ইন্ডাকশন ছাড়া ওভারডিউ ডেটে আমার নরমাল ডেলিভারির গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date October 14, 2023
- Comments 0 comment
আমার প্রথম সন্তান হয় রমজান মাসের এক মহিমান্বিত রাতে। দ্বিতীয় বার কনসিভ করি মহিমান্বিত রমজান মাসে। মন ভরে দুয়া করেছিলাম।
প্রথম প্রেগন্যান্সি তে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় টার সময় ৮ মাস জুড়ে বমি,অরুচি তে সম্ভব হয় নাই৷
প্রেগন্যান্সি জনিত ব্যাথার সাথে পূর্ব মেডিকেল কন্ডিশন মিলে চলাফেরায় ব্যাথা থাকতো নিত্যদিনই। আর সাথে ছিল প্রথম বাচ্চার সিভিয়ার ট্যানট্রাম৷ রাতে ছিল রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম যেটায় আমার পা নিজে নিজে কেপে উঠতো কিংবা আমি স্বস্তি পেতাম না শুয়ে, ছিল ইনসমনিয়া- ঘুম আসতো না, সাথে ছিল প্রচলিত ভাষায় ‘রগ টান’ খাওয়া। সে এক ভীষণ ব্যাথা!
রাতে টেইলর সিটিং, বাটারফ্লাই কিংবা স্কোয়াট পজিশনে বসে থাকতাম ৬ মাস থেকেই৷ এভাবে কিছুটা আরাম বোধ হত৷ সাথে খাবারের কিছু পরিবর্তন। এক্সারসাইজ গুলি প্রিনেটাল কোর্স থেকেই জানলাম৷ আগে ইউটিউবে দেখলেও কোনটার কি কাজ,কোনটা কখন আর কিভাবে এপ্লাই করব – এটা কখনও বুঝতে পারি নি৷ কিন্তু রাবেয়া আপুর ক্লাস করে বুঝতে পেরেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
সময় যেন কাটে না। ছোট আরেকটা বাচ্চার যত্ন নেওয়া, নিজের দিকে তাকানো,পড়াশোনা গোছানো – জীবন কেমন এলোমেলো লাগতো। ৩৭ সপ্তাহের শুরুতে আলট্রাসাউন্ড করাই৷ বাচ্চার হাইট,মাথার ডায়ামিটার, ওজন সব ই কম আসে, অতিরিক্ত কম। মন ভেংগে যায় আমার৷ তখন থেকে প্রোটিন ইনটেইক বাড়াই, ডেইলি যতটুকু দরকার হিসেব করে খেতে থাকি৷
এর মাঝে ৩৭,৩৮,৩৯ – পরপর ৩ সপ্তাহে ৩ টা ফলস লেবার হয় আমার৷ সাথে প্রতিদিন ফলস কন্ট্র্যাকশন চলতেই থাকে। পেলভিক এরিয়া তে ব্যাথা আর লিগামেন্ট স্ট্রেচিং সংগী সাথী। খুব টায়ার্ড লাগতো৷ ঘুম আসতো শুধু। মন খারাপ হত বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারছি না। শুধু ওর ডেইলি কাজ গুলি করে দিতাম৷ ওকে নিয়ে বিকেলে হাটতে চলে যেতাম৷ বাসায় হাটতে ইচ্ছা হত না এতক্ষণ। আর সাথে ডেইলি খেজুর খাচ্ছিলাম৷
ইডিডি কাছে চলে আসলো কিন্তু লেবারের কোন লক্ষন নেই৷ ডাক্তার পিভি করার সময় সার্ভিক্সে সুইপিং করে দিলেন যেন ন্যাচারালি পেইন আসে৷ বললেন চাইলে তখন বা দুদিন পর ইন্ডাকশন(ব্যাথা উঠানো) এর জন্য ভর্তি হতে পারি। বললাম আমি অপেক্ষা করতে চাই৷ ম্যাডাম বললেন সেক্ষেত্রে মুভমেন্ট কাউন্ট করে, ফ্লুইড লেভেল দেখে “সেল্ফ এসেসমেন্ট” করতে হবে।
আমার পাশে ছিল আমার প্রিনেটালের ইন্সট্রাক্টর ও এডমিন গণ৷ উনারা সবসময়ই মানসিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে সাহায্য করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। এই সময় টা খুব কঠিন! নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া৷ কাউকে পাশে লাগে যে সব জানে৷ যার কথায় ভরসা করা যায়৷ আলহামদুলিল্লাহ উনাদের পাশে পেয়েছি৷
আমি ফ্লুইড লেভেল দেখার জন্য ৪০ সপ্তাহে আরেকটা আলট্রাসাউন্ড করি৷ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চার ওজন,গ্রোথ সব নরমাল রেইঞ্জে মাত্র ৩ সপ্তাহে! আল্লাহর কত রহমত আমার উপর তিনি বাচ্চাকে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভে রেখে বেড়ে উঠার সুযোগ দিয়েছেন৷ ফ্লুইড লেভেলও পর্যাপ্ত।
আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই ,পিভি করার সময় সার্ভিক্স সুইপিং এর পর সেই রাতেই আমার মিউকাস প্লাগ খুলে৷ পরদিন সকালে ব্লাডি শো দেখতে পাই। বাসায় শুধু হাজব্যান্ড কে জানাই আর কাউকে না। কারণ শো এর ঠিক কতক্ষণ পরে লেবার প্রগ্রেস করবে এটা নির্দিষ্ট না। হয়ত ১-২ দিন লাগবে।
বাসায় জানালে তখন ই হাসপাতালে নিতে চাইতো৷ আর হাসপাতালে ইন্ডাকশন বা অগমেন্টেড করার সম্ভাবনা বেশি দ্রুত প্রগ্রেস করার জন্য
প্রথম লেবারে আমাকে অক্সিটোসিন দিয়ে অগমেন্টেড করা হয়েছিল অর্থাৎ ব্যাথা বাড়ানোর মেডিসিন। আমি এবার অক্সিটোসিন ছাড়া সম্পূর্ণ ন্যাচারাল একটা লেবার চেয়েছিলাম৷
হাজব্যান্ড কে বলে রাখলাম সব ঠিক থাকলে সন্ধ্যায় একটা চেকাপে যাবো৷ সে অফিসে চলে গেল৷ আমি হস্পিটাল ব্যাগ রিচেক করলাম সব নিয়েছি কিনা, বড় বাচ্চার ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম৷ ওর ডেইলি রুটিন ঠিকঠাক রাখলাম৷
খেজুর খাচ্ছিলাম ১-২ টা করে৷ এরপর বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে সিড়ি দিয়ে উঠানামা করলাম আধা ঘন্টা। রেস্ট নিয়ে শুরু করলাম হাটা। সব ই লেবার প্রগ্রেসের জন্য৷ বিকেলের দিকে বাসায় জানালাম৷ সন্ধ্যায় মাইল্ড একটা পেইন আসলো কিন্তু রেগুলার না।
রাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা৷ শ্বাশুড়ির কাছ থেকে জমজমের পানি নিয়ে নিয়ত করে খেলাম৷সুরাহ মারিয়াম তিলাওয়াত করলাম। ইশার নামাজ পড়ে ও দুই রাকাত নফল পড়ে বড় বাচ্চাকে রাত ১০.৩০ টায় খালার কাছে ড্রপ করে আমার হাজব্যান্ড ও মা সহ ১১ টার দিকে হস্পিটালে পৌছাই৷
সেখানে চেক করে জানা গেল আমার জরায়মুখ ২.৫ সেমি খুলেছে। আরেকবার সুইপিং করে দিলেন ডাক্তার। সেই রাতে আর কোন রোগী ছিল না আমি বাদে৷ আমি একা একা লেবার ওয়ার্ডে হাটতে লাগলাম। ১ ঘন্টা হেটে এসে খেজুর আর জমজমের পানি খাই। এরপর একটু রেস্ট নিই৷ আবার হাটি৷
এভাবে রাত ৩ টায় পেইন বাড়তে থাকে৷ রাত ৪ টায় বেশ ভালো পেইন আসা শুরু হয়। ওজু করে দুই রাকাত নফল পড়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যাথার তীব্রতায় দাড়ানোর শক্তি ছিল না, না ছিল পুব পশ্চিম চেনার মত বোধশক্তি তখন।
শুধু মনে হচ্ছিল বুকের উপর দুইটা হাত রেখে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি যেন অল্প সময়ে সহজ ভাবে অগমেন্টেড করা ছাড়া একটা নরমাল ডেলিভারি পাই৷
ডাক্তার কে ডাকলাম। চেক করে দেখলেন ৩ সেমি।ব্যাথায় তখন আমি চিৎকার দিচ্ছি। এরপর মাত্র ৩ সেমি এ এত ব্যাথা দেখে মন শক্ত করলাম। আর পিভি চেক করাবো না অতিরিক্ত পেইন ছাড়া ভাবলাম আর চিৎকার করলে ব্যাথা অসহনীয় হয়ে যায় তাই অন্য ভাবে সহ্য করব ভেবে নিলাম।
প্রিনেটাল কোর্সের এডমিনের লেবার স্টোরি থেকে জেনেছিলাম কিভাবে মারিয়াম আলাইহাস সালামের মত তিনি ব্যাথার সময় সামনের কিছু ধরে তাতে ধাক্কা দিয়ে ব্যাথা সহ্য করেছিলেন। আমিও সেটা এপ্লাই করলাম। আলহামদুলিল্লাহ এটা ভালো কাজ দিল।
আমি বেডের পাশে স্ট্যান্ড টা চেপে ধরতাম ব্যাথা আসলে। ব্যাথা চলে গেলে ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে যেত। আবার ব্যাথা আসলে পাগলের মত কম্বলে কামড় দিতাম। এক পর্যায়ে চুল ছিড়লাম কিন্তু টু শব্দ করিনি। যতক্ষণ পেরেছি “আল্লহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল ‘আফিয়া” পড়েছি।
৬ টার দিকে আমি ব্যাথার তীব্রতায় একা একা লেবার রুমের এন্ট্রি ডোরে চলে গেলাম এই আশায় যদি বাইরে হাজব্যান্ড কে একটু দেখতে পাই কিংবা আম্মুর হাত টা একটু ধরা যায়। আম্মু কেবিনে আর হাজব্যান্ড তখন হস্পিটালের মসজিদে৷
গার্ড মেয়েটা খুব ই হেল্পফুল ছিল। আমি ব্যাথায় তখন হাটতে পারছিলাম না৷ ও আমাকে ধরে ধরে বেড পর্যন্ত আনার পর আমি নিচে বসে পড়ি।
তখন ডিউটি ডাক্তার, নার্স, আয়া সবাই এসে আমাকে বকা দিয়ে বেডে বসতে বলে। ততক্ষণে আমি ১০ সেমি ডায়ালেটেড আর লেবারের সেকেন্ড স্টেইজে। কিন্তু যেহেতু কোন চিৎকার করা বা ব্যাথা হচ্ছে এমন ভাব দেখাই নি তাই কেউ বুঝতে পারে নাই।
আমি টয়লেটে যেতে চাইলাম। ওরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল। এটা একটা বিরাট ভুল কারণ সেকেন্ড স্টেইজে টয়লেটের যে প্রেশার আসে সেটা মূলত পুশিং টেন্ডেন্সি। আমি টয়লেটে বসে সেটা বুঝতে পারলাম কিন্তু ব্যাথায় তখন ঠান্ডা ভাবে ভাবার অবকাশ ছিল না তাও ডাক দিলাম ” মাসি আমাকে ধরেন।”
আমার ডাকে ৩ জন এসে ধরে বকা দেওয়া শুরু করে কারণ বাচ্চা টয়লেটে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। দ্রুত আমাকে লেবার টেবিলে শোয়ানো হল৷ এবার ধৈর্যের বাধ ভাংলো। চিৎকার সহকারে সেকেন্ড পুশে আমার মেয়ে দুনিয়ার আলো দেখলো আলহামদুলিল্লাহ।
কষ্টের সময় গুলিতে বারবার মনে হচ্ছিলো আম্মু বা বাচ্চার বাবা কে একটু পাশে পেতাম! একটু শুধু হাত টা ধরতে পারতাম!
আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলাম যেন ইন্ডাকশন ছাড়া ন্যাচারালি পেইন উঠে এমন নরমাল ডেলিভারি পাই আর ১০ সেমি ডায়ালেট হওয়ার আগে যেন চিৎকার না দিই।আলহামদুলিল্লাহ দুইটা দুয়া কবুল হয়েছে৷
আমার কাছে জমজমের পানি,খেজুর,দুই রাকাত নফল নামাজ খুব ইফেক্টিভ মনে হয়েছে।
নরমাল ডেলিভারি মানেই সব খুব সুস্থ এমন না৷ পেলভিসের জয়েন্ট এ ফাক হওয়ার জন্য যে পেইন, এপিশিওটমি হিলিং পেইন, জরায়ু আগের অবস্থায় আসার পেইন সব মিলে মাস তিনেক লাগে একটা সুস্থ অবস্থায় আসতে।
এই স্টোরি যারাই পড়বেন অনুরোধ পড়ার সাথে সাথে আমার জন্য দুয়া করবেন যেন আল্লাহ সারাজীবন আমার সন্তানদের দ্বীনের পথে কবুল করে নেন৷
আর জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই৷ ডেলিভারি নিয়ে জানুন, চেষ্টা করুন আর তাকদিরের মালিক আল্লাহ মেনে নিন৷
– উম্মে হামযা
প্রিনাটাল টিম মেম্বার
Other post
You may also like
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …
যেভাবে সন্তানকে ভালো রাখা যায়
আমার বাচ্চাটাকে কানাডাতে আলহা’মদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত রব্বুল আ’লামীন হিফাজতে রেখেছেন। আমি সাধারণত আমার বাচ্চাকে নিয়ে কখনও গর্ব করি না, তার ছবি পোস্ট করি না, খুব একটা কিছু লিখিও না। আল্লাহর আমানত, আমার অহংকার করার কিচ্ছু নাই। আজকে লিখছি, একটা বাচ্চা …