুঝতে পেরেছি সব লক্ষন বুঝতে পেরেছিলাম, এখন বেবিকেও দেখে রাখতে পারছি, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি সবসময় আল্লাহর কাছে চাইতাম যেনো আমার নরমাল ডেলিভারি হয় আর বান্ধবীর হাসপাতালে যেন করাতে পারি কারন সেখানে পর্দাও রক্ষা করতে পারবো আর খরচ অনেক কম, সাথে বান্ধবী থাকবে সবসময়।
আল্লাহ অবশেষে আমার দোয়া কবুল করেছেন আলহামদুলিল্লাহ!!
৪র্থ পর্ব
রাত ১০টার পরে আবার অনেকখানি পানি গেলো আর তখন আম্মাকে জানালাম যে আমার এই সমস্যা হচ্ছে। রাতে আরও ৪/৫ বার পানি গেলো।
২৩ তারিখ সকালে Ultra করলাম। সনোলজিস্ট আমার পানি যাওয়ার বিবরণ শুনে আগে পানি দেখলেন, দেখে বললেন এখনো ১০ সেমি পানি আছে। বেবি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। মাত্র ২ সপ্তাহ আগেই টেস্ট করেছিলাম তখন ১৪.৬ সেমি ছিল পানি। তিনিও পরামর্শ দিলেন দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থা নিতে না হলে বেবির সমস্যা হতে পারে।
বান্ধবীর হাসপাতালে ডাক্তার দেখাই, আর ভর্তি হয়ে যাই, পানি যেতেই থাকে। স্যালাইন দেয়, বাবুর ফুসফুস ম্যাচিউর হওয়ার জন্য ইনজেকশন দেয়। একদম নড়াচড়া যাবেনা দেখে ক্যাথেটার করে দেয়। একটু নড়াচড়া করলেই গড়গড় করে পানি যেতে থাকে।
হাসপাতালের বিছানায় এক পাশে শুয়ে থেকে থেকে দুই পা কোমড়সহ প্রচন্ড ব্যথা করতো। ২৫ তারিখ রাত ৯/১০টার পর থেকে পেটে ব্যাথা। প্রস্রাবের চাপ আসে প্রচুর কিন্ত আমার ক্যাথেটার করা।
বাথরুমের চাপ আসে আর মনে হয় বাথরুম হয়ে যাচ্ছে। সারারাত এভাবে ব্যাথায় গেছে আমার। একজন ডিউটি ডাক্তার এসে চেক করে বলে যে বেবি ভালো আছে কি না! সারারাতের পেইন সহ্য করেছি, কতবার বলেছি যে সিজার করে ফেলতে। সেই রাতে আর পানি যায়নি, যায় স্রাবের সাথে লাল লাল রক্ত। যা দেখে বুঝেছি যে আমার মিউকাস প্লাগ যাচ্ছে এবং লেবার পেইন উঠছে।
নিজেই উঠে বাথরুমে গেলাম, আবার উঠে চলে আসব তখন চাপ আসে আবার বসি, কিন্ত বাথরুম হয়না। পরে বেডের কোণায় ধরে কয়েকবার হালকা নুইয়ে চেষ্টা করেছি, কয়েক মিনিট হেঁটেছি আবার শুয়েছি।
সকাল ৯টার পরে আসে একজন ডাক্তার। তখন তাকে সবকিছু বললে সে সাথে সাথে পিভি চেক করে, চেক করে বলে যে ৬ সেমি ডায়ালেটেড! আলহামদুলিল্লাহ। সকাল ৯:৩০টা, তখন আমাকে নিয়ে যায় অবজারভেশন রুমে। আমার পেইন উঠেছে অনেক। আমি বার বার ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছিলাম তবে ব্যায়াম করতে পারছিলাম না অক্সিজেন লাগানো ছিলো বলে।
শেষ পর্ব
বান্ধবী আসার পরে সাহস পাই। আমার বার বার প্রস্রাবের চাপ আসছিলো। কিন্ত হচ্ছিলো না দেখে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তবুও বার বার আল্লাহকে ডাকছিলাম যে আমি যেন সহ্য করতে পারি।
এরই মাঝে ডাক্তার এসে পিভি চেক করে বলে ৮ সেমি। ফুল ডায়ালেট হলে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যেতে বলেন।
আমি ১/২মিনিট পরে পরেই এভাবে চিৎকার করি আর বান্ধবীকে ডাক দিই। সে পিভি করে বলে যে বাবুর মাথা এখনও নিচে আসে নাই। আবার পিভি করে আর দেখে যে বেবির মাথা নিচে, চুল দেখা যাচ্ছে।
বান্ধবী তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তারকে বলে, নার্স এসে আমাকে নিয়ে যায় আর বলে হেঁটে যেতে। পরে বেডে উঠায় আর তখনি আমার পুশ করার খুব ইচ্ছা হয়। এক ধাক্কা দেই আর ঠিক ১১টা ৩০ মিনিটে বাবু সাথে সাথে বের হয়ে আসে আলহামদুলিল্লাহ। আর আমার ব্যথা সব দূর হয়ে যায়।
বাবু কান্না করতে থাকে আর আমাকে দেখায় সাথে সাথেই। পরে বেবিকে পরিস্কার করে আমার বুকে একবার দেয়। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু এতো সুন্দরভাবে হয়েছে।
আসলে আল্লাহ আমাকে এতো রহমত দিয়েছেন যা বলে শেষ করা যাবেনা। ৩৪ সপ্তাহ ২দিনের দিন বেবি চলে আসলো দুনিয়ায়। যখন পানি যাচ্ছিল তখন একটাই সিদ্ধান্ত ছিলো যদি পানি যেতে যেতে বেবির কোনো সমস্যা হতে পারে এমন বোঝা যায় তাহলে সাথে সাথে সিজার করে ফেলতে হবে আর বেবিকে NICU-তে রাখা লাগবে।
আল্লাহ আমাদের অনেক সুন্দরভাবে পার করে এনেছেন আলহামদুলিল্লাহ। বেবির ওজন ২.৫ কেজি এবং NICU লাগেনি। কয়েকটি পরীক্ষা করিয়ে বেবিকে আমার কাছে এনে দেয় আর আমি তাকে ব্রেস্টফিড করাতে পারি আলহামদুলিল্লাহ। সেদিন আমাদের কেবিনে দিয়ে দেয় বিকেলেই এবং পরের দিন ছুটি দেয়।
সবার উচিত একজন মা হবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করা, সবকিছু জানা। আর সেটা একমাত্র প্রিনাটাল কোর্সের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।