জটিলতা সত্ত্বেও নরমাল ডেলিভারির গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date December 30, 2023
- Comments 0 comment
গত ৪ ডিসেম্বর আলহামদুলিল্লাহ “মারিয়াম” এর মা হিসেবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে কবুল করেছেন। কন্সিভ করার কিছুদিন আগে থেকেই রৌদ্রময়ী গ্রুপের সাথে আমার পথচলা শুরু।
কন্সিভ করার পর পরই প্ল্যান করি, প্রিন্যাটাল কোর্সে জয়েন করার, কিন্তু তখন কোনো রানিং ব্যাচ না থাকায় অপেক্ষা করি, নতুন ব্যাচ স্টার্ট হওয়ার জন্য। এভাবে আমার ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার প্রায় শেষ হয়ে যায়। তারপর ক্লাস শুরু হলো কোর্স।
প্রেগন্যান্সি নিউট্রিশনের ক্লাস করেও কিছুই তেমন ভাবে মেইনটেইন করতে পারছিলাম না, বমির জন্য। তবুও আল্লাহ যতটুক রিযিকে রেখেছিলেন, সেটুকুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। এরপর একে একে সবগুলো ক্লাস শেষ করি এবং আলহামদুলিল্লাহ আমার কোনো কম্পলিকেশন না থাকায় আমি ১৬ সপ্তাহ থেকেই ক্লাসে শিখানো প্রতিটা এক্সারসাইজ স্টার্ট করে দেই। সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার থেকে ডায়েট চার্ট বেশ ভালোভাবেই মেইনটেইন করতে পেরেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
যেহেতু প্রথম প্রেগ্ন্যাসি, তাই সবকিছুই একদম নতুন নতুন এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছিলো, এর মধ্যেই হঠাত করে একদিন হাত পা এর আংগুলে চুলকানো শুরু হলো, সন্দেহ হওয়ায় নিজেই লিভার ফাংশন টেস্ট করে এবনর্মাল রেজাল্ট পাই, তারপর আমার গাইনোকলজিস্ট ম্যামের সাথে কন্সাল্ট করার পর ম্যাম আরো কিছু টেস্ট দেন এবং কনফার্ম করেন যে আমার ICP (Intrahepatic cholestatis of pregnancy) ডেভেলপ করেছে, যার জন্য আমাকে হয়তো ৩৬-৩৮ সপ্তাহের মধ্যে C-Sec এ যেতে হবে।
তখন আমার ৩২ সপ্তাহ, প্রতিটা দিন কিভাবে যে কাটাতাম! শুধু ভাবতাম যে, মিউকাস প্লাগ, ব্লাডি শো, ওয়াটার ব্রেক, কন্ট্রাকশনের সময় ডিপ ব্রিদিং, পুশ, এসব কোনো কিছুই এক্সপেরিয়েন্স করা ছাড়াই মা হয়ে যাবো!! (গ্রুপে বার্থ স্টোরি পড়ে পড়ে তখন আমার কাছে এই ব্যাপারগুলো খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো, তাই আমিও এগুলো এক্সপেরিয়েন্স করতে চাইতাম।)
এরপর থেকে আমি ক্লাসে শিখানো সমস্ত এক্সারসাইজ, প্রচুর দুয়া আর ৩৬ সপ্তাহ থেকে আনারস, খেজুর, কাচা পেঁপে সব খাওয়া স্টার্ট করলাম, ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম। হাজবেন্ড বুঝালো, আমার এসব এক্সপেরিয়েন্স করার থেকে “মারিয়াম” এর সুস্থতা অনেক বেশি প্রায়োরিটি পাওয়া উচিত।
আল্লাহর ফায়সালা মেনে নেওয়ার জন্য মনকে বুঝালাম, এভাবে করে ৩৮ সপ্তাহ এসে গেলো, বাবুর মুভমেন্ট কমে যাওয়ায় ম্যাম এর কাছে আসি, ম্যাম পিভি চেক করে বলেন, তোমার বাবু তো এখনও উপরে, তুমি ওইদিন আসো আমি মেম্ব্রেন সুইপ করে দিবো, যদি কাজ না হয় তাহলে ইন্ডাকশন দিবো, তাতেও ফেইল হলে তারপর সি- সেক এর কথা ভাববো।”
আমি খুব মন খারাপ করে বাসায় আসলাম, একদিকে সি-সেকশন আরেকদিকে মেম্ব্রেন সুইপের ভয়। বাসায় এসে হাজবেন্ড আর বড়দের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম এখনি মেম্ব্রেন সুইপ করাবো না। আরো দুই দিন অপেক্ষা করে দেখি পেইন উঠে কিনা (আসলে ভয় পাচ্ছিলাম, সুইপ করা নিয়ে)।
৩ তারিখ সকাল থেকে Duck Walk, Squatting এসব বাড়িয়ে দিলাম (৩৬ সপ্তাহ থেকেই প্রচুর হাটতাম, সকাল সন্ধ্যার দুয়া, যিকির হেঁটে পড়ে শেষ করতাম)। যখন রাত ১০টা, তখন কোমড়ে হালকা হালকা একধরনের পেইন স্টার্ট হলো, আমি বুঝলাম আল্লাহর ইচ্ছায় লেবার পেইন স্টার্ট হচ্ছে, ভয় পাওয়ার বদলে খুশি হয়ে গেলাম, যে আমার তাহলে সুইপিং লাগবেনা ইন শা আল্লাহ।
হাজবেন্ডকে কল দিয়ে বললাম এলজিন নিয়ে আসতে দেখি true লেবার পেইন কিনা, সে তড়িঘড়ি করে এলজিন নিয়ে আসলো বাসায়, খেলাম সাথে সাথে। খেয়ে ৫ মিনিট যায়, ১০ মিনিট যায়, আমি খুব খুশি যে পেইন কমছে না। আমি হাঁটা বাড়িয়ে দিয়েছি তখন। একটু পর পর এসে হাজবেন্ডকে বলে যাচ্ছি, পেইন তো কমছে না! সেও শুনে খুশি, আমাকে বলছে অবশেষে মারিয়ামকে দেখতে পারবো তাহলে কাল ইন শা আল্লহ।
রাত বাড়ছিলো, পাল্লা দিয়ে কন্ট্রাকশনের টাইম কমে আসছিলো, হাজবেন্ড ম্যাসাজ করে
করে দিচ্ছিলো কোমড়ে আর আমি এদিকে প্রচুর মোচড়া মুচড়ি শুরু করি। তখন বাবু বাথরুম করে দেয় এক পর্যায়ে, আমি বুঝতে পারিনি। শুধু ঘড়ি দেখছিলাম, কখন সকাল হবে আর হসপিটালে যাবো, ম্যামকে মেসেজ দিয়ে রাখলাম, ম্যাম বললেন সাথে সাথে চলে আসতে। আমি এদিকে মিউকাস প্লাগ বা ব্লাডি শো এসব দেখার জন্য বার বার ওয়াশরুম যাচ্ছিলাম। কন্ট্রাকশন টাইম কমে ৩০ সেকেন্ড আর গ্যাপ ১ মিনিটে চলে আসছে।
এরমধ্যে সকাল ৮:৩০ বেজে গেলো, রেডি হতে নিলাম, ঠুস করে ওয়াটার ব্রেক হয়ে গেলো। তাকিয়ে দেখি হলদে কালারের পানি, বুঝে গেলাম মেকোনিয়াম হতে পারে। আর দেরি না করে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালের জন্য গাড়িতে উঠলাম। এসে পৌছালাম ৯ টায়, আমাকে রিসিভ করে ডিউটি ডক্টর আপু হিস্ট্রি নিয়ে, পিভি চেক করে ম্যামকে ইনফর্ম করলেন যে জরায়ু ৫ সেমি খুলে গিয়েছে! আলহামদুলিল্লাহ, ম্যাম ৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসলেন, ম্যাম তখন আমার পেইনের সময়ের মোচড়া মুচড়ি দেখে বললেন, একদম অল্প সময়েই তোমার লেবার খুব ভালো প্রগ্রেস করেছে কিন্তু, তুমি এদিকে এরকম করে করে বাবুটা কে হাগু করিয়ে ফেলসো।”
ম্যাম তখন জিজ্ঞাসা করলেন, কী করবে বলো, নরমাল এর জন্য ১ ঘন্টাও লাগতে পারে, ৩/৪ ঘন্টাও লাগতে পারে, ওয়েট করবা নাকি সি সেক? আমি বললাম আমার হাজব্যান্ডকে জিজ্ঞাসা করে নিতে। ম্যাম তখন আমার হাজবেন্ডকে বললেন পুরো ঘটনা, আর তাকে বললেন সিদ্ধান্ত নিন কী করবেন।
আমার হাজবেন্ড বেচারা আমার অবস্থা দেখে তখন ম্যামকে বললো, ম্যাম তাহলে এনেস্থেসিওলজিস্টকে কল দিন, সিজারের জন্য।
ম্যাম বললেন আচ্ছা উনার আসতে ১/১:৩০ ঘন্টা লাগবে, এরমধ্যে দেখি ট্রায়াল দিয়ে ( তখন আমার অক্সিজেন চলছিলো, মুভমেন্ট একদমই পাচ্ছিলাম না, ডপলারে ইরেগুলার হার্ট বিট আসছিলো বার বার)
সাথে সাথে আমাকে উঠিয়ে ওটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, পজিশনিং করে ম্যাম বললেন পেইনের সাথে সাথে পুশ দিতে (তখন ৭ সেমি খোলা, ২০ মিনিটে খুলে যায়)।
আমি পুশ দিচ্ছিলাম আর পুরো প্রেগন্যান্সিতে এপিশিওটমি নিয়ে যে ভয়টা পেতাম, সেটা চোখের সামনে ঘটে গেলো অথচ লেবার পেইন আর পুশের জন্য কিছুই টের পেলাম না।
৫ বার টানা পুশ দেওয়ার পর ম্যাম আমার হাজবেন্ডকে (ওকে ম্যাম নিজেই ওটি রুমে এলাউ করেছিলেন, যেহেতু সেও ডক্টর) বলছিলেন, “দেখো তোমার মেয়ের চুল দেখা যাচ্ছে আর এদিকে ও পুশ দিচ্ছে না, এভাবে বাচ্চার মাথা লম্বা হয়ে যাবে, রেস্পিরেটরি ডিস্ট্রেস শুরু হবে”।
আমি ৫টা পুশ দিয়ে আসলে ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম, যে এখনও বেবি বের হচ্ছে না, আর হয়ত পারবো না। ওই সময় আমার হাজবেন্ড আমাকে বার বার বলছিলো “তুমি পারবে, আর একটু, আমাদের মারিয়ামকে দেখবেনা? তুমি পারবে প্লিজ লাস্ট একটা পুশ দাও (মাশা আল্লাহ,,আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন এই সময়ের এই কাউন্সিলিং টুকুর জন্য)।
আমি তখন সর্বশেষ পুশ দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ট্রাই করলাম, কিন্তু পুরো শক্তি ব্যয় করার আগেই আমার মারিয়াম ফুলটা ঠুস করে এসে গেলো, আর ম্যাম সাথে সাথে আমার পেট এর মধ্যে তাকে রাখলো, আমি তাকে দেখবো কি! শুধু আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ পড়ছিলাম, রুমে যত নার্স, সিস্টার খালারা ছিলেন সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন।
আমি আমার কপালের উপর টপ টপ করে পড়া গরম পানির উৎস খুজে দেখি, মারিয়াম এর বাবার চোখ থেকে সমানে পানি পড়ছে, খুশির কান্না, আলহামদুলিল্লাহ।
এখনও আমার বিশ্বাস হয়না যে আমি নরমাল ডেলিভারিতে আমার মারিয়ামকে দুনিয়াতে আনতে পেরেছি, সমস্ত কৃতজ্ঞতা আল্লাহ তা’আলার প্রতি এবং
আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্স ও আমার ডাক্তার, আমার হাজবেন্ড এবং আমার ফ্যামিলির প্রত্যেকটা সদস্যের প্রতি।
উম্ম মারিয়াম
রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল কোর্স, ব্যাচ ১২
Other post
You may also like
হাসপাতালে ন্যাচারাল বার্থ সম্ভব: একজন মায়ের অনুপ্রেরণামূলক গল্প
আমি একজন দৌলা হিসেবে আজ একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প শেয়ার করতে চাই। আমার ক্লায়েন্ট আফরোজা আপুর ডেলিভারির অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, সঠিক প্রস্তুতি ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলে হাসপাতালে ন্যাচারাল বার্থ সম্ভব।আফরোজা আপু ন্যাচারাল বার্থের প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। তার স্বামীও …
নরমাল ডেলিভারি: খুবই ভালো অভিজ্ঞতা
গত ১৮ অক্টোবর প্রথমবারের মত পুত্রসন্তানের মা হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। নরমাল ডেলিভারি ছিল, এক্সপেরিয়েন্স খুবই ভাল ছিল আল্লাহর রহমতে।গ্রুপের পোস্ট ফলো করতাম কনসিভ করার পর থেকেই। গ্রুপের পোস্ট পড়ে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। দায়িত্বশীল এবং সবার জন্য অনেক অনেক দু’আ।আমি দেশের …
অতিরিক্ত ওজন নিয়ে নরমাল ডেলিভারির গল্প
সেপ্টেম্বর এর ১৪ তারিখ আলহামদুলিল্লাহ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে আমার প্রথম রাজকন্যার মা হলাম। আমার বার্থ স্টোরি শুরুর আগে আমি আমার কনসিভ করার আগের কিছু কথা শেয়ার করতে চাই যাতে আমার মতো যারা একটু মোটা তারা কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত হোন ইনশাআল্লাহ। আমি …