রবের উত্তম পরিকল্পনা
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date October 14, 2023
- Comments 0 comment
বিয়ের বয়স যখন ২ বছর তখন বাচ্চা নিয়ে ভাবনা শুরু করি। ভাবনাটা ছিলো এ আর এমন কি! হয়ে যাবে শীঘ্রই। আলহামদুলিল্লাহ আমাকে নিয়ে আমার রবের পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন।
কোন সংবাদ ছাড়াই এক বছর পার হয়ে গেলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। নিজেরা চিকিৎসক তবুও একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গেলাম। বললেন ওজন কমাতে এবং কিছু ওষুধ দিলেন। ভাবলাম ঠিক আছে তাহলে সমস্যা বের হলো। হয়ে যাবে শীঘ্রই। মাসের পর মাস যায়। প্রতি মাসেই অপেক্ষা করি, উত্তেজনা কাজ করে তারপর মন ভেঙ্গে যায়।
আস্তে আস্তে নিজের সাথে কিছু বোঝাপড়া শুরু হয়। ফরয ইবাদাত গুলো টেনেটুনে করা আমার মন তখন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়। কে সন্তান দেয়ার মালিক, কার কাছে চাইতে হবে, কখন সন্তান আসবে, সবার কি সন্তান হয়, সবার জন্য সহজ নয় কেন, সন্তান কি আনন্দ নাকি দায়িত্ব… বিভিন্ন প্রশ্ন। কুরআনের সন্তান নিয়ে দুআ গুলো খুঁজে বের করি। আয়াত গুলো অর্থসহ বুঝার চেষ্টা করতাম। আস্তে আস্তে কুরআন এর সাথে বন্ধুত্ব হচ্ছিলো। দুআ কবুল এর শর্তগুলো জানলাম।
এর মধ্যেই আমার রবের অশেষ কৃপায় আমার ও আমার পার্টনারের আল্লাহর ঘরে উমরাহ করার সুযোগ হলো। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। প্রিয় মক্কা মদিনা দেখে আসার পথে নিজেদের সাথে নিজেরা কিছু প্রতিজ্ঞা করে বসলাম। এর মধ্যে এই দুটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সর্বাবস্থায় হারাম থেকে বেঁচে থাকা ( এমনকি সেটা যদি এক টাকা ও হয়) এবং গান শুনা পরিত্যাগ করা।
আল্লাহ এর ঘর থেকে আসার পর আমাদের জীবনযাত্রায় এক আমূল পরিবর্তন আসলো এবং খুব কাকতালীয়ভাবে আমাদের দুজনের একসাথে হালাল চাকরীর ব্যবস্থা হয়ে গেলো যা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছুই না। চলে গেলাম ঢাকার বাইরে। শুরু হলো নতুন জীবন।
এর মধ্যে করোনার জন্য চিকিৎসা বন্ধ ছিলো। তখন আমরা জানি সন্তান দুনিয়ার জীবনের শোভা, সন্তান পরীক্ষার জন্য । আর নিজের আমল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে প্রাণে বিশ্বাস ছিলো আমার রব আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিবেন তবে তার আগে আমাকে তৈরি করে নিচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ। এই সুযোগ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরির সুযোগ। দুশ্চিন্তা – হা হুতাশ না করে সময়কে কাজে লাগানো শুরু করলাম। শুদ্ধ ভাবে কুরআন শিখা, তাফসীর পড়া , বিভিন্ন লেকচার দেখা শুরু করলাম। অনেক বেশি আনন্দ হলো যখন সাল্লাবী সাহেবের সীরাহ্ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বইটি শেষ করলাম। মনে হচ্ছিলো কতো অজ্ঞ ছিলাম এতোদিন আমি ! কী কঠিন জিন্দেগি ছিলো আমাদের প্রিয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।তার উম্মাত হয়ে অল্পতেই আমরা হতাশ হয়ে পরি। হায়!
হতাশা ঝেড়ে ফেলে “প্রোডাক্টিভ মুসলিম” বইটি ফলো করে নিজের সময়কে কাজে লাগানো শুরু করলাম। ওজন কমিয়ে হেলদি লাইফ এ চলে গেলাম। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হলো খুব বমি বমি লাগছে। সারাদিন এমন গেলো। একদিন পর রাতে মাথা ঘুরে পরে গেলাম। একটু ভয় লাগা শুরু হলো। পরদিন প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলাম। এবং পজিটিভ আসলো। কিন্তু আমার পিরিয়ড চলছিলো। তাই ঠিক খুশি হতে পারলাম না। ডাক্তার দেখালাম এবং আমাদের শঙ্কা সত্যি হলো। বাচ্চা আছে বটে তবে টিউবে চলে গেছে। যেটাকে বলে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। সুবহানাল্লাহ!
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সহজ করে দিলেন যে খুব বেশি কষ্ট পেতে হয়নি। ঔষধের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে গেলাম। মন খারাপ হলো তবে আল্লাহর প্রতি সুধারনা পোষন করে ধৈর্য্যহারা হলাম না।
তার কয়েক মাস পর আমার আম্মু করোনা আক্রান্ত হয়ে ১১ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলো। আমি প্রতিটা মুহূর্তে আইসিইউতে আম্মুর সাথে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন তখন আরেকবার বুঝতে পারলাম।
যেহেতু এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি একবার হলে আবার হবার একটি সম্ভাবনা থেকে যায় তাই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে চলে গেলাম। খুব সূক্ষ্মভাবে সব টেস্ট করা হলো। কিছু সমস্যা পাওয়া গেলো এবং আবার ঔষধ দেয়া হলো। সাথে রেগুলার ফলো আপ।
আবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা।
আলহামদুলিল্লাহ এবার খুব বেশদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আল্লাহ এর রহমতে পরের মাসেই প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসে। রক্তের হরমনের মাত্রা নিয়মিত চেক করা হচ্ছিলো। রেগুলার ডাক্তারের সাথে কথা হচ্ছিলো।আলহামদুলিল্লাহ আল্ট্রাসনোগ্রাম করে কনফার্ম হলো যে সব ভালো আছে। তবে ৬/৭ সপ্তাহে একটু ব্লিডিং হলো। ডাক্তার ১ মাস বেড রেস্ট দিলেন। প্রতি মূহুর্তে আল্লাহ এর সাহায্য প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম। ১২ সপ্তাহে NT scan করা হলো। আলহামদুলিল্লাহ স্ক্যান করার সময় স্ক্রিনে বাচ্চার নড়াচড়া দেখে চোখে পানি চলে আসলো। এ এক অন্য রকম অনুভুতি। এরপরের সময় গুলো আসলে খুব স্মুদ ছিলো আলহামদুলিল্লাহ। নিয়মিত হাসপাতালে ডিউটি করতাম ও হাঁটাচলা করতাম। ২০ সপ্তাহের শুরু থেকেই বুঝা শুরু করলাম ভিতরে কেউ একজন নাড়াচাড়া দেয়। ২৪ সপ্তাহে এনোমালি স্ক্যান করলাম। স্ক্রিনে তাকে আবার দেখলাম। এ ভালোবাসা স্বর্গীয়! সব ভালো ছিলো শুধু বাচ্চার মাথা উপরে ছিলো যেটা ঐ সময়ে স্বাভাবিক ধরা হয়।
এর মাঝেই রৌদ্রময়ী থেকে প্রি ন্যাটাল কোর্স এর ব্যাপারে জানতে পারলাম। যেহেতু আমি ঢাকার বাহিরে ছিলাম পরিবার থেকে দূরে খুব মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম এরকম একটি কমিউনিটিতে যুক্ত হতে। আল্লাহ সেই আশা পূরণ করেছেন। ভ্যালুয়েবল প্রেগন্যান্সি ছিলো বলে একটা ভয় ছিলো । আল্লাহ এর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আপুদের কথা গুলো ফলো করছিলাম। প্রমা আপুর ক্লাস করে খাবারের চার্ট ঠিক করে নিলাম। রাবেয়া আপুর শেখানো ব্যায়াম গুলো করে আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেক আরাম পেতাম। প্রথমে আপু করতে বলেছেন দেখে করতাম। পরে এমন হতো আমি নিজে থেকেই করতাম কারণ না করলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করতো। পা এ টান লাগার জন্য ব্যায়ামটা আমার খুব উপকারে আসতো। আর ডিপ ব্রেদিং আমার স্ট্রেস রিলিভ করতো। আলহামদুলিল্লাহ আপুকে দৌলা হিসেবে পাবার সৌভাগ্য ও হয়েছিলো। আপু নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ৩০ সপ্তাহের স্ক্যানেও বেবি ব্রিচ আসলে আপু ব্রিচ বেবি ঘুরানোর ব্যায়াম গুলো বুঝিয়ে দিলেন।
৩১ সপ্তাহে রামাদান শুরু হলো। আল্লাহর নামে রোযা রাখা শুরু করলাম। আমার পুরো প্রেগন্যান্সিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিলো কুরআন পড়া। কুরআন যে শিফা তা আমি খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি। একটু শরীর খারাপ লাগলেই কুরআন নিয়ে বসে যেতাম। আলহামদুলিল্লাহ শরীর খারাপ ভুলে যেতাম। বাচ্চা নড়াচড়া কম করলেও কুরআন নিয়ে বসতাম। এবং আমার বাচ্চা নড়ে উঠতো আলহামদুলিল্লাহ।
রামাদান এর শেষে ঢাকা আসলাম। হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ।এইবার স্ক্যানে আসলো বাচ্চার ওজন কম এবং বাচ্চার মাথা এখনো উপরে। যেহেতু রোজা রাখছিলাম তাই ভাবলাম এটা হয়তো স্বাভাবিক।তবে মনে প্রাণে বিশ্বাস ছিলো আমার এই রোযার পুরষ্কার নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে দিবেন। এর মধ্যে ব্রিচ বেবির ব্যায়াম গুলো করে যাচ্ছিলাম।
ঈদের পরদিন বাচ্চার নড়াচড়া একটু কম বুঝলাম। ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি আবার আল্ট্রাসনোগ্রাম দিলেন। ১০ দিনে বাচ্চার ওজন বাড়েনি এবং পানিও কমে যাচ্ছে। আমাকে সি সেকশন এ যেতে বললেন ডাক্তার। আমি একটু সময় চেয়ে বাসায় আসলাম। ডা: ফাতেমা আপুর সি সেকশন এর ক্লাস এর কথাগুলো কানে বাজছিলো। নরমালের আশা অবশ্যই ছিলো তবে সুস্থ সন্তান এর থেকে বড় পাওয়া ঐ সময় আর কিছুই ছিলো না।
পরবর্তী ৭ দিন ছিলো ৭ বছরের সমান। প্রতিটা মুহূর্তে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিলাম। বুকের উপর যেন একটি পাথর ভর করে ছিলো। ৭ দিন পর আবার ফলো আপে গেলাম। স্ক্যানে আসলো বাচ্চার ওজন আগের মতই আছে এবং মাথা উপরে। কিন্তু কোন কারন বুঝা গেলো না কেন এমন হচ্ছে।
আর দেরি করা ঠিক হবে না এটা আমি ও বুঝে গেলাম। এত কম ওজনের বাচ্চা ! কি হবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। ডাক্তার বললেন এখনি অপারেশন হবে। উনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অনেক জরুরী কাজ ছিলো ম্যাডামের ঐদিন, যা আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।আমাকে রেডি করতে নিয়ে গেলো। আমি একটু সময় চেয়ে নিলাম নামায পড়ার জন্য। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। যেহেতু বাচ্চা ছোট তাই বাচ্চার ডাক্তার রেডি রাখা হলো। আল্লাহর রহমতে এনিস্থিসিয়ার ডাক্তার খুব ভালো ছিলেন। অপারেশন শুরুর পর যখন বাচ্চাটা বের করা হলো খুব ভয়ে ছিলাম সে ঠিক আছে নাকি। বাচ্চাকে খুব দ্রুত ওয়ার্মারে রাখা হয় এবং আমার পুত্র চিৎকার দিয়ে আমাকে জানিয়ে দেয় যে আমার রব মহান। বাচ্চার ডাক্তার এসে জানিয়ে দেন আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চা সুস্থ আছে তবে যেহেতু ওজন মাত্র ২ কেজি একটু অবজারভেশন লাগবে, আর কিছু না।
ঐ দিকে অপারেশন শেষে ম্যাডাম জানালেন আমার জরায়ু হার্ট শেইপড যেটাকে “বাইকর্নুয়েট ইউটেরাস” বলে। বাচ্চা এক পাশে ছিলো তাই মাথা ও ঘুরে নাই এবং ওজন ও আর বাড়ছিলো না। আনকমন একটি অবস্থা তবে আল্লাহ অনেক অনেক সহজ করে দিয়েছেন। প্রিয় রাবেয়া আপু নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন অনেক দিন পর্যন্ত।
যেহেতু বাচ্চার ওজন কম ছিলো আমার ইনিশিয়াল পোস্ট পার্টাম স্টেজটা বেশ কঠিন ছিলো আলহামদুলিল্লাহ। বাচ্চার ফিডিং, বাচ্চাকে সামলানো, নিজের ক্লান্তি তার উপর ছিলো আশে পাশের সবার কথা সামলানো। নাঈমা আপুর ফিডিং এবং পোস্ট পার্টাম পিরিয়ড নিয়ে কথাগুলো অনেক সাহস দিয়েছে। আমার বাচ্চার ডাক্তার ম্যাডাম ও খুবই ভালো ছিলেন।
আল্লাহর অশেষ কৃপা,আমার পার্টনার ও পরিবারের সাপোর্ট, ডাক্তারদের সহযোগিতা এবং আমার প্রিন্যাটাল/পোস্টন্যাটাল এর জ্ঞান – সব মিলিয়ে সেই কঠিন দিনগুলো পার হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। ছেলের মুখের দিকে তাকালে মনে পরে কতো দুআ এর ফসল এই সন্তান! আমার রব উত্তম পরিকল্পনাকারী।আল্লাহ তাকে নেক বান্দা হিসেবে কবুল করে নিক।
“হে আমার রব! তোমাকে ডেকে আমি কখনো নিরাশ হইনি।”
ডাঃ উম্মু মুহাম্মদ
প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ ৭
Other post
You may also like
রংধনু রঙের খেলনাগুলো
ছোটবেলায় আমাদের নিকট প্রকৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি ছিলো, তা হলো সাত রঙের রংধনু। কারণ অধিকাংশ সময় বৃষ্টির দেখা মিললেও, বৃষ্টির পরের রংধনুর দেখা মিলতো খুবই কম। তাই যে জিনিস খুব কম দেখা যায়, সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণও থাকে সবচেয়ে …
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …