হেলদি ব্রিদিং
১। আপনি যদি কোন ছোট শিশুর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে তার তলপেট ওঠা-নামা করছে নিঃশ্বাসের সাথে সাথে। তার বুক প্রায় স্থির থাকে আর কাধ বেশ শিথিল অবস্থায় থাকে। এটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক, রিল্যাক্সড, ডীপ ব্রিদিং।
প্রাপ্তবয়সে পৌঁছানোর পর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস খুব অগভীর হয়ে যায়। আমরা শুধু আমাদের বুক থেকে শ্বাস নেই এবং আমরা ভেতরে যতখানি বাতাস নিতে পারি তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র নেই। আমাদের যতটা ধীরে শ্বাস নেয়া প্রয়োজন তার চেয়ে দ্রুত শ্বাস নেয়ার ফলে আমরা ফুসফুস থেকে পুরনো বাতাস বের করে দেয়ার আগেই নতুন আরেকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফেলি। এর ফলে কিছু পুরনো বাতাস আমাদের নতুন নেয়া বাতাসের সাথে মিশে যায়।
এটা আমাদের অক্সিজেন সাপ্লাইকে কমিয়ে দেয়, সেই সাথে আমাদের জীবনিশক্তিকেও!
২।আমরা যখন শ্বাস নেই তখন বেশ কিছু জিনিস ঘটে। সেসব বোঝার জন্য আমাদের আগে কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন।
যে মাসেল বা পেশী আমাদের বুক ও তলপেটকে আলাদা করে রাখে সেই মাসেল হচ্ছে ডায়াফ্রাম। আমাদের ফুসফুসের চারপাশে রয়েছে শূন্য স্থান যাকে বলে থোরাসিক (thoracic) ক্যাভিটি। ফুসফুসের চারপাশের মেমব্রেন একে বুকের সাথে সংযুক্ত রাখে। আমাদের বুকের খাচার ভেতর যে মাসেল তাকে বলে ইন্টারকোসটাল মাসেল।
যখন আমরা অগভীরভাবে শ্বাস (shallow breathing) নেই, তখন আমরা এই বুকের খাচার ভেতরের ইন্টারকোসটাল মাসেল ব্যবহার করি। যখন আমরা গভীরভাবে শ্বাস নেই তখন ডায়াফ্রাম মাসেল উপর-নিচ করে তালে তালে নড়ে। এর ফলে থোরাসিক ক্যাভিটি পুরোপুরি প্রসারিত হতে পারে।
কার্যকর ব্রিদিং নির্ভর করে ভালো দেহভংগীর (posture) উপর। আপনি যখন কাধ কুজো করে বসেন তখন আপনার বুক সংকুচিত হয়ে যায়। আপনার থোরাসিক ক্যাভিটির ভেতরের জায়গা কমে যায় এবং আপনার ব্রিদিং পরিপূর্ণ হয় না।
ডায়াফ্রাম মাসেল যখন কাজ করে তখন আমরা শ্বাস নেয়ার সময় এটা সোজা বা ফ্ল্যাট হয়ে যায়, পেটের ভেতরের অংগগুলোকে নিচের দিকে চাপ দেয় ও তলপেট বাইরের দিকে আসে। আমরা শ্বাস ছাড়ার সময় এটা রিল্যাক্স হয়, উপরে বুকের দিকে ধনুকের মতো আকৃতি ধারণ করে। আমরা গভীরভাবে শ্বাস নেয়ার সময় এটাই অনুভব করি – নিঃশ্বাসের সাথে তলপেট প্রসারিত হয় ও প্রশ্বাসের সাথে তলপেট ভেতরের দিকে আসে।
প্রতি শ্বাসের সাথে ডায়াফ্রাম উপর-নিচ নড়ার ফলে লিভার, পাকস্থলী ও অন্যান্য অংগে মৃদু চাপ পরে। ফুসফুসের এই ছন্দ কোমল ম্যাসাজের মতো কাজ করে যা শরীরের ভেতরের অংগগুলোর স্বাভাবিক ক্রিয়ায় সাহায্য করে। প্রতি শ্বাসে এইসব অংগে রক্ত সঞ্চালন উদ্দিপীত হয়। ইন্টারনেট থেকে ডায়াফ্রামাটিক ব্রিদিং এর একটা ইমেজ দিয়েছি লেখার কমেন্টে।
আমরা যখন শুধুমাত্র বুক থেকে শ্বাস নেই তখন এই উপকারী ম্যাসাজ অনুপস্থিত থাকে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে প্রতিটি জীবিত কোষ অক্সিজেন শোষণ করে ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। প্রেগন্যান্সি ও লেবারের সময় আমরা শুধু আমাদের জন্যই না, আমাদের সন্তানের জন্যও শ্বাস নেই!
৩। প্রেগন্যান্সিতে ডীপ ব্রিদিং প্র্যাকটিস করা উচিত। এবং এটা করার সময় নাক দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে হবে। মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ার কথা কেন বলা হচ্ছে? কারণ লেবার খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ এবং যেকোন পরিশ্রমসাধ্য কাজের পরই আমরা সাধারণত মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ি।
কিন্তু কেন ডীপ ব্রিদিং প্রেগন্যান্সিতে প্রতিদিন প্র্যাকটিস করা উচিত? কারণ এর ফলে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর থেকে আরো গভীর হবে, যা আপনাকে আপনার ফুসফুসের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করে শ্বাস নিতে সাহায্য করবে এবং আপনার ডায়াফ্রাম মাসেল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করবে।
শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া হচ্ছে আমাদের শরীরের একমাত্র কাজ যা আমরা সচেতন ও অবচেতন দুইভাবেই করতে পারি। আমরা সচেতনভাবে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার ধরণ পরিবর্তন করতে পারি। এবং আমাদের সচেতন মনের ওপর এর সরাসরি প্রভাব পরে।
আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া আমাদের মন ও আবেগের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যা আপনি প্রতিদিন প্র্যাকটিসের মাধ্যমে নিজেই বুঝতে পারবেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করা মানসিকভাবে গভীর সচেতন অবস্থায় পৌঁছানোর একটা সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি। প্রেগন্যান্সিতে ডীপ ব্রিদিং প্রতিদিন প্র্যাকটিস করা আপনার মনকে শান্ত করতে সাহায্য করবে, যা আপনাকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সময় ভালো অনুভব করাবে ইনশাআল্লাহ।
এবার আসি লেবারের সময় ডীপ ব্রিদিং করা নিয়ে। লেবারের সময় আপনি যে তীব্র অনুভূতির মুখোমুখি হবেন ডীপ ব্রিদিং আপনাকে সেটা সামলাতে সাহায্য করবে। আপনি যদি লেবারের সময় চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, ভীত বোধ করেন তাহলে ডীপ ব্রিদিং-এর মাধ্যমে আপনি নিজেকে শান্ত করতে পারবেন এবং নিজের ভেতর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারবেন। এর ফলে আপনার চারপাশে যা কিছু ঘটে চলেছে সেসব ইগনোর করে লেবার সামলানোর জন্য নিজের ভেতর মনোযোগ দিতে পারবেন।
লেবার পেইন যখন তীব্র আকার ধারণ করবে তখন সময় নিয়ে ধীরগতিতে শ্বাস ছাড়ার মাধ্যমে রিল্যাক্স থাকা আপনার জন্য সহজ হবে। প্রতিটি কনট্রাকশনের মাঝের বিরতিতে এটা আপনাকে বিশ্রাম নিতেও সাহায্য করবে। তীব্র কনট্রাকশনের সময় শ্বাস ছাড়ার সাথে সাথে মুখ দিয়ে নিচু স্বরে গভীরভাবে আওয়াজ করা আপনাকে ব্যথার অনুভূতি প্রকাশে সাহায্য করবে। এ সময় নিশ্চুপ থাকা যেমন আপনার জন্য আরো কষ্টকর তেমনি উচ্চ স্বরে চিৎকার করাও আরো বেশি ব্যথার কারণ হবে কারণ এভাবে চিৎকার করা আপনাকে রিল্যাক্স হতে দিবে না।
তাই লেবারের সময় আসার আগেই প্রেগন্যান্সিতে যত আগে থেকে প্রতিদিন আপনি ডীপ ব্রিদিং প্র্যাকটিস করবেন লেবারের সময় আলাদা কোন মানসিক প্রচেষ্টা ছাড়াই এই টেকনিকের সহায়তা নেয়া আপনার জন্য সহজ হবে। শুধু তাই না, সন্তান জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়, মাতৃত্বের দায়িত্বগুলো পালনের দিনগুলোতেও ডীপ ব্রিদিং আপনাকে রিল্যাক্স হতে সাহায্য করবে।
৪। ৮০-র দশকে ন্যাচারাল বার্থের ওপর লেখা জ্যানেট বালাস্কাসের Active Birth বইয়ের “ব্রিদিং” চ্যাপ্টারটা প্রথমবার পড়ে আমার মাইন্ডব্লোয়িং লেগেছিল। সেই বইয়ের সাহায্য নিয়ে এই লেখাটা লিখেছি। নিজের প্রেগন্যান্সিতে শ্বাস কষ্টের সময় এটা প্র্যাকটিস করেছি, পুরো লেবারে এটা ছিল আমার অন্যতম পেইন কোপিং টেকনিক। এমনকি ল্যাকটেশন পিরিয়ডেও এটা প্র্যাকটিস করি। ব্রেস্টফিডিং অবশ্যই ক্লান্তিকর কাজ কিন্তু শারীরিক-মানসিকভাবে রিল্যাক্স থাকার জন্য এটা চমৎকার কাজ করে মাশাল্লাহ। সঠিকভাবে শ্বাস নেয়া মেয়েদের পেলভিক ফ্লোর, যাকে লেবার ও ডেলিভারির সময় অনেক চাপ নিতে হয়, তার স্বাস্থ্যের জন্যও খুব উপকারী। রৌদ্রময়ী স্কুলের প্রিনাটাল কোর্সে প্রেগনেন্সি ব্যায়াম ও লেবারের ক্লাস দুটোতেই ডীপ ব্রিদিং নিয়ে শেখাই। একজন মা নিজের লেবার এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন তিনি এটা প্র্যাকটিস করে রিল্যাক্স থাকতে চেষ্টা করছিলেন। আরেকজন মা আমাকে জানিয়েছেন পুশিং স্টেজে ডীপ ব্রিদিং উনাকে অনেক সাহায্য করেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
রাবেয়া রওশীন,
প্রিনাটাল ইন্সট্রাক্টর, রৌদ্রময়ী স্কুল