রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্সঃ একটি আশীর্বাদের নাম
“রৌদ্রময়ী প্রি-নাটাল কোর্স, একটি আশীর্বাদের নাম” শিরোনাম দেখে কি মনে হচ্ছে? একটা কোর্স কিভাবে আশীর্বাদ হতে পারে? একটু বিস্তারিত বললেই বুঝতে পারবেন।
২০১৬ সালের মার্চ এর ২৬ তারিখ আমার এপেন্ডিসাইটিস এর অপারেশন হয়। আমার জীবনে হাসপাতাল নিয়ে খুব কম অভিজ্ঞতাই ছিল। যদিও সবাই বলেছে ছোট্ট অপারেশন, আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমাকে টানা চার দিন হাসপাতালে থাকতে হলো, এমনকি বাসায় আসার পর ধীরে ধীরে আমি ডিপ্রেশনে ঢুকে গেলাম। সে পোস্ট অপারেটিভ রুমের অসহায়ত্ব, এনেস্থিসিয়া ছাড়ার সময় এর ব্যথা, প্রতি রাতে সেলাইয়ের ব্যথায় জ্বর আসা, আম্মুর এবসেন্সে দিনের পর দিন গোসল না করতে পারা, কোমরের ব্যথা, সব মিলিয়ে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। শুধু একা একা কাঁদতাম।
এক মাসের মাথায় ঠিক হয়ে গেলেও মানসিকভাবে আমার একটা পাকাপোক্ত ক্ষতি হয়ে যায়। আমি আর কখনোই মা হতে চাইনি! এমনকি আমি হাত তুলে আল্লাহর কাছে কখনো সন্তানের জন্য আব্দারও করিনি!
আমার সবসময় মনে হত, আমার পক্ষে এত কষ্ট সহ্য করে মা হওয়া সম্ভব না। আমি হয়ত মারা যাবো ডেলিভারির সময়, কিংবা পোস্ট-নাটাল ডিপ্রেশনে আমার সন্তানকে মেরে ফেলব। এজন্য বিয়ের এক বছর পর সবাই যখন বাচ্চার জন্য বলত, আমি স্বাভাবিক আচরণ করতাম, আমার স্বামীর সাথে কখনো দ্বিমত করিনি। কিন্তু কখনো আল্লাহর কাছে হাত তুলে সন্তান চাইতাম না। আর আমার এই মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কেউ জানত না। একা একা কষ্ট পেতে পেতে আমাকে চারপাশ থেকে হতাশা আটকে রাখত। যখন শুনতাম, কারো সন্তান তাকে কষ্ট দিচ্ছে, তখন ভাবতাম, আমার সন্তান না হলেই বাঁচি। অথচ আমি কতটা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম, তা আমি ছাড়া কেউ জানত না!
আমি সবসময় এর সমাধান খুঁজতাম।
কাকে বলব?
কে আমাকে সন্তানের প্রতি পজেটিভ ভাবে বুঝাবে?
কে আমাকে বুঝাবে যে, আমি চাইলেই একজন আদর্শ মা হতে পারব?
কে আমাকে মেডিক্যালি এবং স্পিরিচুয়ালি ইন্সপায়ার করবে?
আমি কাউকে এসব বলতে পারতাম না। ২০২০ এর অক্টোবর মাস তখন। আমি সেপ্টেম্বর থেকে ডাক্তার দেখাচ্ছি হরমনাল সমস্যার কারণে। পাশাপাশি কন্সিভের জন্যও ওষুধ দিচ্ছে। সবাই দেখছে, আমি পজেটিভ। অথচ আমি একবারও আল্লাহর কাছে সন্তান চাইনি। শেষ পর্যন্ত আল্লাহকে এটুকুই বলি,
“আল্লাহ, তুমি যদি আমার জন্য কল্যাণকর জানো, তবে আমাকে সন্তান দাও। আর যদি তা অকল্যাণের কারণ হয়, তাহলে আমাকে কখনো সন্তান দিও না। তুমি যা করবে, আমি তাইই মেনে নিব”
আলহামদুলিল্লাহ, আমি ততদিনে মা হতে চলেছি যদিও বুঝতে দেরী হয়ে গেছে। যতক্ষণে বুঝেছি, ততক্ষণে আমার কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমার ১১সপ্তাহ চলে, তবুও আমি নেগেটিভ চিন্তাই মনে পোষণ করে আসছি। সবাই খুশি, কেবল আমিই খুশি হতে পারিনি। বছরের পর বছর কুড়ে খাওয়া একটা ভয় আমাকে তখনো তাড়াচ্ছে।
হ্যাঁ, ঠিক ঐ সময়ে রৌদ্রময়ী প্রি-নাটাল ক্লাসের ১ম ব্যাচের এক আপুর রিভিউ আমার চোখে পড়ে। এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে আমি সাথে সাথে তাদের সাথে যোগাযোগ করি। তখন ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ, রেজিষ্ট্রেশন এর শেষ সময় ছিল ডিসেম্বর ২৯।
আমি এখনো ভুলতে পারি না, কত মানসিক কষ্ট, দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে আমি প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নিয়ে যুদ্ধ করেছি। এই যুদ্ধ দেখা যায় না, কেউ দেখে না অর্ন্তযামী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ছাড়া! আমি তার কত বড় নেয়ামত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম, সেটা একমাত্র একা একা চোখের পানি ফেলা আমার ব্যাপারে উনিই জানতেন! কি করে আমি কাউকে এসব বলতাম তাকে ছাড়া? আর তিনিই একারণে আমার সামনে এমন একটা সুযোগ নিয়ে এসেছেন, সুবহানআল্লাহ! নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো আমাদের বান্দাদের হাত ছেড়ে দেন না, আমাদের তার রহমত দিয়ে আবিষ্ট করে রাখেন!
আমি যখন প্রথম ক্লাস শুরু করি, আপুদের প্রথম কথাই ছিল আল্লাহর শক্তি, আল্লাহর মহিমা, এবং আল্লাহর দেয়া এই প্রক্রিয়ার উপর নিজেকে আল্লাহর নামে তাওয়াক্কুল করা। সুবহানআল্লাহ!
আমরা তো এটাই সবসময় ভুলে যাই। ডাক্তার, ওষুধ, স্বামী, পরিবার, সমাজ- এদের নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা ভুলেই যাই আমাদের মাথার উপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ছায়া আছে অভিভাবক হিসেবে! আর কি লাগে?!
কোর্সের ইন্সট্রাক্টর আপুরা আমাদের নিজের বোনের মত এক এক করে প্রেগ্ন্যাসির শুরু থেকে ডেলিভারির পরেও কি করে শিশুর যত্ন নিব, তার প্রতিটা ধাপ বুঝিয়েছেন। কিভাবে আমাদের শরীরে পরিবর্তন আসবে, আল্লাহ কিভাবে আমাদের দেহে একটু একটু করে বদলে দিবেন, কিভাবে আমরা নিজেদের যত্ন নেব, ব্যায়াম করব, কি খাবো কি খাবো না, নরমাল ডেলিভারি ও সি-সেকশন নিয়ে সকল ভুলে অবসান, সন্তান জন্মের পর তাকে সামলে নেয়া, পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশন এবং কেয়ার, কি নিয়ে কথা বলেনি!
আপুরা মেডিকেল প্রসেসের পাশাপাশি আমাদের স্পিরিচুয়ালভাবে বুঝিয়েছেন যা আমি মনে করি একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও প্রতিটা ক্লাস ছিল নতুন সব তথ্যে পরিপূর্ণ যা আমরা আগে কারো কাছে জানার সুযোগ পাইনি। আমাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর আপুরা দেননি, এমনটাও হয়নি। উনাদের আন্তরিকতায় এখন আমি অনুভব করি আমি আসলে কত স্ট্রং, আল্লাহ আমাকে কত শক্ত বানিয়েছেন।
প্রেগন্যান্সির সময় স্বভাবতই মা তার সন্তানের জন্য ওভার প্রটেক্টিভ হয়ে যায়। আমি তো নিজেই নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারছিলাম না, আমার সন্তানের সুরক্ষা কি করে নিশ্চিত করতাম? তখনই আল্লাহ আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। এভাবেই তো উনি আমাদের প্রতি তার ভালোবাসা, রহমত প্রদর্শন করেন, আমাদের সাথে কথা বলেন। আমরাই বরং পার্থিব জীবনে ব্যস্ত হয়ে তার রহমত সম্পর্কে ভুলে যাই!
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর কাছে যিনি রৌদ্রময়ীর মত প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে এর পেছনের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর রৌদ্রময়ী স্কুলের বেস্ট প্রজেক্ট হলো “রৌদ্রময়ী প্রি-নাটাল কোর্স”।
এটা শুধু একজন মা নয়, একজন বাবারও অনেক কিছু জানার আছে, বোঝার আছে, শেখার আছে। কখনো কি জানতেন, বাবা হলে বাবাদেরও হরমনাল চেঞ্জ আসে? মায়ের মত তাদেরও ডিপ্রেশন হয়?
এই কোর্সের পর আমি একা মানসিকভাবে শক্ত হয়েছি শুধু তা না, আমি আশেপাশের সবাইকে সেটা বলি, আমার স্বামীকে বোঝার চেষ্টা করি, নিজের মুড সুইং নিজেই হ্যান্ডেল করি, এবং ইনশাআল্লাহ আল্লাহর ইচ্ছায় আমি মা হতে পারলে আমার সন্তানকেও সুন্দরভাবে পৃথিবীতে গাইড দেয়ার শক্তিও আমার মাঝে আছে।
আমি আসলে কতটুকু কৃতজ্ঞ তা শব্দে প্রকাশ করতে পারব না। মেন্টাল হেলথ নিয়ে বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে আলোড়ন তৈরি হচ্ছে। অথচ এটা এমন এক সমস্যা, যা নিয়ে আমরা খুব কমই কথা বলতে পারি, সমাধান পাই।
আলহামদুলিল্লাহ, আমি পেয়েছি, এবং ঠিক সময় মতো।
যদি অন্য ধর্মের কেউও থাকেন, নিশ্চিন্তে এই কোর্স করতে পারেন। কারণ আপনার আমার স্রষ্টাকে ডাকার আলাদা আলাদা নিয়ম হলেও আমরা কিন্তু নিয়ম করে একজন সৃষ্টিকর্তার কাছেই দিন শেষে নিজেদের সঁপে দেই!
আমার অনুরোধ থাকবে, নতুন বাবা-মা, সবাই যেন সন্তান এবং নিজের নিজেকে বোঝার জন্য, নিজেকে সামলানোর জন্য, যে কোনো সমস্যা সামলানোর জন্য এই কোর্সটি করবেন। একমাত্র তারাই এই কোর্সের আগের এবং পরের পার্থক্য বুঝবেন যারা এই কোর্স করেছেন!
আবিয়ার সুলতানা মারিয়া,
রৌদ্রময়ী প্রি-নাটাল কোর্স
২য় ব্যাচ