অন্ধকার থেকে আলোতে আসা
বি এস সি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই স্বনামধন্য এক ব্যাংকের আইটি সেকশনে চাকুরি জীবন শুরু করি। ”ইন্টারেস্ট কেন হারাম?”এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আল্লাহ তায়ালা আলহামদুলিল্লাহ হেদায়েতের আলোর সন্ধান দেন।
‘‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক, আয়াত-১)
শুরু হলো আমার পড়া এবং আল্লাহ তায়ালা কেনো এই আয়াতই প্রথম নাযিল করেছেন এত আয়াত থাকতে…এই আয়াতই কেন!! নিজের উত্তর নিজে খুঁজে পাওয়া… আলহামদুলিল্লাহ, হারাম চাকুরীটা ছেড়ে দেই তথাকথিত প্রায় সবার বিপক্ষে গিয়ে। শুরু হলো আমার স্রোতের বিপরীতে পথ চলা…আলহামদুলিল্লাহ।
বিয়ের ৪ বছর ৭মাস পর ওভারির সিস্টের কি অবস্থা (PCOS এর Patient আমি) এটা জানতে ডাক্তারের দেয়া টেস্ট করতে হাসপাতালে যাই,আল্ট্রাসাউন্ড করতে গিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি কি প্রেগন্যান্ট?”
-না তো। এমন আমার প্রায়ই হয় পিরিয়ড দেড়ি করে হয়।
-“আল্লাহ কি বলে মেয়েটা?পেট শক্ত লাগে না? খারাপ লাগে না?…ইত্যাদি “
-লাগে তো। সিস্ট আছে তো, অনেকদিন পিরিয়ড হয় না। মনে হয় হরমোন imbalance হয়েছে তাই শরীরটাও খারাপ লাগে।
-“কি বলে মেয়ে দেখো ওর তো বাবু পেটে মাশাল্লাহ কি সুস্থ বাবু,সুন্দর নড়াচড়া করছে। ১৯ সপ্তাহ ৫ দিন হয়েছে।…”
আমি কান্না করতে করতে অবস্থা খারাপ…”আল্লাহ তায়ালার এমন surprise সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ। আল্লাহর এত বড় আমানত!!! আমার হাতে সময় অনেক কম অনেক কাজ বাকি…”
যে দায়িত্ব-এ যখন যে পদার্পণ করে সেই দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখা ফারদে ইলমের মাঝেই পড়ে। শুরু করলাম কি কি করতে হবে জানতে হবে,কিভাবে চলতে হবে তার সন্ধান খোঁজা। ডাক্তার দেখালাম, কিন্তু আমার একটাই অভিযোগ ডাক্তার কথা কম বলে আমার তো অনেক প্রশ্ন!! প্রায়ই বাসায় এসে জামাইকে বলি,”যতই বিখ্যাত হোক আমার মন ভরে না,অনেক অনেক প্রশ্ন আমার।কিন্তু উনি মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলে।” পরে কয়েক ভিজিট পরে নিজেই বুঝলাম এত এত রোগী! এর মাঝে আবার কারো লেবার পেইন উঠলে দৌড়ে ওই রোগীর কাছে যেতে হয়। ডাক্তার তো একা। উনি তো মেশিন না মানুষ। উনার একার পক্ষে এত রোগীকে বুঝানো সব বিস্তারিত বলা বাংলাদেশে অসম্ভব। তখনই বুঝে গেলাম নিজের জানার বিকল্প নেই। ইন্টারনেট ঘাটা শুরু করলাম। না, কেনো যেন মন মত কিছু পাচ্ছি না বিস্তারিত। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া শুরু করলাম। এরপর একদিন আল্লাহ তায়ালা পাইয়ে দিলেন প্রি-নেটাল কোর্সের খবর এক সেমিনার থেকে।
“যখন বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তখন আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যখন সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় তখন আমি তার দিকে এক বাহু অগ্রসর হই। আর যখন সে আমার দিকে এক বাহু অগ্রসর হয় তখন আমি তার দিকে আরো দ্রুত অগ্রসর হই।” ( বুখারী,মুসলিম)
৫ম ব্যাচে ক্লাস শুরু করি। ড. প্রমা আপুর ক্লাস থেকে জানতে পারলাম বিস্তারিত কিভাবে খেতে হবে, কি কি খেতে হবে একজন প্রেগন্যান্ট ও ল্যাকটেন্ট মাকে, মা এবং সন্তানের পুস্টির বিস্তারিত বিষয়টা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। প্রেগ্ন্যাসির মাঝে ৬-৭ মাসের সময় করোনা হয়েছিল, ভেবেছিলাম তার সাইড ইফেক্টের কারণে মাঝে মাঝেই আমি অনেককিছু ভুলে যাই। এই ভেবে কান্না কাটিও করি যে permanent damage হয়ে গিয়েছে আমার!! সুবহানাল্লাহ অথচ প্রমা আপুর ক্লাসেই জানতে পারি mother’s brain develop এর কথা। পিটুইটারি গ্রন্থী থেকে যে হরমন বের হওয়ার ফলেই আমার এমন হচ্ছে যা স্বাভাবিক। সুবহানাল্লাহ। এটা জানার পর যেন আমার মাথা থেকে পাহাড় সমান বোঝা নেমে গেলো।
এরপর রাবেয়া আপুর ৩টা ক্লাস লেবারের প্রস্তুতি,ব্যায়াম ও লেবারের দিনের করনীয় নিয়ে। একটা একটা ক্লাস করছি আর মনে হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোতে ধীরে ধীরে পদার্পন করছি সকল কুসংস্কার-মিথ পেরিয়ে। ব্যায়াম, সূরা মরিয়মের(২৩-২৬) আয়াতের ব্যাখ্যা,visualisation, relaxation techniques,husband সাপোর্ট কিভাবে করতে পারে,কখন বুঝবো এটাই আসল লেবার…আরো অনেক অনেক কিছু! সবকিছু মিলিয়ে যেন এক পূর্ণ প্যাকেজ। আল্লাহর ইচ্ছায় আপুর দেয়া knowledge এর উসিলায় আমি ছিলাম লেবার রুমে সবচেয়ে আত্নবিশ্বাসী হবু মা। যে ক্রমাগত ক্লাসের শেখানো বিষয়গুলো apply করার চেস্টা করেই যাচ্ছিলাম আল্লাহর ইচ্ছায়। ওই জ্ঞানগুলো কাজে লাগানোর ফলে লেবারের রুমে ডাক্তার, নার্স,পিসিএ এটা বলেছে যে,”আমি ছিলাম তাদের দেখা সর্বোচ্চ চেস্টা করা,প্রশান্ত রোগী।”আসলে রাবেয়া আপুর ক্লাসের ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলে আমার কয়েকঘন্টা লেগে যাবে। আমার মনের গভীর থেকে শুধু তার জন্য দোয়াই আসে।
এরপর ডঃ ফাতেমা আপুর ক্লাসে সি সেকশন কখন করা দরকার,কখন দরকার না, এর বিস্তারিত বিষয় একজন ডাক্তার হিসেবে জানালেন আলহামদুলিল্লাহ। খুবই জরুরী ক্লাস এটা অনেক ভুল ধারণা ভাংগার জন্য। এটা করা জরুরী কারণ আমরা এক চেটিয়া ডাক্তারদের দোষ দেই যা খুবই অন্যায়।
প্রথম ৫টা ক্লাস করার পরই আলহামদুলিল্লাহ আমাকে আল্লাহ তায়ালা আল্লাহর দান আমানত,নিয়ামত মারইয়ামকে দান করলেন আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর বাবুকে নিয়েই ক্লাস করলাম ডা. নাইমা আপুর(আপুর ক্লাস ছিল সবচেয়ে বেশি) ক্লাস newborn care,breastfeeding &mix feeding, Post natal care. আমার জন্য জার্নিটা ছিল অসাধারণ কারণ আমি ক্লাসের সাথে সাথে শিখছিলাম। আপু ক্লাসে শেখাচ্ছে আর আমি বাবুকে ওইভাবে র্যাপ করা শিখছিলাম ওটা ছিল মজার। এরপর বাবুকে কিভাবে গোসল করাবো,কিভাবে শোয়াতে হবে SUDI থেকে নিরাপদ থাকার জন্য, কান্নার রহস্য, কিভাবে বাবুকে খাওয়াবো,ল্যাচিং পদ্ধতিতে খাওয়ালে যে সর্বোত্তমরুপে খাবার পাবে বাবু…ইত্যাদি। আপু এত প্রানবন্তভাবে সব বোঝান এবং বোঝানোর এই আয়াতের বিষয়টা অনুধাবন করানোর চেস্টা আমার খুবই ভালো লেগেছে। আল্লাহুম্মা বারিকলাহা।
“তিনি যদি রিযিক বন্ধ করে দেন, তবে কে আছে, যে তোমাদেরকে রিযিক দিবে…” (সূরা মুলক: আয়াত ২১)
“আমরাই যে আমাদের সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ মা তাই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেই নির্বাচন করেছেন এই সন্তানের জন্য। ” এই বিষয়টা উপলব্ধি করানোর পর থেকে কি যে ভালো লাগছে। সুবহানাল্লাহ।
এরপর post natal care নিয়ে বিস্তারিত বোঝানো। এবং এটা সবার আগে অনুভব করানো যে, “সুস্থ সন্তানের জন্য সবার আগে দরকার একজন সুস্থ মা।”
সব হবু বাবা মাকে এই ক্লাস করতে বলবো। বাবা মা হওয়া FOR granted কিছু না। এর জন্য তৈরি হওয়া খুবই জরুরী বিষয়। এই কোর্সের আরেকটা ***স্পেশালিটি উনারা husband কেও ক্লাস করতে বলেন। তাদেরকে বোঝান যে একটা ভালো সুস্থ সন্তানের জন্য তাদের দুইজনকেই একসাথে প্রয়োজন, দুইজনের দুইজনকে সহযোগিতা প্রয়োজন তা হোক ব্যায়ামে,খাবারে, post natal part এ। সব জায়গায়।
এক কথায় এই কোর্স,
“সকল মিথ কুসংস্কার ভেংগে অন্ধকার থেকে আলোতে নেয়ার মত একটা কোর্স।”
জাজাকুমুল্লাহু খইরন পুরো টিম আপুদের। তারা যেন একটা পরিবার হয়ে আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরও তাদের পরিবারকে কবুল করুক,দ্বীন,দুনিয়া,দাওয়াহ ও আখিরাতে। ছড়িয়ে যাক তাদের ও তাদের পরিবারের সাদাকায়ে জারিয়ার মিশন। আমিন।
সবার কাছে একটা অনুরোধঃ পড়তে থাকুন, পড়ার কোন বিকল্প নেই। জানার কোন বিকল্প নেই।
“…যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।” (সূরা যুমার ৩৯ঃ আয়াত ০৯)
“…চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’
(সুরা : আর-রুম, আয়াত : ২১)
–উম্মু মারইয়াম,
প্রি-নেটাল কোর্স,৫ম ব্যাচ।