সঠিক পোস্টপার্টাম কেয়ার পেলে, সারাজীবনের সুস্থতা মেলে
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Blog, Others
- Date April 15, 2024
- Comments 0 comment
সুরা লুকমানে আল্লাহ তাআলা মাতৃত্বের প্রসঙ্গে বলেছেন “কষ্টের পর কষ্ট”, এখানে কিন্তু শুধু কষ্টকর বলেননি। বলেছেন একটা কষ্টের ধাপের পর আসে আরেক ধাপ কষ্ট। সেখানে গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং দুধের বয়স পর্যন্ত মানে পোস্টপার্টাম সময়ের কষ্টের কথা উল্লেখ আছে। মাতৃত্বের এরচেয়ে পারফেক্ট এক্সপ্লেনেশন আর হতে পারেনা।
আমাদের দেশের মা ও পরিবারগুলো প্রেগন্যান্সি ও ডেলিভারি পিরিয়ড নিয়ে সচেতন থাকলেও পোস্টপার্টামের ব্যাপারটাতে একদমই অজ্ঞ। যদিও এটা প্রেগনেন্সির সময়ের মতোই একজন মায়ের শরীরের জন্য খুবই সেন্সিটিভ একটা সময়।
একটা মা নয় মাস প্রেগনেন্সির বিভিন্ন জটিলতার সাথে লড়াই করে, তারপর সন্তান জন্মদান একটা মানুষের শরীরের জন্য সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া।গর্ভাবস্থা ও প্রসবের ধকল শরীরের উপর দিয়ে যায় বলে শরীরে নানারকম পরিবর্তন আসে। শরীর অনেক নাজুক হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও জটিলতা দেখা যায়।
প্রসবের সময় প্রচুর হরমোন একযোগে কাজ করায় প্রসব পরবর্তী কিছুদিন মায়ের মাঝে নানা রকম আবেগীয় পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রসব পরবর্তী কিছু মাস চুল পরা, পেটে চর্বি জমা,কর্ম শক্তির অভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, জরায়ু তার আগের জায়গায় ফিরে আসার জন্য পেটে থেকে থেকে চাপ দেয়া ব্যাথা হওয়া, হরমোনের অতি উপস্থিতিতে শরীরে শীত বা গরমবোধ একটু পর পর পরিবর্তন হতে পারে।
এগুলো সেরে উঠতে বেশ কিছু সময় লাগে।প্রসোবোত্তোর নাজুক শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে প্রায় ৬ থেকে ৮ মাসের মত সময় লাগে।
নরমাল ডেলিভারিতে এপিসিওটমি বা টিয়ারের কারনে ডেলিভারির পর বেশ কিছুদিন টয়লেট করা এমনকি হাটাচলা, বসাও কঠিন লাগে। এটা ঠিক হতে ১০/১৫ দিন রেস্ট লাগে, স্পেশাল কেয়ার লাগে । এটাকে ভাল মত না সারালে সেলাইয়ে ইনফেকশন হয়ে যায়, রেস্ট না পেলে পরবর্তীতে জরায়ু নিচের দিকে নেমে যাওয়া, পেলভিক অরগান প্রোলাপ্স করা, ইন্টেমেসিতে প্রবলেম সহ আরো বিভিন্ন ধরনের রোগে সাফার করতে হয়। সি সেকশনের পরের ৬ মাস শোয়া থেকে ওঠা বসার নিয়ম না মানলে, ভারী কাজ করলে, রেস্ট না পেলে ভিতরের সেলাই খুলে যেতে পারে, ওখানে জ্বালাপোড়া করতে পারে, সারা জীবন কোমর ব্যাথায় ভুগতে হতে পারে, হারনিয়া হয়ে যেতে পারে।
সাধারণত হবু মা ও তার পরিবার প্রেগনেন্সি ও ডেলিভারি সময়কার প্রস্তুতি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন, নতুন শিশু দেখার আনন্দে প্রসবের পরে যে মায়ের শরীরের যত্নের প্রয়োজন হয় সে সম্পর্কে জানতে আর তার প্রস্তুতি নিতে ভুলে যান।
প্রসবের পরবর্তী সময়টা গর্ভাবস্থার বাকি তিনটা ট্রাইমিস্টারের মতোই জটিল এবং সতর্কতার দাবি রাখে। এজন্য প্রসব পরবর্তী সময়কে চর্তুথ ট্রাইমেস্টার বলা হয়।
প্রসব পরবর্তীতে সেরে ওঠার জন্য যে যত্ন ও চিকিৎসা প্রয়োজন তা যদি একটা মা না পায় তাহলে তাকে সারা জীবন বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে হয়। প্রয়োজনীয় নিউট্রিশন না পেলে এবং কিছু নিয়ম কানুন না মানলে ওই মায়ের পঙ্গুর মত বাকি জীবন কাটাতে হয়।
নরমাল হলে ছয় সপ্তাহ আর সিজার হলে ছয় মাস ভারী জিনিস না তোলা, তলপেটের পেশীর যত্নে সঠিক ভাবে বেল্ট ইউজ করা, পিঠের যত্নে অতিরিক্ত কোমর বাঁকানো থেকে বিরত থাকা,বাচ্চা বা অন্য কিছু বহনের ক্ষেত্রে এমন ভাবে নিতে হবে যেন মেরুদন্ড সোজা থাকে। আমরা কলসী কাখে নেবার মত যেভাবে বাচ্চা নেই সেটা পেলভিক ফ্লোরের জন্য ভালনা।
কোষ্ঠকাঠিন্যর জন্য প্রচুর শাক সবজি ফাইবার জাতীয় খাবার খাওয়া জরুরি। এসময় বেশি প্রেশার দিয়ে টয়লেট করা যাবেনা। দরকার প্রচুর পানি ও তরল খাবার।গর্ভের শিশু মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি নিয়ে নিয়ে বেড়ে ওঠে, তাই নতুন মায়ের শরীরে অনেক পুষ্টির ঘারতি দেখা যায়। তাই গর্ভাবস্থায় আয়রন, ক্যালশিয়াম সহ অন্যান্য ঘাটতি গুলো পূরণের নতুন মায়ের দরকার প্রচুর পুষ্টিকর খাবার। ব্রেস্ট ফিডিং মায়েরতো একটা প্রেগনেন্ট মায়ের থেকেও বেশি ক্যালরির চাহিদা থাকে। মাছ মাংস দুধ ডিম এসব খাবে প্রতিদিন। আয়রন ক্যালসিয়াম এবং মায়ের দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গুলো নিতে মা যেন ভুল না করেন। এই ঘারতি গুলোর জন্যই পরে পিঠ ব্যাথা, পা ব্যাথা, মাসল ক্রাম্প, হাত পা অবশ লাগা, এ্যনিমিয়া এগুলো হয়। সাথে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও ঘুম না পেলে,স্ট্রেসে থাকলে বাচ্চার দুধ আসবেনা। সাধারণত ডেলিভারি ৬ সপ্তাহ পরে ডাক্তারের চেকআপ থাকে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অনেকেই এটায় অবহেলা করে যায় না।
দুঃখজনক বিষয় হলো সন্তান জন্মদানের কিছুদিনের মধ্যেই একজন মা আবার পূর্ন উদ্যমে সাংসারিক কাজে যুক্ত হবেন পাশাপাশি বাচ্চার যত্ন নিবেন এরকম একটা ভুল চাওয়া আমাদের পরিবার গুলোতে আছে।
সাধারনত কোন একটা অপরেশন বা অসুস্থতার পর মানুষ কিছুদিন বিশ্রাম পায়। কিন্তু একটা মায়ের গর্ভাবস্থা ও প্রসবের লম্বা ধকলের সাথে সাথেই তার কাঁধে এসে পরে একটা শিশুর দায়িত্ব। দেখুন একটা অসুস্থ মানুষ তার শরীর নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ করতে পারে কিন্তু একটা মায়ের এই খোঁড়া পায়ের সাথে লাগানো থাকে বিশাল ওজনের বেড়ি। একটা মা স্বাভাবিক টাইম মেনে কোন কাজ করতে পারেনা। বাচ্চা কতক্ষন খাবে, কখন ঘুমাবে, কখন উঠবে কখন পি পটি করবে সব কিছুই আনপ্রেডিক্টেবল। মা অসুস্থতার কষ্টে /বাথরুমের চাপে/ঘুমে শেষ হয়ে গেলেও তার আগে বাচ্চার নিডগুলো ফুলফিল করতে হয়। খোঁড়া মানুষের থেকেও সে আরো বেশি আটকিয়ে থাকে। তখন যদি ঘরের মানুষ তার যত্ন না নেয়, তার কাছে যদি একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো অন্যান্য সব সার্ভিস আশা করে তাহলে সেটা সেই মায়ের জন্য জন্য জুলুম ছাড়া আর কিছুই না।
বাচ্চাটা মায়ের পেটে থাকাকালীন যেমন মায়ের বিশেষ কেয়ার দরকার, তেমনি ছোট শিশু থাকা অবস্থায়ও মা কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে প্রধানত বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের।
বাবা হয়েছেন, তার সমস্ত ধকল কিন্তু গিয়েছে মায়ের উপর দিয়ে, আপনি আপনার ওয়াইফের প্রেগনেন্সি চাইল্ড বার্থের কষ্ট কমাতে পারবেন না, সেই ক্ষমতা আপনার নেই। কিন্তু আপনি চাইলেই তার পোস্টপার্টামটা একটু সহজ করতে পারেন, তার পুষ্টিকর খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যাবস্থা করতে পারেন। সেই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আপনাকে দিয়েছেন। দেখা যায় প্রেগনেন্সি টাইমে যেই হাসবেন্ড খুব কেয়ারিং ছিলো পোস্টপার্টামে সে হয়ে যায় কেয়ারলেস। কারন সে জানেনা যে প্রেগনেন্সির মত এই সময়টাও সেন্সিটিভ।
অনেকে বলবে আমিতো এতো নিয়ম মানিনি, কই আমারতো কিছু হয়নি। তার মেডিকেল স্টোরি শুনলেই দেখবেন সে এমন কোন একটা সমস্যায় ভুগছে যার উৎস আসলে পোস্টপার্টাম কেয়ার না পাওয়া বা নিয়ম না মানা। কিন্তু তা সে জানেনা। আবার অনেকে বলে সি সেকশন করার পর থেকে আমি পঙ্গু হয়ে গেছি, বা নরমাল করেই আমার এই সমস্যা। আসলে সমস্যা আপনার সিজার বা নরমাল ডেলিভারির কারনেনা, ডেলিভারির পরে আপনার খাবার, রেস্ট, আর নিয়ম কানুন না মানার কারনেই এই অবস্থা।
একটা সময়ে সরকার প্রেগনেন্সির সময়ে যত্ন মা ও বাচ্চার জন্য কতটা জরুরি এটা বুঝিয়ে মিডিয়া ও মাঠ পর্যায় মিলিয়ে প্রচুর কাজ করেছে, এর সুফল এখন ভোগ করছে দেশ। প্রসবের সময়ে শিশু মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যুর হার অনেক কমেছে।
যারা মেডিকেল/নিউট্রিশন/ফিটনেস সেবা নিয়ে কাজ করেন, সচেতনতা মূলক কন্টেন্ট বানান, লেখালেখি করেন, সবাই পোস্ট পার্টাম সময়ে মায়ের যত্ন নিয়ে মানুষকে সচেতন করুন প্লিজ।
প্রেগনেন্সির মত পোস্টপার্টাম সেবাও একটা মানুষের হিউমেন রাইটসের মধ্যে পরে। একটা মেয়ের মা হবার পর বাকি জীবনের সুস্থতার জন্য পোস্ট পার্টাম কেয়ার আবশ্যক।
তামান্না তাবাসসুম
লেখক ও শিক্ষক
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স এসোসিয়েট ও পার্টিসিপ্যান্ট
Other post
You may also like
রংধনু রঙের খেলনাগুলো
ছোটবেলায় আমাদের নিকট প্রকৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি ছিলো, তা হলো সাত রঙের রংধনু। কারণ অধিকাংশ সময় বৃষ্টির দেখা মিললেও, বৃষ্টির পরের রংধনুর দেখা মিলতো খুবই কম। তাই যে জিনিস খুব কম দেখা যায়, সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণও থাকে সবচেয়ে …
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ছোট বাবুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য – আসুন সচেতন হই
খাদিজা তার এক মাস বয়সী মেয়ে আমিনাকে কোলে নিয়ে ঘরের মৃদু আলোয় বসে ছিলেন। রাত বাজে আড়াইটা। জানালা ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো ঘুমের কুয়াশা ভেদ করে তার মুখে এসে পড়ল। হঠাৎ থেমে থেমে আমিনার কান্নার শব্দ বাড়ে এবং কমে। …