
আমার মা হবার গল্পটা যতটা না প্রচেষ্টার, তার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসের…
আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি যে হাদীসদির সত্যতা প্রমাণ পেয়েছি তা হলো, রাসূলুল্লাহ্ বলেছেনঃ আল্লাহ্ বলেনঃ আমার সম্পর্কে আমার বান্দার যেমন ধারণা, আমি তেমনই ব্যবহার করে থাকি। [সহীহ বুখারী: ৭৫০৫]
নরমাল ডেলিভারি – এক স্বপ্নের নাম সবার কাছে বর্তমানে। কারণ পরিবারে আশেপাশে সবখানেই দেখি শুধু সিজারিয়ান ডেলিভারি। সিনিয়র সকল কাজিনদের যেখানে সিজারিয়ান ডেলিভারি, সেখানে আমি তাদের সবার ছোট, আদর আহ্লাদে তুলুতুলু করে বড় হওয়া বাবা মার একমাত্র মেয়ে, আপুরা ভাবতেই পারত না, আমার নরমালে বেবী হওয়া সম্ভব।
আমার মা হওয়ার গল্পটা আল্লাহ কতটা সহজ করেছিলেন তা বোঝাতে একটুখানি পেছনে যেতে হবে…
মাস্টার্স চলাকালীনই জব হয়ে গেল। ঢাকাতে চলে আসলাম। ডিসেম্বর এর ১১ তারিখ জয়েন করলাম। তার দু’দিন আগে ৯ তারিখ থেকে আমাদের টোনাটুনির সংসার শুরু। মাস ছয়েক পর, জুন মাস। ১ তারিখে মোটামুটি একাডেমিক ঝামেলা শেষ। মানে মাস্টার্স এর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। অবশিষ্ট রইল শুধু থিসিস। ল্যাবের কিছু কাজ শেষে ৩ তারিখ খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরলাম। এদিকে ১১ তারিখে আমার জবের কনফার্মেশন হলো। এ মাসেরই ২২ তারিখের দিকে দিন ১৫ এর জন্য আমার শশুর শাশুড়ী বেড়াতে এলেন আমাদের ঢাকার বাসায়। ২৫ তারিখ পিরিয়ডের ডেইট ছিল। মিস…
সেরকম কিছু ভাবিনি। ব্যাকপেইন হয় হালকা, অফিসের ডক্টর দেখালাম, ডক্টর কিছু টেস্ট দিলেন, সেগুলো দেখে ভিটামিন ডি, ফলিক এসিড এ জাতীয় কিছু সাপ্লিমেন্ট দিলেন। ২ তারিখে অফিসে বমি বমি পাচ্ছিল, লাঞ্চ এর পর ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। এদিকে শশুর শাশুড়ী ওইদিন ঢাকাতেই আমার ফুপু শাশুড়ীর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাড়িতে শুধু আমরা দুজন। রাতে কী মনে করে ওকে বললাম কীট কিনে আনতে। কীটের গায়ে লেখা – কয় সেকেন্ড অপেক্ষা করতে দুটো লালদাগের জন্য।
আমার কোন অপেক্ষা করা লাগল না। রকেট স্পীডে দুটো স্পষ্ট লাল দাগ উঠে গেল। কেমন যেন স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। ওকে বললে ও সাথে সাথে আরও দুটো ভিন্ন কোম্পানির কীট কিনে নিয়ে এল। আবারও সাথে সাথেই দুটো লাল স্পষ্ট দাগ। রাত তখন ১২ টা পার। কোভিডের জন্য যেহেতু জীবন থেকে দুটো বছর হারিয়েছি, সংসার শুরু করতে দেরী হয়েছে, বেবীর ইচ্ছা মনে মনে ছিল, কিন্তু সুযোগ করে উঠতে পারছিলাম না, ভেবেছিলাম মাস্টার্স এর থিসিস শেষে মানে আরো মাস ছয়েক পর বেবী নেয়ার চেষ্টা শুরু করব। পুরাই আনপ্লানড প্রেগ্ন্যাসি আলহামদুলিল্লাহ। শশুর শাশুড়ীকে ওই রাতেই আমার উনি বাসায় চলে আসতে বললেন। শাশুড়ী মা ছেলের পাগলামি দেখে ফোনের ওপারে হেসেই খুন।
আমার শশুর শাশুড়ী আমাদের বাসাতেই শিফট করে চলে এলেন। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় জব করে, সংসারের কাজ করে, নতুন সংসার, খুব একটা কাজ পারিনা তাড়াতাড়ি তাই একা তো পারব না। আমার শাশুড়ি ‘মায়ের মত’ বললে ভুল হবে। উনি আমার মা ই। এত যত্ন করেছেন। রান্না তিনি করতেন। আমি খুব মাঝে মাঝে হালকা কিছু করতাম। অফিসে ঘনঘন ক্ষুধা লাগত। ৩ রকমের টিফিন তিন টাইমের জন্য প্যাক করে দিতেন। পেয়ারা কেটে তাতে লবণ মাখিয়ে টিফিন বক্সে ভরে আমার ব্যাগে দিয়ে দিয়েছেন, এত যত্ন!
আল্লাহর পরিকল্পনা বেস্ট ছিল। তাই থাকে আসলে…
এবার চিন্তা থিসিস কিভাবে শেষ করব সেই খুলনা গিয়ে। এক সিনিয়র আপু ছিলেন একদম আপন বোনের মত রিলেশন। আপুরও বেবী হওয়ার জন্য একটু গ্যাপ দিয়েছিলেন, আমাদের সাথে মাস্টার্স শেষ করার ইচ্ছা। আপু ল্যাবের কাজ শুরু করল। আমি অফিস থেকে বৃহস্পতি আর রবি ছুটি নিয়ে চারদিনের জন্য খুলনা গেলাম। তখন সারে চার মাসের প্রেগ্ন্যাসি আমার। এদিকে ওইযে ফাইনাল পরীক্ষার পর দু-তিন দিন ল্যাবের কাজ এগিয়ে রেখে এসেছিলাম। আবার ঢাকায় ফিরে দিন ১৫ পর একবারে ৯ দিনের ছুটি নিয়ে আল্লাহর নাম করে খুলনা গেলাম। এই শেষ ছুটি। নতুন চাকরি তো, ইম্প্রেশনের ব্যাপার আছে, খুব একটা ছুটি নেয়া যাবেনা, তার উপর কনফার্মেশন হতে না হতেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি। কাজ শেষ হলে হবে না হয় মাস্টার্স বাদ।
যাই হোক, যে কাজ আমার অন্য ব্যাচমেটরা ২/৩ মাসে শেষ করেছে সেই কাজে আমাকে ১৫ দিন টাইম দেয়া লাগল মাত্র। সবাই ভয় দেখাচ্ছিল, রেজাল্ট আসছে না ল্যাবের টেস্ট গুলোয়, তবে আমার আল্লাহর উপর অগাধ ভরসা ছিল। আমি জানতাম অলৌকিক কিছু হলেও হবে। আমার সাথে আল্লাহ সবসময় এমনই করেন আলহামদুলিল্লাহ। সুপারভাইজার স্যার অনেক ইজি করে দিয়েছিলেন আমার কাজ, অথচ তাকে সবাই জমের মত ভয় পায়, আমার বেলায় আল্লাহ তার মন পানির মত গলিয়ে দিলেন। যে টেস্ট তিনবার করা লাগে, তা তিনি একবারেই এক্সেপ্ট করেছেন। সিনিয়র আপু অনেক হেল্প করেছে। সব মিলিয়ে কিভাবে যেন রেজাল্ট চলে এল। সব ব্যাচমেট তো অবাক। এত দ্রুত রেজাল্ট কিভাবে সম্ভব! চাকরি করে, সংসার করে, বেবী পেটে নিয়ে সেই ঢাকা থেকে খুলনা এসে, অমন কড়া সুপারভাইজরের আন্ডারে থেকে কিভাবে আমার থিসিস হয়ে গেল!
থিসিসের ঝামেলা শেষ করে এবার ফিরে এলাম। ততদিন পর্যন্ত আমার সব মেডিকেল রিপোর্ট নরমাল। এনোমেলি স্ক্যান করালাম। ডক্টর ম্যাম বেশ ভালো ছিলেন। আমার হাজবেন্ডকে এলাও করলেন আল্ট্রাসাউন্ড রুমে। অনেকক্ষণ ধরে আমাদেরকে বেবীর মুভমেন্ট দেখালেন। প্রথমবার যখন ওর একটা স্পষ্ট অবয়ব দেখিয়ে ডক্টর বলল, এই যে আপনার বেবী, পা নাড়াচ্ছে, আমার মুখে হাসি কিন্তু চোখে পানি। আনন্দ অশ্রু যাকে বলে। ২৪ সপ্তাহ পর্যন্তও আমার সব রিপোর্ট ভালো, বেবীর ওয়েট সবসময় হালকা বেশীই থেকেছে।
২৪ সপ্তাহে এসে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। ডক্টর তেমন গুরুত্ব দিলেন না, কার্বোহাইড্রেট কম খেয়ে কন্ট্রোল করতে বললেন। আমার হাজবেন্ড শুরু থেকে প্রতিদিন আমার এত যত্ন করত নিয়ম করে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এবার তার যত্ন সকল সীমা অতিক্রম করে গেল। ডায়েট চার্ট বানালো ইনক্লুডিং ক্যালরির হিসাব, টাইম টু টাইম খোঁজ করা, সেইভাবে কেনাকাটা, বাড়ি মাথায় তুলে নিল একদম। ২৮ সপ্তাহে আর একটা আল্ট্রা করাই, তখনও ইনসুলিন বাদেই শুধু ডায়েটে সুগার কন্ট্রোলে মোটামুটি। বেবীর ওয়েট তখনও ভালো।
কষ্টের পালা শুরু হলো এবার। ৩০ সপ্তাহের দিক। এত কম ভাত খেয়ে কখনো কষ্ট করিনি। কী যে কষ্ট হত! কোনভাবেই সুগার কন্ট্রোলে থাকছিল না৷ ডায়াবেটিস স্পেশালিষ্ট দেখালাম, ইনসুলিন দিয়ে দিলেন। ইনজেকশন এ আমার জমের মত ভয় ছিল। সেই আমারই তিনবেলার সাথী হয়ে গেল ইনসুলিন। সাথে কার্ব কম তখনও রাখছিলাম, নাহলে সুগার কন্ট্রোল হচ্ছিল না। সে যে কী কষ্ট!
৩৭ সপ্তাহ। আল্ট্রাতে আসল বেবী ওয়েট কম বেশ খানিকটাই। আল্ট্রার ডক্টর ম্যাম আল্ট্রা করাতে করাতে একবার আমায় জিজ্ঞেস করলেন- পানি কম কেন হ্যাঁ? অথচ রিপোর্ট এ দেখি fluid ১২। সন্দেহ হলো। আমি রিপোর্ট পেয়ে আবার আল্ট্রার রুমে গেলাম fluid লেভেল শিওর হতে। ততক্ষণে ডক্টর লাঞ্চ ব্রেকে চলে গেছেন। কর্মচারী আপু ম্যামকে আমার সামনে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক পেশেন্ট এর কি fluid কম বলেছিলেন? ওই আপু নিজে রিপোর্ট লিখেছে, তারমানে সে নিজেও শিওর না। ম্যাম আর উনি ঝানাই পানাই আন্সার দিয়ে কোনরকমে আমাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “১২ তো, ফ্লুইড আরও থাকলে ভালো হয়, তাই কম বলেছি”। আমার মন মানল না, প্রিন্যাটাল কোর্স করছি, কোর্সে আমি এরকম শিখিনি, প্লাস আমার স্পষ্ট মনে আছে ম্যাম পানি যথেষ্ট কমের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আমায়। যে হসপিটালে ডায়াগনোসিস এর উপর আমি সন্তুষ্ট না সেখানে ডেলিভারি করাব না ডিসাইড করলাম কারণ ডেলিভারির দিনও তো ডায়াগনোসিস করতে হয়৷ ভুল রিপোর্ট আসলে তখন? ডক্টর ম্যামের উপরও আস্থা ততদিনে শেষ। ডায়াবেটিস নিয়ে তিনি একদম উদাসীন ছিলেন, আমার বেবী ওয়েট কম অনেকটা সঠিক পরামর্শের অভাবেই। ২.৫ কেজির কম হলে অনেক ক্ষেত্রে এনআইসিইউ লাগে। আমার হাজবেন্ড তো পাগল হয়ে গেল একরকম।
ডক্টর চেঞ্জ করলাম শেষ মাসে এসে আরেক টেনশন। বিআরবিতে ফয়েজা ম্যাম কে দেখাব সিদ্ধান্ত নিলাম। ইনি প্রথম থেকেই আমাদের ফার্স্ট চয়েস ছিল কিন্তু অনেক খরচ বিআরবিতে, প্লাস প্রথম ডক্টরকে আমার শশুর বাড়ির রিলেটিভ নিজে সাজেস্ট করেছিলেন, তার ডেলিভারি করিয়েছিল, প্লাস উনার ব্যবহারও খুব মিষ্টি ছিল, তাই। ফয়েজা ম্যাডাম দেখেই আবার আল্ট্রা দিলেন দেবজানী ম্যামের কাছে যাকে বেস্ট সনোলজিস্ট হিসেবে চেনে সবাই। আল্ট্রা করতে গিয়ে দেবজানি ম্যাম তো অবাক। আগের আল্ট্রা যেটা মাত্র ৫ দিন আগে করা তার সাথে fluid লেভেল মেলাতে পারল না। বলল, “আপনি আবার ৩০ মিনিট পর আসুন, আপনাকে আর একবার দেখব, মাত্র ৫ দিনে fluid এত কমার তো কথা নয়।” ২য় বার আল্ট্রা করিয়েও সেইম রেজাল্ট। Fluid ৬.৭। পরদিন ১১মার্চ, ফয়েজা ম্যামকে রিপোর্ট সহ দেখালাম। ম্যাম পিভি চেক করে বললেন সার্ভিক্স অলরেডি ১ সেমি খুলে গেছে। কিন্তু fluid কম। আমার ইডিডি ছিল ৩১ মার্চ। অতদিন বেবীকে পেটে কম পানিতে রাখলে অনেক সময় নিউমোনিয়া হবার চান্স থাকে। তাই ম্যাম জরায়ুর মুখ আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন যেটা পেইন আসতে হেল্প হয়। প্রাইমরোজ ওয়েল এর একটা ক্যাপসুল দিলেন ১০ দিন খেতে। এর মধ্যেও যদি পেইন না আসে তবে ২৩ তারিখ পেইন ইনডিউস করে ট্রাই করবেন ডক্টর।
এদিকে বেবীর ওয়েট কম। হাতে বেশি টাইমও নাই। র্যাপিডলি ওয়েট বাড়াতে সপ্তাহে দুটো করে প্রোটিনেক্স আল্ট্রা স্যালাইন দিলেন ইন্ট্রা ভেনাস। আমি তো নিজেকে একদম সুস্থ ভাবতাম। তাই তখনও অফিস করে যাচ্ছিলাম। জেনে অবাক হতো সবাই যে আমি রেগুলার ৬ তলায় আমার বাসায় সিড়ি দিয়ে উঠতাম। আমি এটাকে এক্সারসাইজ ভাবতাম, সিড়িতে দুই জায়গায় স্টুল রেখেছিলাম। একটু জিড়িয়ে নিতাম। আমাকে দেখে অফিসে সবাই অবাক হত এত ফিট কিভাবে দেখাই আমি। আসলে আমি মেন্টালি নিজেকে অসুস্থ কখনোই ভাবিনি।
সেই আমার fluid৬.৭! আর বেশি দিন বাকিও নেই। ১১ তারিখে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম। সেদিনও অামি ৬ তলায় সিড়ি দিয়ে উঠেছি। প্রিনেটাল কোর্সের আপুরা অনেক হেল্প করেছেন এই টেনশনের সময়টাতে। রেগুলার টেলিগ্রাম গ্রুপে আপডেট দিতাম, সব সমস্যা বলতাম, আপুরা হেল্প করেছেন অনেক। পানি খাওয়া শুরু করলাম দিনে ৫ লিটার আপুদের পরামর্শে, প্রেগকেয়ার স্যালাইন দিনে ২ টা। হাঁটাহাঁটি ব্যায়াম সব চলছে। ১৩ তারিখে ব্লাডি শো পেলাম। ফলস পেইন রোজ আসতে লাগলো। আমি রোজ ভাবতাম আজ কালের মধ্যে পেইন উঠে যাবে ইন শা আল্লাহ। কিন্তু আসে না। আসলে পেইন ওঠার প্রসেসে আমি ছিলাম, ঠিক টাইমে হয়তো পেইন ন্যচারালি চলে আসত, কিন্তু আমি যে ৩১ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না।
২২ তারিখে আল্ট্রা করাই ম্যামকে না জানিয়েই, যদি fluid বাড়ে তাহলে ৩১ তরিখ পর্যন্ত ওয়েট করব এই চিন্তা করে। নাহ, fluid বাড়ে নাই। ৬.৮ মাত্র।
সিজারের কথা আমি কখনো ভাবতাম না। যদিও কোর্স থেকে সিজারের জন্যও মেন্টালি প্রিপারেশন রাখতে বলেছিল। কিন্তু ভয় পেতাম সিজারকে৷ আমার কনফিডেন্স ছিল আল্লাহ আমায় সবসময় হেল্প করেন, আমার নরমালেই হবে ইন শা আল্লাহ।
২৩ তারিখ। পেইন এল না। সকাল ৯ টায় ব্যাগ গুছিয়ে হসপিটালে চলে গেলাম। ভাবছি, পেইন ইনডিউস করার পর কাজ না হলে তো আজই সিজার, কিন্তু আমি তো সিজারের জন্য মেন্টালি প্রিপারেশনই নেইনি, কী হবে?
ম্যাম পিভি চেক করে দেখলেন দেড় সেমি খোলা জরায়ুর মুখ। জেল দিলেন পেইন ইনডিউস করতে, দুপুর তখন ঠিক ১২ টা। আমরা ৪ জন পেশেন্ট লেবার রুমে, ৪ জনকেই একই সাথে জেল দেয়া হলো। আমার আলহামদুলিল্লাহ ১ মিনিট যেতে না যেতেই পেইন আসা শুরু হলো৷ বাকিদের কোন ভাবই নেই। আমি হাঁটাহাঁটি করছিলাম যতটা পারি হাজবেন্ড আর আম্মুর হাত ধরে। প্রথম দিকে ৫ মিনিট পর পর ১৫/২০ সেকেন্ড পেইন আসছিল। মানে শুরু থেকেই আমার ফ্রিকোয়েন্সী অনেক বেশি পেইনের। আসরের নামাজ পরলাম। নামাজের মধ্যে ২ বার পেইন আসল, কিভাবে যে নামাজ পরলাম, সে কী কষ্ট! অন্য পেশেন্ট দের ১৫/২০ মিনিট পর পর পেইন আসছে, বাকি ২ জনের পেইনই আসে নাই। এদিকে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি পেইন সামলাতে গিয়ে ৩/৪ মিনিট পর পর। সন্ধ্যা ৬ টা, সাড়ে ৪ সেমি জরায়ুর মুখ খুলেছে। ম্যাম জেল দিলেন আবার সেকেন্ড ডোজ।
এবার পেইন আসতে লাগল এক দেড় মিনিট পরপর ৪৫/৫০ সেকেন্ড, আস্তে আস্তে এক দেড় মিনিট করে। কষ্ট সহ্যের বাইরে। পর্দা আকড়ে ধরছিলাম যখন পেইন আসছিল, দোয়া ইউনুস পরছিলাম কিন্তু একসময় সেটাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। শুধু “আল্লাহ আল্লাহ” বের করতে পারছি। বাকি পেশেন্টদের এত ঘনঘন পেইনও আসছে না, প্রগ্রেসও ভালো না এত, এদিকে আমার জরায়ুর মুখ ৭ সেমি খুলে গেছে আলহামদুলিল্লাহ।
মাগরিবের নামাজের জন্য ওযু করে এলাম, কিন্তু ৩ রাকাত নামাজও শেষ করতে পারলাম না। আমি শুরু থেকে পেইন ম্যানেজমেন্ট এর সবরকম ট্রিকস ফলো করছিলাম। কিন্তু এ পর্যায়ে আর কিছুই পারছিনা। হাজবেন্ড আর আম্মুকে ডাকলাম। হাজবেন্ড দেখে আমি রীতিমতো থরথর করে কাঁপছি, পেইন আসলে নিজেকে রিল্যাক্স করার বদলে আরও নিজেকে শক্ত করে ফেলছি।
তখন বাজে ৭ টা। পেইনলেস এর ইনজেকশন নেয়ার অপশন ছিল, কিন্তু আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম নিব না। কিন্তু এ পর্যায়ে ডক্টর বললেন আমি যেভাবে নিজেকে শক্ত করে ফেলছি তাতে জরায়ুর মুখ খুলবে না, আর এভাবে ফাইট করতে করতে পুশিং স্টেজে আসতে আসতে ততোক্ষণে সব এনার্জি হারিয়ে ফেলব, সিজার করা লাগবে তখন। এদিকে ৮ বা সাড়ে আট সেমি খুলে গেলে পেইনলেস দিয়েও কাজ হয় না। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আসলে ন্যাচারাল পেইন আর ইনডিউজড পেইন আলাদা। বডি এডজাস্ট করতে পারছিল না। অনেক বেশি ফ্রিকুয়েন্টলি আর অনেক বেশি ডীপ পেইন আসছিল। আর পারলাম না। মাত্র ঘণ্টা খানেকের কাছে আমি মাথা নত করলাম।
পেইনলেস ইনজেকশন (এপিডুরাল) নিলাম। যদিও খুব অল্প ডোজ, শুধু লোডিং ডোজ লেগেছিল আমার, মেইনটেনেন্স ডোজ লাগেনি যেহেতু অলরেডি জরায়ুর মুখ সাড়ে সাত সেমি খুলে গেছে। ঘণ্টা খানেক কিছুটা সহ্য করার মত অবস্থায় ছিলাম পেইনলেস এর রিয়্যাকশনে। তারপর আবার সেই একই ব্যাথা, ওই যে, পুশিং স্টেজের আগে পেইনলেস আর কাজ করেনা, তখন সব ন্যাচারালি এগোতে থাকে। তখন সাড়ে আট টা।
৮.৪৫ এ জরায়ুর মুখ ফুল ডায়ালেটেড। পুশিং রুমে নিয়ে গেল আমায়। পুশ করতে চেষ্টা করলাম সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। কতটা শক্তিশালী যে একজন মেয়ের হওয়া লাগে এই স্টেজে! মেয়েরা নাকি দুর্বল! আমি আল্লাহু আকবর বলছি আর এক একটা পুশ দিচ্ছি। কিন্তু ইনাফ হচ্ছে না। প্রায় ১৫ মিনিট। আমার মনে হচ্ছিল আর পারব না, এতক্ষণেও কেন পারছি না আমি। শেষে নার্সরা বলল, আপনি একটু চেষ্টা করুন আরও দ্রুত কারণ বাচ্চার হার্টবিট কমে যাচ্ছে এ পর্যায়ে। তখন তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া অবস্থা। আমি শেষ শক্তি দিয়ে পুশ দিলাম জীবনের সবচেয়ে জোরে। এদিকে নার্স একজন পেট থেকে নিচের দিকে এত জোরে চাপ দিল মনে হলো আমার পাজরের নিচের দুই তিনটা হাড্ডি শিওর ভেঙে গেছে, একই সাথে ম্যাডাম সাইড কাটলেন সামান্য। তিনদিক থেকে চেষ্টায় অবশেষে একটা
কান্নার আওয়াজ।
আলহামদুলিল্লাহ। রাত ৯.০৫। সাইড কাটার সময় আমার পারমিশন নিলেও কখন কেটেছে আমি টেরও পাইনি, আসলে ওই পেইনের কাছে এই সামান্য পেইন কিছুই না। পরে সেলাই করার সময় বুঝলাম সাইড কাটা হয়েছে, কনফিউশান ক্লিয়ার হলো।
আমার সকল ব্যাথা, কষ্ট পানি হয়ে গেল একটা চেহারা দেখে। জুওয়াইরিয়া মিনহা। ক্রন্দনরত আমার সন্তানের মুখটা প্রথম দেখাতেই দেখি, এ তো হুবহু আমি নিজে, চোখ, নাক, ঠোঁট সব, আমিই তো আরে। কার্বনকপি৷ আমার বুকের উপর রাখতেই সে কান্না থামিয়ে দিল। আমাকে চিনেছে।
ওকে নিয়ে গেল সবাইকে দেখাতে। আমাকে সেলাই দিয়ে মিনিট ১০ পরে হুইল চেয়ারে নিয়ে গেল পরিবারের সবার কাছে। আমি কাঁদছি। আমার শাশুড়ি বলছে- কাঁদছো কেন, তুমি successful! আম্মু বলছে – তুমি জান্নাত পেয়ে গেছো। কিন্তু আমি কাঁদছি। আহ্লাদে কাঁদছি আসলে৷ আদরে লুতুপুতু ভাবে বড় হওয়া সেই আমি নরমালে একটা বেবী জন্ম দিতে পারলাম? আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আমার হাজবেন্ড আমার মাথায় হাত রাখতেই আমি বলে উঠলাম, “ও পুরো আমার মত হয়েছে”। এদিকে পরে ভিডিওতে দেখেছি, আমার হাজবেন্ড খুশিতে বেবীর কানে আযান দেয়ার সময় আযান ভুলে গেছিল এক লাইন।
সেলাইয়ের কষ্ট ১০ দিনেই ঠিক হয়ে গেছিল আলহামদুলিল্লাহ, নিফাস শেষ হবার আগেই সেলাই এর সুতা পড়ে গেছিল। তেমন কষ্ট একদমই করিনি। এখন তো সেলাই খুঁজেই পাই না, হা হা। তবে নার্স শেষ সময়ে বেবী বের জন্য যে চাপ দিয়েছিল তার জন্য পাজরের হাড্ডিতে ব্যাথ্যা ছিল প্রায় এক মাস।
বেবীর বয়স ৬ মাস এখন। অফিসও শুরু হয়ে গিয়েছে। অফিসেই ডে কেয়ার আছে। নিয়ে আসি বেবীকে। এর মাঝে বেবী হবার পর প্রেগ্ন্যাসি লীভেই থিসিস এর ব্লাক বুক লিখে কমপ্লিট করি। বাচ্চা ছোট বলে অনলাইনেই স্যার আমার ডিফেন্স নিয়ে নেন। কত বরকত তাইনা? সেই ১৫ দিনের প্রেসার ভুলবার নয়। তবে অফিস চলাকালীন সম্ভব ছিল না, ম্যাটারনিটি লীভের মধ্যে পড়েছিল বলে পেরেছি। মাস্টার্সও শেষ করলাম আমি আলহামদুলিল্লাহ। সব আল্লাহ সহজ করে দিয়েছিলেন বলে।
মিনহা আমার জীবনে বরকত, রহমত বয়ে এনেছে। পড়াশোনা, চাকরি, সংসার সব একসাথে সামলাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ। বড় পরিবার। শশুর শাশুড়ী দেবর আমরা সবাই একসাথে থাকি। তবে আমি এখন পর্যন্ত হা হুতাশ করিনা আর পাঁচটা মায়ের মত। বেবী হবার পর জীবনে প্যারা বেড়ে গেছে হ্যান ত্যান। এসব আমি মনেই করি না। আমি অনেক ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি সবসময় পজেটিভ ধারণা রাখি আমার রবের উপর। আর আল্লাহ সবকিছু আমার জন্য সহজ করে দেন আলহামদুলিল্লাহ।
রাতে ঘুম আগের মত আমারও হয় না। ডার্ক সার্কেল পড়েছে। সকালে বেবীর সকাল দুপুর দুই বেলার সলিড দুই রকম রেসিপি বানিয়ে অফিসে আসি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেও ১০ টা মিনিট রেস্ট পাইনা, ওকে দুধ খাওয়াই। ওর গোসল করাই। আমারও চুল পড়ে শেষ। আগের মত হাজবেন্ড এর সাথে ঘুরতে যেতে পারিনা। এমনও হয়েছে রেডি হওয়া শেষ, বেবী কান্না করছে, ট্যুর ক্যান্সেল। শশুর শাশুড়ির সাথে থাকলে অনেক স্যাক্সিফাইস করতে হয়। বুদ্ধি করে চলতে হয়। আমার আজ অব্দি কোনদিন কথা কাটাকাটি তো দূর মনোমালিন্যও হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।
জীবনটা সহজ? অফিস, বাচ্চা, পড়াশোনা, সংসার সব সামলিয়ে তবুও সবাই জানে আমি অনেক হ্যাপি। আমাকে দেখেই বোঝা যায়। শরীর একদম ফিট। পেটের মেদ নাই। ডায়াবেটিস বেবী ডেলিভারির দিনই ঠিক হয়ে গেছে। ওয়েট বেবী কনসিভ করার আগে ৫৫ ছিল। এখন ৫৬। অফিসে সবাই বেবী হবার পরও ফিগার এমন কিভাবে দেখে অবাক হয়।
হ্যাঁ, আমি পজিটিভ থাকি সবসময়। মূল কথা আমার আল্লাহর উপর অগাধ ভরসা। তাই হ্যাপি থাকি। আর আল্লাহ আমার লাইফ সহজ করে দেন অলৌকিকভাবে সবক্ষেত্রেই, আলহামদুলিল্লাহ।
উম্মে মিনহা
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স, ব্যাচ ১৫