লেবারের জন্য অপেক্ষা ও আর্লি লেবার- কি করবেন, কি করবেন না? (পর্ব-২)
লেবারের জন্য অপেক্ষার দিনগুলোতে যে ভুলগুলো আমরা করে থাকি তার আলোচনা আগের পর্বে করেছি। এবার কিছু সাজেশন দেই কিভাবে এই সময়টা রিলাক্স থাকা সম্ভব আল্লাহ চাইলে।
Submit, Surrender, Relax
সর্বপ্রথম মাথায় এই ৩টা শব্দ গেথে নিন। লেবারের আগে ও লেবার চলাকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আল্লাহর উপর, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের কাছে, আল্লাহর অগাধ জ্ঞানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া ও সম্পূর্ণ নির্ভার থাকা। এতে করে প্রচুর relaxin হরমোন নিঃসরণ হয়ে শরীরকে বাচ্চা জন্মদানের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও তাওয়াক্কুল
আল্লাহ তায়া’লা আপনাকে, আপনার সন্তানকে নানাভাবে সুরক্ষিত রেখেছেন। প্রথমতঃ আল্লাহ কুরআনে সুরা যুমারে(৩৯ঃ৬) বলেন, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মায়ের গর্ভে পর্যায়ক্রমে তিনস্তর বিশিষ্ট অন্ধকারে। তিনিই তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তারই।
এমন এক সময় যখন আজকের মত উন্নত প্রযুক্তি ছিলনা তখনই আল্লাহ তার রাসূলকে জানিয়েছেন যে মায়ের গর্ভে একজন সন্তান আল্লাহর নানাবিধ সুরক্ষাবেষ্টনীর মধ্যে থাকে। সুবহানাল্লাহ! তিন তিনটা লেয়ার- আমাদের তলপেট, তার ভেতর জরায়ু, তার ভেতর আবার এমনিওটিক স্যাক, তিন ধাপে সর্বোচ্চ হিকমাহ এর সাথে বাচ্চার ডেভলপমেন্ট সম্পন্ন করছে। এর ভেতর রয়েছে আপনার সন্তান, যার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, নড়াচড়া যার জ্ঞানে আছে তিনি হলেন আমাদের রব। যতদিন বাচ্চা মায়ের গর্ভে থাকে ততদিন আল্লাহর কুদরতের ভেতর থাকে আর রবের হেফাজত নিশ্চয়ই সর্বোত্তম জায়গা বাচ্চার জন্য। স্বাভাবিক প্রসবের মধ্যে যত পরিমাণ কল্যাণ আছে আপনার জন্য ও আপনার সন্তানের জন্য তা বিবেচনায় নিয়ে হলেও একটু ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ যখন চাইবেন বাচ্চা নিজের গতিতে হবে, শরীর নিজস্ব গতিতে লেবার শুরু ও শেষ করবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে এই অল্প কয়টা দিন নিজের জন্য আমানত মনে করে কাজে লাগান। কে জানে হয়তো আরও বহু বছরেও এই অবসর সময় আর আসবে না!
একজন পজিটিভ ও সাপোর্টিভ ডাক্তার খুঁজে নিন, প্রয়োজনে ডাক্তার চেইঞ্জ করুন যতদিন না সাপোর্টিভ ডাক্তার না পাওয়া যায়। অন্যদিকে নিজে ও নিজের টিম মেম্বার অর্থাৎ হাজবেন্ড, আপনার সাথে যারা হসপিটালে থাকবেন সবাই কমবেশি প্রেগন্যান্সি, লেবার ও ব্রেস্টফিডিং বিষয়ে জানুন ও পড়াশোনা করুন। এই বিষয়ে যতই বলব কম বলা হবে। মনে রাখবেন আপনার ডাক্তারের ও হসপিটাল স্টাফদের ভূমিকা অনেক বেশি আপনার ডেলিভারির আগের মূহুর্তগুলোয় আপনাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। আমি বলব প্রেগন্যান্সি শুরু থেকেই একজন সাপোর্টিভ ডাক্তার খোঁজা উচিত। তবে ৩৫ থেকে ৩৮ সপ্তাহের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেবারের সময় কী ধরনের সাপোর্ট আপনি পাবেন সেটা আগেই জিজ্ঞাসা করে জেনে নিন।
কী কী জানতে চাইবেন
পেইন কী কী কারণে ইনডিউস করেন/ বাথা উঠার জন্য কতদিন পর্যন্ত ওয়েট করেন?
কখন সিজার প্রয়োজনীয় বা সিজার ছাড়া অন্য কোন অপশন থাকে না/উনার সিজারের পেশেন্ট রেইট কেমন?
কোন ধরনের মেডিসিন বা অপ্রয়োজনীয় মেডিক্যাল হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাভাবিক লেবার ও প্রসবের ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন??
এপিসিওটোমি /কর্ড দেরী করে কাটা বা এই ধরনের প্র্যাক্টিসের ব্যাপারে আপনার কী মতামত?
আপনার ডক্টর যদি আপনার প্রশ্ন শুনতেই রাজি না হন বা বিরক্তি প্রকাশ করেন, কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন বা এড়িয়ে যান বা উনার রোগীদের সাথে কথা বলে যদি জানতে পারেন উনি স্বাভাবিক প্রসব সাপোর্টিভ না, তাহলে ডাক্তার চেইঞ্জ করার কথা ভাবুন। অনেকেই কিন্তু থাকেন লেবারের আগে পর্যন্ত কথা-বার্তায় সাপোর্টিভ থাকলেও পেইন নিয়ে হসপিটালে গেলে উনারা অব্জারভেশনে না রেখে তাড়াহুড়ো করে কোন ডিসিশন চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন! এজন্য ২/৩ জায়গায় দেখিয়ে রাখেন যাতে লেবারের সময় আপনাকে আগে দেয়া কথার বিপরীত হলে আপনি অন্য একজন সাপোর্টিভ ডাক্তারের আন্ডারে চলে যেতে পারেন।
Estimated Due Date বা ডিউ ডেট ভুলে যান!!
হ্যাঁ। ভুলে যান কবে আপনার ডেলিভারির সম্ভাব্য ডেইট। যারা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চায়/বার বার কল করছে তাদেরকে আশ্বস্ত করুন যে আল্লাহ যেদিন প্ল্যান করেছেন সেদিনই বাচ্চা দুনিয়ায় আসবে। কথা কম বলবেন। কারণ যত এই টপিকে কথা হবে তত আপনার স্ট্রেস বাড়বে। একজন একজন করে সবাইকে জ্ঞান দেয়া আমাদের কাজ না, অন্ততপক্ষে এই সময় না। প্রতিটা দিন গুণে গুণে পার না করে এভাবে ভাবুন যে কতগুলো দিন কেটে গেল ভালভাবে আলহামদুলিল্লাহ, বাকি তো আর মাত্র ৮/১০ টা দিন! আবারও বলছি ডেইট মাথায় রাখবেন না। ডেইটের জন্য অপেক্ষা করার কিছু নাই। অপেক্ষা হল লেবারের মূহুর্তের জন্য, আপনার সন্তানের দুনিয়ায় আসার দিনের জন্য, কোন নির্দিষ্ট তারিখের জন্য না।
পজিটিভ এনার্জি শরীরে জমা করা:
দ্বিতীয়ত লেবার একটা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। লেবারকে প্রায়শই তুলনা করা হয় ম্যারাথন দৌড়ের সাথে বা এক দেড় কিলো সাতার কাটার সাথে। এই কাজগুলো করতে কী পরিমাণ শারীরিক শক্তি, স্ট্যামিনা, পেশীগুলোর নমনীয়তা ও অনুশীলন প্রয়োজন! লেবারেও কিন্তু সমপরিমাণ প্রয়োজন বা তারচেয়েও বেশি। কারণ লেবার শুধুমাত্র শারীরিক কাজই না বরং মানসিক ও ইমোশনালও পরিশ্রম। আর তাই তো প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, রেগুলার এক্সারসাইজ করা ও প্রচুর রেস্ট নেয়া। মনে রাখবেন লেবার একটা পরীক্ষার মত আর পরীক্ষার আগে অতিরিক্ত লিখে হাত ব্যাথা করে পরীক্ষার হলে গিয়ে হাত ব্যাথার কারণে লিখতে না পারা যেমন বোকামি তেমনি লেবারের আগেও অতিরিক্ত পরিশ্রম করা, দুশ্চিন্তা করে করে না ঘুমানো, খাওয়াদাওয়া না করা বা অপর্যাপ্ত রেস্ট নেয়াও ঠিক তাই। তাই বলব পর্যাপ্ত রেস্ট নিন, পর্যাপ্ত খাওয়াদাওয়া করুন ও রেগুলার একটা এক্সারসাইজের রুটিন মেইনটেইন করুন।
পজিটিভ বার্থস্টোরি শুনুন ও নিজেকে পজিটিভ ভাইব দিন:
নিজের ফ্যামিলি ও ফ্রেন্ডস যাদের নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ও পজিটিভ অভিজ্ঞতা আছে তাদের প্রিয় পজিশন ও পেইন এর সাথে কোপ আপ করার টেকনিক জেনে নিন। তাদের বার্থ স্টোরি শুনুন।
প্র্যাক্টিস, Practice এবং প্র্যাক্টিস:
লেবারের সময় পেইন ম্যানেজ করার টেকনিকগুলো যেমন Tummy breathing ও relaxation বার বার প্র্যাক্টিস করা খুব জরুরি যাতে করে লেবারের সময় এগুলো আয়ত্বে থাকে ও স্বাভাবিক রিএকশন হিসেবেই চলে আসে। এছাড়া যেসকল পজিশন ও এক্সারসাইজ লেবার সহজ করে সেগুলোর প্র্যাক্টিস বারবার করা, যেমন হিপ রোটেশন। প্রচুর হাটা ও স্কোয়াট করা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও আরও অনেক উপকারী ব্যায়াম আছে যেগুলো জানা ও প্র্যাক্টিস করা জরুরি।
নিজের যত্ন নেয়া:
মজার ব্যাপার হল আমাদের সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের মূহুর্তগুলোয় আমরা নিজেদের সবচেয়ে অযত্ন করি। অথচ এই সময়গুলোয় নিজেদেরকে গুছিয়ে একটু পরিপাটি করলে, বারান্দায় একটু একাকী হাওয়া খেয়ে নিলে, ভাল একটা ড্রেস পরে একটু সাজগোজ করলে মন সত্যিই ফ্রেশ লাগে। নিজের শখের যত্ন নেয়া যেতে পারে যেমন বই পড়া, বাগান করা, কাথা সেলাই, কুশিকাটা, শপিং করা যেটাই ভাল লাগে।
এছাড়া নিজের পছন্দের খাবার রান্না করে নিজেকেই নিজে ট্রিট দিতে পারেন কিংবা বেশি এনার্জি থাকলে ঘরের মানুষদের জন্য স্পেশাল কিছু রান্না করে সবাই মিলে উপভোগ করুন।
পরিচ্ছন্নতা অভিযান:
হ্যাঁ! লেবারের আগে একটা সময় আসে খুব এনার্জি আসে শরীরে। তখন পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন একে একে সব বেসিন, বাথরুম, কিচেনের বিভিন্ন কোণ। গুছিয়ে নিতে পারেন নিজের ওয়ার্ডরোব, আলমারি, শোকেসের সব মালপত্র। এতে করেও দুশ্চিন্তা অনেকটা হালকা হয়। তবে খেয়াল রাখবেন পর্যাপ্ত রেস্ট অবশ্যই নিতে হবে।
এছাড়াও আল্লাহর যিকির ও কুরআন তিলওয়াতের মধ্যে সময়ের সর্বোত্তম ব্যাবহার করতে পারেন। যেহেতু অন্তরের অস্থিরতা দূর হয় এই দুই জিনিসে, অন্তরের প্রশান্তি আসে যিকিরের দ্বারা। দৈনিক একটা টার্গেট নিতে পারেন যে ইস্তিগফার ১০০০ বার করা, দরুদ যত বেশি সম্ভব পড়া, কুরআন থেকে তিলওয়াত করা বা শোনা, আল্লাহর যেসকল গুণবাচক নাম আছে তা ধরে ১০০/১০০০ বার ডাকা। যেমন আল্লাহ তাআলা হালীম অর্থাৎ ধৈর্য্যশীল, আর এই গুণ আমার এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।
দুয়ার কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। আল্লাহর কাছে সহজ প্রসব, সুস্থ, নেককার সন্তান চেয়ে দুয়া করা খুব জরুরি। এমনকি আল্লাহর কাছে খায়ের বা ভালাই চেয়ে দুয়া করা ও আল্লাহর সিদ্ধান্ত খুশিমনে মেনে নেয়ার যোগ্যতা চেয়েও দুয়া করা দরকার। তাহাজ্জুদে এবং অন্যান্য দুয়া কবুলের মূহুর্তগুলো কাজে লাগিয়ে দুয়া করা আল্লাহ যেন সহজ ডেলিভারি, সহজ রিকভারি নসীব করেন। সিজদা করে করে দুয়া করা যদি সম্ভব হয়।
এরপরও এই বিষয়ে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আমি আমার জন্য যা চেয়েছি তাই সর্বোত্তম না, বরং আল্লাহ আমার জন্য যা চেয়েছেন ও ফায়সালা করেছেন তাই সর্বোত্তম, তার মধ্যেই আমার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত আছে। অনেকের লেবার ও ডেলিভারি প্ল্যান মোতাবেক হয়না, অনেকেই খুব খারাপ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান কিন্তু এগুলো নিয়ে মনে কষ্ট না রেখে আল্লাহর ফায়সালা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ও শুকরিয়া আমল করা সম্ভব হলে ইনশাআল্লাহ ডিপ্রেশনে পড়া থেকে বাচা সম্ভব।
ব্রেস্টফিডিং প্রিপারেশন:
প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে আমরা সাধারণত বাচ্চার ডেলিভারি নিয়ে এত ভাবি, এত এত প্রস্তুতি নেই অথচ এরপর যে আরেক লম্বা জার্নি শুরু হচ্ছে তা সম্পর্কে বেখবর থাকি। অথচ এই সময়কে গণীমত মনে করে ব্রেস্টফিডিং নিয়েও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। বিশেষ করে শাল দুধের প্রয়োজনীয়তা, শাল দুধ কেমন হয়, কতটুকু প্রয়োজন বাচ্চার জন্য, কিভাবে বাচ্চাকে দুধ ধরাতে হয়, ব্রেস্টফিড বাচ্চার জন্য ঠিক কতটুকু দুধ পাওয়া নরমাল এমন আরও অসংখ্য বিষয়।
এর বাইরেও বাচ্চা হবার পরেও যে শরীরে হরমোনের প্রভাব শেষ হয় না, বেবি ব্লু, পোস্টপার্টাম পিরিয়ডে নিজের যত্ন বিষয়েও জানা থাকার অভাবে সামান্য কষ্ট থেকেও কত মা ডিপ্রেশনে পড়ে যান।
প্রেগন্যান্সি, লেবার, পোস্টপার্টাম নিয়ে এত এত বিষয় জানার আছে যে বলে শেষ করা যাবেনা। এজন্যই প্রিন্যাটাল কোর্সের কোন বিকল্প নাই। আর এই বিষয়গুলো নিয়ে জানা থাকার ফলে যে মায়েরা নিজেদের ডিসিশন নিজেরাই নিতে পারেন ও খুব সুন্দরভাবে সব ম্যানেজ করতে পারেন তার উদাহরণ অসংখ্য।
আয়েশা সিদ্দিকা হোমায়রা,
রৌদ্রময়ী দৌলা ইন্টার্ন