ছোট বাবুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য – আসুন সচেতন হই
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Blog
- Date July 24, 2024
- Comments 0 comment
খাদিজা তার এক মাস বয়সী মেয়ে আমিনাকে কোলে নিয়ে ঘরের মৃদু আলোয় বসে ছিলেন। রাত বাজে আড়াইটা। জানালা ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো ঘুমের কুয়াশা ভেদ করে তার মুখে এসে পড়ল। হঠাৎ থেমে থেমে আমিনার কান্নার শব্দ বাড়ে এবং কমে। এবার কান্না ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো! ছোট্ট ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ছোট সোনামনির কান্না, যা এখন খাদিজার কাছে অতি পরিচিত। খাদিজা মেয়েকে আলতো করে ঝাঁকিয়ে আদর দিতে থাকে। কেন জানি তার নিজের চোখ দিয়েও এক রাশ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে শান্ত করে নিজেকে কিছু বলার চেষ্টা করে, নিজেকে পজিটিভ কিছু বলতে যেন ব্রেন হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এমন কথা। মনে করার চেষ্টা করে জিকির ও দুয়া গুলো, বলতে চায় সেগুলো, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়। ঘুমহীন রাত, আর নতুন এই জীবনের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া চাহিদা তাকে ক্লান্ত ও হতাশ করে ফেলেছে।
একসময়ের আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত খাদিজা এখন কয়েক রকমের নেগেটিভ চিন্তায় ডুবে আছে। সে একজন মা হিসেবে নিজের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, মনে করে সে সবদিক থেকেই আমিনা সোনাকে ব্যর্থ করছে! দুধ পাচ্ছে নাকি পাচ্ছে না? ঠিকমতো কোলে নিতে পারছি নাকি পারছি না? ঠিকমতো ঢেকুর তোলাতে পারলাম নাকি পারলাম না? বাথরুম যতোটুকু হওয়ার কথা ততটুকু হচ্ছে নাকি হচ্ছে না? —এগুলো সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়। আর প্রতিবার মেয়ের কান্না শুনলেই খাদিজার হৃদয় অপরাধবোধে ভরে ওঠে।
অবিরাম ক্লান্তি, বিধ্বস্ত শরীর, হরমোনের ওঠা নামা তার এই চিন্তাগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে। যার ফলে তার পক্ষে বর্তমান মুহূর্তের বাইরে কিছু ভাবা কঠিন হয়ে পড়ে। নিজের যত্ন নেওয়ার মতো শক্তি তার খুব কমই থাকে। হতাশায় সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে, পরিচিত দুনিয়ার সাথে তার যোগাযোগটা যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
আবার থেকে থেকে বিভিন্ন মানুষের কষ্টদায়ক মন্তব্য গুলো, খোঁচা দেওয়া কথাগুলো তার এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে তোলে। “আমাদের সময় তো এসব ঝামেলা ছাড়াইই কাজ হয়ে যেত,”
“এত ডায়পার পড়ালে কোমর চিকন হয়ে যাবে! আমরা কত এগুলো সাফ করেছি! কখনো অভিযোগ করিনি!”
“আরে মুখে প্যাসিফায়ার দিচ্ছ কেন ? বাচ্চার মুখ তো চাপা হয়ে যাবে? একটুও কান্না সহ্য করতে পারো না কেমন মা তুমি?”
এ ধরনের বিভিন্ন মন্তব্য খাদিজার নিজের মা হওয়ার আত্মবিশ্বাস উড়িয়ে দেয়। মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজের মানুষের সচেতনতার অভাব তার কাছে স্পষ্ট ছিল।
সাহায্য চাওয়া মানে তার কাছে ছিল ব্যর্থতা স্বীকার করা! আর এমন দুর্বলতা সে কখনোই দেখাতে চায় না অন্য কাউকে। সবাই সামাজিক কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিবে এই ভয় এবং সকলের সীমাহীন প্রত্যাশা পূরণের চাপ তাকে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। সে তো খুবই খুশি, কৃতজ্ঞতা, এবং আল্লাহর বরকত সহকারে মাতৃত্বের পর্ব শুরু করতে চায়।
হঠাৎ করে খুব একা হয়ে গেল যেন! একা একাই সে এই লড়াই করছে, আর তার কাছের মানুষেরা তাকে বুঝতে পারছে না, যা তার যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে …
খাদিজা আল্লাহকে খুব ভালোবাসে। যখন প্রথম সাহাবী খাদিজার গল্প শুনেছিল তারও খুব ইচ্ছা যে, জান্নাতে সেই মা খাদিজার সাথে তার দেখা হবে কোন একভাবে ইন শা আল্লাহ —এই দৃশ্যটা যখন সে কল্পনা করে, একমাত্র তখনই কোথায় একটা ফিকে আলো হালকা জ্বলে ওঠে।
খাদিজার মতো মায়েদের সাহায্য করার জন্য প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা অর্থাৎ পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এটা মেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি একটি বাস্তব সমস্যা, যা ক্ষেত্রবিশেষে গুরুতর হতে পারে। এর জন্য আশেপাশে মানুষের সহানুভূতি, সচেতনতা, এবং অল্প একটু রহম করার মানসিকতা খাদিজার মত মায়েদেরকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আসুন খাদিজার মত মায়েদের পাশে দাঁড়াই।
এই সংক্রান্ত সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে বাস্তবসম্মত কিছু উপায় এবং পদ্ধতি বলছি:
১) নতুন মায়েদের জন্য একটা সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলার চেষ্টা করা (আমাদের পেইজের সাথে কানেক্টেড ফেসবুক ও টেলিগ্রাম গ্রুপগুলো সেরকম সাপোর্ট সিস্টেম হতে পারে। লিংক পাবেন কমেন্টে।)
২) যেহেতু আমাদের সমাজে এই বিষয়ে তেমন সচেতনতা নেই, তাই মায়েরা এই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন এবং আশেপাশের পরিবারকে এবং আপনার স্বামীকে এই বিষয়ে শেখানোর চেষ্টা করুন।
৩) যদি নতুন মায়ের কখনো নিজেকে আঘাত করতে, অথবা বাচ্চাকে আঘাত করার মত কোন চিন্তা মাথায় আসে, তাহলে ইমারজেন্সি ভিত্তিতে কোন সাইকিয়াট্রিস্ট, কাউন্সিলর অথবা যে কোন প্রফেশনাল সাহায্য নিন।
৪) প্রিয়জনের সাথে নিজের অনুভূতি নিয়ে খোলামেলা শেয়ার করুন।
৫) বিষন্নতা মনে আসছে দেখে নিজেকে দোষারোপ করবেন না। বরং নিজের অনুভূতি মূল্যায়ন করবেন।
৬) নিজের অনুভূতি মূল্যায়ন করুন নিজেকে ভ্যালিডেট করুন এটা বলে, “যেহেতু আমার শরীর অনেক বড় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, হরমোনের ওঠানামা এবং নির্ঘুম রাত —সবমিলিয়ে আমার মাঝে এই বিষন্নতা কাজ করছে। অনেক মায়েদের এটা হয়। আমি একা নই। আল্লাহর সাহায্যে আমি ঠিক হয়ে যাব ইন শা আল্লাহ।“
৭) তবে একই সাথে, কোন নেগেটিভ চিন্তাকে বিষণ্ণতার অযুহাতে প্রশ্রয় দিবেন না। আপনার নেগেটিভ আচরণের প্রভাব আপনার জীবন ছাড়িয়ে পরিবার ও সমাজের উপরও পড়বে এটা মাথায় রাখবেন।
৮) অসুখ হলে তার চিকিৎসা নেয়া যেমন জরুরী তেমনই বিষন্নতার চিকিৎসা নেয়াও জরুরি। এখন হাতের কাছেই এমন সুযোগ রয়েছে। রৌদ্রময়ী অনলাইন ক্লিনিকেও কাউন্সেলিং সেবা পাওয়া যায়। সব রকম সাপোর্ট সিস্টেম খুঁজে সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করা আপনার দায়িত্ব। সর্বোপরি, দায়িত্বে অবহেলা বা চিকিৎসাহীন থেকে রোগের অযুহাতে নিজের বা অন্যের ক্ষতিসাধন করলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা আছে এটা স্মরণে রাখবেন।
৯) যে জিনিসগুলোর প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ সেগুলো প্রতিদিন ডায়েরীতে লিখে রাখার চেষ্টা করুন।
১০) যখন বাবুর সাথে সময় কাটাবেন, তখন তার চোখেরদিকে তাকিয়ে আপনার মুখস্থ করা কমন দুয়া এবং সূরা গুলো পড়ার চেষ্টা করবেন—যেমন আয়াতুল কুরসি, ফালাক, নাস ইত্যাদি পরে নিজের গায়েও ঁফু দিবেন এবং বাচ্চার গায়েও ফুঁ দিবেন।
১১) আল্লাহর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন, বাবুকে কোলে নিয়ে বাবুর কান্না থামাতে থামাতেই আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকবেন যে ,,”আল্লাহ আপনি আমার বাচ্চার কান্না কে কমিয়ে দিন এবং আমার অন্তরের শান্তি দিন”
১২) নিজেকে মনে করিয়ে দিবেন, “আমার বাচ্চার জন্য আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ মা। কারণ আল্লাহ আমাকেই তার জন্য মা হিসেবে পছন্দ করেছেন”
১৩) নিজের জন্য একটা শক্ত ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবেন শুরু থেকেই, যেন অন্য কেউ আপনাকে নেগেটিভ কথা বলার আগেও একবার চিন্তা করে।
১৪) আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করবেন আল্লাহ যেন মানুষের কটু কথা এবং জিহ্বার ক্ষতি থেকে আপনাকে হেফাজত করেন
১৫) সর্বোপরি সকল অবস্থায় আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখবেন । আল্লাহ কখনোই আপনাকে সাধ্যের অতিরিক্ত দিবেন না । এবং এই পরিস্থিতিতেও ধৈর্য এবং দোয়ার মাধ্যমে আপনি আল্লাহর অনেক কাছাকাছি চলে যেতে পারেন।
শারিন সফি অদ্রিতা
মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর
প্রিনেটাল ইন্সট্রাক্টর, রৌদ্রময়ী স্কুল
Other post
You may also like
নতুন মায়েদের জন্য কার্যকর ব্রেস্টফিডিং টিপস
নবজাতকের সুস্থ ও মজবুত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মায়ের দুধ সবচেয়ে উপকারী। তবে নতুন মায়েদের জন্য ব্রেস্টফিডিং শুরুতে একটু কঠিন মনে হতে পারে। মায়েদের জন্য কিছু কার্যকর ব্রেস্ট ফিডিং টিপস দেওয়া হলো, যা মায়ের ও শিশুর দুজনের জন্যই সহায়ক …
মুবাশশিরার লেড উইনিং
মুবাশশিরার বয়স যখন ৫ মাস ২৫ দিন, তখন থেকেই আমি ওকে সলিড দেওয়া শুরু করি। কারণ সলিড শুরু করার সব সাইন আলহামদুলিল্লাহ তার মধ্যে দেখা গিয়েছিলো। সে বসতে পারতো, খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখাতো, ঘাড় ডান থেকে বামে ঘুরাতে পারতো, মুখের …
মা হওয়ার পরের দিন গুলোতে ভালো থাকা
১)প্রথম সন্তানের মা হওয়া সবার জন্য কতই আকাঙ্খিত। ৩৭ সপ্তাহ শেষে ইডিডির বেশ আগেই হঠাৎ পেইন উঠে নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছিল আমার মেয়ে। হাসপাতালে যখন যাই তখন ৩ সেমি জরায়ু মুখ খুলেছিল। তারপরও রুটিন অনুসারে সেলাইন, পিটোসিন, ডেলিভারির সময় এপিসিওটমি দেওয়া …