Back

ইমন, এটা কি পজিটিভ?
হ্যাঁ এটা পজিটিভ মাশাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।

এ দিয়েই শুরু আমার মা হয়ে উঠার গল্প।

আমি তানজিন, ছোটবেলা থেকে বরাবরই খুব নারীবাদী আর স্বাধীনচেতা। নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের পরিচয় তৈরী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতাম। কোনোকিছুতেই ভয় পেতামনা শুধু ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ছাড়া।

২৬ টা বছর লেগে গেলো আমার ব্লাড গ্রুপ জানতে, এতোই ভয় পেতাম ইঞ্জেকশনকে।
ভোটার আইডি কার্ড করতে ব্লাডগ্রুপ লাগে তাই ২৫ বছর ভোটার আইডি কার্ড বানাইনি। হাজব্যান্ড জোর করাতে ভোটার আইডি কার্ড বানিয়েছি মিথ্যে ব্লাড গ্রুপ দিয়ে। আমার ব্লাড গ্রুপ নাকি AB+! আর সেই আমি সিজারে বাচ্চার মা হয়েছি আর মা হওয়ার সুবাদে জানতে পারলাম আমার ব্লাড গ্রুপ B+।

যাই হোক আল্লাহর অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে মা হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। গর্ভকালীন সময়ে প্রতি মুহুর্তে ওর মুভমেন্ট খেয়াল করতাম আর অপেক্ষা করতাম আল্ট্রা করার, কবে একটু দেখবো বাচ্চাটাকে সে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করতো।

চোখের পলকে ৯ মাস কেটে গেলো। সুখ দুঃখের স্মৃতিতে ভর্তি ছিলো ৯ টা মাস। অনেকে হয়তো চায়নি আমার বাচ্চাটা দুনিয়াতে আসুক। অনেকের কাছে হয়তো এখনো আমার বাচ্চাটা তাদের চোখের কাঁটা সেসব কথা আজ থাক।

ভোর ৪টা বেজে ৫ মিনিট হঠাৎ পেইন অনুভব করলাম। কিছু লক্ষণও দেখতে পেলাম বুঝতে আর বাকি নেই। এসে গেলো সেই মুহুর্ত যখন জানতে পারলাম আমার বাবাটা এইবার আমার বুকে আসতে চলেছ। আনন্দের আর তর সয়না। ওমা কি করবো, কি না করবো আনন্দে দিশেহারা। বাকিরা সবাই চিন্তায় চুপচাপ, হয়ে গেলাম এডমিট।

দীর্ঘ ১২ ঘন্টা লেবার পেইনে থেকে আমি এতোই ট্রমাটাইজড হয়ে গেছি আমার ওইদিনের তেমন কোনো স্মৃতিই আর মনে নেই। যেটুকু মনে আছে খুব আবছা। বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য সিজার হয়েছে।যাই হোক আলহামদুলিল্লাহ।

আমার বাচ্চার মাত্র ৪ মাস ১০ দিন চলে। ওকে নিয়ে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে খুব মজার যা আগামীদিনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। যদিও একটা স্মৃতি আছে  ডাক্তার প্রথম আমার বাবাটাকে আমার চোখের সামনে ধরে বললো, এই যে দেখেন আপনার ছেলে বাবু।

তাকিয়ে দেখি বাচ্চা আমার খুব রাগ করে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে, ওর বোধহয় মন খারাপ ছিলো এতো তাড়াতাড়ি আসার তো কথা ছিলোনা এই ব্যাস্ত দুনিয়াতে। আর আমার মনে তো সে কি আনন্দ, ওহ কি শান্তি আমার বাচ্চা।

নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে মায়েদের কিরকম অভিজ্ঞতা হয় তা আমার জানা নেই তবে আমি একজন সিজারিয়ান মা হিসেবে অনেক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। সব অভিজ্ঞতা বলতে গেলে এটা গল্প থেকে ইতিহাস হয়ে যাবে তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছি।

সিজার পরবর্তী সময়ে মায়েদের অনেক অনেক সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক সমস্যা, সেতো অনেক; আর তার জন্য ডাক্তার আছে। শারীরিক সমস্যা সবাই চোখে দেখে তাই অনুভব করতে পারে।

কিন্তু মানসিক সমস্যা?

আহা সেটা কেউ দেখেনা তাই বুঝতেও পারেনা। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে উঠে আসার জন্য নিজেকেই নিজের মনোবল বাড়াতে হবে।
আমি কোনো কিছুতেই নিজের উপর জোর করতামনা নিজের যেটা ভালো লাগে সেটাই করতাম।  নিজেকে বোঝাতাম আমার দ্রুত সুস্থ হতে হবে। আমার অনেক দায়িত্ব, আমি ভালো থাকলে তবেই আমার বাচ্চা ভালো থাকবে। প্রচুর ডিপ্রেশন হতো, আর ঠিক সেই সময় একটা ডিপ ব্রিদ নিতাম আর বলতাম আমি সবার সেরা। আমার কিছুই হয়নি।

এই ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে আমি আরও একটা কাজ করতাম। আমি আমার পেইজ নিয়ে বিজি থাকতাম। কারণ আমার ভালো থাকার আরেকটা পয়েন্ট হলো আমার বিজনেস পেইজ। আলহামদুলিল্লাহ ডিপ্রেশন আমার কাছে হেরে গেছে।

হয়তো আমি ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিজেই খুজে নিয়েছিলাম। কিন্তু নতুন মা হিসেবে অনেক অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলাম, যেমন ৪০ দিনে বাবুর চুল কাটতে হবে। আমার এটা খাওয়া যাবেনা ওটা খাওয়া যাবেনা, গোসল করা যাবেনা আরও কত কি।
কিন্তু নাহ, আমি তানজিন আমার বাচ্চার যেটা ভালো হবে, আমি সেটাই করেছি এবং করবো। আমি আমার বাচ্চার উপর বা আমার উপর কারো মনগড়া এক্সপেরিমেন্ট করতে দেইনি।সেইদিক থেকে এখনো খুব স্ট্রং আছি। আর শিশু বিশেষজ্ঞ  ডাক্তার নাজমুল এর চ্যানেল ফলো করে খুব উপকার পেয়েছি।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমার বাচ্চার এই বয়সে আমি ওকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছি। কৌতুহলবশত ওর ২মাস বয়সেই আমি বেবি বুকস কিনি।

একটা ছোট্ট উপদেশ প্লিজ মেনে চলবেন। যাকে তাকে বিশ্বাস করে আপনার বাচ্চাকে কখনো অন্যের হাতে ছেড়ে দেবেন না। আপনি মা আপনিই হয়ে উঠুন আপনার বাচ্চার কম্ফোর্ট জোন।

হয়তো গল্পটা মায়েদের কিন্তু এই পুরো জার্নিতে আমার একমাত্র সাপোর্ট ছিলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ইমন, গল্পের শুরু যাকে দিয়ে সে আমার হাজব্যান্ড।

তানজিন আক্তার
“মা হওয়ার গল্প” প্রতিযোগিতার পার্টিসিপ্যান্ট