Back
১.
প্রস্রাব করে উঠে দাঁড়াতেই আমার দু পা বেয়ে কলের ধারার মতো হাল্কা গরম পানি নেমে যেতে লাগলো। একটু আগে মিউকাস প্লাগও বেরিয়ে আসতে দেখেছি। সন্দেহের আর অবকাশ রইল না যে পানি ভেঙে গিয়েছে। স্বচ্ছ, সাদা পানি, কোনো স্মেল নেই। পরিমাণে এতোটাই ছিল যে টয়লেট থেকে বিছানা অব্দিও আসতে পারছিলাম না। প্রতি কদমে ঝরঝর করে পানি পরছিল। উপায় না পেয়ে পড়নের পেটিকোট খুলে সেটাকে ভাজ করে দু’পায়ের মাঝে চেপে ধরে কোনোরকমে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
 
আমার প্রেগন্যান্সির তখন ৩৯ সপ্তাহ চলে। রাত সাড়ে দশটার মতন হবে। আম্মু ঘুম, পাশেই আমি শুলাম। কাউকে কিচ্ছু বললাম না। কারণ তখনও আমার কোনো ব্যাথ্যা ছিল না। ভয় ছিল, যদি কেউ জানতে পারে যে পানি ভেঙে গিয়েছে, ডিরেক্ট হাসপাতালে নিয়ে সিজার করিয়ে দিবে।
 
প্রেগন্যান্সির প্রথম থেকেই আমি নরমাল ডেলিভারি চাচ্ছিলাম। কতো যে দোয়া করেছি। প্রথম থেকেই এক্টিভ ছিলাম আর শেষের দিকে নিয়মিত ব্যায়ামও করেছি। ডেইলি নিয়ম করে টানা ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা হেঁটেছি। ইউটিউব দেখে দেখে নরমাল ডেলিভারির জন্য অন্যান্য ব্যায়ামও করতাম সকাল সন্ধ্যা। তখনো পর্যন্ত আমার রিসোর্স বলতে ‘আমানি বার্থ’ বই আর নিজের করা অনলাইন রিসার্চ। প্রিনাটাল কোর্সে ভর্তি হলেও সবে ক্লাস হয়েছে মাত্র দু’টো। এখনো আফসোস হয়, ইসস যদি আরো আগেই আমি এই কোর্সের সন্ধান পেতাম তাহলে হয়তো আমার জন্য লেবারটা আরেকটু সহজ হতো! যাই হোক আল্লাহই উত্তম পরিকল্পনাকারী।
 
গুগল করে জেনে নিলাম পানি ভাঙার পর কতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। বাচ্চা ঠিক থাকলে মোটামোটি ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারবো জেনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তখনও ব্যাথা শুরু হওয়ার কোনো বালাই নেই। চিন্তা হচ্ছিল, সাথে দোয়াও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম যাতে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। কারণ কিছু পরেই আমার প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হবে।
 
কিন্তু ঘুম কী আর হয়! এপাশ ওপাশ করেই গেল শেষ রাত অব্দি। রাত সাড়ে তিনটার দিকে হাল্কা হাল্কা কন্ট্রাকশন ফিল করতে লাগলাম। আমি তো যরপনাই মহা খুশি, অবশেষে লেবার শুরু হলো। ফজরে আম্মু উঠলো, তখন আম্মুকে বললাম যে আমার লেবার শুরু হয়ে গিয়েছে। আম্মু তৎক্ষনাৎ আমার শ্বাশুড়িকে ফোন করলেন। শ্বশুর বাড়ি কাছেই হওয়াতে সকাল ৭ টার আগেই আমার হাসবেন্ড আর শ্বাশুড়ি মা এসে উপস্থিত।
 
লেবার শুরু হওয়ার পর আমি হাসি খুশিই ছিলাম, কিন্তু ভেতরে ছিল চাপা দুশ্চিন্তা। হাটাহাটি আর হিপ রোটেশন করছিলাম রুমের মধ্যেই। এরমধ্যেই আমার এক বড়মা আসলেন, যিনি হোম বার্থে এক্সপেরিয়েন্সড ছিলেন। মজার কথা হলো আমার হাসবেন্ড যে দাই-এর হাতে জন্ম নিয়েছিলেন তাকেও নিয়ে আসা হলো। উনি সরকারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই। আমার পিভি চেক করলেন। বললেন এক সেমি পর্যন্ত খুলেছে এবং ওনার পরিচিত নিকটস্থ একটা বার্থ সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
 
আমি আগে থেকেই ওই বার্থ সেন্টার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছিলাম। ইতোমধ্যে দু’বার গিয়ে ওখানকার মিডওয়াইফ-দের দিয়ে চেক আপও করিয়েছিলাম। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে নিজের জড়তা কাটানোর চেষ্টা করেছি। কারণ প্রসব হচ্ছে নারীজীবনের সবচেয়ে ইন্টিমেট একটা ইভেন্ট। এসময় অপরিচিত কারো সামনে হুট করে উন্মুক্ত হওয়ার থেকে তাদের সাথে আগেই পরিচিত হওয়াকে আমি আমার জন্য বেশি স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করেছি।
 
২.
দুপুর ১ টা। এর মধ্যে আমি ভারি খাবারসহ শক্তি যোগায় এমন খাবার কয়েকবার খেয়েছি। লেটেন্ট ফেইযে পেট ভরে খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কারণ আমি জানতাম এক্টিভ ফেইযে আমি কিছুই খাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে থাকবো না, কিন্তু আমার তখন শক্তির প্রয়োজন হবে। তখন পর্যন্তও কেউ জানতো না যে আমার পানি ভেঙে গিয়েছে। আসলে পুশিং স্টেজের আগে কেউ বুঝতেই পারেনি। আমি বার বার বাচ্চার মুভমেন্ট খেয়াল করছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ বাবু খুবই এক্টিভ ছিল।
 
বার্থ সেন্টার আমার বাসায় থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। গাড়িও রেডি ছিল, তারপরও বাসার সবার চাপাচাপিতে দুপুরের মধ্যেই সেখানে গেলাম। সাথে আম্মু, শ্বাশুড়ি মা, সেই বড় মা আর হাসবেন্ড। বাসা কাছেই হওয়ায় আব্বু আর ভাই আপ-ডাউন করছিল।
 
ওখানে বিশাল একটা রুমে দুটো বেড, একটা ডেলিভারির টেবিল আর একপাশে বাথরুম। এটাকে লেবার রুম আর কেবিন দুটোই বলা যায়। পাশে আরেকটা রুম হচ্ছে অফিস আর বাকি রুমগুলোতে ওখানের দুই মিডওয়াইফ ওনাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করে। লেবার টেবিলের মাথার কাছের জানালাটা খুললেই জমিদার বাড়ির বিশাল ঈদগাহ মাঠ আর সেন্টারের গেইট দিয়ে ঢুকতেই জবা, রঙ্গন, লিলিসহ হরেক রকমের ফুল গাছ দিয়ে ভর্তি। এত্তো গুছানো, ছিমছাম, ঘরোয়া আর সাধারণ একটা পরিবেশ! সুবহানাল্লাহ। সবচেয়ে ভালো ছিল পর্দার পরিবেশ। পুরুষ কেউ এদিকে আসতে পারতো না, আসলেও বড়জোর অফিস রুম পর্যন্ত।
 
লেবার রুমে গিয়ে দেখি ওখানে অলরেডি আরেকজন মা আছে, যারও লেবার শুরু হয়েছে মধ্যরাত থেকে। ওর নাকি সার্ভিক্স একটুও খুলেনি, তাই মিডওয়াইফ আপুরা ওকে হাসপাতালে চলে যেতে বলেছে। তখনও আমি ইফেস আর ডায়ালেশন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। জানলে হয়তো ওকে আমি আরেকটু সাহস দিতে পারতাম।
লেবার রুম ভর্তি মানুষ। আমার সাথে তিন জন, ওই মেয়ের সাথে দুই জন, একজন আয়া, দুইজন মিডওয়াইফ। পরিবেশ একটু হযবরল ছিল যখন মহিলাগুলো নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করা শুরু করেছিল। এরইমধ্যে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যখন শুনলাম মিডওয়াইফ আপু হাতে গ্লাভস পড়ে আমার পিভি চেক করবে। এতক্ষণ পর্যন্ত হাসিখুশি থাকলেও এবার আমার আত্মা উড়ে গেল। আমি গ্লাভস ছাড়া করতে বললেও আপু রাজি হলেন না, এতে নাকি ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতক্ষণে আমি ন্যাগিং শুরু করলাম। কোনো যুক্তি মানতে চাচ্ছিলাম না, জাস্ট চাচ্ছিলাম যে এটা আমার সাথে না হোক। আম্মু বুঝাচ্ছিল যে এটা না করলে লেবারের অগ্রগতি বুঝা যাবে না। কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না। রীতিমতো জোর করেই আমাকে পিভি করানো হয়। ইসস, কিভাবে যে সেদিন ডেলিভারি টেবিলে ছটফট করেছিলাম।
 
তখন অব্দি নাকি মাত্র দেড় সেমি খুলেছিল, যেখানে সকালেই ছিল এক সেমি। আমি ভেবেছিলাম আরেকটু বেশি হবে। এখন ভাবি হয়তো ডায়ালেশন রিভার্স হয়ে গিয়েছিল, কারণ আমি পিভি চেক নিয়ে প্রচুর স্ট্রেস নিয়েছিলাম আর কান্নাকাটিও করেছিলাম। তখন তো আর ডায়ালেশন রিভার্স হয়ে যাওয়ার বিষয়টা জানতাম না, তাই নিজেকে শান্ত রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনি। আসলে ঠিক এই কারণেই মায়েদের প্রিনাটাল, পোস্টনাটাল আর ডেলিভারি সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করা খুবই প্রয়োজন। নাহলে নিজের অজান্তেই নেয়া ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অনেক বেশি সাফার করতে হয়।
 
দু’ঘন্টা পর আবার পিভি চেক করা হলো লেবার প্রোগ্রেস বুঝতে। বললো লেবার যেভাবে আগাচ্ছে তাতে রাতের আগে ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মাঝে মাঝে পেটে ফানেলের মতো কি যেন একটায় কান লাগিয়ে বেবির হার্টবিট শুনছিলেন। বেবি ভালো ছিল আর আমি তো মুভমেন্ট খেয়াল করছিলামই। তখনও আমার প্রচুর ব্যথা ছিল। আমি আর লেবারে থাকা ওই মেয়েটা রুমের মধ্যে হাটাহাটি করছিলাম। আমি মাঝে মাঝে আকুপাংচার, হিপ রোটেশন, আর স্কোয়াট করছিলাম। ওকেও শিখিয়ে দিচ্ছিলাম কিভাবে এসব করতে হয়। বার বার টয়লেটে যাচ্ছিলাম। কমোডে না বসে ফ্লোরেই বসে কাজ সেরেছিলাম সাবধানতার জন্য। খেজুর আর পানি খেয়েছি সুবিধামতো।
 
পিভি চেক করা বাদ দিয়ে পুরো সময়টা আমি খুবই নিরব আর শান্ত ছিলাম। কন্ট্রাকশন শুরু হচ্ছে বুঝতে পারলেই দাঁতে দাঁত চেপে ধরতাম। যার কারণে ডেলিভারির পর আমার দাঁত আর মাড়িতে কিছুটা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। আমি টেনশনে ছিলাম, আম্মু অলরেডি ভেঙে পড়েছে, এরমধ্যে যদি আমি কোনো দুর্বলতা দেখাই তাহলে তারা আমাকে সিজারের জন্য জোর করতে পারে। নিজের আওয়াজ-কে এভাবে দমিয়ে রাখা আসলে উচিত হয়নি। পরবর্তীতে চাইল্ডবার্থ এডুকেটর ও দৌলা হিসেবে ট্রেনিং নিতে গিয়ে জানতে পেরেছি ‘লেবারের সময় মা দোয়াসহকারে নিচু স্বরের আওয়াজ দ্বারা নিজেকে আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নিজের শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে’।
 
আসরের পর আমার সাথে লেবারে থাকা ওই মেয়েটার মল মিশ্রিত কিছুটা রক্তপাত দেখা দেয়। যা লেবারের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু ওখানে থাকা আমাদের মধ্যে কেউই তা না জানার কারণে আমরা সবাই ঘাবড়ে যাই। মিডওয়াইফ আপুকে ডাকা হলে উনি স্পষ্ট জানিয়ে দেয় “আপনাদের তো দুপুরের আগেই বলে দিয়েছি চলে যেতে, ওর জরায়ু একটুও খুলেনি, নরমালে হবে না।” এসব শুনে তড়িঘড়ি করে ওরা ব্যাগ গুছাতে থাকে হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য। মেয়েটার জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। ও খুব করে চাচ্ছিল কাঁটা ছেঁড়ার মধ্য দিয়ে না যেতে। তাছাড়া এই মুহূর্তে ওই রুমে থাকা একমাত্র ওই ছিল যে আমার কষ্ট বুঝতে পারছে। কারণ আমরা তখন একই পথের পথিক।
 
ইন্সট্রাক্টর রাবেয়া আপুর লেবারের ক্লাসটা আমি আমার ডেলিভারির পর করেছিলাম। ক্লাসে যখন জানতে পারলাম ওই ব্লিডিংটা লেবার প্রোগ্রেসের একটা সাইন ছিল, কি যে আফসোস লেগেছিল! আগে জানলে অবশ্যই আমি মিডওয়াইফ আপুকে বলতাম ওর আবার পিভি চেক করতে আর ইফেসমেন্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। মায়েরা যারাই আমার এই লেখাটা পড়ছেন, আপনাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো, কখনোই ডেলিভারি সংক্রান্ত জ্ঞানার্জনকে হেলা করবেন না, কখন কোন ইনফরমেশন আপনার পুরো কনসিকুয়েন্সকে পরিবর্তন করে ফেলবে বুঝতেই পারবেন না। নিজের সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন।
 
ওরা চলে যাওয়ার পর আমি একাই হাটাহাটি চালিয়ে যেতে লাগলাম। মাগরিবের পর প্রচুর ব্যথা শুরু হয়। অসহ্য যাকে বলে। আমি আশায় ছিলাম হয়তো এখন আমার এ যাত্রা শেষ হচ্ছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়লো যখন পিভি চেক করে বলা হলো সকালের আগে কিছু হচ্ছে না, আমার সার্ভিক্স এখনো ফুল ডাইলেট হয়নি।
 
৩.
রাতে ছোটমাছ দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। কন্ট্রাকশনের ফাঁকে ফাঁকে আম্মু খাইয়ে দিচ্ছিল। ডাব, খেজুর, কলা, পানিও খেয়েছিলাম। এতো ব্যাথার মাঝেও আমি খাচ্ছিলাম এই ভেবে যে পুশিং স্টেজে আমার শক্তির প্রয়োজন হবে।
 
সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে লম্বা রাত ছিল সেই অক্টোবরের ২৮ তারিখের রাত। কন্ট্রাকশন শুরু হলেই শ্বাশুড়ি মা আর বড় মা আমার কোমর ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলেন। বিশ্বাস করেন এটা জাদুর মতো কাজে দিচ্ছিল। রুমের অল্প আলোতে ডেলিভারি টেবিলে শুয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে শুনতেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম পুরো রাতটা। সাথে দরূদ, ইসতিগফার আর অন্য একটা দোয়া।
 
ফজরের পর মিডওয়াইফ আপুরা আসলেন। পিভি চেক করে জানালেন ফুল ডাইলেট হয়েছে। কিন্তু আমার তখন ব্যথার তীব্রতা কিছুটা কমে গিয়েছিল। ওনারা দুজনেই খুব অভিজ্ঞ। একজন ১৬ বছর, আরেকজন ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মিডওয়াইফ। আমার পেটের মধ্যে আলতো করে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিভাবে যেন ম্যাসাজ করছিলেন, সাথে সাথেই চির চির করে কন্ট্রাকশন শুরু হতো। ব্যথা আরেকটু বাড়াতে আইভি লাইনে পিটোসিন ইনজেক্ট করা হলো। তাতে কন্ট্রাকশনের তীব্রতা তো বাড়লোই, সাথে পেটে প্রচুর গ্যাস হয়ে বুকটা ভারি হয়ে আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিল যেন ঠিক বুকের মাঝখানে কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল।
 
আমার মাথার কাছে তখন আমার শ্বাশুড়ি মা আর বড় মা। আম্মুকে দেখলাম রুমের এক কোণায় মোনাজাতে হাত উঠিয়ে কান্নাকাটি করছে। আম্মুকে এভাবে দেখে আমি আর কোনো শব্দ করলাম না। কন্ট্রাকশন হচ্ছিল ঘন ঘন। আমি চিত হয়ে শুয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আছি। দুই হাত দিয়ে পায়ের গোছা শক্ত করে ধরে রেখেছি। আপরাইট কোনো পজিশন ওনারা এলাও করছিল না আর আমি শক্তিও পাচ্ছিলাম না সারা রাতের ধকল সহ্য করার পর। মাঝে মাঝে পানি খাচ্ছি। ব্যথার তীব্রতা এতোই ছিল যে শুধু একটা দোয়া ছাড়া বাকি সব দোয়া ভুলে গিয়েছিলাম। ওটাই পড়ছিলাম মনে মনে বার বার, মুখে কোনো আওয়াজ নেই। প্রসব নিরাপদ হলেও ব্যথামুক্ত নয়। Labor is labor, এটা মানতেই হবে।
 
কয়েকবার জোরে পুশ করলাম। বেবির মাথা বের হয়েও হয় না এমন এক পরিস্থিতি। শেষ রাতের দিকে লম্বা সময় আমি টয়লেটে যাইনি। আসলে শরীরে শক্তি আর মনে ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না ডেলিভারি টেবিল থেকে উঠে টয়লেটে যাওয়ার। পুশ করার চেষ্টা করতেই ইউরিন আর বাওয়াল ডিসচার্জ হয়ে যায়। সেটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি হলেও ওনাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল এমন ঘটনায় ওনারা অভ্যস্ত। তারা খুব ক্যাজুয়ালি নিল বিষয়টা। আয়া পরিষ্কার করে দিল। এবং প্রথমবারের মতো ওনারা আবিষ্কার করলেন যে আমার পানি আগেই ভেঙে গিয়েছে। তবে তখনও বেবি পুশ করার মতো পানি ছিল পেটে আর বেবির মুভমেন্টও ভালো ছিল।
 
অবশেষে কিছুটা ডিপ ব্রিদিং করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে জোরে একটা পুশ করতেই সকালের প্রথম রোদের সাথে সাথে আমার দুনিয়া আলো করে বেরিয়ে এলো আমার কলিজার টুকরা। আমি আগে থেকেই এপিসিওটমি যেন না দেয় সেটা বলে রেখেছিলাম। ওনারা কথা রেখেছিলেন। যদিও ফার্স্ট ডিগ্রি টিয়ার ছিল। তবে আমার মনে হয় যদি আপরাইট কোনো পজিশনে পুশ করতে পারতাম তাহলে হয়তো এটাও হতো না, আল্লাহ মালুম। কিন্তু ওনারা ডিলেইড কর্ড ক্লাম্পিং করতে রাজি হয়নি আর করেওনি। কারণ আগে ওনারা কখনোই এটা প্রাক্টিস করেনি আর এর উপকারিতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন না। সাথে সাথে কাটা হলো নাড়ি।
 
বেবিকে প্রসবের সাথে সাথেই আপু ওকে আমার পেটের ওপর দিলেন। তার সাথে আমার প্রথম স্পর্শ, আহ! তারপর ওকে পরিষ্কার করে ওর দাদির কাছে দেয়া হলো। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! ওইসময় বাবু হওয়ার থেকে আমি আর আম্মু এই ভেবে বেশি খুশি ছিলান যে অবশেষে আমার ব্যাথার পর্ব শেষ হলো। টানা ২৮ ঘন্টা+ লেবার সহ্য করার পর আল্লাহ আমাকে মায়ের মর্যাদা দান করলেন।
 
বেবি ডেলিভারি হওয়ার পর আমার থাই-এর মধ্যে আরেকটা ইনজেকশন পুশ করা হলো। এটা প্লাসেন্টা ডেলিভারি তরান্বিত করার জন্য। প্লাসেন্টা ডেলিভারি হওয়ার পর ওনারা আমার টিয়ারে একটা সেলাই দিবে কিনা জানতে চাইলেন। এতে নাকি আমার আরেকটু আরাম হবে। সেলাই আবার খুলতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। তারা বললো, না, কসমেটিক সেলাই দেবো। পাঁচ দিন পর একবার চেকআপে এসো আর সেলাই আপনাতেই পড়ে যাবে, খুলতে হবে না। জায়গাটা অবশ করার জন্য আরেকটা ইনজেকশন পুশ করে সেলাই দেয়া হলো।
ওইসময় বাইরে অফিস রুমে অপেক্ষা করছিল বাবুর বাবা। ফজরের পর ওর আরো কিছু বন্ধুও এসেছিল। বাবুকে বাবার কাছে দেয়া হলে কানে আজান-ইকামত দেয়া হলো। তাহনিক করানো হলো।
 
এদিকে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। বুকে গ্যাস জমে ছিল, পেট গুলিয়ে আসতে লাগলো, বমি বমি লাগছিল। বমি আসছে এটা বলতে বলতেই আমি, আমার কাপড়, ডেলিভারি টেবিল আর ফ্লোর বমিতে মাখামাখি। আপুরা যখন বললের পিটোসিনের কারণে এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক তখন আর ঘাবড়ালাম না। তবে শরীরে শক্তি ছিলোনা বিন্দুমাত্রও। এমনি চোখ খুলে তাকানোর মতোও শক্তি ছিল না গায়ে। শরীর প্রচুর কাঁপছিল। আম্মু দুটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল আমাকে। ওখানে শোয়ানো অবস্থাতেই কাপড় পাল্টে দিলেন আপু। বেদানা, কলা আনা হলো। কোনো রকমে খেলাম ওগুলো।
 
ততোক্ষণেও আমি জানতামই না আমার ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে হয়েছে। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলে বললো ছেলে হয়েছে। আসলে আমি জেন্ডার নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না। বাচ্চা সুস্থ ছিল, এটুকু ইনফরমেশনই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য। বাবু কান্না করেছিল, হাঁচি দিয়েছিল, প্রসবের পর ম্যাকোনিয়ামও পাস করেছিল। আমি কিছুটা স্ট্যাবল হলে ব্রেস্টফিডও করানো হয়েছিল। জন্মের আধা ঘণ্টার মধ্যে এসব হয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ।
 
গাড়ি আনা হলো যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে ভালোভাবে রেস্ট নিতে পারি। কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম এখানে অন্তত একঘন্টা হলেও রেস্ট নিয়ে তারপর যেতে। যদিও বাড়ি কাছেই তবে এতো নাজুক পরিস্থিতিতে আমি গেইট পর্যন্তও হেঁটে যেতে চাচ্ছিলাম না। আসলে পারলামও না। সবার জোড়াজুড়িতে উঠে বসলেও মাথা এমন চক্কর দিলো আর চোখ অন্ধকার হয়ে আসলো যে আবার শুয়ে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে গাড়িকে দুঘন্টা পর আসতে বলে ফেরত পাঠানো হলো।
 
ততোক্ষণ আমি ওই ডেলিভারি টেবিলে শুয়েই ঘুমিয়ে নিলাম। মাঝে আরেকবার ব্রেস্টফিড করানো হলো। দু’ঘন্টা পর গাড়ি আসলে আমরা বাড়ি চলে আসলাম। সাথে নিয়ে আসলাম এক অন্যরকম এমপাওয়ারিং আমার আমিকে, যে এখন মা ❤️
আলহামদুলিল্লাহ!
 
উম্মে আবু দুজানা
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স পার্টিসিপ্যান্ট, ব্যাচ ১৫