একটি ভালোবাসার গল্প
১ম পর্ব
গত বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কোনো এক সকালে প্রেগন্যান্সি কীটের মাধ্যমে আমার ভেতরে এক নতুন সত্তার অস্তিত্ব টের পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা একমাত্র আমার রবের, যিনি আমাকে দয়া করেছেন, আমাকে দিয়েছেন মাতৃত্বের পরম অনুভূতি।
প্রেগন্যান্সি কনফার্ম হওয়ার পরপরই আমি আর আমার হাজবেন্ড সিদ্ধান্ত নিলাম সব ঠিক থাকলে এবং আল্লাহ চাইলে অবশ্যই নরমাল ডেলিভারি করাবো। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশন যে হারে বেড়েছে এবং বেশিরভাগ ডাক্তারদের নরমাল ডেলিভারিতে নিরুৎসাহ দেখে মোটামুটি দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে আমার বাসা শহরের এক কোনায় হওয়ায় সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও কিছুটা দুর্বল। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে একজন ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি কিছু ওষুধ লিখে দিলেন এবং সাথে CBC, ultrasound টেস্ট দিলেন। ওনাকে জানালাম যে আমরা নরমাল ডেলিভারিতে আগ্রহী। উনি জানালেন যেহেতু আমার বয়স খুব বেশি না (২৭) এবং আমি লম্বা, সেহেতু নরমাল ডেলিভারি হতে পারে। ওনার কথায় তেমন একটা আশ্বাস পেলাম না আমরা।
এদিকে প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই প্রচন্ড বমি, ক্লান্তি এবং মুড সুইং নিয়ে কোনোরকম দিন কাটাচ্ছি। আমার হাজবেন্ড আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো মনের মানুষ। আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু অনভিজ্ঞ হওয়ায় উনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না আমাকে কিভাবে হেল্প করবেন। বাসায় আমরা মাত্র দুজন। নিজে রান্না করলে সেই রান্না মুখে দিতে পারিনা, ঘ্রাণেই বমি আসে। অন্য কারো রান্না বা রেস্টুরেন্টের খাবার যদিওবা কিছুটা গিলতে পারি, সাথে সাথেই বমি করে সব বের করে দেই। বাধ্য হয়ে বাবার বাসায় এলাম। তিন মাস পার হলে বমির সমস্যা কিছুটা কমলো। আলহামদুলিল্লাহ, সেবারের রোজায় আমি ৩০টা রোজা করতে পেরেছি। সে সময়ে কমপ্লিকেশন বলতে ঘুম কম হতো এবং কনস্টিপিশন। চেষ্টা করতাম রাতে পর্যাপ্ত পানি খেতে। ইফতারে ভাজাপোড়া না খেয়ে সেদ্ধ ছোলা, সেদ্ধ ডিম, টক দই আর সালাদ দিয়ে মাখিয়ে খেতাম। ডিম, দুধ, কলা, সবজি, ডাল এগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রেখেছিলাম। মাংসও খেতাম, তবে মাছ খেতে পারতাম না একদমই। আপেল, আম, ডালিম, পেয়ারা, ডাব এগুলোও খেতাম।
এদিকে আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। আমার হাজবেন্ড তার দুই বন্ধুর কাছ থেকে ঢাকায় একজন ডাক্তারের খোঁজ পেলেন যিনি নরমাল ডেলিভারি করান। ঈদের পর ভাবলাম ওনাকে দেখিয়ে আসি। ওনাকে দেখালাম। উনি আগের রিপোর্ট গুলো দেখলেন এবং নতুন করে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং এনোমালি স্ক্যান করাতে বললেন। রিপোর্ট সব ভালো আসলো আলহামদুলিল্লাহ। ম্যাডাম বললেন সব ঠিক আছে, রেগুলার হাটাহাটি এবং ঘরের টুকিটাকি কাজ চালিয়ে যেতে। আল্লাহ চাইলে নরমাল ডেলিভারি হবে।
৬ মাসের সময়ে আবার চট্টগ্রাম চলে গেলাম নিজের বাসায়। আবারও সেই একা লাইফ। একা থাকি, মুড সুইং হয়, খেতেও ইচ্ছা করেনা৷ হাজবেন্ড অফিস থেকে আসলে মুড ভালো হয়। বাইরে ঘুরতে যাই, রেস্টুরেন্টে খাই। এভাবেই চলছিলো। হঠাৎ একদিন রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্সের ব্যাপারে জানতে পারি৷ হাজবেন্ডকে বলি, উনি প্রথমে আগ্রহী না হলেও আমার পীড়াপীড়িতে রাজী হন। শুরু হয় আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট টাইম। প্রেগন্যান্সি রিলেটেড সকল কিছু এই কোর্সে জানতে পারি৷ প্রেগন্যান্ট হলে মেয়েদের বডি, মাইন্ড কি ধরনের চেঞ্জ আসে, নিউট্রিশন মেইনটেইন এর গুরুত্ব, লেবার প্রসেস, এর প্রতিটা ধাপ, সিজারিয়ান কখন দরকার সকল কিছু জানতে পারি।
ইন্সট্রাকটর আপুদের শিখিয়ে দেয়া কিছু ব্যায়াম, ভারী কাজ বাদে ঘরের সব কাজ, সিড়ি বেয়ে ওঠা নামা, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাটাহাটি এগুলো কন্টিনিউ করে যেতে লাগলাম। ক্লাস টাইমে হাজবেন্ড অফিসে থাকায় একসাথে ক্লাস করা হতো না। তবে আমি সব নোট করতাম। পরে উনি আসলে সবকিছু উনাকে বুঝিয়ে বলতাম। আমার হাজবেন্ডও অনেক কিছু শিখে গেলেন আলহামদুলিল্লাহ। পুরো জার্নিতে আমি তার কাছ থেকে ভীষণ সাপোর্ট পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
এদিকে একা একা থাকায় নিউট্রিশন এর পার্টটা ভালোভাবে মেইনটেইন করতে পারছিলাম না। তাই কুরবানির ঈদের পরপরই আবার ঢাকায় চলে আসি। ৩১ সপ্তাহে আবার ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার কিছু রেগুলার টেস্ট দেন। CBC টেস্টে জানতে পারলাম আমার হিমোগ্লোবিন অনেক কমে গেছে। যেখানে অন্তত ১১.৫ থাকার কথা, সেখানে আমার আছে মাত্র ৭। ডাক্তার বললেন ইমার্জেন্সি ২ ব্যাগ রক্ত নিতে। সাপ্লিমেন্টও বাড়িয়ে দিলেন কিছু। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না অবস্থা এতো খারাপ। তখন মনে পড়লো প্রিন্যাটাল ক্লাসে আপু বলেছিলেন হিমোগ্লোবিন কমে গেলে সাধারণত তা সহজে বুঝা যায় না। কারণ, হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যে ধরনের সিম্পটম দেখা যায় যেমন মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা এগুলো সাধারণ প্রেগন্যান্সিরও লক্ষণ। তাই অনেক সময় এই দুই ধরনের সিম্পটম আলাদা করা যায় না। রক্ত নেয়া লাগবে শুনে ফ্যামিলির সবাই তো অবাক। তারা সবাই ধরেই নিলো ডাক্তার বাড়াবাড়ি করছে, রক্ত নেয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। কিন্তু আমি যেহেতু প্রিন্যাটাল ক্লাস করেছি, আমি কিন্তু জানি আমার অবশ্যই ব্লাড নিতে হবে। নাহলে সাপ্লিমেন্ট,ইঞ্জেকশন বা খাবারের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন লেবেল নরমালে নিয়ে যাওয়া পসিবল না। তাই দেরি না করে দুদিনের মধ্যে দু ব্যাগ ব্লাড নিয়ে নিলাম…….
২য় পর্ব
গত বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কোনো এক সকালে প্রেগন্যান্সি কীটের মাধ্যমে আমার ভেতরে এক নতুন সত্তার অস্তিত্ব টের পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা একমাত্র আমার রবের, যিনি আমাকে দয়া করেছেন, আমাকে দিয়েছেন মাতৃত্বের পরম অনুভূতি।
প্রেগন্যান্সি কনফার্ম হওয়ার পরপরই আমি আর আমার হাজবেন্ড সিদ্ধান্ত নিলাম সব ঠিক থাকলে এবং আল্লাহ চাইলে অবশ্যই নরমাল ডেলিভারি করাবো। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশন যে হারে বেড়েছে এবং বেশিরভাগ ডাক্তারদের নরমাল ডেলিভারিতে নিরুৎসাহ দেখে মোটামুটি দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে আমার বাসা শহরের এক কোনায় হওয়ায় সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও কিছুটা দুর্বল। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে একজন ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি কিছু ওষুধ লিখে দিলেন এবং সাথে CBC, ultrasound টেস্ট দিলেন। ওনাকে জানালাম যে আমরা নরমাল ডেলিভারিতে আগ্রহী। উনি জানালেন যেহেতু আমার বয়স খুব বেশি না (২৭) এবং আমি লম্বা, সেহেতু নরমাল ডেলিভারি হতে পারে। ওনার কথায় তেমন একটা আশ্বাস পেলাম না আমরা।
এদিকে প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই প্রচন্ড বমি, ক্লান্তি এবং মুড সুইং নিয়ে কোনোরকম দিন কাটাচ্ছি। আমার হাজবেন্ড আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো মনের মানুষ। আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু অনভিজ্ঞ হওয়ায় উনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না আমাকে কিভাবে হেল্প করবেন। বাসায় আমরা মাত্র দুজন। নিজে রান্না করলে সেই রান্না মুখে দিতে পারিনা, ঘ্রাণেই বমি আসে। অন্য কারো রান্না বা রেস্টুরেন্টের খাবার যদিওবা কিছুটা গিলতে পারি, সাথে সাথেই বমি করে সব বের করে দেই। বাধ্য হয়ে বাবার বাসায় এলাম। তিন মাস পার হলে বমির সমস্যা কিছুটা কমলো। আলহামদুলিল্লাহ, সেবারের রোজায় আমি ৩০টা রোজা করতে পেরেছি। সে সময়ে কমপ্লিকেশন বলতে ঘুম কম হতো এবং কনস্টিপিশন। চেষ্টা করতাম রাতে পর্যাপ্ত পানি খেতে। ইফতারে ভাজাপোড়া না খেয়ে সেদ্ধ ছোলা, সেদ্ধ ডিম, টক দই আর সালাদ দিয়ে মাখিয়ে খেতাম। ডিম, দুধ, কলা, সবজি, ডাল এগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রেখেছিলাম। মাংসও খেতাম, তবে মাছ খেতে পারতাম না একদমই। আপেল, আম, ডালিম, পেয়ারা, ডাব এগুলোও খেতাম।
এদিকে আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। আমার হাজবেন্ড তার দুই বন্ধুর কাছ থেকে ঢাকায় একজন ডাক্তারের খোঁজ পেলেন যিনি নরমাল ডেলিভারি করান। ঈদের পর ভাবলাম ওনাকে দেখিয়ে আসি। ওনাকে দেখালাম। উনি আগের রিপোর্ট গুলো দেখলেন এবং নতুন করে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং এনোমালি স্ক্যান করাতে বললেন। রিপোর্ট সব ভালো আসলো আলহামদুলিল্লাহ। ম্যাডাম বললেন সব ঠিক আছে, রেগুলার হাটাহাটি এবং ঘরের টুকিটাকি কাজ চালিয়ে যেতে। আল্লাহ চাইলে নরমাল ডেলিভারি হবে।
৬ মাসের সময়ে আবার চট্টগ্রাম চলে গেলাম নিজের বাসায়। আবারও সেই একা লাইফ। একা থাকি, মুড সুইং হয়, খেতেও ইচ্ছা করেনা৷ হাজবেন্ড অফিস থেকে আসলে মুড ভালো হয়। বাইরে ঘুরতে যাই, রেস্টুরেন্টে খাই। এভাবেই চলছিলো। হঠাৎ একদিন রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্সের ব্যাপারে জানতে পারি৷ হাজবেন্ডকে বলি, উনি প্রথমে আগ্রহী না হলেও আমার পীড়াপীড়িতে রাজী হন। শুরু হয় আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট টাইম। প্রেগন্যান্সি রিলেটেড সকল কিছু এই কোর্সে জানতে পারি৷ প্রেগন্যান্ট হলে মেয়েদের বডি, মাইন্ড কি ধরনের চেঞ্জ আসে, নিউট্রিশন মেইনটেইন এর গুরুত্ব, লেবার প্রসেস, এর প্রতিটা ধাপ, সিজারিয়ান কখন দরকার সকল কিছু জানতে পারি।
ইন্সট্রাকটর আপুদের শিখিয়ে দেয়া কিছু ব্যায়াম, ভারী কাজ বাদে ঘরের সব কাজ, সিড়ি বেয়ে ওঠা নামা, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাটাহাটি এগুলো কন্টিনিউ করে যেতে লাগলাম। ক্লাস টাইমে হাজবেন্ড অফিসে থাকায় একসাথে ক্লাস করা হতো না। তবে আমি সব নোট করতাম। পরে উনি আসলে সবকিছু উনাকে বুঝিয়ে বলতাম। আমার হাজবেন্ডও অনেক কিছু শিখে গেলেন আলহামদুলিল্লাহ। পুরো জার্নিতে আমি তার কাছ থেকে ভীষণ সাপোর্ট পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
এদিকে একা একা থাকায় নিউট্রিশন এর পার্টটা ভালোভাবে মেইনটেইন করতে পারছিলাম না। তাই কুরবানির ঈদের পরপরই আবার ঢাকায় চলে আসি। ৩১ সপ্তাহে আবার ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার কিছু রেগুলার টেস্ট দেন। CBC টেস্টে জানতে পারলাম আমার হিমোগ্লোবিন অনেক কমে গেছে। যেখানে অন্তত ১১.৫ থাকার কথা, সেখানে আমার আছে মাত্র ৭। ডাক্তার বললেন ইমার্জেন্সি ২ ব্যাগ রক্ত নিতে। সাপ্লিমেন্টও বাড়িয়ে দিলেন কিছু। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না অবস্থা এতো খারাপ। তখন মনে পড়লো প্রিন্যাটাল ক্লাসে আপু বলেছিলেন হিমোগ্লোবিন কমে গেলে সাধারণত তা সহজে বুঝা যায় না। কারণ, হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যে ধরনের সিম্পটম দেখা যায় যেমন মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা এগুলো সাধারণ প্রেগন্যান্সিরও লক্ষণ। তাই অনেক সময় এই দুই ধরনের সিম্পটম আলাদা করা যায় না। রক্ত নেয়া লাগবে শুনে ফ্যামিলির সবাই তো অবাক। তারা সবাই ধরেই নিলো ডাক্তার বাড়াবাড়ি করছে, রক্ত নেয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। কিন্তু আমি যেহেতু প্রিন্যাটাল ক্লাস করেছি, আমি কিন্তু জানি আমার অবশ্যই ব্লাড নিতে হবে। নাহলে সাপ্লিমেন্ট,ইঞ্জেকশন বা খাবারের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন লেবেল নরমালে নিয়ে যাওয়া পসিবল না। তাই দেরি না করে দুদিনের মধ্যে দু ব্যাগ ব্লাড নিয়ে নিলাম…..
শেষ পব
লেবার রুমে একটা বেডে আমাকে শুয়ে পড়তে বললেন নার্স৷ জুনিয়র ডাক্তার এসে পিভি চেক করে বললেন এখনো ৩ সে.মি. ই আছে। পুরো রাত লেগে যেতে পারে বাচ্চা হতে। এদিকে আমার কন্ট্রাকশন বেড়েই চলেছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে এবং প্রতিবারের কন্ট্রাকশন আগের বারের তুলনায় বেশি। তবু তখনও সহ্য করতে পারছিলাম। বিকাল ৫.৩০ এ লেবার রুমে ঢুকেছিলাম, রাত ৯ টা বেজে গেল। আমাকে স্যালাইন দেয়া হলো।ব্যথা বাড়তে বাড়তে তীব্র হতে লাগলো। প্রতিবারের কন্ট্রাকশনে আমি মনে হয় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলাম। ওই ব্যথাটা আসলে বলে বুঝানো যাবে না। অথচ তখনও সার্ভিক্স ৩ সে.মি. আছে।
এরপর আমার ডাক্তার আসলেন উনি পিভি চেক করে বললেন তোমার তো পানি ভেঙে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে, এখনো সার্ভিক্স খুলছে না। তুমি কি এপিডুরাল নিতে চাও? আমি না করলাম। এভাবেই ট্রাই করবো ইনশাআল্লাহ৷ প্রচন্ড ব্যথায় আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। যেসব দুয়া মুখস্থ করেছিলাম এই সময়ে পড়ার জন্য, তার কিছুই মনে পড়ছে না। আয়াতুল কুরসীও ভুলে যাচ্ছি৷ তখন শুধু আল্লাহ আল্লাহ করে ডাকছিলাম আর গগনবিদারী চিৎকার দিচ্ছিলাম একটু পরপর ।
ওদিকে লেবার রুমের বাইরে আম্মু আমার চিৎকার শুনে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আমার হাজবেন্ডকে বলছে কেন যে তোমরা জোর করে নরমাল ডেলিভারি করাচ্ছো! মেয়েটা কতোক্ষন ধরে এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। ডাক্তারকে বলে দাও সিজার করাতে। আমার আব্বু তখনও এসে পৌঁছাননি । উনিও আম্মুকে ফোন করে বারবার সিজার করিয়ে ফেলতে বলছেন। শাশুড়ীও ফোনে আমার হাজবেন্ডকে ধমকাচ্ছেন কেন পানি ভাঙার পরেও এতোক্ষণ ওয়েট করছি। আমার হাজবেন্ড তখন প্রচন্ড দ্বিধার মধ্যে আছেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না৷
এদিকে ব্যথায় আমার প্রান যায় যায়। আমি ছোটবেলা থেকেই ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ি। পিরিয়ডের ব্যথাটাও সহ্য হতো না। খুব কান্নাকাটি করতাম ব্যথায়। আর লেবার পেইন যে কি পেইন, যার হয়েছে কেবল সেই জানে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। পানিও মুখে নিতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে স্ট্র দিয়ে পানিতে ঠোঁট ভেজালাম একটু৷ ডাক্তার আবারও সার্ভিক্স চেক করে দেখলেন মাত্র ৪ সে.মি.। এবার আমি মনোবল হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো এতো ব্যথা সহ্য করছি অথচ সার্ভিক্স এখনো মাত্র ৪ সে.মি.। পুরোপুরি ডায়লেটেড হতে হতে তো ব্যথায় মরেই যাবো৷ ওনাদের বললাম আমার হাজবেন্ডকে ডাকতে, আমি কথা বলতে চাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি আসলেন। ওনাকে দেখেই আমি কেঁদে ফেললাম। ওনার হাত দুটো ধরে বললাম আমাকে তুমি মাফ করে দিও, আমি আর পারছি না। এপিডুরাল এর পারমিশন দিয়ে দাও৷ উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন আমি জানি তুমি পারবে, আরেকটু ধৈর্য্য ধরো। আমি তবু ব্যথায় চিৎকার করছিলাম আর বলছিলাম প্লিজ তুমি কিছু একটা করো। আমার কান্নাকাটি দেখে উনি ডাক্তারকে বললেন এপিডুরাল এর জন্য রাজী আছেন। ডাক্তার উনাকে বন্ড পেপার দিলেন সই করার জন্য। উনি তখনও আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ ডাক্তার কি মনে করে আবার পিভি চেক করলেন। এবারে দেখলেন সার্ভিক্স ৮ সে.মি খুলে গেছে৷ শুনে তো আমি অবাক৷ ১০ মিনিট আগেও তো মনে হয়নি এতো দ্রুত এতোটা ডায়ালেটেড হবে৷ তখন সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম৷ এপিডুরাল নিবো না৷ হাজবেন্ড আমাকে আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন।
এরপর শুরু হলো আসল যুদ্ধ। তীব্র ব্যথার মাঝে ডাক্তার আমাকে বলতে লাগলেন পুশ করতে। আমি শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার বেড তখন মাথার দিকটায় উঁচু করে আমাকে আধশোয়া অবস্থায় রাখা হয়েছে। এদিকে আমি বেশিক্ষণ দম নিয়ে জোর দিতে পারছিলাম না। ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। ডাক্তার এবার তাকিয়ে বললেন আপনার বাবুর চুল দেখা যাচ্ছে, আপনি আর একটু চেষ্টা করেন। আমি তখন আরও জোরে প্রেশার দিতে লাগলাম। হঠাৎ ডাক্তার চেঁচিয়ে বললেন সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকতে। বাচ্চার মাথা একদম জরায়ুমুখের সামনে চলে এসেছে। আমাকে তখন তাড়াতাড়ি করে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে অন্য একটা চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসিয়ে দেয়া হলো। ডাক্তার এলেন। এরপরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কি কি ঘটলো আমার কিছুই মনে নেই৷ আমি হঠাৎ ভীষণ গরম তরল আমার ভ্যাজাইনা এরিয়ায় অনুভব করলাম। সাথে সাথেই একটা বেশ গরম তুলতুলে মুখ আমার মুখের সাথে লাগিয়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন এই যে তোমার মেয়ে। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে মেয়ের গালে চুমু দিলাম, ওকে এক পলক দেখলাম। ক্লান্তিতে চোখ ভারী হয়ে আসছিলো। কিন্তু সকল ব্যথা ভুলে গেলাম৷
এরপর সম্ভবত প্লাসেন্টা বেরিয়ে আসলো। আলহামদুলিল্লাহ এপিসিওটোমি ছাড়াই নরমাল ডেলিভারি হলো। ১০ অক্টোবর, ২০২১ রাত ১০.৩২ মিনিটে আমার কন্যা দুনিয়ায় এলো।
আমার মেয়েকে পরিষ্কার করে বাইরে নিয়ে গিয়ে বাবার কোলে দিলো। উনি মেয়ের কানে আজান দিলেন, ইকামত দিলেন। এরপর আমার কাছে এনে আমার কোলে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমার চোখে পানি চলে এলো। মেয়ে একদম বাবার চেহারা পেয়েছে৷ সকল প্রসেস শেষে আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে মেয়েকে কোলে দিয়ে বাইরে নিয়ে আসা হলো। আমার হাজবেন্ড তখন দৌঁড়ে ছুটে এলো আমার কাছে। আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে”। আলহামদুলিল্লাহ, এই মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। আমার চোখে পানি চলে এলো। আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তখন সুখের কান্না কাঁদছি….।
এভাবেই আল্লাহর রহমতে, রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল কোর্সের ইন্সট্রাক্টর আপু এবং আমার ডাক্তার নার্সদের আন্তরিক সহযোগিতায় প্রেগন্যান্সির এই জার্নিটা ভালোভাবে শেষ হয়। মেয়ের নাম রেখেছি মারইয়াম। আমার মারইয়ামের জন্য দুয়া করবেন সবাই।
– উম্ম মারইয়াম,
প্রিনাটাল কোর্স, ৪র্থ ব্যাচ
Bottom of Form