VBAC এর গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date October 16, 2023
- Comments 0 comment
আমার তখন ৩৪ সপ্তাহ রানিং। সময় যত ঘনিয়ে আসছে আমার টেনশনও বেড়ে যাচ্ছে। কোনো উপায় না পেয়ে আমি রৌদ্রময়ী প্রি নেটাল কোর্স এর ইনস্ট্রাক্টর রাবেয়া রওশিন আপুকে নক করলাম। আমার ডিটেইলস জানানোর পর উনিই প্রথম আমাকে VBAC সম্পর্কে ধারণা দিলেন। সময় নিয়ে খুব সুন্দর মত বুঝিয়ে বললেন। আপু পরামর্শ দিলেন ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ গুলোতে VBAC এর রিভিউ দেখার জন্য।
বি:দ্রঃ (আমি যখন প্রি নেটাল কোর্স করেছি তখন VBAC বিষয় টা কোর্সের আওতাভুক্ত ছিলোনা।
পরবর্তীতে চতুর্থ ব্যাচ থেকে VBAC সম্পর্কে আলাদাভাবে ধারণা দেওয়া হচ্ছে)।
pregnancy, birth & motherhood; BANGLADESH গ্রুপে VBAC সমন্ধে অনেকগুলো পোস্ট পেলাম।অনেক আপু সফলভাবে VBAC করিয়েছেন এবং তাদের রিভিউ শেয়ার করেছেন। আমি তাদের ২/৩ জনকে নক করলাম এবং তাদের এক্সপেরিয়েন্স ও পরামর্শ নিলাম।
যেহেতু আমার বাসা এয়ারপোর্টের কাছে। তাই উত্তরা বা এর আশেপাশের কোনো হাসপাতালে হলে ভালো হয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম প্রফেসর ডাক্তার সংযুক্তা সাহা ম্যাম উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বসেন। উনার রিভিউও ভালো পেলাম। দ্রুত সিরিয়াল নিয়ে উনার সাথে দেখা করলাম। প্রথম দিন চেক করার সময় উনি আমার পেটে হাত দিয়েই বললেন, মেঘলা…তোমার বাবুটা একটু লম্বাটে লাগছে। একেই বলে অভিজ্ঞতা। আলহামদুলিল্লাহ।হয়েছিলও তাই। আমার ছেলেটা অন্যান্য বাচ্চার তুলনায় ভালই লম্বা। আল্লাহুম্মা বারিক লাহু।
প্রথম ভিজিটে তিনি কিছু টেস্ট দিলেন যেগুলো দিয়ে বোঝা যাবে যে আমার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব কিনা এবং কোনো জটিলতা আছে কিনা। টেস্টগুলোর মধ্যে Vitamin D3, USG of pregnancy profile (to see scar thikness), blood sugar উল্লেখযোগ্য।
ওইদিনই রিপোর্ট পেলাম। Scar thikness ভালো থাকলেও দেখা গেল আমার Vitamin D3 এর লেভেল অনেক কম যার কারণে পায়ের পেশীতে খুব বেশি টান টান লাগতো। হাঁটতে, চলতে, উঠতে, বসতে খুব বেশি কষ্ট হতো।
✓scar thikness test- পূর্ববর্তী সিজারে জরায়ুর সেলাইয়ের জায়গার মাংসপেশির পুরুত্ব কতটুকু সেটা জানার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে যে টেস্ট করা হয় সেই টেস্টকে স্কার থিকনেস টেস্ট বলা হয়।
রিপোর্ট দেখে ম্যাম বললেন আমার নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা ৭৫%। আমার এবং বাচ্চার ওজন যেন বেশি বেড়ে না যায় এইজন্য শর্করা খাবার একদম কম খেতে বললেন। হাটাহাটি আর ব্যায়াম করতে বললেন। উনার সাহায্যকারী ইউটিউবে pregnancy easy exercise দেখিয়ে দিল। বললো ওগুলো দেখে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে। ঠিক প্রি নেটাল কোর্সে যে ব্যায়ামগুলোর কথা বলা হয়েছে। যদিও আমি সেভাবেই চলছিলাম। মাঝখানে কিছুদিন একটু গাফেল হয়ে গিয়েছিলাম যার ফলাফল জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস!
✓জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সংক্ষেপে GDM বিশেষ এক ধরনের ডায়াবেটিস, যেটি কিনা কেবল প্রেগন্যান্সিতেই হয়ে থাকে। হরমোনের লেভেল ও নতুন শারিরীক পরিবর্তনের কারনে মায়ের শরীর সঠিক পরিমান ইনসুলিন তৈরী করতে ব্যার্থ হয়। ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন, যা অগ্ন্যাশয়ে তৈরী হয়। এটি শরীরকে রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যখনি শরীর যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণও বেড়ে যায়। যাকে ডাক্তারী পরিভাষায় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বলা হয়। সাধারণত ডেলিভারীর পর এটা চলে যায়। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে টাইপ ২ এর মতো থেকেও যেতে পারে। তবে থাকুক, আর নাই থাকুক, অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মধ্যে থাকতে হবে।
আমার জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস এর মাত্রা ছিল ৭.৯। চেষ্টা করেছি এটা যাতে বেড়ে না যায়। লাস্ট মাসে শর্করার পরিমাণ একদম কমিয়ে দিয়েছিলাম। ডায়েটে ছিলো প্রচুর সবজি, সালাদ, ফল, ডাবের পানি। এরপর যতবার ব্লাড সুগার চেক করেছি ৪.৪ থেকে ৫.২ এর মধ্যেই ছিল আলহামদুলিল্লাহ।এরপর প্রতি সপ্তাহে ম্যামের কাছে গিয়েছি। ডেলিভারির দুই সপ্তাহ আগে উনি চেক করে বললেন যে, আমার জরায়ু মুখ একটু সরু মনে হচ্ছে তাই বেশি বেশি স্কোয়াট, আর অন্যান্য ব্যায়াম করতে।
আমার ইডিডি/EDD(Estimated Date of Delivery) ডেট ছিল এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ। লাস্ট যেদিন ভিজিটে গেলাম তখন ম্যাম বললেন এপ্রিলের ১৫ তারিখে ভর্তি হওয়ার জন্য। কারণ ১৬ তারিখ উনি সময় দিতে পারবেন এবং ইন্ডিউস দিয়ে নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করবেন। আর বলে দিলেন এর মাঝে যদি পেইন উঠে বা পানি ভেঙে যায় তবে দ্রুত উনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
বিগত প্রায় এক সপ্তাহ থেকে আমার হুয়াইট ডিসচার্জ যাচ্ছিল। কাকতালীয়ভাবে এপ্রিলের ১৫ তারিখ সকাল ১০ টার দিকে আমার পানি ভাঙ্গা শুরু হল। ম্যামকে জানালাম। উনি হসপিটালে যেতে বললেন। হসপিটাল ব্যাগ রেডি করা ছিল। মেয়ের আর ওর বাবার কিছু কাপড় ব্যাগে ভরে নিলাম। মেয়েকে গোছল করিয়ে খাইয়ে দিয়ে আমিও গোছল সেরে নিলাম। এর মাঝে আমার হাসব্যান্ড অফিস থেকে বাসায় চলে এলো। ওইদিন ছিল দ্বিতীয় রমাদান। রোজা রেখেছিলাম। বের হওয়ার আগে আম্মু আমাকে জোর করে একটু ভাত খাইয়ে দিল। দুপুর ২ টা নাগাদ আমরা হসপিটালে পৌছালাম। ভর্তি হওয়ার পর পরই আমাকে লেবার রুমে ঢুকানো হলো। যদি ব্লাড লাগে এইজন্য ক্রস ম্যাচিং এর জন্য ব্লাড নেওয়া হলো, ক্যানোলা করা হলো। তারপর আমার পেটে বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করার মেশিন লাগিয়ে দেওয়া হলো। যেহেতু পানি ভেঙে গিয়েছিল তাই আধা ঘন্টা পর পর বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করা হচ্ছিল।
আমি লেবার রুমে শুয়ে অনবরত দোয়া পড়ে যাচ্ছি। ওদিকে আমার মেয়েটা কখনো এতক্ষণ ধরে আমার থেকে আলাদা থাকে নি তাই বারবার আমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। মায়ের কাছে যাবে বলে ওর বাবার কাছে বায়না করছিল। আমার বাবা ওকে নিয়ে বাইরে ঘুরাঘুরি করে ওকে আমার কথা ভুলিয়ে রাখছিল। রোজা অবস্থায় একবার কেবিনে, একবার লেবার রুমের বাইরে, একবার ওষুধের দোকানে যাতায়াত করতে করতে আমার স্বামীর বেহাল দশা। আর আমার মেয়েটাকে সামলাতে সামলাতে আমার আব্বু আম্মুর বেহাল দশা।
আমি যে একটু মেয়েটার কাছে যাবো সে উপায়ও নেই। অনবরত পানি ভাঙছে এবং একটু পর পর বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করা হচ্ছে। বিকালবেলা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে বলা হলো। আমাকে আল্ট্রা রুমে নিয়ে যাওয়া হল এবং সেখানে প্রায় চার ঘন্টা পর আমার মেয়ের সাথে দেখা হলো। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করলাম। কিন্তু আমার হাতে ক্যানোলা করা দেখে ও কি বুঝলো জানিনা! আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকলো না! এরপর আমি আল্ট্রা রুমে ঢুকলাম আর ডাক্তার চেক করা শুরু করলেন। আমি বারবার জিজ্ঞেস করছি বাচ্চার কি অবস্থা। উনি বললেন পানি অনেকটা কমে গেছে আর বাচ্চাটা একদম কুকড়ে আছে তাই যা করার দ্রুত করতে। বাকি রিপোর্ট দেওয়া হবে ইফতারের পর।
আমি ফিরে গেলাম লেবার রুমে। আমাকে বেডে রেখে নার্স আর ডাক্তাররা সবাই ইফতার করতে চলে গেলো। আমি শুয়ে শুয়ে দুয়া পড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এসে আমাকে ইফতার দিয়ে গেল। ইফতারের পর আবার বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করা হলো। ততক্ষণে পানি ভাঙ্গা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি ভাবলাম যেহেতু আর পানি ভাঙছে না তাই একটু হাঁটাহাঁটি করলে হয়তো ভালো লাগবে। আমি উঠে একটু হাটতে লাগলাম। আমাকে হাটতে দেখে একজন নার্স এসে বলল আপনি হাঁটছেন কেন? শুয়ে থাকুন। আমি বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়লাম আর ভাবতে লাগলাম পানি ভাঙলে কি হাটাহাটি করা যায়না নাকি? বাধ্য হয়ে শুয়ে শুয়ে দোয়া পড়তে লাগলাম আর ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে লাগলাম। মনে পড়ে লেবার রুমে ঢুকার পর থেকে ডেলিভারির আগ পর্যন্ত পুরো সময় একটু পর পর পানি পান করেছি আর ব্রিদিং এক্সারসাইজ করেছি।
সন্ধ্যার পর রিপোর্ট আসলো এবং ম্যাম কে জানানো হলো। ম্যাম বললেন উনি এগারোটার দিকে এসে চেক করে যা ব্যাবস্থা নেওয়ার তাই করবেন। প্রায় ১২ টার দিকে ম্যাম এসে চেক করে বললেন যে আমার জরায়ু মুখ খুলতে শুরু করেছে। ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত খুলেছে তাই অপেক্ষা করতে হবে। একঘন্টা পর ডিউটিরত ডাক্তার এসে চেক করলেন এবং বললেন ৬ সেন্টিমিটার খুলেছে। আলহামদুলিল্লাহ ডায়ালেশন খুব দ্রুতই হচ্ছিল। রাত প্রায় ২ টার দিকে ম্যাম এসে চেক করে বললেন ৮ সেন্টিমিটার খুলে গিয়েছে।
একটু পর পর ব্যথা আসছে আবার চলে যাচ্ছে। আমি শুধু চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকছি। থেকে থেকে ব্যাথার ওয়েভ আসছে আর আমি কুকড়ে যাচ্ছি। প্রবল ব্যাথার চোটে আমি যেন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলাম। চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গিয়েছিল। ওদিকে আমার চিৎকার শুনে দায়িত্বরত নার্স সফেদা খালাও দোয়া পড়তে লাগলেন এবং আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। উনাকে পাশে পেয়ে যেন একটু স্বস্তি পেলাম। যখনই ব্যথা ওঠে তখনই আমি চিৎকার দিয়ে খালাকে জড়িয়ে ধরি এবং উনি পরম মমতায় আমাকে বুকে আগলে রাখেন। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর ম্যাম আসলেন এবং বললেন পেইনলেস করে দেওয়ার জন্য। এরপর ইনজেকশন দেওয়া হলো। ব্যাথা অনেকটাই কমে গেল। প্রায় আধঘন্টা পর আবার পেইন শুরু হলো। আমি পেলভিক রক স্টাইলে বেডের উপর উপুড় হয়ে রইলাম। অনেকটাই আরামবোধ করলাম। যদিও আমার তখন ঐ ব্যায়াম টার কথা মনে ছিলনা। ব্যাথার তীব্রতায় আরামবোধের জন্য মনের অজান্তেই ওই পজিশনে চলে গিয়েছিলাম। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে ডিউটিরত ডাক্তার এসে বললেন আপনি ওভাবে আছেন কেনো? আমি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। একবার মনে হচ্ছিল কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিই। লেবার পেইন এর সময় যেখানে মাকে হাঁটাহাটি এবং ব্যায়ামের জন্য উৎসাহিত করা হয়, সেখানে একজন একজন ডিউটিরত ডাক্তার কিভাবে এরকম করে বলতে পারে! নাকি তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই জানেন না? পরবর্তীতে ব্যথার প্রগাঢ়তায় তাকে আর কিছু বলার সুযোগ হয়নি।
এরপর প্রায় ৩.৫০ এর দিকে ম্যাম আসলেন। চেক করে বললেন ১০ সেন্টিমিটার খুলে গেছে কিন্তু বাচ্চা নিচের দিকে নামছে না। তারমানে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। এটা আর কোনভাবেই নরমালে সম্ভব হচ্ছে না। সিজার করতে হবে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এতো কষ্ট করে লাস্ট এ এসে এমন কথা শুনে আমি একদম হতাশ হয়ে গেলাম। তখন ডিউটিরত ডাক্তার আর আয়া আমাকে ধরে জোরে জোরে হাটানো শুরু করলো। এতটা সময় পার হলো তারা একবারও আমাকে হাঁটতে বলেনি। আমি যখন হাঁটছিলাম তখন মানা করেছে। এখন শেষ বেলা এসে আমাকে জবরদস্তি হাটাচ্ছে। অবশ্য হাঁটার ফলে কিছুক্ষন পর মনে হলো প্রেসার আসছে। আমি বসে পুশ করলাম। হালকা একটু ব্লাড আসলো। তারপর আবার উঠে হাঁটলাম। কিন্তু এবার আর কোনো প্রেসার ফিল করলাম না।
ম্যাম আমার স্বামী এবং আমার বাবা মাকে ডাকলেন এবং বললেন সিজার করতে হবে। বাচ্চা নিচে নামছে না। সবাই সম্মতি জানালো।
খুব দ্রুত ওটি রেডি করা হলো। আমার ডেলিভারির দৌড়াদৌড়িতে কেউই ঠিকমত সাহরী খেতে পারলোনা। সবাই কোনরকম দুই এক লোকমা খাবার আর পানি খেয়ে দ্রুত ওটি তে আসলো। ওটির বেডে শুয়ানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মানতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না। মনে হচ্ছিল এখনই হয়তো কোনো মিরাকল ঘটবে। কিন্তু আমার ভাবনার রাজ্যে ছেদ ঘটিয়ে এনস্থেশিয়া দেওয়া হলো। আমার অর্ধেক শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার আমার চোখে পানি ঝরঝর করে পড়তে লাগলো। একদিকে আমি শীতে কুকড়ে যাচ্ছি আরেকদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। উহ…কি দুর্বিষহ সময়!
ভোর ৪.১৫ তে সিজার করা হলো। সিজারের পর দেখা গেল যে বাচ্চার গলায় দুই রাউন্ড কর্ড প্যাঁচানো।
উল্লেখ্য যে……কর্ড প্যাঁচানো থাকলেই যে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না, তা কিন্তু নয়। কর্ড প্যাঁচানো থাকলেও অনেক নরমাল ডেলিভারি হয় এবং হচ্ছে। আমার বড় জায়ের তিনটা বাচ্চার গলায়ই কর্ড প্যাঁচানো ছিল তারপরও তার তিনটাই নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। কর্ড প্যাঁচানো থাকলে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা বাচ্চা ও মায়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, বাচ্চা দূর্বল হয়ে যেতে পারে, পানি বেশি কমে যাওয়া, বাচ্চার পজিশন ঠিক না থাকার কারণে সিজার বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
ফিরে আসি লেবার রুমে। আমার ৩৮ সপ্তাহের প্রেগন্যান্সির আলট্রাসনোগ্রামে বাচ্চার গলায় কর্ড প্যাঁচানো ছিল এটা বোঝা যায় নি! আল্ট্রাসনোগ্রামে বুঝা গেলে এতগুলো মানুষকে এত সময় ধরে কষ্ট করতে হতো না। অনেক আগেই একটা ব্যাবস্থা নেওয়া যেত!
আমি অবাক হয়েছি ম্যামের দায়িত্বশীলতা দেখে। ওদিকে সেন্ট্রাল হসপিটালে একজন ভর্তি VBAC এর জন্য আর এদিকে আমি। এর মাঝে প্রায় ১০০+ মানুষ সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছে হাসপাতালে ম্যামকে দেখাবে বলে। একে তো রমাদান মাস তার উপর লকডাউন। রোগী দেখার পাশাপাশি একবার দৌড়ে আমার খোঁজ নিয়ে যান আবার সেন্ট্রালে দৌড় লাগান। এর মাঝে শাড়ি পরে সাজুগুজু করেও থাকেন ! একটা মানুষ কি করে এত কিছু সামাল দেন আল্লাহ ভালো জানেন! আল্লাহ ম্যামকে দীর্ঘ হায়াত দান করুন আমিন।
আমি আমার ছেলের কান্নার আওয়াজ পেলাম।আলহামদুলিল্লাহ বলে আমার বাচ্চার জন্য বরকতের দোয়া করলাম। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম!
ঠিক কতক্ষন পর আমার বাচ্চাকে আমার কাছে আনা হয়েছিল জানিনা। আমি ঘুমের ঘোরে বাচ্চাকে হালকা চোখ মেলে দেখলাম। নার্স ওকে ব্রেস্টফিডিং করিয়ে আম্মুর কাছে দিয়ে আসলো।
আমি ঘুমের ঘোরে একটু পর পর পানি পানি করে চিৎকার করছি। কিন্তু কেউ আমাকে পানি খেতে দিচ্ছেনা। সেলাইন লাগানো অবস্থায় পানি দেওয়া যাবেনা। কিন্তু আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে পরিস্থিতি কল্পনা করলেও গা শিউরে উঠে। এরমাঝে আম্মু আর একবার এসে বাবুকে ব্রেস্টফিডিং করিয়ে নিয়ে গেছে।
সকাল দশটার দিকে আমাকে কেবিনে দেওয়া হলো। মেয়েটা ওর ভাইয়ের সাথে খেলছিল। ছোট ভাইকে কাছে পেয়ে ও কতটা খুশি সেটা ওর চোখে মুখেই ফুটে উঠছিল। আলহামদুলিল্লাহ।
আমি কতবার আমার মেয়েটাকে ডাকলাম আমার কাছে আসার জন্য। কিন্তু আমার হাতের ক্যানোলা, সেলাইন এসব দেখে ও আমার কাছে আসতে চাইলো না। হয়তো বুঝেছে যে, মা ব্যথা পাবে। আমি আল্লাহর শোকর করলাম। আলহামদুলিল্লাহ। মনে হচ্ছিল এক দিনেই মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। একটু পর পর ওর ভাইকে হাত দিয়ে ধরছে, আদর করছে। ছেলেটা কান্না করলে বড়দের মত শান্তনা দিয়ে বলছে….ও..ও..বাবু কাঁদে না কাঁদে না।
তিন দিন হাসপাতালে থাকার পর আমরা বাসায় চলে আসলাম। আলহামদুলিল্লাহ দ্বিতীয় দিন থেকেই বাবু পর্যাপ্ত দুধ পাওয়া শুরু করেছিল। ব্রেস্টফিডিং নিয়ে তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
এরপর সপ্তম দিনেই বাবুর আকীকা করে ফেললাম। ওর ঘন কালো চুল গুলো ফেলে দিলাম। ওর সুন্দর একটা নাম রাখলাম। আলহামদুলিল্লাহ ছেলেটা আমার আল্লাহর পক্ষ থেকে এক উত্তম নিয়ামত। আল্লাহ ওকে একজন দ্বীনের দায়ী হিসেবে কবুল করুন আমিন। সুম্মা আমিন।
উম্মু আরওয়া
প্রি নেটাল কোর্স, প্রথম ব্যাচ
Other post
You may also like
রংধনু রঙের খেলনাগুলো
ছোটবেলায় আমাদের নিকট প্রকৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি ছিলো, তা হলো সাত রঙের রংধনু। কারণ অধিকাংশ সময় বৃষ্টির দেখা মিললেও, বৃষ্টির পরের রংধনুর দেখা মিলতো খুবই কম। তাই যে জিনিস খুব কম দেখা যায়, সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণও থাকে সবচেয়ে …
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …