আমার বাচ্চাদের বার্থ স্টোরি
১ম পর্ব
একটা দম্পতির জন্য সন্তানের বাবা মা হওয়াটা তাদের থিতু হওয়া সংসার জীবনের পরের ধাপ। কে না চায় নিজ সন্তানের বাবা মা হতে? পৃথিবীর সবচেয়ে পীড়াদায়ক ভয়াবহ এবং জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও প্রতিটা দম্পতি বারবার এই অভিজ্ঞতা চায়। কারণ সন্তানেরা যখন চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, একেকজন আলাদা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়, তার চেয়ে আনন্দের বুঝি কিছুই থাকে না। সেই আনন্দের কাছে সন্তান জন্মদান এবং তাদের পালনের কষ্টগুলো নস্যি।
তবে সবার মতো আমার বাচ্চা নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। আমার ভেতরে একটা ট্রমা কাজ করতো, যদি আমার বাচ্চা মানুষের মত মানুষ না হয়? যদি আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাকে ভালো মানুষ না বানাতে পারি? যদি বাচ্চা হওয়ার সময় আমি মারা যাই?- এই সব নেগেটিভ চিন্তাধারার কারণে আমি প্রথম এক বছর আগ্রহ প্রকাশ করিনি। এরপর করোনার মাঝে দুজনেরই মনে হলো, এবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমি যেহেতু ওকে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করতে চাই না, তাই আমি কখনো আমার মনের কথা বলিনি। তবে কখনো আল্লাহর কাছে দুয়াও করতাম না। একদমই না।
২০২০ এর জুলাই এ আমার কিছু সমস্যা হয়। সেসব নিয়ে গাইনী ডক্টর দেখানোর পর উনি কিছু ওষুধ দেন। আমার PCOS ছিল, পলি সিস্টিক ওভারী সিন্ড্রম। সাথে পজেস্টরেন হরমোন এর অভাব। দুইমাস ওষুধ চলে। অক্টোবরে আমি কন্সিভ করি যেটা নভেম্বরে জানার কথা। কিন্তু আমার অনুঝপনার জন্য বুঝতে পারিনি। সিঁড়ি ভাঙতাম দিনে দুই তিনবার, হাঁটাহাঁটি করতাম। এর মাঝে হাল্কা ব্লিডিং দেখা দেয়ায় সেটা নিয়ে পরিচিত এক ডক্টরের সাথে কথা বলি। উনি বললেন, পজেস্টরেন হরমোনের ওষুধের জন্য এমন হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই।
দুই সপ্তাহের মাঝে আমি বুঝে গেলাম, সামথিং রঙ। আমি তখন আব্বু আম্মুর বাসায় ফ্যামিলি গেট টুগেদার এর জন্য এসেছি। বলে রাখি, আব্বু আম্মুর বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই আমাদের টোনাটুনির বাসা। এজন্য আরও বেশি সিঁড়ি ভাঙা হতো।
নভেম্বর ২৯,২০২০।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বাসা থেকে প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে কনফার্ম না হয়ে যাবো না। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে ফাইনালি দুটো দাগ স্পষ্ট হলো। আমি বলতে দেরী, খবর ছড়াতে দেরী হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল, দুই মাস হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি কিছুদিন পর আল্ট্রা করে দেখি ১০ সপ্তাহ ৫দিন। যারা জানে না, তাদের জন্য বলি, প্রেগ্ন্যাসিতে মাস হিসেবে সময় গোণা হয় না, সপ্তাহ গোণা হয়। ৪ সপ্তাহে ১ মাস। তার মানে তখন আমার আড়াই মাস শেষ। সেদিন আল্ট্রার রিপোর্ট পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি আমার প্রেগ্ন্যাসির আড়াই মাস, মানে প্রথম ট্রাইমিস্টার প্রায় শেষ! ভাইয়া তখন আমার মাথা ওর বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এই যে খুশি, এই যে আনন্দ, এর কোনো ভাষা হয় না।
তখনও আমি রিস্কজোনে আছি। হাল্কা ব্লিডিং, যাকে স্পটিং বলে, সেটা আছে। আমি খুব সাবধানে চলি, কমপ্লিট বেড রেস্ট দিয়েছে ডক্টর। সাথে ওষুধ। ঐ সময় সব রকম টেস্ট করা হয়- সিবিসি, থাইরয়েড, ডায়বেটিস, ইউরিন, সব। স্পটিং ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না। যেহেতু করোনার কারণে ঢাবির ক্লাসও বন্ধ ছিল, আমি আব্বু আম্মুর কাছে আরামেই ছিলাম। তারেক মাঝে মাঝে আসতো, আবার চলে যেতো। বাসা কাছে বলে ও রাতে সবসময় থাকতো না। এর মাঝে আব্বুর ফুড পয়জনিং হয়ে ভয়াবহ ডায়রিয়া হয়। এক সকালে উঠে দেখি, আম্মু কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর লুঙ্গি ধুচ্ছে। সারারাতই নাকি আব্বু ঘন্টায় তিন থেকে চারবার বাথরুমে গিয়েছে। একে তো মাস ছয় আগেই বড় কাকা আর বড় ফুপি মারা গেল, তার মধ্যে আব্বুর এই অবস্থা। আমরা সবাই খুব টেন্সড ছিলাম। আমার তখন পেটে চিনচিনে ব্যথা। সেই ব্যথা নিয়েও আব্বুর পাশে বসে থাকলাম। কারণ আব্বু বিছানা থেকে উঠতে উঠতেই কাপড় নোংরা হয়ে যায়। ওদিকে তারেক কোনো ফার্মাসি খোলা পাচ্ছে না। গুলশান পর্যন্ত সব বন্ধ। তখন সকাল ৮টা। ও আমার কাছে এসে বলল,
-তুমি যে এভাবে হাঁটাহাঁটি করতেছ, বেবির যদি ক্ষতি হয়?
আমি খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম,
-ওর নানা অসুস্থ। এই অবস্থায় যদি ও টিকতে না পারে, তাহলে ওর থেকে কি হবে? আমার কিছুই হবে না, ওরও হবে না।
আমার এত মনের জোর ছিল তখন! আব্বু সকালের মাঝেই মোটামুটি সুস্থ হলো। আমি তারপর জানুয়ারি মাসে আমার বাসায় চলে আসলাম। বাসায় তখন বুয়া রাখা হলো। এর আগে সব কাজ আমিই করতাম। দুঃখজনকভাবে সে ১২ তারিখে চলে গেল। নতুন বুয়া পাচ্ছি না। ঘরের কাজ আমিই করতাম। কাপড়ও দু একবার ধুয়ে ফেললাম বাধ্য হয়ে। ঘরের কাজ করতে করতে জানুয়ারীর শেষে আরেক বুয়া পেলাম। বুয়া দিনে একটা কাজ করতো। তাও সে এক দিন, দুইন গ্যাপ দিয়ে আসতো। উপায় না পেয়ে আমি রুটি বানিয়ে ফেলতাম।
এর মাঝে আমার আর কোনো টেস্ট করা হয়নি। আমাকে বেড রেস্ট দেয়ার পরও আমি টুকটাক কাজ করতাম যেহেতু তারেক সারাদিন অফিসে থাকতো। ওকে ঠিকমতো খাবারও রান্না করে দিতে পারতাম না। চুলায় তেল মশলা দিতে না দিতেই পানি সব্জি, সব ঢেলে দিতাম। আমার ধৈর্য্যই ছিল না রান্না করার মত। উপরন্তু কষানো তরকারির ঘ্রাণ নাকে আসলেই বমি আসতো। মনে হতো, এরচেয়ে বিশ্রি খাবার আর হয় না! তার উপর রান্না করার মত জুলুম আর ছিল না। এর মাঝে ওর সাথে খিটিমিটি লেগেই থাকতো। মর্নিং সিকনেস ছিল না৷ কিন্তু মুড সুইং খুব হতো। এই খুশি, এই কান্না, এই রাগ, এই হতাশা। ও মাঝে মাঝে রেগে যেতো। মুড সুইং এর বাহানা দিয়ে আসলে সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করা, তারপর ‘আমার মুড সুইং হয়েছে তাই এইরকম করেছি’ এসব বলা মোটেও ঠিক না। এইজন্য যতই ঝগড়া হতো, দিন শেষে আবার কান্না করে ওর সাথে সব ঠিক করে ফেলতাম।
সেবার কোনো বইয়েও হাত দিলাম না। বইমেলাতেও গেলাম না। তবে জানুয়ারী মাসে রৌদ্রময়ী পেইজের ‘প্রি-নাটাল কোর্স’ এ ভর্তি হলাম। সেখানে প্রেগ্ন্যাসির জন্য প্রস্তুতি, প্রেগ্ন্যাসিতে খাওয়া দাওয়া, নিজের যত্ন নেয়া, ব্যায়াম, কোন ট্রাইমিস্টারে কি করতে হবে, সি-সেকশন হলে কি করতে হবে, নরমাল ডেলিভারির জন্য কি করতে হবে, ডেলিভারির সময় কিভাবে লেবার পেইন ম্যানেজ করতে হবে, বেবি হওয়ার পর তার যত্ন, এমনকি বাচ্চার বাবাদেরও যে ডিপ্রেশন হয়- এসবও শিখালো। এক মাসের সেই কোর্সটা আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসলো আমার মনে। আমার কনফিডেন্স তখন অনেক। একটুও দুশ্চিন্তা হয় না নিজেকে নিয়ে।
ফেব্রুয়ারী মাসে ডক্টর আমার পলি সিস্টের ওষুধ বন্ধ করে দিল, মিসক্যারেজের ওষুধও বন্ধ। আমি আরও নিশ্চিন্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাফেরা করছি।
দেখতে দেখতে মার্চ চলে আসলো। মার্চের ৭ তারিখ দুপুর থেকে কেমন পানি পানি ভাঙছিল। ৮ তারিখ থেকে খেয়াল করলাম, আমি কোনো রকম নড়াচড়া ছাড়াই পানি আসতেছে। ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। একেবারে সটান হয়ে শুয়ে থাকি। পরদিন ৯তারিখে দুপুরেই ইবনে সিনাতে চলে যাই এনোম্যালি স্ক্যানের জন্য। এটাও একটা আল্ট্রা। মূলত ৫-৬ মাসের মাঝে এই আল্ট্রা করে দেখা হয় বাচ্চার সব অর্গান ঠিক মতো ডেভেলপ হয়েছে কিনা। অনেক সময় জেন্ডারও দেখা হয়। ইবনে সিনায় ডাক্তারের রিকমেন্ডেশান ছাড়া এনোম্যালি স্ক্যান করতে রাজী হচ্ছিল না। কারণ অনেকেই জেন্ডার জানতে এই আল্ট্রা করে, পরে বাচ্চা নষ্ট করে/ ঝামেলা করে। আমি জোর করে করলাম। আল্ট্রার ডক্টর আর নার্স এর মুখ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। দু’বার জিজ্ঞেস করেও জবাব পেলাম না। নার্স বলল,
-আপনার ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে জেনে নিয়েন।
তখনও জানি না আমি কত বড় সর্বনাশের রাস্তায়।
বাসায় আসলাম দুরু দুরু বুকে। বাসায় আম্মু, বড় কাকী, মেঝ ফুপি, আমার ফুফাতো বোন মিম সবাই হাজির। সবার মুখ ভয়ে পাংশুটে হয়ে আছে। এত আগে পানি ভাঙা কত খারাপ, এখন আমার কি হবে, এসব ভেবে সবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। সন্ধ্যায় ডক্টর এর কাছে গেলাম। ডক্টর কে বললাম, আমার প্যাড ভিজে যাচ্ছে। উনি চেক করলেন। উনার সামনে কিছুই বের হলো না। আর উনি আল্ট্রার রিপোর্ট ঠিক মতো না দেখেই বললেন, এসব কিছু না। প্রেগ্ন্যাসিতে এসব হয়ই। একটা ওষুধ দিয়ে কমপ্লিট বেড রেস্ট দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অথচ আমার আল্ট্রার রিপোর্ট এ দুই যায়গায় বোল্ড করে লিখা 21 weeks pregnancy with short cervix.
Cervix নির্দিষ্ট সময় এর আগে এর ছোট হওয়া মানেই বিপদ সংকেত। আমার ডক্টরের একটা বেখেয়াল তখন আমাকে জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অভিজ্ঞতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল আমাদের সবার অগোচরে!
২য় পর্ব
মানুষের যখন বিপদ আসে, তখন সব দিক থেকেই ভুল হয়। আমার কাজিনের মেয়ে গাইনী ডক্টর, আমার আরেক কাজিন শিশু ডক্টর, তার হাজবেন্ড মেডিসিন ডক্টর, আমার দুই ফ্রেন্ড ডক্টর। এদেরকে আমি সব রিপোর্ট আল্ট্রা পাঠাই। অথচ সেই রিপোর্টটা আমি কাউকে পাঠাইনি। এমনকি আমি নিজেও যদি ভালো মত খেয়াল করতাম, আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পারতাম। প্রিনাটাল কোর্সে সার্ভিক্স নিয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছে।আমরা পুরো রিপোর্ট পড়েছি, মেয়ে হবে সেটা নিয়েও গবেষণা করেছি, বেবির নাকের হাড়, মাথার খুলি, দুটো কিডনি, হার্ট, সব কিছু হয়ে গেছে-সেসবও পড়েছি। কেবল শর্ট সার্ভিক্স লেখাটা খেয়াল করিনি।
আমি বাসায় ফিরে নিশ্চিন্তে আগের মত টুকটাক কাজ করছিলাম। ডক্টর যেহেতু বলেছে স্বাভাবিক, আমার বাড়ির মানুষজনও চিন্তামুক্ত। আমার বুয়াও ৮ তারিখের পর আসেনি। অথচ ৯তারিখ থেকে আমার বিপদ শুরু হয়ে গেছে অজান্তেই। বুয়ার এবসেন্সে আমাকে কিছুটা হলেও বেশি কাজ করতে হচ্ছিল।
১২ মার্চ, ২০২১, শুক্রবার।
আমি ৯ তারিখের পর আমার মেঝ বোনকে আমার বাসায় এসে থাকতে বললাম। ও আমাদের পাশের রুমে থাকতো। শুক্রবারে ওকে বললাম,
-মেয়ে হলে নাম রাখবো তামারা বিনতে তারেক, ছেলে হলে তালহা বিন তারেক। আর ওকে নিয়ে ইনশাআল্লাহ আমরা ওমরাহ করতে যাব। বিয়ের পর পরই তো যাওয়ার নিয়ত ছিল, হলো না। এবার যাবো।
বিকেলে ও বলল, ওর তিন বা চারজন কলিগ আসবে। কিছু নাস্তা করতে। আমার শরীর খারাপ তাই বললাম, নুডুলস আর কফির বেশি কিছু করতে পারবো না। সাথে আমার মেঝ বোন আফনান আর বড় চাচাতো বোন তানিয়া আপু ছিল। ওরাই আমাকে সন্ধ্যায় সব করতে সাহায্য করলো। আমি একটু নুডুলস আর কফি নাড়া দিতে দিতেই এত ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম! মনে হচ্ছিল দুই পায়ে অনেক ওজন, আমার শরীর আর কাজ করছে না, কোমর ধরে আসছে। আগের দিন রাতেও এরকম মনে হচ্ছিল, সেদিন আবার। আমি কোনোমতে ওদের নাস্তা রেডি করে তারেককে বললাম নিয়ে যেতে। তারপর নিজেরা কফি আর নুডুলস নিয়ে হেলান দিয়ে বসে বসে গল্প করছিলাম।
৯ টার দিকে আফনান নিজের কিছু জিনিস আনার জন্য বাসায় গেল, তানিয়াপুও চলে গেল। আমি তখন অনেক কষ্টে উঠে ডাল রান্না করলাম। দুপুরের আগের দিনের তরকারি খেয়েছি। রাতে খাওয়ার মতো এখন কোনো তরকারিই নেই। ডাল রান্না করতে করতে আমার বান্ধবী নিশি কল দিল। ওর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বললাম,
-বাসায় খাওয়ার মত তরকারি নাই একটাও। রান্না করবো, সেই এনার্জিও নাই। আমি জানি না তারেক কি খাবে। এই কয় মাসে ঠিক মতো রান্নাও করতে পারতেছি না। দেখি, আম্মু একটু তরকারি দিলে ও খাবে নে। আমার খাওয়ার রুচিও নাই।
ওর ফোন কেটে আফনানকে কল করে বললাম,
-আম্মু যেন দুই টুকরো মাছ তরকারি পাঠায়। কালকে রান্না করবো। আজকে তোদের দুইজনের রাতের খাবার হয়ে যাবে।
তারপর চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পায়ের ব্যথা তখন কোমর পর্যন্ত উঠে এসছে। ঘড়িতে ৯.৩৫।
তারেক কিছুক্ষণ পর বাসায় ঢুকে আমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? বললাম খারাপ লাগার কথা। তারপর কিছুটা ঘুমিয়ে উঠলাম সাড়ে দশটার দিকে। খাবার না খেলেও এশার নামাজ পড়া হয়নি। আমি চেয়ারে বসে নামাজ পড়ি তখন। চেয়ার বসা অবস্থায় এশার দুই রাকাত সুন্নতের মাঝে শেষ রাকাতে যখন আমি, তখন প্রচন্ড ব্যথা হিট করলো। আমি নামাজের মধ্যে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আফনানও তখন বাসায়। আমার কান্না শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠলো। তারেক বিছানাতেই শুয়ে ছিল। আমি সালাম ফিরে ওদেরকে বললাম, আমার প্রচন্ড পেট ব্যথা। আমি সহ্য করতে পারতেছি না একদমই।
আমার কাজিনকে কল দিল আফনান। আপু বলল, এলজিন খেয়ে শুয়ে থাকতে। এলজিন খেয়ে শুয়ে থেকে পনের বিশ মিনিট পর বেতর নামাজ পড়লাম। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারেক আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
ঠিক রাত ১.১৫ মিনিট ঠাস করে কিছু একটা ফেটে পানিতে পুরো বিছানা ভেসে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলাম,
-তারেক! আমার পানি ভেঙে গেছে!
৩য় পর্ব
রুমের আলো জ্বেলে আমার অবস্থা দেখে ও দিশেহারা। কখনো তো এমন কিছু দেখেনি! কি করতে হবে, জানেও না! আমি চিৎকার করে বললাম,
-ব্যাগ নাও। আমার একটা ড্রেস আর স্কার্ট নাও, টাওয়েল নাও। আমার গায়ের গোল্ডগুলো খুলে আফনানকে দাও।
আফনান তখন বাসায় ফোন দিয়েছে। আমার ভাই দৌড়ে এসেছে। তারেক ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে যখন দাঁড় করালো, তখন বাকি পানি টুকুও পড়ে গেছে। বিছানার চাদরেই আমাকে পেচিয়ে নিল ওরা। তারপর গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলাম আর আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। এমন কোনো দুয়া নাই যেটা পড়ি নাই। শুধু কান্না না করে দুয়া পড়ে গেলাম। লেবার পেইন তো আছেই।
নিচে তখন উবার দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ানকে ঘুম থেকে তুলে বের হলাম। একজনের কোলে মাথা রেখে আরেকজনের কোলে পা রেখে পেছনের সিটে শুয়ে ছিলাম। উবার ড্রাইভারকে বলল মিরপুর ইবনে সিনায় নিতে। কিন্তু সেটা অনেক দূর। উবার ড্রাইভার বলল, উনাইটেড হসপিটালে নিতে যেটা প্রাক্তন আয়শা মেমোরিয়াল। মহাখালী তুলনামূলক কাছে, তাই ওখানেই গেলাম। স্ট্রেচার, লেবার রুম, এসব পার হয়ে ওরা আমাকে ভর্তি করতে বাধ্য হলো। রাতে ডিউটি ডক্টর আছে, বড় ডক্টর নেই। এজন্য রাতটা অবজার্ভেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নিল।
আড়াইটার দিকে ডিউটি ডক্টর চেষ্টা করলো আমার বেবির হার্টবিট পাওয়া যায় কিনা শোনার। খুব একটা পেলো না। আমি তখনও ডেকে যাচ্ছি আল্লাহকে, আমার বেবিটা তুমি নিও না, আমার পেটে যেন একটু হলেও পানি থাকে, প্লিজ আল্লাহ!
সারারাত ছটফট করে লেবার পেইন নিয়ে কাটলো। কেবিনে একটাই বেড থাকায় সোফার দুই মাথায় তারেক আর আফনান বসে থেকে থেকে রাত কাটালো। ভাইয়া তিনটার দিকে বাসায় চলে গিয়েছিল। আমি যতবার ব্যথায় গুঙিয়ে উঠতাম, ততবার ওরা দুজন ছুটে আসতো। কিন্তু কারো কিছু করার ছিল না। ফজরের দিকে কান্না করে বললাম, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। নার্স এসে অক্সিজেন লাগিয়ে দিল। আমি তখনও বাম কাতে শুয়ে আছি কারণ প্রেগ্ন্যাসিতে বাম কাতে বাচ্চা বেশি অক্সিজেন পায়। আমি কেবল আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছি।
৬টার দিকে আম্মু হাস্পাতালে আসলো। ব্যথা কমার যত দুয়া আছে, সব পড়লো, পড়ালো, আমাকে খাওয়ালো। আমি দেয়ালে হাত দিয়ে তায়াম্মুম করে ফজর পড়লাম। আশা এই যে, বেবিকে আল্লাহ সেইভ করবেন। কেবিনের টিভিতে লাইভ মক্কার চ্যানেল চলছে। আমি বারবার সেখানে তাকাই আর আল্লাহকে ডাকি। মনের ভেতর কু ডাক ডাকছে শুধু।
৯.২০ এ ডক্টর সানজিদা রহমান আসলেন তার মেডিকেল টিমসহ। যেহেতু এটা একটা মেডিকেল কলেজ আর উনি একজন প্রফেসর, তাই প্রতিবার মেডিকেল টিমসহ আসতেন। উনি আমার পিভি চেক করলেন। তখন উনার হাত ভর্তি হাল্কা সবুজ শ্লেষা। উনি সেটা দেখেই বললেন,
-ওর তো ভেতরে পুরো ইনফেকশন হয়ে গেছে!
তারপর টিমসহ বাহিরে গেলেন, সাথে তারেক আর আম্মু গেল। হাসপাতালে তখন ওরা দুজনই আছে, আমার বোন বাসায় চলে গেছে।
কেবিনের ভেতর তখন আমি একা। মিনিট খানেক পর শুনলাম আম্মু জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আমি চোখ বন্ধ করে বুঝে গেলাম, আর কোনো আশা নেই। ওরা দুজন একটু পর দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো। আম্মু কান্নার দমকে আমার দিকে তাকাতে পারছিল না। সে অন্য দিকে ফিরে সোফাতে গিয়ে বসলো। তারেকও চশমা পরে স্বাভাবিক থাকার খুব চেষ্টা করছিল। আমি হাত তুলে ওকে ডাকলাম। ও কাছে এসে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি ঠান্ডা মাথায় শান্তভাবে বললাম,
-ডক্টর কি বললো? তুমি বলো, আমি ভয় পাবো না।
ও বলার সাথে সাথে কেঁদে ফেললো,
-বেবিকে আর রাখা সম্ভব না।
আমি চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ছেড়ে বললাম,
-নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করবেন, তার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলার স্পর্ধা আমাদের নাই।
আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল ছিল, কিন্তু তার ভয়াবহ অগ্নি পরীক্ষা কত কঠিন, সেটা আমরা ফিল করতে পারলাম। আমাকে লেবার রুমে নিয়ে গেল। ওকে বলেছিল, আরও ২ সপ্তাহ মেডিসিন দিয়ে বাচ্চা রাখা যাবে। কিন্তু ২২ সপ্তাহ অনেক আর্লি। এত ছোট বাচ্চা পানি ছাড়া বাঁচবে না। পাশাপাশি ভেতরে হওয়া ইনফেকশন আমার শরীরেও ছড়িয়ে যাবে। তখন আমাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে। তারেক তাই আমাকে সেইভ করতে বললো।
তারপরও ডেলিভারি রুমে ও একবার ঢুকে গিয়েছিল, যদি এখনো উপায় থাকে বেবিকে বাঁচানোর। কিন্তু ততক্ষণে আমাকে মেডিসিন দিয়ে দিয়েছে। বেবি নরমালি ডেলিভারি হবে। ডেড।
একটা বাবা হিসেবে তারেক কিছুই করতে পারে নাই সেদিন। ও হাউমাউ করে কান্না করেছে। ওর কান্নার সাক্ষী আম্মু। আমাদের মেয়েদের কান্না খুব স্বাভাবিক, একটুতেই কান্না করি। কিন্তু ছেলেরা ভয়াবহ কষ্ট ছাড়া চোখের পানি ছাড়তে পারে না। সেখানে একটা ছেলে যখন এভাবে কান্না করে, কল্পনা করা যায় সে কত আঘাত পেয়েছে? আমি লেবার রুমে ছটফট করে নরমালে বেবিকে জন্ম দিলাম, যে কিনা কান্না করেনি, ওদিকে একজন বাবা কেঁদে যাচ্ছে…।
৪র্থ পর্ব
বেবি ডেলিভারির পর ওকে আমার উরুর উপর রাখা হলো। আমার তখন পুরো শরীরের সব শক্তি শেষ। একেবারে শান্ত আমি, কোনো ছটফটানি নেই। শক্তি না থাকা সত্ত্বেও শান্তভাবে চোখ খুলে নার্সকে বললাম,
-আমাকে একটু ওকে দেখাবেন?
-না আপু, আপনি না দেখলেই ভালো হবে। দেইখেন না।
-আমি অনেক শক্ত, আমি ভয় পাবো না। প্লিজ, একবার দেন না?
-না আপু। আপনার কষ্ট হবে। আপনার আবার বাচ্চা হবে, একদম ভেঙে পড়বেন না। আপনি সুস্থ আছেন।
নার্স আমাকে কিছুতেই বেবিকে দেখতে দিল না। আমি যে নিজ থেকে ওকে কোলে নিব, সেই শক্তিও ছিল না। একটা সবুজ কাপড়ে ও মোড়ানো ছিল, ওর মাথার তালু দেখতে পাচ্ছিলাম। লাল রঙের, রগ গুলোও দেখা যাচ্ছে। আমি কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার মেয়ে তামারা! তোমাকে তোমার মা জন্ম দিল, কিন্তু কোলে নিতে পারলো না!
কিছুক্ষণ পর আমাকে ক্লিন করে কেবিনে দিল। সাথে বেবিকে সবুজ কাপড়ে মুড়িয়ে বক্সে করে দিয়ে গেল। আম্মু কাঁদছে। আমার বোন আসলো কিছু সময় পর, এক ভাসুর আসলো, ওর দুই বন্ধু আসলো, ভাইয়া আসলো। সবার মুখ অন্ধকার। বলার মত ভাষা কারো নেই। একটা নবজাতক আসলে সবার কত উচ্ছাস থাকে! আগের দিনও সবার কত উচ্ছাস ছিল, পরিকল্পনা ছিল। একদিন পরই সব শেষ। বাক্স খুলে কেউ দেখবে, সেই সাহস কারো নেই।
আফনান আর তারেক আমার সাথে রয়ে গেল। খবর পেয়ে আমার শশুর, শাশুড়ী আর ছোট ননদ সকালেই ঢাকা চলে এসেছে। আম্মু সকাল থেকে হাসপাতালে ছিল বলে আম্মু বক্সটা নিয়ে ভাইয়ার সাথে বাসায় চলে গেল। বাসায় তখন সবার উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে, ছোট থেকে বড়। ওর ছোট নিখুঁত কান, রক্ত জমাট বাঁধা হাত পা, সব মিলিয়ে ৫০০ গ্রামের কম শরীরটা দেখে প্রত্যেকে কেঁদেছে। আমার ছোট বোন গুলো সহ্য করতে পারছিল না। ওকে তারপর কবর দেয়া হলো। আমি দেখলাম না, ছুঁলাম না। মা হয়ে গেলাম, কিন্তু মা ডাক শোনার সুযোগই থাকলো না।
বাচ্চার বাবার দশা আরও করুণ। আমার সামনে সে কাঁদতেও পারে না, কেবল মাথা নত করে থাকে।
সেদিন ১৩ মার্চ, ২০২১, শনিবার।
আমার মাথায় বারবার ঘুরছে, আমি নিজে বাঁচার জন্য আমার মেয়েকে মেরে ফেললাম। কেন ওকে বাঁচানোর কোনো উপায় থাকলো না? কেন ও এভাবে চলে গেল? কার দোষ ছিল? আমার? নাকি অন্য কিছু দায়ী?
আমাকে একদিন অবজার্ভেশনে রেখে রিলিজ দিয়ে দিল। সাথে জানালো কত দিন পর টিভি আল্ট্রা করে তার কাছে আবার আসতে হবে। আরও কিছু টেস্ট করতে হবে। যেমন- রুবেলা, লুপাস এন্টিকোলাগল্যান্ট সহ আরও কিছু টেস্ট। রুবেলার কথা অনেকেই জানে, লুপাস এন্টিকোলাগল্যান্ট বা এলএ টেস্ট হলো মায়ের একটা সমস্যা যার কারণে ব্লাড কট হয়ে বাচ্চার কাছে খাবার, পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং বাচ্চা মারা যায়। যার এলএ পজেটিভ হয়, তার বারবার এই কারণে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। একারণে পুরো প্রেগ্ন্যাসি ইঞ্জেকশন এর উপর থাকা লাগে। শিল্পা শেঠীর একটা ইন্টারভিউ দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। ফিটনেসে পার্ফেক্ট এই মহিলা এলএ পজেটিভ। প্রথম বাচ্চা এবরশনের পর সেকেন্ড বেবির সময় সে ইঞ্জেকশন এর উপর ছিল। তার দুই পায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল ইঞ্জেকশন নিতে নিতে।
যাই হোক, আমি পরদিন রবিবার বাসায় রওনা দিলাম। তখন দুপুর পৌনে দুইটা যখন আমার বাসার কাছে পৌঁছাই। যেহেতু বেবি নেই, আমারও নরমাল ডেলিভারি, তাই বাবার বাড়ি যাইনি, নিজের বাসাতেই আসলাম। বাসার সামনের গলিতে যখন আসলাম, তখন থেকে আমার বাঁধ ভাঙা কান্না। আশেপাশের সবাই আমাকে দেখছে জানার পরও আমি ওর হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এক একটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি যখন নিচের গেটে ঢুকছি, আমার দুই রাত আগের স্মৃতি মনে পড়ছে। তামারাকে পেটে নিয়ে এখান থেকে বের হয়েছিলাম। এখন ও নেই। প্রতিটা সিঁড়ি ভাঙতে আমার কষ্টে দম আটকে যাচ্ছিল। আমি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত চার তলা উঠে আমার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। এই বাসার ভেতর থেকে সেদিন কত দুয়া পড়তে পড়তে গিয়েছি! কিচ্ছু কবুল হয়নি। এখন এই বাসায় আমি ওকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?
তারেক আর আফনান আমাকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। আমি এসে গরম পানি দিয়ে গোসল করলাম, খেলাম। তারপর বাচ্চাদের মত চুপ করে শুয়ে পড়লাম। বিকেলে বাড়িওয়ালী আন্টি আসলো ফল নিয়ে। আন্টি বলল, উনারও দুজন বাচ্চা মারা গেছে। উনার বাচ্চারা এত বেশি বড় হয়ে যেত যে বাচ্চারা শ্বাস আটকে মারা যেত। এখন তার দুই ছেলে মেয়ে। তার বড় মেয়ের নামও মারিয়া। আমি আন্টিকে বললাম,
-আন্টি, এখন তো দুইজন আছে। তবুও কি প্রথম বাচ্চার কষ্টটা ভুলতে পারেন? নিজের বাচ্চা হারানোর কষ্ট কি মৃত্যুর আগেও ভোলা যায়?
আন্টির চোখে পানি টলটল করছিল। একজন মায়ের যত গুলো সন্তানই হোক না কেন, প্রতিটা বাচ্চাই তার শরীরের অংশ। প্রথম বা দ্বিতীয় বলে সেখানে কোনো কথা নেই।
এরপর এক এক করে অনেকেই দেখতে আসলো আমাকে। যারা দেখতে আসতে পারেনি, তারা কল দিত। সবার একই প্রশ্ন, কিভাবে হলো? তুমি কি কিছুই বুঝোনি? কেউ কেউ বললো, আমার ঐ ডাক্তারকে ধরা উচিত। উনি এত বড় ভুল কিভাবে করলেন? কিন্তু সেই ডাক্তারকে ধরলেও বা কি হবে? আমার মেয়ে কি ফেরত আসবে? আমি কি আর আগের অবস্থানে যাবো? ভুল তো আমারও হয়েছে। ফ্যামিলিতে এতগুলো ডাক্তার থাকতেও কাউকে আল্ট্রার রিপোর্ট দেখাইনি।
প্রতি রাতে বরকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতাম আমি। আহা, দুই দিন আগেও ওর নড়াচড়া আমি টের পেতাম। সাড়ে পাঁচ বা ছয় মাস পর্যন্ত বেবি মুভমেন্ট একজন মাই কেবল অনুভব করতে পারে। বাহির থেকে কেউ বুঝতে পারে না। আমি যখনই ওর বাবাকে বুঝাতে যেতাম, বেবি চুপ হয়ে যেত। ওর বাবা হাত সরিয়ে ফেললে আবার নড়তে শুরু করতো। আমি বলতাম, বেবি লজ্জা পাচ্ছে। অথচ এখন সেখানে কোনো অনুভূতি নেই, একেবারে শূন্য।
এই সময় আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা ছিল এই হাদীসটা-
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কারও সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করে ফেলেছ?’ তারা বলেন ‘হ্যাঁ’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তার কলিজার টুকরার জান কবজ করে ফেলেছ?’ তারা বলেন‘হ্যাঁ’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলেন, ‘আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে।’ তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর এবং তার নামকরণ কর ‘বাইতুল হামদ’, অর্থাৎ, প্রশংসার ঘর।’ (তিরমিজি সূত্রে রিয়াজুস সালেহিন : ১৩৯৫)।
তাছাড়াও অনেক হাদীসে আছে, যেসব বাচ্চা ছোটবেলায় মারা যায়, তারা জান্নাতে প্রজাপতির মতো উড়ে। মেরাজের রাতে ইব্রাহিম আঃ কে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এসব বাচ্চাদের দায়িত্বে থাকতে দেখেছেন। আবার আমাদের রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সব ছেলে মারা যায় তার জীবদ্দশায়। আইয়ুব আঃ এরও সব সন্তানকে আল্লাহ নিয়ে যান। এইসব ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম। তবুও মন মানতো না। মাঝরাতে অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে তাকিয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলতাম, আল্লাহর কাছে কান্না করতাম। আসলে আমরা সবাই কত অসহায়! জীবনের কিছু কিছু সময় টাকা, সম্পদ, ক্ষমতা কিছুই কোনো কাযে আসে না। আল্লাহর সিদ্ধান্তের কাছে সবাই অসহায় হয়ে যায়। মৃত্যুও তেমন একটা বিষয়। এটা কারো নিয়ন্ত্রণে নেই।
আমার মেয়েকে এমনিতেই কোনো জানাজা বা গোসল ছাড়াই দাফন করা হয়। কিন্তু আমার মন মানছিল না। আমি জানতাম, ১২০ দিনের দিন একজন মানুষের দেহে রূহ দেয়া হয়। তার মানে ১২ দিন বা ৪ মাস থেকে একটা বাচ্চা পুর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৪ মাসের পর মারা গেলে বাচ্চাটা বাবা মায়ের জন্য কেয়ামতের দিনও আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। তাহলে কেন বাচ্চার জানাজা, গোসল হবে না?
খোঁজ নিয়ে জানলাম, গোসল জানাজা ও প্রোপার দাফন করতে হবে। কিন্তু আব্বু বলল, কোনো বাচ্চা নাকি না কাঁদলে সেই বাচ্চার জানাজা হয় না। আমাদের পরিবারে আগে যত বাচ্চা মারা গেছে, কারো জানাজা হয়নি। এসব নিয়ে আব্বুকে প্রেশার দিলাম। তখন আব্বুও জানলো, একটা বাচ্চাকে গোসলের মত দিতে হবে, তার জানাজা হবে, দাফন হবে এবং তার নামও রাখতে হবে যেই নাম দিয়ে কেয়ামতের দিন তাকে ডাকা হবে।
আমার মেয়ে মারা যাওয়ার পরের শুক্রবার আব্বু ওর গায়েবী জানাজা পড়ালো। ওর নাম ঠিক করাই ছিল- তামারা বিনতে তারেক।
এরপর আসলো আমার আরেক স্ট্রাগল।
তোমার বাচ্চা কেন মরলো? তুমি কি করছ? তুমি মাগরিবের সময় বের হইছিলা, তুমি যে লেকের পাড়ে গেছিলা, এইজন্য দোষ পড়ছে! জ্বীনের চোখ পড়ছে! এইজন্য ও মরছে! বাচ্চার শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল এইজন্যই! জ্বীনে মারছে! অথবা তুমি যে পাপ করছো, পছন্দে বিয়ে করছো, এইজন্য বাপ মায়ের অভিশাপ লাগছে!
এইসব মন্তব্য এমন সব কাছের মানুষ থেকে এসেছে যারা রক্তের সম্পর্কের, চাইলেও এদের থেকে দূরে থাকতে পারবো না। এসব মন্তব্যে আম্মুও বিশ্বাস করে আমাকে বকলো। কারণ আম্মুর কানের কাছে সারাক্ষণ এসবই বলতো তারা। ডাক্তারও নিশ্চিত হতে পারছিল না আমার এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা কারণ সম্পর্কে। তবে আমি রুবেলা পজেটিভ ছিলাম। ডক্টর বলেছে, রুবেলার জন্য হতে পারে কারণ রুবেলার সংক্রমণের সাথে এই দুর্ঘটনার মিল আছে। তারপরও দোষ আমার উপর পড়লো। যেন আমি জেনে বুঝে আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছি!
আমি ফ্রাস্ট্রেশনে কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ব্যথা হয়ে যেত। বাচ্চা তো আমার, আমাদের! আমরা আমাদের বাচ্চা হারালাম! সবচেয়ে বেশি আঘাত তো আমরা পেয়েছি! অথচ পুরো বিষয়ে দোষও আমারই হলো! এই মানসিক কষ্টে আমি আগের দুঃখ ভুলবো কি, আরও ট্রমাটাইজড হয়ে গেলাম।
৫ম পর্ব
আমাকে ডক্টর সানজিদা রহমান বলেছিলেন টিভি আল্ট্রা করতে আনোয়ার খান মর্ডান এ ডক্টর হুমায়রার কাছ থেকে। সেখানে গেলাম সকাল ১০টায়। আল্ট্রার সিরিয়াল আসতে আসতে ৩.১৫। আল্ট্রা পেতে সন্ধ্যা ৬টা। সারাটা দিন এইখানেই খতম। এরপর ডক্টর এর কাছে যাওয়ার পর উনি বললেন, এখনো ভেতরে কিছু ব্লাড কট আছে। মাস খানেক পর সেটা চলে যাওয়ার কথা। তবুও না গেলে ডিএন্ডসি লাগবে। এক মাস পর আমি আল্ট্রা করিনি। দুই মাস পরে গিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সব ঠিক ছিল।
আমি খুব দ্রুত আবার একটা বেবির জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। প্রথম বার আল্লাহর কাছে একবারও বলিনি, আল্লাহ আমাকে একটা বেবি দাও। বরং মাসের পর মাস দ্বিধার পরে বলেছিলাম, আল্লাহ! যদি আমার জন্য কল্যাণ মনে করো, তাহলে আমাকে সন্তান দিও। আর যদি অকল্যাণ মনে করো, তাহলে দিও না। তুমি যে ফয়সালা করবা আমি তাইই মেনে নিব!
আল্লাহ তখন খুশি হয়ে আমাকে মেয়ে দিয়েছিল। আবার উনি সেই মেয়েকে নিয়েও গেলেন। এই নিয়ে আসলে আমার অভিযোগের কিছু নেই। জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলতে গেলে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আমরা যেমন একজন মানুষের জন্মকে সর্বাবস্থায় স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে, এবরশন, তার খরচের চিন্তায় অস্থির হওয়া যাবে না, তেমনই মৃত্যুকেও স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। আমার মেয়ের আমাদের ছেড়ে যাওয়াকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো আমাকে শান্তি দিচ্ছিলো না।
তামারাকে হারিয়ে ফেললাম, কিন্তু এর মাঝে আমার টেস্ট করতে হচ্ছে, আয়রন ট্যাবলেট খাচ্ছি, নিজের শরীর নিয়ে ডিল করছি, যে ফোন দিচ্ছে, তার সাথে কান্না করছি, বাচ্চা হারানোর দায় মাথায় ঘুরছি। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিল যে, তামারার নড়াচড়া আর আমি অনুভব করতে পারছিলাম না। আমার ভেতরটা খালি হয়ে গিয়েছিল। ৫ বা ৬ মাস পর্যন্ত বেবি মুভমেন্ট একজন মাই কেবল বুঝতে পারে। ৬ মাস থেকে অন্যরা পেটে হাত দিলে হালকা মুভ বুঝে। তার আগের সবটা অনুভূতি মায়ের একারই। তামারার মুভ আমি চার মাস থেকেই বুঝতাম। মাঝে মাঝে যখন ওকে হাত রাখতে বলতাম, ও হাত রাখলেই বেবি থেমে যেত, যেন লজ্জা পাচ্ছে। ও হাত সরিয়ে ফেললে আবার ছটফট শুরু হতো। সারারাত বাচ্চাটা আমার মাঝে ঘুরে বেড়াতো। আমি একা বাসায় বসে বসে ওর সাথে টুকটাক কথা বলতাম। অথচ ও আমার মাঝে তখন আর নেই! আমার খাবারেও যার ভাগ ছিল, সে এখন আর পৃথিবীতেই নেই। ওর অস্তিত্ব পৃথিবীতে এক মাত্র আমিই অনুভব করতে পারতাম, সেই আমিই ওর অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি মুষড়ে পড়েছিলাম।
না, ভুল বললাম। ওর বাবাও কষ্ট পাচ্ছিল। মেয়েকে হারানোর এক দিন পর ওর প্রমোশনের ভাইভা ছিল। ছয় মাস পর ওর প্রমোশন লেটার ঠিকই আসলো। আমাদের সৌভাগ্যের চাবি, আমাদের মেয়ে আমাদের ছেড়ে গেলেও সৌভাগ্য যায়নি। এক দিক থেকে এসবও সান্ত্বনা ছিল।
এপ্রিলে ৮/১০ তারিখ হবে। তখন রমজান মাস চলছে। আব্বুর করোনা ধরা পড়লো। আমার মেয়ে হারানোর মাসও পার হয়নি। আগের বছর বড় কাকা, বড় ফুপি মারা গেল। এই বছর পাগলের মত সিট খুঁজে আব্বুকে ভর্তি করলাম বনশ্রী এডভান্স হসপিটালে। দুইদিন ওয়ার্ডে থেকে তারপর কেবিনে। বাসার সবার টেনশন। সপ্তাহ খানেক পর বাসায় আনা হলো। আবার একদিন পরে আব্বুর প্রেশার বেড়ে গেল। ওষুধেও কন্ট্রোল হচ্ছে না। আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। আল্লার কাছে কান্না করে বললাম, এই বছর আমার মেয়ে তো চলেই গেল। আর কাউকে নিও না। আমাদের ঘর আর খালি করিও না।
আল্লাহর রহমতে আব্বু ইদের আগেই সুস্থ হলো। আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম আবার কন্সিভের জন্য। এক মাস সময়ও নিতে চাচ্ছিলাম না। আমার বোন, যিনি ঢামেক এর পেডিয়াট্রিক বিভাগে আছেন, উনি বললেন, ‘বেবিটা সাড়ে পাঁচ মাস তোর ভেতর ছিল।ও তোর অনেক পুষ্টিই নিয়ে নিয়েছে। এখন যদি আবার কন্সিভ করিস, তাহলে এই বেবিটা পুষ্টি কম পেতে পারে। তোর উপরও প্রভাব পড়বে’
‘তাহলে কত দিন গ্যাপ নেয়া আইডিয়াল?’
‘৬ মাস। আমরা বলি ৬ মাস গ্যাপ দিলে মায়ের শরীরে পুষ্টির অভাব পূরণ হয়। এরপর আবার কন্সিভ করলে বেবি পুষ্টি পায়’
‘আচ্ছা আপু, আমার বেবিটাকে কি কোনোভাবেই সেইভ করা যেত না?’
‘দেখ, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্য। যদি রুবেলার জন্য এমন হয়ে থাকে, তাহলে যা হইছে, তা তোদের দুইজনের জন্যই মঙ্গলজনক। কারণ রুবেলা হলে বেশিরভাগ বাচ্চাই সার্ভাইভ করে না। আবার করলেও হয় অন্ধ, কিংবা কোনো ডিস্ফাংশন নিয়ে জন্ম নেয়। একটা অন্ধ বা প্রতিবন্ধী বাচ্চা বাবা মায়ের জন্য কষ্টের কারণ, নিজের জন্যও। সবসময় মনে রাখবি, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই। একটা সুস্থ বাচ্চা সবসময় আশীর্বাদ’
সেদিনের আপুর কথাগুলো আমার জন্য ব্লেসিং ছিল। আমি আস্তে আস্তে শক্ত হই। তবে কাঁদতাম। মাঝে মাঝে মাঝরাতে যখন ও আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকতো, রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আল্লাহকে বলতাম, আমার মেয়ে কি আমাকে মাফ করবে আমি যে ওকে কোলে নিতে পারিনি, তাই?
ধীরে ধীরে সময় কাটতে লাগলো। আমার ওজন আগের চেয়ে বেড়ে গেল। ওজন বাড়ার চাইতে আবার কন্সিভ করলে ওজন যেন বাঁধা না হয়, একারণে জীম করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর মাঝে আমার শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এসে শখ জাগলো কাঁথা সেলাইয়ের। বিশাল কাঁথার কাপড় কিনে এনে বাসায় ফ্লোরে বিছিয়ে একা একা পুরোটা সেট করলাম। দুই সপ্তাহ লাগলো। তারপর বসে বসে সাইড গুলো সেলাই করলাম যেটাকে আমাদের এলাকায় বলে মুড়ি দেয়া। এই কাজ করতে গিয়ে কোমর ব্যথা হয়ে গেল। এত ব্যথা যে আমি কোনো ভাবেই শান্তি পাই না। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে কোনোভাবেই শান্তি নেই। তাই দ্রুত জীমে আবার এডমিট হলাম। আমি ২০১৩ থেকে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে বছরে দুই তিন মাস জীম করি। এটা হলো এরোবিক জীম। আমি সেখানে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করি না যদিও অনেক কিছুই আছে। এবারও তাই করলাম।
তখন সেপ্টেম্বর, ২০২১।
দুই মাস জীম করলাম, কিন্তু ওজন ৩কেজির পর আর কমে না। ওদিকে ১২ অক্টোবর থেকে আবার আমার এমএড ক্লাস শুরু হবে। ইভেনিং কোর্স করছি, জীমও বিকেলে, অগত্যা জীম ছেড়ে দিলাম। এখান থেকে শাহবাগ পর্যন্ত বাসে যেতাম। শাহবাগ থেকে হেঁটে আইইআর পর্যন্ত যেতাম। অনেক দিন পর পরীক্ষা, ক্লাস, অন্য রকম রিফ্রেশমেন্ট। মাঝে যে এত ঝড় গেল, তা থেকে কিছুটা মুক্তি পেলাম।
ভার্সিটির কিছু বড় আপু আমার কথা শুনে বললেন,
তুমি শুকরিয়া করো। তুমি একটা জান্নাতি বাচ্চার মা হয়ে গেছ! ইনশাআল্লাহ, আবার কন্সিভ করবা, আবার আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করবে। হতাশ হওয়ার কিচ্ছু নেই।
আমি আবিষ্কার করলাম, হাতে গোণা গুটি কয়েক আঘাত করা মানুষ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই আমাকে শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে, ভালোবাসে। গুটিকয়েক ফালতু মানুষের কথার কাছে এত এত মানুষের ভালোবাসা কি ফেলনা হতে পারে??
৬ষ্ঠ পর্ব
অক্টোবর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শুরু হলো বিচরণ, নতুন উদ্যমে। ক্লাসে যাই, যাওয়ার আগে মল চত্বরের পানি পুরি বা ভেলপুরি খাই। প্রথমে আগের সেমিস্টারের পেন্ডিং পরীক্ষা হলো। এরপর আসলো সাবজেক্ট চয়েজ। দুইটা বিষয় অন্য ডিপার্ট্মেন্টের নিতে হবে। আমি ল্যাঙ্গুয়েজ ডিপার্টমেন্ট এর হলেও আমার দ্বিতীয় পছন্দ ছিল সাইকোলজি। এজন্য নিলাম চাইল্ড সাইকোলজি। ওখানে যতজন মেয়ে ছিল, তার মাঝে শুধু একজন অবিবাহিত। আর বাকি সব মেয়েরা বাচ্চার মা। তাদের টার্গেট, তাদের বেবীদের সাইকোলজি নিয়ে জানা, টিচিং এ সেসব এপ্লাই করা। একমাত্র আমিই ছিলাম, মা হয়েও না হওয়া মা। সাহস নিয়ে বছরের শুরুতে প্রিনাটাল কোর্স করেছিলাম অপেক্ষারত অতিথিকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি হিসেবে। অতিথি চলে গেছে। তবুও নতুন উদ্যমে আবারও প্রস্তুতি নিচ্ছি।
চাইল্ড সাইকোলজি ওয়াজ ফান। এমএড এর পুরো কোর্সই আমার জন্য মোটামুটি ফান ছিল কারণ এমএড হলো বাস্তব জীবনে এপ্লাই বেইজড পড়াশোনা। এখানে থিওরি কম। পড়তে পড়তে একদিন আসলো প্রিনাটাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে। সেখানে দুটো ফেক্টর ছিল- টেরাটোজেন্স আর মেটার্নাল ফেক্টরস। টেরাটোজেন্স হলো পরিবেশগত উপাদান যেমন রেডিয়েশন, ড্রাগস, এলকোহল, টোবাকো, ইত্যাদি যেসব শিশুর মায়ের গর্ভে থাকতেই প্রভাব ফেলে। আর মেটার্নাল ফেক্টর গুলো হলো সব মায়ের অসুখ বা শারীরিক সমস্যা, শারীরিক ফ্যাক্ট গুলো। সেখানে রুবেলা, মাম্পস, এইডস, চিকেন পক্স, ইত্যাদি অসুখের কারণে বেবির কি কি ক্ষতি হয়, সেসব দেয়া। সেখানে রুবেলার কারণে লেখা- মিসক্যারেজ হতে পারে, লো বার্থ ওয়েট হতে পারে, ফিজিক্যাল ম্যালফাংশন হতে পারে, ম্যান্টাল রিটার্ডেশন হতে পারে।
ঐদিন আমি প্রথম সারির কোণায় বসেছিলাম যেকারণে স্যারের চোখ ছিল অন্য সবার উপর। আমি এক দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নেকাবের ফাঁক গলে আমার চোখ জোড়া থেকে সমানে পানি পড়ছিল। আমি কোনোভাবে সহ্য করতে পারছিলাম না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারছিলাম না। টুপটুপ করে চোখের পানিতে নিকাব ভিজে গেল, কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না সবার মাঝখানে থেকেও আমি কেমন ট্রমার মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ক্লাস শেষে স্যার একটা ভিডিও দেখিয়েছিল, কিভাবে কন্সিভের পর থেকে মায়ের গর্ভে বেবি ডেভেলপ হয়। আমি সেটা দেখে আধো আলো আধো অন্ধকারে নীরবে কেঁদেছি। সব ঠিক থাকলে আমার মেয়ে এতদিনে আমার কোলে থাকতো। সেখানে আমি রিক্ত হস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ক্লাস থেকে বের হয়ে সেদিন আর কারো সাথে তেমন কথা বলিনি। রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরটা আমার মতই লাগছে, নিঃসঙ্গ, একাকীত্বে মোড়ানো অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সব, হাজার হাজার ঘটনার নীরব স্বাক্ষী হয়ে। গাছ গাছালির ফাঁক গলে বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসা ছটাক ছটাক আলোয় কেবল পথটুকু দৃশ্যমান, চোখের কোলে জমা অশ্রু গুলো নয়।
আমার সাথে আমার যে বান্ধবী আসা যাওয়া করতো, সেদিন ওর সাথে বাসায় গিয়েছিলাম কিনা মনে নেই। কেবল মনে আছে, আমি ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম।
মাঝে মাঝেই মাঝরাতে একা ডাইনিং এ বসে কাঁদতাম। এই তো, পেটের এখানটায় বেবিটা মুভ করতো। আমার নিঃশ্বাসে ও নিঃশ্বাস নিত। কি ভুল করলাম যে জন্য ও চলে গেল? হয়ত আরেকটু সতর্ক হলে এমন হতো না। হয়ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে থাকলে এটা ঘটতো না। অথবা অন্য ডাক্তার কেন দেখালাম না। কিছু কিছু রাত নিঃসঙ্গ আর হাহাকারে ভরে থাকতো। পড়তে পারতাম না, লেখালেখিও করতে পারতাম না। চারপাশ থেকে হতাশা আমাকে চেপে ধরছিল।
এর মধ্যে আম্মু আমার ‘পড়া কালিজিরা’ নিয়ে আসে এক মহিলার কাছ থেকে। সে আমাকে আর আমার চাচাতো বোন, যে আপুরও সমস্যা, দুজনকে দিয়েছে। পিরিয়ডের প্রথম তিন দিন ঘুম থেকে উঠে কারো সাথে কথা না বলে গোসল করে ভেজা কাপড়ে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক চিমটি খেতে হবে!
আমি কিছুক্ষণের জন্য মাননীয় স্পিকার হয়ে গেলাম। কি বলে আম্মু এসব?! হাসি চেপে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,
-সকালে যদি ভুলে ওর সাথে কথা বলে ফেলি?
-বলবি না কথা!
-এত সকালে শীতের মধ্যে গোসল করবো? এমনেই তো পানি ধরতে ইচ্ছা করে না!
-না করলেও করতে হবে!
-ভিজা কাপড়ে কোন ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খাবো? আমি কি এখন ফ্ল্যাটের সামনে দরজা খুলে সকাল সকাল সঙ সেজে ভিজা কাপড়ে এগুলা খাবো? ফ্লোর ভিজে যাবে না? আজব!
-নিয়ম তো নিয়মই। তুই বাসায় বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খাবি।
-বুঝলাম না! জীবনেও তো আপনি এসব করেন নাই, বিশ্বাসও করেন নাই। তাহলে এখন কেন? আমি এমনিই ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়ে খেলে হবে না?
-সবারই তো চিকিৎসার একটা নিয়ম থাকে! কি জানি, এটা হয়ত তার নিয়ম!
আমি মনে মনে মুখ ভেঙচালাম। ঘোড়ার ডিম! কালিজিরা আর মধু- হাদীস মতে এই দুটো মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের ঔষধ। বাকি থাকলো সকালে ঘুম ভেঙে খাওয়ার ব্যাপারটা। ঘুম থেকে উঠার পর বাঁসি মুখে আমাদের যে লালা থাকে, সেটা অনেক রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এজন্য কোনো গোটার উপর যদি সেটা লাগান, কিংবা প্রতি সকালে মুখ না ধুয়ে এক গ্লাস পানি খান, শরীর এবং হজমের জন্য সেটা উপকারী। এটাও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর গোসল করলে হয়ত হজম ভালো হয়, এ কারণে হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পিরিয়ডের প্রথম তিন দিন ফার্টিলিটি বাড়ার জন্য ডক্টররা ওষুধ সাজেস্ট করে যারা বেবির জন্য ট্রাই করছে। তার মানে এই তিন দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কন্সিভের দিক থেকে। মাঝখানে ভেজা শরীর, কারো সাথে কথা বলা, ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়া- এগুলো ফাও কথাবার্তা।
যে এই জিনিস দিয়েছে, সে এসব জানে। কিন্তু তার জানার সাথে একটু ভুংভাং নিয়ম দিল, যাতে কন্সিভ হলে তার ক্রেডিট হয়। হাউ ফানি!
তখন থেকে নতুন জ্বালা শুরু হলো। আম্মু প্রতি মাসে আমাকে খোঁচা মারে। আমি প্রথম মাসে ভুলেই গেলাম খেতে। দ্বিতীয় মাসে খেলাম কিন্তু ঘুম থেকে উঠে ওর সাথে কথা বলে ফেললাম! গোসল করতে যাওয়া দূরে থাক, শীতের মাঝে কম্বল ছাড়তেই তো আমার আধাঘন্টা লাগে! তবুও খেলাম। কিন্তু প্রথম দিন ভুলে গেলাম। আর আম্মু তো সুযোগ পেলেই বকে। আমি মনে মনে হিসাব কষছি, জানুয়ারী মাসে পরীক্ষা শেষ হবে। তাহলে ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ঘুরতে যাবো। আমার শাশুড়ী অনেক দিন ধরে বলতেছে, আমি থাকি না। আমার জায়েরাও বলে। এজন্য ভাবলাম, তারেক ঢাকায় থাক, আমি পরীক্ষা শেষে ঘুরে আসি।
ডিসেম্বর মাস থেকে তাহাজ্জুদ পড়া শুরু করলাম। তাহাজ্জুদ বলতে এশার নামাজের সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তাম। দু’একদিনের বেশি বাদ যায়নি। ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা শেষ হলো। ১০ তারিখ বৃহস্পতিবার গ্রামে চলে গেলাম আমি আর ছোট ননদ। সেখানে ঘুরছ, ফিরছি, খাচ্ছি, সবার সাথে মজা করছি। আফরা আর আফরিনেরও গ্রামে যাওয়ার কথা পরের শুক্রবার মানে ১৮ তারিখ। কিন্তু সেদিন আমার খালাতো ভাসুরের বিয়ের তারিখ হুট করে ঠিক হওয়ায় ১৭ তারিখ বৃহস্পতিবার ঢাকায় রওনা দিলাম।
আসার সময় বাসে একেবারে পেছনের সিট পেয়েছি। এমনিতেই দেরি, তাই আর দ্বিরুক্তি করিনি। কিন্তু পেছনে বসে ঝাঁকি খেতে খেতে তলপেট ব্যথা করছিল। আমি ঠিক নিশ্চিত না যে আমি কন্সিভ করেছি কিনা কারণ পিরিয়ডের আগে সেটা বোঝার উপায় নেই। তবুও শরীরে খুব অস্বস্তি।
দুপুর দেড়টার দিকে আমার খালা শ্বশুর বাড়ি পৌঁছালাম। সেখানে সব ঘরে বিয়ের আমেজ। দেখতে দেখতে হলুদ আর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় দুদিন কেটে গেল। আমার শরীর খারাপ লাগা বাড়ছে, ঘুম হচ্ছিল না, তলপেটে অস্বস্তি। খাবারের দিকেও খুব একটা আকর্ষণ নেই। চেহারাও ফুলে কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে আছে। আমি ভাবছি, জার্নি, গ্রামের পরিবেশে ৮ দিন থাকা, খাবার পানির বদল, হৈচৈ, এসবের জন্যই হয়ত এমন হচ্ছে। তাছাড়া পিরিয়ড সামনে। হয়ত একারণেই এই অবস্থা। তবুও সতর্ক থাকলাম। কারণ প্রথম বার আমি কন্সিভের পরেও টের পাইনি। ইচ্ছেমতো চলার ফলে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম।
১৯ তারিখ শনিবার আমরা বাসায় চলে আসলাম। ২১ তারিখ আমার তৃতীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। আমি সহ সবাই খুব এক্সাইটেড। কিন্তু ওদিকে আমার পেট থেকে থেকে চিনচিন ব্যথা করছে। এটা যে স্বাভাবিক ব্যথা না, তা খুব ভালো মতোই বুঝতে পারছি। তবুও কাউকে কিছু বলিনি, একা একা সতর্ক থাকছি। যদি সুখবর হয়, তখন তো বুঝতেই পারবো। তার আগে পর্যন্ত কারো কাছে, এমনকি নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাই না। নাহলে আবার আশা ভঙ্গের কষ্ট চেপে ধরবে।
এর মাঝে বেশ কয়েকবার ফেব্রুয়ারির বই মেলায় যাওয়া হয়। শেষ দিন বাসায় আসার পর থেকে তারেক বেশ চটে যায়। আমি শিওর না হয়েও কেন চলাফেরা করছি, যদি কোনো সমস্যা হয়। ওকে বাধ্য হয়ে কথা দিলাম, আর বের হবো না টেস্ট করার আগে পর্যন্ত।
১লা মার্চে সবার প্রেশারে শেষ অব্দি টেস্ট করলাম। রেজাল্ট পজেটিভ!
৭ম পব
প্রথম যখন প্রেগ্ন্যাসি কিটে পজেটিভ এসেছিল, কি যে খুশি ছিলাম! একদিক দিয়ে আম্মুকে বললাম, অন্য দিক দিয়ে আম্মু সবাইকে জানিয়ে দিল যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। এবার উলটো হলো। পজেটিভ আসার পর টেনশন আরো বেড়ে গেল। ১৩ মার্চ আমার মেয়েকে আমি হারিয়েছি। সামনেই সেই দিন আসছে। আবার যদি কিছু হয়? এবার কি সহীহ সালামতে আমার বেবি পৃথিবীতে আসবে? নাকি আবার কোনো ভয়াবহ পরীক্ষার মুখে পড়বো? এবার আমি সতর্ক থেকেও কি পারবো দুর্ঘটনা এড়াতে? ভয় আর শঙ্কায় দুজনে কাউকে না জানিয়ে বসে থাকলাম। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি কাউকে জানালাম না। আমার দুই তিনটা বান্ধবী ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। তার মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারী আমার আরেক বান্ধবীর তিন মাসের বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেল। পেট ব্যথার কারণে ওকে দেখতে যেতে পারিনি। এবার আমার মাথায়ও সব খারাপ খারাপ চিন্তা ঘুরতে থাকলো।
যেহেতু আগের ডাক্তার বাদ, তাই আয়শা মেমোরিয়াল বা ইউনিভার্সাল মেডিকেলের সানজিদা রহমানের কাছে গেলাম। সেখানে উনাকে পেলাম না। তারপর ইবনে সিনায় কাজী ফারহানা নামের একজন পিজির ডক্টরকে দেখালাম, তিনি ইবনে সিনায় বসেন। প্রাইমারীভাবে উনি ব্লাড টেস্ট দিল। ১০ সপ্তাহের পরে আল্ট্রা দিবেন।
যারা প্রেগন্যান্ট হয়নি বা অবিবাহিত, তাদের জন্য বলি, প্রেগ্ন্যাসি কিন্তু সপ্তাহের হিসাবে হিসাব করা যায় যেটা এক্যুরেট। ৪ সপ্তাহ বা ২৮ দিনে ১ মাস হয়। অর্থাৎ আপনার পিরিয়ডের ৩য় দিন থেকে কাউন্ট হয়। অর্থাৎ আপনার শেষ পিরিয়ড ১ তারিখে হলে ৩ তারিখ থেকে প্রতি সপ্তাহ কাউন্ট হবে। এই তারিখ অনুযায়ীই ডক্টররা ইডিডি ডেট দেয়। বেশিরভাগ নরমাল ডেলিভারি যাদের হয়, তাদের প্রথম আল্ট্রার ইডিডি ডেট অনুযায়ী হয়ে যায় যেটা ৪০ সপ্তাহের আগে পরে।
যাই হোক, আমি বাসায় বসে থাকি তখন মন খারাপ করে কারণ বই মেলা চলছে, আর আমি যেতে পারছি না। যাকে কথা দিয়েছিলাম, রাখতে পারছি না। আমার তৃতীয় বই নিয়েও আমার মন খারাপ। এর মাঝে মার্চের শেষ দিকে আবার প্রথম বারের মত স্পটিং! ডক্টর এইচপিসি ইঞ্জেকশন লিখে দিল। ৩দিন পর পর ১টা এম্পুল করে নিতে হবে।
এই ইঞ্জেকশন এর ছবিটা এটাচ করে দিলাম। এই ইঞ্জেকশন যে কি যন্ত্রণা, সেটা যাদের নিতে হয়েছে কেবল তারা জানে! সাথে এক্সপেন্সিভও। তবে টাকার চেয়ে শারীরিক কষ্ট যে প্রচুর, সেটাই মাথা ব্যথার মূল কারণ।
প্রথম ইঞ্জেকশন ফার্মাসিতে পুরুষকে দিয়ে নিয়েছি বলে বাঁ হাতে নিয়েছি। কি যে ব্যথা! এরপর থেকে এলাকার একজন নার্স, উনাকে দিয়ে কোমরে নিতাম। আমার শাশুড়ী তখন আমার বাসায় চলে আসলো গ্রাম থেকে কারণ আমার পূর্ণ বেড রেস্ট। বাথরুম ছাড়া আর কোনো হাঁটাচলা নেই। খাবারও বিছানায় আমার ননদ বা তারেক দিয়ে যাচ্ছে।
এর মাঝে রোজা চলে আসলো। তৃতীয় রোজায় আমার মেঝ জায়ের আব্বা মারা গেলেন। আমি জোর করে ননদ আর শাশুড়ীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম কারণ একজন মুরুব্বি মারা গেছে, যেতেই হবে। আমার বাসা থেকে ৫মিনিটের দূরত্বে বাবার বাড়ি। সেখান থেকে ১বেলা খাবার পাঠালেই হবে। বুয়া এসে রুটি বানায়, ঘর মুছে, কাপড় ধোয়, টয়লেট ধোয়। তার মানে আমার তেমন ভারী কাজ নেই। তার উপর রোজার সময় বেশি খাওয়াও হয় না। অফিস থেকে এসে তারেকই সব গুছিয়ে ফেলে।
রোজার তৃতীয় সপ্তাহের শুরু আম্মু আসলো আমার বাসায় থাকতে। এখান থেকে এখানে হলেও আম্মু ইফতার, সাহরীতে একা একা রান্না করতে করতে বিরক্ত হওয়ায় রিলাক্স করতে এখানে চলে আসলো। আম্মু আসার আগে থেকে তারেক আমাকে সংযুক্তা সাহার কাছে নিতে চাচ্ছিল। যেহেতু আগের বার একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে এবং কেন হয়েছে আমরা নিশ্চিত না, তাই এবার রিস্ক না নিয়ে বড় ডাক্তার দেখানো উচিত।
সংযুক্তা সাহা বসেন উত্তরা ক্রিসেন্ট আর সেন্ট্রাল হসপিটাল, গ্রীন রোডে। আমাদের জন্য সেন্ট্রালই কাছে, সেখানে গেলাম। উনাকে দেখাতে একটা বড় হ্যাসাল আর অনেক অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। আগের দিন ৯-৯.৩০ এর মধ্যে সিরিয়াল দিতে হয়। পরদিন উনার জন্য কম করে হলেও ২-৩ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। দিনে দেড়শ-দুশো রোগী দেখেন উনি! উনার কাছে দেখিয়ে আল্ট্রা সহ সব টেস্ট করলাম। ধরা পড়লো ডায়বেটিস আর থাইরয়েড।
দিয়ে দিলেন খাওয়ার আগে ৩ বেলা নভোরেপিড ইন্সুলিন আর রাতে খাওয়ার পরে লেভেমির ইন্সুলিন। আর সাথে ডায়েট চার্ট, রোজা রাখা বন্ধ! আমার প্রায়ই মুখ শুকিয়ে আসতো, রোজা রাখা অবস্থায় সকাল ৯টা থেকেই মুখ শুকাতো। আমি কি আর জানি আমার এত ডায়বেটিস? ডক্টর বললেন, তোমার আগের বেবিও ডায়বেটিস এর কারণে মারা গেছে। স্ট্রিক্ট ডায়েটে চলে যাও!
এমনিতেই খাবারের রুচি ছিল না ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত। এখন যাই একটু রুচি এসেছে, রিজিক বন্ধ হয়ে গেছে। উলটো শুরু হয়েছে আমার ইঞ্জেকশন এর উপর জীবন যাপন!
এক সপ্তাহ পরেই উনার কাছে আবার সুগার চেক করে যেতে হবে।
এপ্রিল ২৭।
আমি প্ল্যান করলাম, সেঝ বোন আফরাকে নিয়ে সেন্ট্রালে যাবো। ম্যামকে দেখিয়ে তারপর আসার সময় তেজগাঁও এর বড় আড়ং এর শোরুমে যাবো, সামনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর বিয়ে, ওর জন্য গিফট কিনবো। ম্যামের কাছে গেলাম। উনি আমাকে বলল,
-তোমাকে ডায়বেটিস কন্ট্রোল করতে হবে, তাহলে আমি সেলাই দিব না। নাহলে তোমার জরায়ু মুখে সেলাই দিতে হবে।
-ম্যাম, আমার কিন্তু এর আগের বার মিসক্যারেজের আগে আল্ট্রাতে এসেছিল শর্ট সার্ভিক্স। কিন্তু আমার ডক্টর দেখেনি আমিও দেখিনি।
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন,
-কি বলো! তুমি দেখবা কেন? এটা দেখা তো ডাক্তারের কাজ, তোমার না! তোমার কিন্তু পানি ভেঙে গিয়েছিল?
-ম্যাম, ব্যথা উঠে পানি ভেঙেছিল। তারপর ডেলিভারি
উনি তৎক্ষণাৎ আমাকে চেক করে বললেন,
-আবার সার্ভিক্স ছোট দেখাচ্ছে। তুমি আজকেই ভর্তি হয়ে যাও। সেলাই দিতে হবে!
আমরাও পরিকল্পনা করিও, আল্লাহও করেন। কি ভেবে বাসা থেকে বের হলাম, আর এখন কি হচ্ছে! কাঁদতে কাঁদতে তারেককে, আমার ডক্টর কাজিনকে ফোন দিলাম। আমার স্ট্রাগলের আরেক অধ্যায়ের তখন শুরু।
৮ম পর্ব
ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে। অবশ্য আগের বারের দুর্ঘটনার পরে বারবার মনে হয়েছে, হয়ত আল্ট্রা করার পর সেলাই দিলে আমার মেয়েটা বেঁচে থাকতো। এবার অবশ্য সতর্ক থাকার পরও সেলাই লাগবে, ভালো হবে না খারাপ, এসব ভেবে ভেবে ওয়েটিং রুমে এসে চোখের পানি ঝরাচ্ছিলাম। তারেককে কল দিয়ে হাসপাতালে আসতে বললাম। মুনিয়া আপু, আমার ডক্টর কাজিনকে কল করে জিজ্ঞাসা করলাম। আপু সুন্দর করে বুঝিয়ে বলল, অনেকের জরায়ু মুখের ইনকম্পিটেন্স থাকে। বাচ্চাটা বেড়ে গেলে জরায়ু মুখ ভার নিতে পারে না, খুলে যায়। সেলাই দিলেই নিরাপদ হবে পুরো বিষয়টা।
আমার ছোট বোনটা অসুস্থ ছিল। তবুও ওকেই আমার সাথে রাখলাম হাসপাতালে। বেচারি ইফতারেও তেমন কিছু খেতে পারেনি, তারেকও ভালো কিছু পায়নি। সেন্ট্রালের ক্যানটিনে মোটামুটি রকমের খাবার থাকলেও তাতে যাচ্ছেতাই দাম, আবার দাম অনুযায়ী খাবারও আহামরি না। ভর্তি হয়ে কেবিন নিলাম। দশটার দিকে এসে আমাকে ওটির ড্রেস পরালো। দুইটা বা আড়াইটার দিকে আমাকে ওটিতে নিল।
এর আগে ২০১৬ তে এপেন্ডিসাইটিস এর জন্য ওটিতে গিয়েছিলাম। তখনও এত ভয় পাই নি। এবার মনে হচ্ছিল প্রতি মোড়ে মোড়ে আজরাইল আঃ দাঁড়িয়ে আছে। কলিজা শুকিয়ে মন চাচ্ছিল চিৎকার করে কাঁদি৷ তারেকের হাত যখন ছুটে গেল, একা যখন ওটি রুমে আসলাম, নিজেকে মৃতপ্রায় লাগছিল। আমাকে ওটির বেডে শুইয়ে একটু পর এনেস্থিসিয়ার ডক্টর আসলো। আমি কান্না শুরু করলাম। এপেন্ডিসাইটিস এর সময়ও তো এনেস্থিসিয়া লেগেছিল। তখনকার অভিজ্ঞতা আমার ভয়াবহ। সেবার বেডে দেয়ার পর যখন এনেস্থিসিয়া শরীর থেকে যাচ্ছিল, আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। আবার অপারেশন এর এক মস পরে সৌদি গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার মাস খানেক পরে এত কোমর ব্যথা ছিল যে ৫০০এমজির পেইন কিলার খেয়েও ব্যথা সারেনি। পরে বুঝলাম পানিশূন্যতার কারণে এই ব্যথা করেছে। সেই যন্ত্রণা থেকে আমার ট্রমা হয়ে গিয়েছে। যে কারণে সিজারের কথা শুনলেই আমি আজও আঁতকে উঠি।
এনেস্থিসিয়া ডক্টর যখন বালিশ বুকে চেপে সামনে ঝুঁকতে বলল, তখন ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কেন দিতে হবে এই জিনিস? ডক্টর আমাকে শান্ত করতে করতে এনেস্থিসিয়া দিল। আমি তখন উ উ উ করে কেঁদে যাচ্ছি। আমাকে সে একটু ভয় দেখালো, ম্যাম এরকম কাঁদতে দেখলে রেগে যাবে। এমনিতেই সংযুক্তা ম্যাম রাগী, তার উপর এই অবস্থায় রাগ করলে আমি কান্নাকাটি করে কি করবো নিজেও জানি না। এত শক্ত মানুষ আমি, এবার একেবারে কাদামাটি হয়ে গেছি। কেবল কথায় কথায় মৃত্যু ভয় জেঁকে বসে।
ওটির বেডে শুয়ে শুনছি, ম্যাম অম্য এক রোগীর সিজার করছে। সে কাজ শেষ করে আমার কাছে আসবে। আমাকে ওটির এসিস্ট্যান্টরা রেডি করছে। ওদিকে স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ম্যাম আসলো। হলুদ রঙের কোনো একটা লিকুইড দিল শরীরের উপরে। আমি কেঁপে উঠে কান্না করে বললাম,
-আমি সব ফিল করতে পারছি। প্লিজ, এখন না!
আমার ধারণা ছিল, যেহেতু লিকুইড দিয়ে ক্লিন করছে টের পেয়েছি, তার মানে ম্যাম যখন সেলাই দিবে, সেটাও টের পাবো। ম্যাম ধমক দিল। আর স্যার আমাকে কিভাবে কিভাবে যেন ম্যানেজ করলো। আমি চোখ বন্ধ করে কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে প্রশ্ন করলাম,
-ওটিতে তো আমার চেয়েও অস্থির রোগীরা আসে। তাদেরকে কিভাবে শান্ত করেন?
উনি হেসে বললেন,
-এই যে, আপনাকে যেভাবে করলাম!
একটা সুরাহ পড়তে থাকলাম। পড়তে পড়তেই সেলাই শেষ। আমাকে ক্লিন করে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে গেল। ঘড়িতে তখন ৩ বা ৩.০৫ বাজে। আমি ভেবেছিলাম তারেককে এখনই দেখতে পাবো, কলিজা ঠান্ডা হবে। সেটা হওয়ার সুযোগ নেই। আরও বেশকিছু সময় ধৈর্য্য ধরতে হবে।
আমার মতে অপারেশন থিয়েটার এর চেয়ে পোস্ট অপারেটিভ রুম বেশি ভয়ংকর। কারণ মাত্র নাজুক একটা অবস্থা থেকে আপনি সেখানে আপনার চেয়ে ভয়াবহ কিছু রোগী দেখবেন সেখানে। হয় আপনি তখন শুকরিয়া করবেন যে আপনার অবস্থা এত সিরিয়াস না, অথবা আপনি আরও ভয় পাবেন। আমার ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেকোনো সময় এদের যেকারোর চেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। একজন বয়স্ক রোগী ছিল, তার গলায় কি যেন একটা পড়ানো, তার মাঝ দিয়ে কাটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখে কেমন যে ভয় লাগছে আমার!
এক সময় ঘুমের চেষ্টা করতে থাকলাম। আধো ঘুম, আধো জাগরণে অনেকটা সময় কেটে গেছে। আমাকে এসে কোনো এক ফাঁকে মরফিন দিয়ে গেছে। আর হাতের ক্যানোলাতে Nalepsin নামে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করা। এই জিনিস দেয়ার দুই সেকেন্ডের মাথায় পুরো গলা, শরীরের ভেতর গরম হয়ে গেল। মনে হলে ভেতরে এসিড ঢুকে গেছে। আমি হাত নেড়ে বহুকষ্টে নার্সকে বললাম, আমার মুখ থেকে ভাপ বের হচ্ছে, বিছানাটা একটু উঁচু করতে। আমি ঘেমেও যাচ্ছি। মাথার দিকটা উঁচু করায় আমার বমি পেয়ে গেল। পুরো পেট খালি, তাই মনে হচ্ছিল বমি করে ভেতরের অঙ্গগুলো বেরিয়ে আসবে! আবার নার্সকে ডাকলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
-এই ওষুধ দিলে এমনই হয়। এজন্যই তো উঁচু করতে চাচ্ছিলাম না। আপনিই বললেন। কিন্তু সহ্য করতে পারলেন না।
মরফিনের কারণে আমি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় চলে গেলাম। তখন যেই আসছিল ইঞ্জেকশন দিতে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের মুখ, শরীর একেবারে হলুদ; যেন কেউ হলুদ দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে!হাসিও পাচ্ছিল এটা মরফিনের প্রভাব বুঝতে পেরে।
১১টার দিকে আমাকে কেবিনে দিল। তখন তারেককে দেখে আমার কান্না চলে আসলো। ছোট বোনটা ভালোই অসুস্থ, ওর বাসায় যেতে হবে। ও রেডি হয়ে ছিল। ঐ সময় দ্বিতীয় বার নালেপসিন পুশ করলো। আমার মুখ থেকে এমন গরম ভাপ আসছিল আর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল যে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওকে বললাম,
-আমি আর কোনোদিন বাচ্চা নিব না! যদি এই কষ্টের মাঝ দিয়ে প্রত্যেকবার যেতে হয়, তাহলে আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না! আমি আর পারবো না!
তারেক আমাকে শান্ত করলো।
দুপুরে হাসপাতালের ডায়েট খাবার দিল। এত্ত বেস্বাদ জিনিস! ক্যাথেটার করা, কোনো মুভমেন্ট নেই, ইন্সুলিন, আর ইঞ্জেকশন। বৃহস্পতি, শুক্রবার, দুই দিন গেল। আমি ভেবেছিলাম শুক্রবার ছাড়া পাবো। পারলাম না। সেদিন ক্যাথেটার খুললো, কিন্তু আরো একদিন থাকতে হবে। আমার সবকিছু তখন বিছানায় বসে করতে হবে, টয়লেটটাও। নাহলে সেলাই খুলে যাবে।
একজন সুস্থ সবল মানুষ যখন হুট করে বিছানায় পড়ে, তার মানসিক অবস্থার যে অবনতি হয়, সেটা ঐ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। মনে কষ্ট, ২৭ রোজার রাতে কদরের নামাজও পড়তে পারলাম না। শুক্রবারে অবশ্য ক্যাথেটার খোলার পর নামাজ পড়লাম। তারেক বালতি মগ বিছানায় এনে ওজু করিয়ে দিল প্রতিবার। ও যখন আমার পা ধুয়ে দিত, আমার ভীষণ কান্না পেত। দাঁত ব্রাশ করানো, খাবার এগিয়ে দেয়া, খাইয়ে দেয়া- সব ও করতো। বাসার অন্যরা অসুস্থ ছিল, আব্বু আম্মু এসে দেখে গিয়েছিল; কিন্তু তারেক ছাড়া কেউ থাকেনি। সারাটা সময় ও আমাকে যেভাবে আগলে রেখেছে, আমি প্রতিবার অনুভব করেছি, গুটিকয়েক মানুষ কেবল এমন ভালোবাসা পায়।
এদের মাঝে আমি একজন।
৯ম পব
এপ্রিল ৩০, শনিবার।
বাসায় আসতে আসতে পৌনে ৬টা বাজলো। সুস্থ একটা মানুষ গেলাম, দুইজনের হাত ধরে বাসায় ফিরে আসলাম। আমাকে স্ট্রিক্ট বলে দিল, বাচ্চা রাখতে চাইলে হাঁটাচলা বন্ধ করতে হবে। টয়লেটও বেডপ্যানে করতে হবে।
আমি অবশ্য একবারের বেশি কথা শুনিনি। আম্মু এমনিতেই সারাদিন কষ্ট করে। ঘরের এত এত কাজের দায়িত্ব তার। আবার আমার সেবা করাও লাগবে? দুইদিন পর ইদ। এর মধ্যে কিভাবে নিজের মাকে এত কষ্ট দিই? আমি দেয়াল ধরে ধরে টয়লেটে চলে গেলাম, কারো কথা শুনলাম না। শোনা সম্ভবও ছিল না।
এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। জরায়ু মুখের সেলাইকে ডক্টররা শিরদকার বলে। শিরদকারের জন্য আমাকে এইচপিসি ইঞ্জেকশন দুইটা এম্পুল একেবারে দুই দিন পর নিতে হবে। তার উপর সামান্য খাবার সত্ত্বেও ডায়বেটিস এর লাফালাফি। যেহেতু আমি বেরুতে পারছি না, তাই ক্লিনিক থেকে লোক বাসায় এসে রক্ত নিত সুগার টেস্ট এর জন্য। সাথে প্রতিদিন দুই বেলা, নাস্তা আর লাঞ্চের পর সুগার মেপে কাগজে লিখে রাখতে হতো। আমাকে তখন দিনে ৬-৭বার শরীরে সুঁই নিতে হচ্ছে। আবার ১ বা ২ সপ্তাহ পর পর দুইবেলা সুগারের জন্য ব্লাড দেয়া। এত সুই এর সাইড এফেক্ট ছিল, জীবনটা বিষের মত লাগতো।
পেট এ রক্ত জমে যাচ্ছিল ইন্সুলিন নিতে নিতে। ভয়ে তখন পায়ে নেয়া শুরু করলাম। পায়েও একই অবস্থা। রক্ত বের হতো, জমতো, প্রায়ই খুব চুলকাতো। এটার একটা কারণ ছিল, পেন দিয়ে ইন্সুলিন নিলে সেটা ৯০° এঙ্গেলে নিতে হয়, আর সুই নিলে ৪৫°। আমাকে ডক্টর ভুল বলেছিল। একারণে ইন্সুলিন সব চামড়ার নিচে জমে চাকা হয়ে যেত, রক্ত জমাট বাঁধতো, এমনকি এখনো পায়ের ঐ মাসল গুলো কিছুটা আনইভেন অবস্থায় আছে। সাড়ে সাত মাসের দিকে জানতে পারি। তখন থেকে ইন্সুলিন নিতে অবশ্য বেশি অসুবিধা হয়নি।
আর এইচপিসি ইঞ্জেকশন এর কথা কি বলবো! এই জিনিস যখন শরীরে ঢুকতো, তখন যে কি যন্ত্রণা! আমি বালিশে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কাঁদতাম। যে আন্টি দিত, তারও মুখ কালো হয়ে যেত, আম্মু সহ্য করতে পারবে না বলে রুম থেকে বের হয়ে যেত। আর আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যেত। ইঞ্জেকশন নেয়ার ২/৩ ঘন্টা পর ফুলে এমন ব্যথা শুরু হতো যে রাত বাড়ার সাথে সাথে পেইন রিলিফ এর জন্য নাপা খেতাম আর গরম ছ্যাক নিতাম। এক পায়ে একবার নিয়ে দুই দিন পর আরেক পায়ে নিতাম। এরকম অবস্থা ছিল যে, ফোলা, আর যন্ত্রণা ভালো হতে না হতেই আবার ইঞ্জেকশন নেয়ার সময় চলে আসতো। যেহেতু দুইটা এম্পুল এক সাথে, তার জন্য এফেক্ট ছিলও দ্বিগুণ।
আমার হাসপাতালে যাওয়া অর্থাৎ কোনো ধরনের জার্নি নিষেধ ছিল। এজন্য তারেক কখনো ২ সপ্তাহ পর পর, কখনো এক সপ্তাহ পরেই ডক্টরকে সুগার রিপোর্ট দেখাতে যেত। আমি প্রতিবার ভাবতাম, এই বুঝি ইন্সুলিন বা এইচপিসি বন্ধ করবে। নাহ! সেই আশায় গুড়ে বালি।
ঈদের মাসখানেক পরের কথা।
এক বিকালে আমি বিছানায় অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছি। আম্মু রুমে এসে বকতে বকতে বলল,
“কুরআন না পড়ে খালি শুয়ে বসে থাকস! তোর বোনের প্রেশার উঠছে। দেখ গিয়ে বাচ্চা বাঁচে কিনা। হাসপাতালে ওরা!”
বলতে বলতে আম্মু কেঁদে দিল। আমার একটু ভয় লাগলো। আমার ১৭ সপ্তাহ, আর ওর ২০+ সপ্তাহ। এখন হাই প্রেশার মানে কি?! ছোট ফুপি সহ ওরা হাসপাতালে। আমি কল দিয়ে বললাম, বেশি টেনশন না করতে। হাসপাতালে হাই প্রেশার নিয়ে ভর্তি হলে ওরাই ব্যবস্থা নিবে। ফুপি প্রতিউত্তরে তেমন কিছুই বলল না।
আমরা সবাই অপেক্ষায় বসে আছি। ঘন্টাখানেক পরে বলল, আপুর বেবির হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটা বাচ্চা ফ্যামিলি থেকে শেষ।
সবার সে কি কান্না! আপুর অনেক সাধনার পর কন্সিভ হয়েছিল। প্রি একলামশিয়ার কারণে এক দিনের ব্যবধানে সব শেষ। ওদের বাসায়, আমাদের বাসায় কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। এখন ওকে ব্যথা উঠার ওষুধ দিয়েছে, নর্মাল ডেলিভারি হবে।
ওর ব্যথা উঠার ওষুধ দেয়ার পরও ব্যথা উঠছিল না। চারদিন পর এক সকালে বেবিটা হলো। ছেলে বেবি ছিল। আহা, সবার কি কান্না! বাবুটাকে অবশ্য আমার মেয়ের মত এমনি এমনি মাটিচাপা দেয়া হয়নি, জানাযা দিয়ে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। আমাকে দিয়ে সবাই শিক্ষা পেয়েছিল।
ওর ফুটফুটে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিদিন প্রেশার মাপি। আমার যদিও প্রেশার লো থাকে, তবুও মাপি। একটু ঘাড় ব্যথা করলেই অস্থির হয়ে যাই। তার উপর আমার মেয়েটা চলে গিয়েছিল ২২ সপ্তাহে। সামনেই এই সময়টা আসছে। আমি কিভাবে পার করবো?
একটা একটা করে দিন গুনতাম। আমি। তারপর এক সপ্তাহ পার হলে বলতাম, আলহামদুলিল্লাহ, একটা সপ্তাহ গেছে! ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখতাম। আমার ছেলের নড়াচড়া টের পেতে পেতে আমার ২০ সপ্তাহের বেশি লেগে গিয়েছিল। যখন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ওর নড়াচড়া বুঝতে চেষ্টা করতাম, তখন বুক ভেঙে কান্না আসতো। আমার মেয়েটাও তো এভাবে নড়তো। কেউ কিছু বুঝার আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমার ছেলেটা আমার সাথে থাকবে তো?
১৯ জুন বিকালে ভাত খাওয়ার পর আমি হাঁটু ভর করে বিছানার অন্য পাশে থাকা ফোন আনতে গেলাম। হঠাৎ হাঁটুতে খোঁচা! পাশেই আমার সেলাই করা কাঁথা ছিল যার কাজ তখনও কিছুটা বাকি। আমি চেক করে দেখলাম, সুঁইয়ের মাথা নেই। মাথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও। হাঁটুতে দেখি, হালকা রক্ত।তারপর চাপ দিয়ে দেখি হাঁটুর ভেতর সুঁইএর মাথা নড়ছে!
আব্বুকে ডেকে সে কি কান্না আমার! আম্মুও বাসায় নেই। আমার ডায়বেটিস না থাকলে তখনই ব্লেড দিয়ে কেটে সুই বের করা যেত। কিন্তু ডায়বেটিস এর ভয়ে কাটলাম না। অনেক কষ্টে গাড়ি ম্যানেজ করে এক হাসপাতালে গেলাম। প্রেগন্যান্ট আর ডায়বেটিস আছে শুনে তারা জানালো কিছু করতে পারবে না। তারপর আরেক যায়গায় গেলাম। সেখানে ভর্তি হয়ে এক্স- রে করলো। তারপর অপারেশন থিয়েটার এ নিয়ে সেটা কেটে বের করলো।
একটা কথা জানিয়ে রাখি, প্রেগ্ন্যাসিতে এক্স রে ইমার্জেন্সি না হলে করা যাবে না। আর করলেও শিল্ড দিয়ে তারপর করতে হবে যেন এক্স রে এর রেডিয়েশন কোনোভাবে পেট পর্যন্ত না যায়। নাহলে ৫০-৫০ চান্স থাকে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হওয়ার।
সেদিন পায়ের এই অবস্থা নিয়ে বাসায় আসলাম সাড়ে আটটায়। আমি বেখেয়ালি, আমার কোনো ব্যালেন্স নাই, আমি কেয়ারলেস- কত রকম মন্তব্য যে শুনলাম! অথচ এই যে কষ্ট, এই যে যন্ত্রণা, এটা তো একান্তই আমার। কই, কেউ তো আমার কষ্টের ভাগ নিতে পারলো না! অথচ ঠিকই সবার বিরূপ মন্তব্য নিজের ভেতরটা বিষিয়ে দিচ্ছিল। মানুষ কেন বোঝে না যে আল্লাহ সব কিছুর হিসাব রাখছে?
১০ম পর্ব
হাঁটুর স্টিচের কারণে এক সপ্তাহ ডান পা ভাঁজ করতে পারিনি। এক সপ্তাহ পর থেকে আবারও হাল্কা পাতলা চলাফেরা শুরু করি। ৮ সপ্তাহ থেকে আমি চেয়ারে বসে নামাজ পড়ি। মাঝে শিরদকারের পরে শুয়ে শুয়ে পড়তাম। এখন আবার বসে বসে পড়ি। কাজকর্ম টুকটাক করতাম, অন্তত আমার গোসলের কাপড় ধোয়ার চেষ্টা করতাম। বলতে গেলে আমি সেভাবে বেড রেস্ট মানতাম না। বেড রেস্ট দেয়ার পর দুই বার আল্ট্রা করতে, ৩বার ডেন্টিস্ট এর কাছে, আর ৩ বার গাইনী ডক্টর এর কাছে গিয়েছিলাম। ব্লাড কালেকশন করতে ক্লিনিক থেকে লোক আসতো। তবে আমি অন্য কাউকে বলবো না বেড রেস্ট দেয়ার পরও আমার মতো বাসার ভেতর ঘুরে বেড়াতে, টুকটাক কাজ করতে। সবার শরীর, অবস্থা এক না।
সময়ের সাথে সাথে পেট বাড়তে থাকলো। ২০-২২ সপ্তাহ পর্যন্ত আমি খুব আতঙ্কে থাকতাম। কারণ এই সময়ই আমি আর আমার বোন দুজনেই প্রথম বেবি হারিয়েছি। তখন আমি প্রতি ঘন্টাও গুনতাম। সময় যেন কিছুতেই কাটতো না ২৮ সপ্তাহ পর আমার ইন্সুলিন বাদ দিয়ে ওষুধ দেয়া হলো ডায়বেটিস এর জন্য। কারণ সুগার অনেক কম এসেছিল। তখন ওষুধ খেতাম। ৩০ সপ্তাহ পর আল্লাহর রহমতে এইচপিসি ইঞ্জেকশন বন্ধ হলো। কিন্তু ৩২ সপ্তাহের দিকে আবার সুগার বেড়ে গেল। আবারও ইন্সুলিনে চলে গেলাম। তখন আমাকে ডক্টর বললো, ইন্সুলিন পেটে নিতে। পায়ে বা হাতে নিলে নাকি কম কার্যকর হয়।
বাবু ছয় মাস থেকে ভালোই নড়তো। হঠাৎ ওর নড়াচড়া পেটের উপর থেকেই বুঝতাম। আমি যখনই বুঝতাম, তখন হাত দিয়ে বসে থাকতাম। মা হওয়ার সবচেয়ে প্রখর অনুভূতি এই বাচ্চার নড়াচড়ার মধ্যেই। আপনি যখন অনুভব করবেন, একটা নতুন প্রাণ আপনার শরীরে, হাত পা নেড়ে নেড়ে সে তার উপস্থিতি জানাচ্ছে, তখন যে স্বর্গীয় অনুভূতি হয় তা মা ছাড়া কেউ বুঝবে না। আর বেবি হয়ে যাওয়ার পর এই নড়াচড়ার অনুভূতিটাই একজন মা সবচেয়ে বেশি মিস করে।
আমার ছেলে বেশিরভাগ সময় নামাযে বসলে যখন হাত বাঁধতাম, হাতের নিচে নড়তো। আমি সালাম ফিরে হাত দিয়ে ওর নড়াচড়া অনুভব করতাম। প্রথম প্রথম ও ওর বাবা এবং যে কারো কন্ঠ শুনলে নড়াচড়া বন্ধ করে দিত। সাত মাস থেকে ও ওর বাবার কন্ঠে রেসপন্স করতো। ওর বাবা ডাকলে সে নড়ে উঠতো। আর আমার বোনরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো। দিনে, রাতে এসে জিজ্ঞেস করতো, “নড়ে, নড়ে?” আমি হ্যাঁ বললেই তারা পেটে হাত দিয়ে বিভিন্ন রকম সাউন্ড করা শুরু করতো। কখনো যদি খুব জোরে নড়ে উঠতো, ওরা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠতো। আর যদি আমি নড়াচড়া কোনো কারণে একটু কম পেতাম, তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে যেত! পানি খেয়ে বাম কাতে শুয়ে থাকতাম। বাচ্চার নড়াচড়ার কারণে অনেকের রাতের ঘুম নাকি ভেঙে যায়। আমি আলহামদুলিল্লাহ ঘুমালে আর খবর থাকতো না বাবু নড়লো কি নড়লো না। সাত মাস বা ২৮ সপ্তাহ থেকে দিনে ১০-১২ বার স্বাভাবিক নড়াচড়া। এর কম হলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। বেশি হলে তো আলহামদুলিল্লাহ!
আট মাস থেকে এক কাত থেকে আরেক কাতে যেতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এর মাঝে এবডোমেন এর স্কিন ফাটা, সেলাইয়ে চাপ তো আছেই। ঠান্ডা লেগেছিল ৩বার, ১ বার এন্টিবায়োটিক খেতে বাধ্য হয়েছিলাম। প্রেগ্ন্যাসিতে এন্টিবায়োটিক খেতে হলে অবশ্যই একজন গাইনীর পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। কারণ সব এন্টিবায়োটিক প্রেগ্ন্যাসিতে খাওয়া যায় না। আর সাধারন ব্যথায় প্যারাসিটামল খাওয়া যায়, কিন্তু তবুও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া একদম ঠিক না।
এছাড়াও তিন বার দাঁতের জন্য ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হয়েছিল। আমার দাঁতে তখন রুট ক্যানেল করেছিলাম এবং এন্টিবায়োটিক ছাড়াই পুরো ব্যথাটা সহ্য করেছিলাম।
২৬ সপ্তাহে আমি দ্বিতীয় বারের মত আল্ট্রা করেছিলাম। তখন আমার দুই বোনও আমাদের সাথে ক্লিনিকে গিয়েছিল। ওরা যখন আল্ট্রার রুমে ঢুকতে চাইলো, ডক্টর এলাউ করলো না। আমি আল্ট্রা শেষে তারেককে ডাকলাম। ডক্টর তারেককে ডেকে দরজা বন্ধ করে জানালো ছেলে হবে। আমি অবশ্য দুইবার ফজরের সময় স্বপ্ন দেখে ফেলেছি আমার ছেলে হবে। তারপরও একটা আগ্রহ ছিল। ছেলে হলে প্রচলিত যেসব লক্ষণ প্রকাশ পাবে বলে সবাই বলে, সেসবের সব কিছু আমার মাঝে ছিল না।
৬ অক্টোবর, ২০২২, বৃহস্পতিবার।
সেদিন আমার রেগুলার চেক এর জন্য যাওয়ার কথা। আমি যখন বের হয়ে আসি, তখনও জানি না ডক্টর কি বলবে। কারণ আগের সপ্তাহেই ভর্তি হওয়ার মত অবস্থা ছিল। ডক্টর সিটিজি করে বাবুর হার্টরেট দেখে আবার পরের সপ্তাহে আসতে বলে। আমরা হসপিটালের ব্যাগ বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। যদি ডক্টর ভর্তি হতে বলে, সেক্ষেত্রে আম্মু ব্যাগ আর সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসবে। আর বাসায় ফেরত আসতে হলে তো যাবোই।
ডক্টর দেখে জানিয়ে দিল, ভর্তি হও। ব্যথা উঠিয়ে নরমাল ডেলিভারি করবো আজকেই। এটাকে বলে পেইন ইন্ডিউস করা।
শুরু হলো আমার লেবার প্রস্তুতি আর স্ট্রাগল।
১১তম পর্ব
৬ অক্টোবর,২০২২৷ বৃহস্পতিবার
রাতে ভর্তি হলাম হাসপাতালে। আম্মু ১০টার দিকে সেখানে আসলো। তারেক কিছুতেই বাসায় যাবে না। আম্মু জিনিসপত্র গুছিয়ে খাবার আনলো, তারপর অনেক কষ্টে তারেককে বুঝালাম, আজকে বাসায় যাও, আজকে বাবু হবে না।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের সিস্টেম হলো, সেখানে যারা নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করে, তাদের সাথে কেবল একজন এটেনডেন্ট থাকতে পারে এবং কেবিন নিতে দেয়া হয় না। বেবি হয়, এরপর কেবিন দেয়। তার আগে যে কেউই আসুক, ডেলিভারি ওয়ার্ডের বাইরের গেইটে দাঁড়িয়ে থাকেন, নাহলে নিচে ওয়েটিং রুমের বেঞ্চে ঘুমিয়ে থাকেন!
এরকম একটা মিসম্যানেজমেন্ট এর জন্য তারেককে জোর করে পাঠালাম বাসায়। রাতের দেড়টার দিকে আমাকে সহ আরও তিনজনকে রেডি হয়ে আসতে বলল, ব্যথা উঠার জন্য জেল দিবে আর জরায়ু মুখের সেলাই কাটবে। আমরা ৪জন বসে ছিলাম ডেলিভারি রুমের বাইরের করিডরে। ৪জন গল্প করছিলাম আর মুখ চেপে হাসছিলাম। জান্নাত, প্রিয়া, আমি আর সুমাইয়া। জান্নাত আপুর আগেই পেইন ছিল, আর আমাদের কারো পেইন নেই। প্রিয়া আপুকে কম্ফোর্ট এর ডাক্তার বলেছিল সিজার করতে হবে, বাচ্চা বড় হয়ে গেছে, ৩.২ কেজি। সংযুক্তা সাহা বললেন, নরমালেই হবে। আমার একমাত্র ৩৭ সপ্তাহ চলে। বাকিদের ৩৯,৪০ সপ্তাহ। ম্যাম আমাদের হাসতে দেখে বললেন, শেষ পর্যন্ত যেন মুখে এই হাসি দেখি!
২টার দিকে জেল দিল। ৪০ মিনিট মাথাও তোলা যাবে না। ৪০ মিনিটের আগেই ব্যথা উঠা শুরু।
আলহামদুলিল্লাহ, প্রি-নাটাল কোর্স থেকে শেখা ব্রিদিং এক্সারসাইজ, পেলভিক রক এগুলো কাজে লেগেছে খুব। আর পেইন ম্যানেজমেন্ট এইসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফজর পর্যন্ত মোটামুটি ব্যথা ছিল। আমার থেমে থেমে ব্যথা হচ্ছিল। ফজরের পর থেকে আস্তে আস্তে ব্যথা কমে গেল।
ধীরে ধীরে আমার আর সুমাইয়ার ব্যথা কমে গেল, কিন্তু প্রিয়া আপু আর জান্নাত আপুর ব্যথা বাড়ছিল। দুজনের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম আর ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল। দুপুর নাগাদ জান্নাত আপুর আর বিকালে প্রিয়া আপুর মেয়ে হলো। আমার আর সুমাইয়ার তেমন কোনো ব্যথা নেই। ইন্সুলিন নিচ্ছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, হাঁটছি, স্কোয়াট করছি। বাসায় ওদিকে আব্বু বকছে, কেন ব্যথা না উঠতেই হাসপাতালে আসলাম, এগুলো কেমন কথা। আম্মু ঘুমাতে পারছিল না কারণ সেন্ট্রালে এটেনডেন্সের ঘুমানোর যায়গা নেই। রোগীর সামনে চেয়ারে অথবা রোগীর সাথে বেডেই হেলান দিয়ে বেশিরভাগের মা/বোনেরা শুয়ে শুয়ে সময় কাটাচ্ছে।
তারেক সকাল সাড়ে দশটায় হাজির। এরপর থেকে সে আর বাসায়ই যায়নি। সারাক্ষণ তার কথা, যদি বাবু হয়ে যায়? তখন ও তো মিস করবে। আমি আর আম্মু বুঝাতেই পারছি না যে আমার ব্যথা নেই, থাকলেও ব্যথা উঠেই বাচ্চা হবে না।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের নিয়ে গেল এপিডুরালের চ্যানেল করতে। আমি ভেবেছি তখনই দিবে। না, ওরা তখন লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়ে কোমরের দিকে একটা চিকন চ্যানেল করেছে। এইটা ছিল আরেক যন্ত্রণা। মেরুদন্ড, কোমর এমন ব্যথা করতো যে বাম কাত হতেই জান বের হয়ে যেত। আমাকে শেষ পর্যন্ত এপিডুরাল দেয়নি কিন্তু এই চ্যানেলের ব্যথায় জান খারাপ হয়ে গেছে।
এপিডুরাল এর চ্যানেল করার পর নিল আল্ট্রা করতে। আমার ২৬ সপ্তাহের পর আর আল্ট্রা করা হয়নি। যখন হুইল চেয়ারে আমাকে নিল, তখন ডেলিভারির আগে শেষবারের মত তারেকের সাথে দেখা। ও সহ আল্ট্রার ওখানে গেলাম। সেখানে গিয়ে সিরিয়ালে বসে আছি অথচ ব্যথা আর ব্যথা। অনেক কষ্টে বেড এ শুলাম। ডক্টর আল্ট্রা করার সময় আমাকে দেখালো। বাবু গালে হাত দিয়ে রেখেছে। ওকে দেখে আমি কেঁদে ফেললাম। আর কিছু ঘন্টা পরেই ওর আমার সামনাসামনি দেখা হবে! আমার সমস্ত সত্ত্বা কাঁপছিল।
পুরো দিন হাল্কা ব্যথায়ই কেটে গেল। রাতের ২টায় আবার আমাকে আর সুমাইয়াকে বলল, জেল দিবে।আমাদের সাথে আরেকজন যোগ হলো সাবিনা। আগের দিন দুজনেই হাসছিলাম। এবার দুজনেরই মুখ অন্ধকার। কারণ যদি এবারেও কাজ না হয়, আমাদের সিজার করবে। সিজারের জন্য কেউই রেডি না। আমি তো কান্না করে অস্থির হয়ে গেলাম, কিছুতেই সিজার করবো না। সিজারই যদি করতাম, তাহলে তো এত অত্যাচার, এত স্ট্রাগল সব ভেল্যুলেস হয়ে যাবে। পুরো প্রেগন্যান্সিতে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে নরমালের জন্য দুয়া করেছি।
আবারও রাত ২টায় জেল দিল, ব্যথা উঠলো। সাথে ক্যানোলায় লাগিয়ে দিল পিটোসিন ওষুধ। এবার আর ব্যথা আগের মত চলে গেল না। সকালে সুমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর নাকি রাতে পানি ভেঙে গেছে। আমার তখনও পানি ভাঙেনি। ব্যথাও থেমে থেমে আসছে, কিন্তু সহ্য করতে পারছি। সবচেয়ে কষ্ট ছিল ডাক্তারদের পিভি চেক করা। এটা হলো জরায়ু মুখে হাত দিয়ে তারা চেক করে সার্ভিক্স কতটুকু খুলেছে। এত তীব্র ব্যথা! আমি চিৎকার করে নড়ে উঠতাম আর ডক্টর বকা দিত কারণ নড়লে উনি বুঝতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত আকুতি করেছিলাম, প্লিজ ম্যাম, আস্তে হাত দেন, প্লিজ, আমি সহ্য করতে পারি না। কখনো ডিউটি ডাক্তার, কখনো সংযুক্তা ম্যাম এসে দেখতো।
৮ অক্টোবর, ২০২২ শনিবার।
দুপুরে ম্যাম বলল, ৩০% সার্ভিক্স ইফেসমেন্ট হয়েছে। সময় লাগবে, কিন্তু জরায়ু মুখ খুলবে। সুমাইয়ার সন্ধ্যার দিকে ছেলে হলো। আমার ব্যথা আছে কিন্তু তখনও সময় লাগবে। আম্মু প্রতিবার আব্বুকে বা তারেককে ফোনে বলে, বিকালের মধ্যে বাবু হয়ে যাবে, সকালের মাঝে বাবু হয়ে যাবে। অথচ জরায়ু মুখ তখনও খুলেনি পুরোপুরি। আম্মুকে বললাম, আর কাউকে বলবেন না কখন হবে। বাবু কখন হবার সেটা তো আল্লাহই ভালো জানে। আমরা জানি?
দুজনেরই মনের আশা, বাবু যেন ফজরের সময় হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমার পানি ভাঙে। তখন আমার বান্ধবী নিশি সামনে ছিল। সেন্ট্রালে একজনের বেশি এলাউ করে না, তাই ও বেশি থাকতে পারেনি। ওদিকে রোগীর চাপ বাড়ছে। বাবু হওয়ার পর আমরা কেবিনও পাবো না। সব কেবিন বুকড।
এর মাঝে আরেকটা অত্যাচারের নাম ছিল সিটিজি টেস্ট। পেটে একটা বেল্ট চেপে লাগিয়ে একটা সেন্সর লাগিয়ে দেয় যাতে বাবুর হার্টবিট পাওয়া যায়। চল্লিশ মিনিট কানের কাছে একটা মেশিনে বাবুর হার্টবিট জোরে জোরে বাজতে থাকে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে দশবার এর মত এই অত্যাচার করা শেষ। এদিকে সিটিজি করতে হলে সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হয়, তখন হয় আবার শ্বাসকষ্ট। তখন আবার লাগায় অক্সিজেন। আবার সোজা হলে বাবু নড়ে না। তখন ডাক্তার বলে, বাবুর নড়াচড়া নাই! অথচ সব খুলার পর আমি কাত হওয়ার সাথে সাথে বাবু নড়ে উঠে। এতবার এই টেস্ট করতে হয়েছে যে আমি সেদিন রাত১২টার দিকে হাত পা ছুড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“আমার বাবু ঠিক মত এখনো নড়তেছে। প্লিজ, আমি আর পারতেছি না। আর এই টেস্ট করবেন না, প্লিজ!”
ডক্টররা অনেক কষ্টে আমাকে ২০ মিনিটের জন্য সিটিজি করাতে রাজি করালো। ওদিকে একজন ডিউটি ডক্টর বলল, আমার জরায়ু মুখ খুলতে এত সময় নিচ্ছে, সেলাই না দিলেও বোধহয় হতো! তখন যে দুঃখ লেগেছিল! এত গুলো মাস সাফার করলাম কি অকারণেই?
ব্যথা বাড়ার সাথে সাথে আমি পিটোসিন এর স্ট্যান্ডসহ করিডরে হাঁটতাম জোরে জোরে, আম্মুর হাত ধরে স্কোয়াট করতাম, হিপ রোটেশন করতাম। ওখানকার খালারাও বলছিল, আমি কত ডেডিকেটেড ছিলাম। সাবিনা হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, ওকে ওর মা আমাকে দেখিয়ে ইন্সপিরেশন দিত।
রাতের দুইটা থেকে ব্যথা আরও বাড়ছিল। চারটায় ব্যথা তীব্র হলো। আমার মনে হচ্ছিল জরায়ু মুখ ছিড়ে যাবে! ডক্টর বলেছিল, আপনার পায়খানার চাপ হবে। ওটাই বেবি পুশ করার সময়। আমাদের তখন বলবেন। আমি এর আগে ব্যথা কোঁকিয়ে উঠলেও এবার আর পারলাম না। এত জোরে চিৎকার বেরুচ্ছিল যে দম আটকে থাকতো গলায় আর আমি ‘আল্লাহ’ ছাড়া আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। যত কিছু শিখেছি কোর্সে, সব ব্যথার ধাক্কায় মাথা থেকে বের হয়ে যেত!
আম্মু বলল, ব্যথা উঠলে চিৎকার না দিয়ে পুশ দিবি। ওদিকে ডক্টর এসে আমাকে দেখে বলল, পুশ না দিতে। তারা সংযুক্তা ম্যামকে কল দিচ্ছে। আর এদিকে একেকটা ব্যথার ঢেউ আমার সব শক্তি ড্রেইন করে ফেলছে। আমি ডায়বেটিস এর জন্য ৯টার দিকেই ইন্সুলিন নিয়েছি, কোনো চিনি দেয়া জুস বা খেজুর, কিচ্ছু খেতে পারিনি। অবস্থা এমন যে, আর কতক্ষন পুশ দিতে পারবো নিজেও জানি নাহ!
শেষ পর্ব
আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল।সেখানে দুজন ডিউটি ডক্টর ছিল। উনারা যখন শুনলেন, ম্যাম আনছে, কেবল তখন আমাকে হুইল চেয়ারে করে লেবার রুমে ছুটলেন। লেবার বেডে দুই পা দুই দিকে রাখার স্ট্যান্ড আছে। সেখানেও আমার পা রাখতে দেয়নি। স্ট্যান্ডের দুই পাশে পা রাখতে হলো। ফলে পুশ দেয়ার সাথে সাথে আমাকে পায়ের ব্যালেন্সও রাখতে হচ্ছিল। বিষয়টা যে কত এক্সসটিং আমি বলে বুঝাতে পারবো না। এতক্ষণে ডক্টররা আমাকে বলল ব্যথার সাথে সাথে দম বন্ধ করে পুশ দিতে। একমাত্র নরমালে হওয়া মায়েরা জানে এই সময় কি পরিমাণ শক্তি লাগে! একে তো খাবার কম খেয়েছি, অন্য দিকে ম্যামের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আমার অনেক গুলো এটেম্পট নষ্ট হলো। আমি দম খিঁচে এত জোরে পুশ দিচ্ছিলাম যে আমার সব এনার্জি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বাবু নিয়ে বাসায় যখন এসেছিলাম, তখন অবশ্য আমার চোখে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। সম্ভবত চাপের কারণেই। এক সময় আর পুশ দিতে পারছিলাম না। ডক্টররা বলছিল, আরেকটু দেন, আরেকটু। কিন্তু আমি কিছুটা চাপ দিয়ে দম চেড়ে দিচ্ছিলাম। তখন টের পেলাম সংযুক্তা ম্যাম আসলো, এসেই আমাকে লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়ে এপিশিওটোমি দিল, যাকে সাইড কাটা বলে। ডেলিভারির ব্যথা আসলে এত তীব্র হয় যে এই কাটার ব্যথাকে কোনো ব্যথাই মনে হয় না।
ম্যাম এপিশিওটোমি দেয়ার পর যে ব্যথা আসলো, তখন পুশ দিলাম, আর ডক্টর হাত একটানে বেবি বের করে আনলো!
আমি অন্য কারো কথা জানি না, কিন্তু আমার মনে হলো আমার রুহ বের করে ফেলেছে! মনে হলো আমার শরীর থেকে সব বের করে ফেলেছে! এই ব্যথার পর আমার শরীর একেবারে ছেড়ে দিল। তবে সেন্স ছিল। আমি মুয়াযের কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। ঐ অবস্থাতেও হাসি আসছিল, কারণ আগের দিন একজনের বাচ্চার কান্না শুনে ভাবছিলাম, তার বাচ্চা বিড়ালের বাচ্চার মত কাঁদতেছে কেন? এখন নিজের ছেলের কান্নাই শুনলাম বিড়ালের মত!
ডক্টর আমার সেলাই দিচ্ছিল। তখন কিছুটা ব্যথা পাচ্ছিলাম। তাই গোঙাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে এরচেয়ে বেশি কোনো শক্তিও ছিল না। ম্যাম জিজ্ঞাসা করছিল, ” এখন তো সব শেষ। এখন কি সমস্যা?”
আমি খুব শান্ত কন্ঠে জবাব দিলাম,
“সেলাইয়ের ব্যথা”
আম্মুকে সম্ভবত নার্সরা বলেছিল, ছেলে হয়েছে। আম্মু তারেককে ফোন দিয়ে বলছিল, “তুমি তাড়াতাড়ি আসো। তোমার ছেলে তো তোমাকে ডাকতেছে!”
তারেক নিচের ফ্লোরে ফজরের নামায পড়তে গিয়েছিল। ও এই কথা শুনে ছুটে উপরে আসলো। আম্মুর কন্ঠ শুনে ম্যাম আবার প্রশ্ন করলো, “কাকে ফোন দিয়ে আসতে বলতেছে?”
আমি জবাব দিলাম, “ওর আব্বুকে। নিচে নামায পড়তে গিয়েছে”
কিছু সময় পর ডক্টর বাবু নিয়ে বাইরে গিয়ে তারেকের হাতে দিল। উনি নবজাতককে সবসময় বাড়ির পুরুষ সদস্যদের হাতে আগে দেন। এটা কেন করেন জানি না, তবে আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি সবসময় চাইতাম আমাদের বাচ্চাকে প্রথম আব্বু অথবা তারেক কোলে নিবে।
আমাকে তারপর আয়ারা পরিষ্কার করছিল। আর তারেক তখন সেখানে আসলো। আমি আমার ছেলেকে জন্মের পর পর দেখতে চাইনি। আমার মনে হচ্ছিল, সুস্থ তো আছেই। আমি তো অনেক কষ্ট করলামই। বলতে গেলে দুইটা বছর কষ্ট করলাম। এখন একটু বিশ্রাম দরকার। তাছাড়া শরীরে শক্তিও ছিল না। এমন সময় তারেক আসলো। আমি চোখ খুলে প্রথম ওকে দেখলাম। ডেলিভারি রুমের কড়া আলোয় ওর আলুথালু চুল আর রাতজাগা বিধ্বস্ত চেহারার কিছুই চোখে পড়লো না। বরং মনে হলো, একটা ফেরেশতাকে দেখছি। ও আমাকে অভিনন্দন বা আলহামদুলিল্লাহ, এ জাতীয় কিছু একটা বলে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেল।
আমি ডেলিভারি রুম থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম, ও বাবুর কানে আযান দিচ্ছে। ওর কন্ঠ কাঁপছিল, শেষ দিকে ও আযান ভুলে গিয়েছিল। আম্মু ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
এই দুইটা মুহূর্ত আমার কাছে স্বর্গীয় ছিল। জানি না জান্নাতে মানুষ কত সুখে থাকবে। তবে এই মুহূর্ত দুটো আমি ভুলতে পারবো নাহ।
এরপরের অধ্যায়টা মাতৃত্বের, আমার জীবনটা মুয়াযের একটু একটু করে দখলের, প্রতি সেকেন্ডে যুদ্ধ করে আমার একটু একটু করে মা হয়ে ওঠার। আর এসবে আমার পরিবারের সবাই অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আমি পাগলের মত আচরণ করলেও তারা আমাকে সামলে নেয়। তাদের কারণে মাতৃত্বকে, কিংবা আল্লাহ প্রদত্ত এসব কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না।
এই বার্থস্টোরির মূল উদ্দেশ্য, যদি কেউ সতর্ক হয়, বুঝতে পারে কিছুটা হলেও মায়ের কষ্ট, কিছুটা হলেও মন নরম হয়। জীবনে কষ্ট যেমন থাকবে, তেমনি কষ্টের শেষও থাকবে। এই যেমন, এত কষ্টের ফল, আমার ছেলে যখন আমাকে হাত দিয়ে ধরতে চায়, আমাকে দেখে হাসে কিংবা কাঁদে, আমাকে দেখে জেদ দেখায়, আমি তখন বুঝতে পারি, এই বাচ্চাটার জীবন আমাকে ঘিরে ঘুরছে! এই যে সুখানুভূতি, এত কষ্ট না হলে কি এতটা উপলব্ধি আসতো?
আল্লাহ সব মেয়েদের মা হওয়ার অনুভূতি, আনন্দ দিক!