স্বল্পতম সময়ে আমার নরমাল ডেলিভারির গল্প
বিয়ের পর পরই আমি আর আমার হাসবেন্ড চেয়েছিলাম আমাদের সন্তান আসুক। কিন্তু কেন যেন ব্যাপারটা হচ্ছিল না। আমার পড়াশোনা এবং তার চাকরীর কারনে দুইজন দুই শহরে থাকতাম।অপেক্ষা করছিলাম সংসার শুরু করার। আল্লাহর কাছ সুসন্তানের জন্য সবসময় দোআ করতাম।
করোনায় সব বন্ধ হয়ে গেলে লকডাউনের মধ্যে আমি চট্টগ্রাম থেকে ওর কর্মস্থল সিলেটে চলে গিয়েছিলাম।রমজান মাস ছিল। প্রতি রোজার সেহরী ও ইফতারে দোআ করলাম।ঈদুল ফিতরের ২ দিন পর আমার শশুড় আব্বা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন।পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।ঠিক পরের মাসে আমার পিরিয়ড মিস হল। করোনাকালীন সময়ে তখন আমরা আইসোলেশনে ছিলাম।
ডেট মিস হওয়ার ১৪ দিন পর টেস্ট কিটের ব্যাবস্থা করা হয়।ততদিন হালকা বমি ভাব, চোখের নিচে কালি এইসব লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। আল্লাহর নাম নিয়ে ফজরের পর টেস্ট করলাম। আলহামদুলিল্লাহ জ্বলজ্বলে দুটো দাগ। আমার হাসবেন্ডকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালাম। সে এক অন্যরকম সুখের অনুভূতি। আমাদের দুজনের মধ্যে আরেকজন জায়গা করে নিচ্ছে।
সুখবরটা শোকাহত পরিবারে যেন একটা শান্তনার পরশ বুলিয়ে দিল। সবাই আলহামদুলিল্লাহ অনেক খুশি হয়েছিল। ভীষণ সুখের অনুভূতির সাথে সাথে শুরু হয় প্রেগ্ন্যাসি চ্যালেন্জ।প্রথমে বমি বমি ভাব ছিল। পরের সপ্তাহে এমন অবস্থা হয় যে আমি বমি করতে করতে ফ্লোরে শুয়ে পরতাম। আর উঠার শক্তিও হত না।কিছু খেতে পারতাম না সব গন্ধ লাগতো। পানি খেলে পানিও বমি করতাম।
এই সময় প্রথম ডাক্তার চেকআপে গেলাম। রুটিন টেস্ট করে দেখা গেল সব কিছুই আলহামদুলিল্লাহ নরমাল।আল্ট্রাতে একটু ছোট্ট বিন্দুর মত বাবু দেখা গেল। ৭ সপ্তাহের ফিটাস তখনও হার্টবিট আসে নাই। ডাক্তার বমি আর গ্যাসের ওষুধ দিয়েছিল। বমির ওষুধে কোন কাজ হত না। সব কিছুতেই গন্ধ লাগতো। প্রথম তিনমাস আমি মধু,খেজুর,শুকনা রুটি,সাদা ভাত,ডিম,দুধ আর ডাবের পানির বাইরে কিছু খেতে পারতাম না। খেয়েও বমি হয়ে যেত। অসম্ভব রকম গলা, বুক জ্বলত।
আমার একজন আত্মীয় আছেন যিনি এফসিপিএস করা ডাক্তার হয়েও এখন হোমিওপ্যাথি নিয়ে গবেষণা করছেন। তার দেওয়া কিছু হোমিও ওষুধ খেয়ে আমার অতিরিক্ত গ্যাসের সমস্যাটা কমেছিল। ২.৫ মাস চলাকালীন আমার হাসবেন্ডর কাছ থেকে ঢাকায় শশুর বাড়িতে চলে আসতে হয়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হয়। যদিও ট্রেন জার্নি সবচেয়ে নিরাপদ তবে আমি প্লেনে এসেছিলাম। ৬-৭ ঘন্টা ট্রেনে থাকা, এতবার বমি করে দূর্বল শরীরে কস্ট হয়ে যেত। এসময় সবদিক থেকে আমি পরিবারে যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি।আমাকে কোন ভারী কাজ করতে হয়নি। ঢাকায় এসে সবার মাঝে থেকে আমার সমস্যা কিছুটা কমেছিল।
১২ সপ্তাহে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম, এবার আল্ট্রাসনোর সময় ডাক্তার হার্টবিট শুনালো। আমি বাবুকে দেখতে চাইলাম। ডাক্তার স্কীন ঘুরিয়ে দেখালো বাবু নড়াচড়া করছে। আমি অবাক এত ছোট বাবু নড়তেও পারে! আবেগে আমার চোখে সেদিন পানি চলে এসেছিল। এ অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যাবে না।বাবুর বাবা পাশে ছিল না ওকে খুব মিস করছিলাম।
৫ মাসের সময় আমার মাস্টার্স ডিফেন্সের ডেট দিলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বাবার বাড়িতে চলে আসি।এবারও প্লেনে এসেছিলাম। বাসায় বসে অনলাইনে ডিফেন্স দিয়েছি। করোনার কারনে আমি এই সুবিধাটা পেয়েছিলাম। ভার্সিটিতে যেয়ে ফাইনাল থিসিস কপি জমা দিয়ে আসি।
আমার বমির সমস্যা ৫ মাস পর্যন্ত ছিল। ৬-৭ মাস সময়টা আমার ভালো কাটে। আমি সব রকম পুস্টিকর খাবার খাওয়ার চেস্টা করেছি। ফল, শাকসবজী,মাছ,মাংস কিন্তু ভাত খেতে কস্ট হত। প্রথম ৩ মাস কোন ওজন বাড়েনি। এরপর থেকে ওজনও বাড়ছিল। চট্টগ্রামে এসে আমার এক বোনের পরামর্শে একজন ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। পরে আমার হাসবেন্ড এসে আমাকে অন্য একজন সিনিয়র ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপে যেতাম।
২১-২২ সপ্তাহে এনোম্যালি স্ক্যানে দেখা গেল বাবুর সব ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ। প্রতিবার আল্ট্রাসনো করানোর সময় আমি খুব খুশী হতাম আমার বাবুটা কেমন আছে জানত পারবো, ওকে একটু দেখতে পারবো। ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে এনোম্যালি স্ক্যান করেছিল আর বলছিল বাবুটা খুব দুষ্ট। জিজ্ঞেস করার পর যখন ডাক্তার বলে নাই ধরে নিলাম মেয়ে বাবু হবে।আমার প্রথম সন্তান মেয়ে। মেয়ের বাবা অসম্ভব খুশী হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথম নরমাল ডেলিভারি নিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ফেসবুকে একজন সৌদি মায়ের ন্যাচারাল বার্থ স্টোরি পরে। ওখানে প্রথম আমানি বার্থের কথা জেনেছিলাম। ডেলিভারি সম্পর্কে তখনও আমার কোন কিছুই জানা ছিল না। আমি কিছুটা চিন্তিত ছিলাম কিভাবে কী হবে। দুইটা ওয়েবসাইটের লেখা নিয়মিত পড়তাম – ফেইরিল্যান্ড পারেন্টস বিডি আর মাতৃত্ব ব্লগ। মাতৃত্ব ব্লগে বার্থ স্টোরি গুলো পড়তে ভালো লাগতো। একদিন ফেসবুকে দেখলাম রৌদ্রময়ী গ্রুপে প্রিনেটাল কোর্স হবে। মনে হল এমন কিছুই চাচ্ছিলাম। হাজবেন্ডের সাথে পরামর্শ করে এনরোল করলাম।
প্রথম কথাটায় ভালো লেগে গেল – যে জানে আর যে জানে না এরা কখনও সমান হতে পারে না। আমি তো তখন বিভিন্ন উপায়ে জানারই চেস্টা করছিলাম। এখান থেকে সুন্দর করে ধারাবাহিক ভাবে প্রেগন্যান্সি,ডেলিভারি, লেবার সম্পর্কে ডিটেইস জানলাম। প্রেগন্যান্সি ব্যায়ামগুলো করতে শুরু করলাম। আমি আগেও ইয়োগা করেছি তাই রিলাকজেশন ব্রিদিং সম্পর্কে জানতাম। এভাবে যে লেবার পেইন ম্যানেজ করা যায় সেটা জানা ছিল না।
বেশ ভালো লেগেছে কোর্সের সময়টা। সব চেয়ে বড় যে ব্যাপারটা আমার নরমাল ডেলিভারি নিয়ে একটা ভয় কাজ করছিল তা দূর হয়েছিল। প্রেগন্যান্সিতে নিজের যত্ন থেকে শুরু করে জন্মের পরে শিশুর যত্নসহ সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম। প্রতিবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় মনে নানা রকম প্রশ্ন উঁকি দিত।কখনও জিজ্ঞেস করতাম কখনও করা হত না। এই কোর্সটা করার পর আমি ডাক্তারকে করার মত কোন প্রশ্ন আর খুঁজে পাইনি। মনে হল সব বিষয় আমার জানা।
৩০ সপ্তাহের সময় আমার বাবা করোনায় আক্রান্ত হলেন। ১ মাস তাকে বাসার মধ্যে আইসোলোশনে রাখা হল। পরিবারে অন্য সদস্যদের কোন উপসর্গ ছিলনা।একমাস পর আমাদের সবার মধ্য কিছু না কিছু উপসর্গ দেখা গেল। আমার নরমাল ফ্লুয়ের মত হয়েছিল। তখন টেস্ট করানো এত সহজ ছিল না। টেস্টের জন্য লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত তাই করালাম না।ডাক্তারের সাথে সবসময় কথা হচ্ছিল। তার পরামর্শে ওষুধ খেয়েছিলাম। শরীরে লাগলে সরাসরি হসপিটালে ভর্তি হয়ে যাব ভেবেছিলাম। এই সময় পরিবারে সবাই অসুস্থ ছিল। আমার খাওয়ার প্রতি বিশেষ মনযোগ ছিল না,রুচি কমে গিয়েছিল। গত মাসের তুলনায় আমার ওজন বাড়ে নাই। সুস্থ হয়ে গাইনি ডাক্তারের কাছে গেলাম। রুটিন টেস্টে দেখা গেল ইউরিন ইনফেকশন আর বাবুর ওজনও বয়স অনুযায়ী কম।
৩৩ সপ্তাহে বাবুর ওজন ছিল ১৬০০ গ্রাম। সেদিন ডাক্তারের ব্যবহার আমার ভালো লাগেনি এবং প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছিল Intra uterine growth retardation। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলাম। কত কি ভেবে ফেললাম কম ওজনের বাচ্চা কী সমস্যা হবে ওজন কী আর বাড়বে, আবার যদি এনআইসিইউ লাগে! রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেল। আম্মু আর শাশুড়ী মা শান্তনা দিয়ে বলেছিল ছোট বাবুই ভালো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, নরমালে হতে সুবিধা হয়। বাবুর বাবা বলেছিল বাবু ওজন কম কোন সমস্যাই না তোমার আর বাবু সুস্থতাই আসল।ইউরিন ইনফেকশনের জন্য ১ সপ্তাহে এন্টিবায়োটিক খেয়ে আবার টেস্ট করেছিলাম।
ওজনের ব্যাপারটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। একদিন শরীর খারাপ লাগায় বাসায় ব্লাড প্রেসার মেপে দেখলাম ১৩০/৯০। ডাক্তারকে ফোন দিলে বললেন ঘুৃমের ওষুধ খেয়ে দেখতে। প্রেশার কমল না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই ডাক্তারের কাছে আর যাবো না। ৩৪ সপ্তাহে এসে আমার সেই আগের ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমার হাসবেন্ড বলল তুমি যাকে ভালো মনে কর তার কাছেই যাও। পুরো প্রেগন্যান্সিতে বিভিন্ন জায়গায় থাকার কারনে ৪ জন ডাক্তারকে দেখিয়েছি। এই ডাক্তারকে আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছিল। উনার কাছে আবার গেলাম
আমার ব্লাড প্রেশার তখনও ১৩০/৯০ছিল। ডাক্তার জানালেন ১৩০/৯০ এর বেশি হলেই ওষুধ খেতে হবে।উনি হাত দিয়ে পেট ধরে দেখলেন। ডপলার দিয়ে হার্টবিট শুনে বললেন বাবু সুস্থ আছে। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে দেখাতে এবং বাবুর নড়াচড়া গুনে রাখতে বললেন। পরের চেকআপে দেখা গেল প্রেশার ১৪০/৯০, প্রেশারের ওষুধ খাওয়া শুরু করলাম।
৩৭ সপ্তাহের সময় ডাক্তার পিভি চেক করে বললেন বাচ্চা নিচে নেমেছে ১ সপ্তাহের মধ্যে পেইন উঠতে পারে। নাহলে উনি ইনডিউস করার চেস্টা করবে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যেহেতু ব্লাড প্রেশার কিছুটা বেড়েছে নরমাল ডেলিভারি হবে কিনা। ডাক্তার বললো উনি চেস্টা করবেন। শেষ একটা আল্ট্রাসনো করতে বললেন। এবার রিপোর্ট এল বাবুর ওজন ২.৫ কেজি। প্রেগ্ন্যাসির শেষ পর্যন্ত আমার ওজন বেড়েছিল ১১ কেজি। আমি মোটামুটি স্বস্তি পেলাম। ঘুরে ফিরে আম্মুর সাথে শপিং করে বাসায় গেলাম। কালকে আমার জন্য কি সারপ্রাইজ আল্লাহ রেখেছেন তা তো জানা ছিল না।
পরদিন দুপুরের পর দেখি মিউকাস প্লাগ যাচ্ছে সাথে কিছুটা ব্লাড। আমি ভেতর থেকে ফিল করলাম আমার লেবার শুরু হচ্ছে। ডাক্তারকে ফোন দিলাম অপেক্ষা করতে বললো। পিভি চেকের কারনে এমন হতেই পারে।পানি ভাঙা বা পেইন কিছুই ছিল না। আমি শান্ত মনে প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আমার কাপড়,বাবুর কাঁথা, কাপড়,ডায়পার ওয়াইপস,আন্ডার গার্মেন্টস,জমজমের পানি খেজুর বাদাম এইসব। বাসার সবার সাথে আলোচনা করলাম। বড়দের অনেকে বললো না এত তাড়াতাড়ি কি হয়। ইডিডি সামনের মাসের ৩ তারিখ আর আজকে মাত্র ৯ তারিখ আরও ২০-২৫ দিনের মত বাকী। আমি ভালোমত খাওয়া দাওয়া করে ঘুমালাম।
ঘুম উঠার পর দেখি পানি ভাঙছে। একটা প্যাড পরে নিলাম কোন পেইন নাই। কিছু সময় পর পর পানি ভাঙছে। ডাক্তারকে ফোন দিলাম উনি বললেন পেইন উঠলে হসপিটালে এডমিট হতে। সন্ধ্যায় প্রথম পেইন ফিল করলাম। ১০-১৫ মিনিট পর পর পেইন আসছিল।বাসায় খুব ভালো ভাবে পেইন ম্যানেজমেন্ট করতে পেরেছিলাম। হাঁটাহাটি করছিলাম,হিপ রোটেশন আর স্কোয়াট করছিলাম। আম্মু বললেন ভাত খেয়ে হসপিটালে চল। সেই ভাত বেড়ে রেখে আমি আর খেতে পারলাম না।
রাত ৮টার সময় হসপিটালে রওনা দিলাম। বাবুর বাবা তখন সিলেট ছিলেন। আমার হসপিটালে যাওয়ার কথা শুনে উনিও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা করলেন। বাসা থেকে হসপিটালের ৩০ মিনিটের দূরত্বকে সেদিন অনেক বেশী মনে হয়েছিল। সরাসরি হসপিটালের লেবার রুমে গেলাম। ডিউটি ডাক্তার চেক করে বললো ৩ সেমি ডায়ালেট হয়েছে। প্রেশার মেপে দেখা গেল ১৪০/৯০। আমার ডাক্তারকে কল দেওয়া হল। উনি প্রেশারের মেডিসিন দিলেন। আর এসে দেখে বললেন যে নরমালের জন্য পেইন সহ্য করতো হবে। বাবু হওয়ার আরও অনেক সময় বাকী আছে। সকালের দিকে হবে। পেইন যদি সহ্য করতে না পারি তাহলে নরমাল হবে না। আমার খুব কস্ট হচ্ছিল কিন্তু কিছু বলার অবস্থায় ছিলাম না। বলতে পারলে অবশ্যই বলতাম সিজার করান।বাবুর মুভমেন্ট পাচ্ছি কিনা জানতে চাইলে আমি মাথা নেড়ে না করি। আমি আসলে পেইন আসার পর থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করি নাই। এর মধ্যে আম্মু এসে আমাকে খেজুর, জমজমের পানি খাইয়ে দোআ করে দিয়ে গেল। এরপর আমাকে ক্যানুলা করে স্যালাইন দেওয়া হল। মুখে অক্সিজেন মাক্স পরিয়ে দিয়ে বাম কাত হয়ে শুয়ে থাকতে বলল।
তখন শুরু হল আমার আসল পরীক্ষা। আর কোনভাবে পেইন ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। অক্সিজেন মাস্কের জন্য রিলাকজেশন ব্রিদিং করতে পারছিলাম না। সুবিধা মত পজিশনে গেলে পেইনটা ম্যানেজ হত কিন্তু নার্স আয়ারা কেউ আমাকে উঠতে দিচ্ছিল না।একসময় বিছানার পাশে আমি স্কোয়াট পজিশনে বসে গেলাম ডিউটি ডাক্তার সহ সবাই দৌড়ায় এসে আমাকে শুইয়ে দিল। আয়ারা বললো এরকম করবেন না আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের চাকরী চলে যাবে। আমি শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম। আল্লাহ সহজ করে দাও। তুমি সহজ করে দিলে কোন কিছুই আর কঠিন হয় না। সহ্য করতে পারছিলাম না, ব্যাথায় চিৎকার করছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ পাশে বসে হাত ধরে থাকলে ভালো লাগতো।
একজন আয়া একটু পরপর এসে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ডিউটি ডাক্তার পিভি চেক করলো তখন ৬ সেমি ডায়ালেট হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি প্রগ্রেস হচ্ছে বলে মনে হল। একসময় আর কোন বিরতি ছাড়াই ঝাঁকে ঝাঁকে প্রচন্ড ব্যাথা আসতে থাকল। মনে হল আমি ঘেমে যাচ্ছি। নিজের ভেতর থেকে পুশ করার ইচ্ছা হচ্ছিল। আশেপাশের কেউ মানা করলো বলে মনে হল। তারপরে সব স্মৃতিগুলো কেমন আবছা আবছা। মনে হল একজন আমাকে হাত ধরে অন্য একটা রুমে লেবারের চেয়ারে বসালো। ডাক্তার এপিসিওটমি দিল বললো পুশ করেন। লেবার চেয়ারে আমি মলত্যাগ করে দিয়েছিলাম। ক্লীন করে দেওয়া হল। এরপর আমি আল্লাহর নামে পুশ করলাম।তারপর আমার সব কস্ট শেষ। খুব আরাম আরাম একটা অনুভুতির সাথে অনেক শান্তি পাচ্ছিলাম।
মনেপ্রাণে অনুভব করলাম নিশ্চয়ই কস্টের পরে স্বস্তি আছে। অবশ্যই আমার সৃষ্টিকর্তা কোন ভুল ওয়াদা করেন নাই। রাত ১০.৫৫ মিনিটে আমার প্রথম কন্যা সন্তান এই দুনিয়ায় আসে। আল্লাহ হায়াতে তৈইয়েবা এবং নেক আমলের তাওফিক দান করুক। আবছা চোখে দেখলাম একটা রক্ত মাংসের ছোট পুতুল ভ্যা করে কাঁদছে। ওজন শুনলাম ২৩০০ গ্রাম। ডাক্তার বললেন বাচ্চা ঠিক আছে এনআইসিইউ লাগবেনা। বাবুকে ওরা নিয়ে গেল, লেবার রুমের বাইরে আমার বাবা মা বসে আছেন। বাবুর বাবা তখন সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে। আমার সাথে সাথে স্কিন টু স্কীন কন্টাক্ট করানো হয় নি। বুকটা ফাঁকা লাগলো। ডাক্তার স্টীচ দেওয়ার সময় ব্যাথা লাগছিল,বলার পর ইনজেকশন দিয়ে দিল। আমাকে লেবার রুমে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে রাত তিনটার দিকে কেবিনে পাঠানো হল। এর মধ্যে বাবুকে ২/৩ বার দুধ চোষানো হয়েছে।
কোর্সের মাধ্যমে এটাচমেন্ট এর ব্যাপারটা আর দুধ আসতে দেরী হবে জানতাম। তাছাড়া ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বাবুর খাওয়ার দরকার হয় না। বাবু ঘুমিয়ে পরলো।আমি রবের শুকরিয়া আদায় করে একটু শান্তিতে ঘুমালাম।
তবে ডেলিভারির আমি এন্টিবায়োটিক কোর্স ঠিকমতই করেছি। বাসায় আসার পর আমার আর কোন পেইনকিলার লাগে নাই। বাসায় আসার পর থেকে হাঁটাচলা, বাবুর যত্ন করতে পেরেছিলাম। আমার ব্রেস্ট ফিডিং জার্নি খুব ভালো ছিল আলহামদুলিল্লাহ। আমি প্রথম ৩ দিন দুধ না আসায় একটুও টেনশন করি নাই। বেশী করে পেঁপে বা লাউয়ের ঝোল দিয়ে মুরগীর তরকারী,ডিম,মাছের ঝোল, দুধ সাগু খেয়েছিল। ৩ পর থেকে বাবু পর্যাপ্ত দুধ পায় এবং ওর ওজন খুব দ্রুত বেড়ে স্বাভাবিক রেন্জে চলে আসে আলহামদুলিল্লাহ। স্টীচের জন্য বসে খাওয়াতে কস্ট হত একটা ফিডিং পিলো খুব কাজে দিয়েছিল। আমি যাদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি দোআ করি আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিক।
নরমাল ডেলিভারির জন্য কেউ পরামর্শ চাইলে বলবো প্রথম থেকে আমার মনোভাব খুবই পজেটিভ ছিল। আমার লক্ষ্য ছিল নরমালের কিন্তু সিচুয়েশন অনুযায়ী সি সেকশনের কথাও ভেবে রেখেছিলাম। আমি আল্লাহর কাছে নরমাল ডেলিভারির জন্য দোআ করেছি। এরপর দোআর সাথে সাথে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেস্টাও করেছি। জেনে বুঝে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। রৌদ্রময়ী কোর্স-এ ভালোভাবে সবকিছু বুঝানো হয়েছিল যেটা আমার জন্য সুবিধাজনক ছিল।এখান থেকে ওখান থেকে পড়ে আমি সহজে অনেক কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এছাড়া বার্থ স্টোরিগুলো আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি নিয়মিত পুস্টিকর খাবার খাওয়ার চেস্টা করেছি।ক্যালসিয়াম ও মাল্টি ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেয়েছি।আয়রন লেভেল ও সবসময় ভালো ছিল। ৫ মাসের পর থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে ৩০ মিনিট হেঁটেছি। স্কোয়াট, কেগেল এক্সারসাইজ, রিলাকজেশন ব্রিদিং প্র্যাকটিস করেছি। একটিভ জীবন যাপন করেছি, শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে নামাজ পরতে পেরেছিলাম। দোআ করেছি আল্লাহ যাতে সুন্দর ভাবে ব্যাবস্থা করে দেন। দোআ কখনও বিফলে যায় না। আল্লাহ যেমন পরিকল্পনা করে রেখেছেন সেটাই আপনার জন্য উত্তম। আল্লাহর কাছে চাইলে সবসময় উত্তমটাই চাওয়া উচিত।
এটাই আমার গল্প। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। আপনাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য আমার এই অভিজ্ঞতা লিখেছি। যদি কারও উপকারে আসে অবশ্যই আমার পরিবারের জন্য দোআ করবেন। আল্লাহ যাতে আমাদের নেককার কৃতজ্ঞ বান্দাদের মধ্যে সামিল করে নেন। আল্লাহ আমার সব বোনদের ডেলিভারি সহজ করুন এবং নেকসন্তান দান করুন।আমিন।
উম্মে ফারহিন,
প্রিনাটাল কোর্স, ১ম ব্যাচ