অতিরিক্ত ওজন নিয়ে নরমাল ডেলিভারির গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date November 6, 2023
- Comments 0 comment
অতিরিক্ত ওজন (৯০কেজি) নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর নরমাল ডেলিভারিতে মেয়ে সন্তানের মা হলাম আলহামদুলিল্লাহ।
এটা আমার প্রথম প্রেগন্যান্সি। বিয়ের ৬/৭ মাসের মাথায় ৬০ কেজি থেকে ৭৮ কেজি ওজনে চলে আসি। হাইট অনুযায়ী পারফেক্ট ওজন ৫৬/৫৭, তো ৬০ কেজিতে তেমন খুব বেশি স্বাস্থ্য মনে হতো না। শেষমেশ ৭৮ কেজি ওজন নিয়ে কন্সিভ করি। শুরু থেকেই চিন্তিত ছিলাম ওজন বেশি হওয়ার জন্য। এই বাড়তি ওজন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা মাথায় আসতোনা।
প্রেগন্যান্সির একদম শুরুতে তেমন বমি বা খাবারে অরুচি আসেনি। টেস্ট পজিটিভ আসার কয়েকদিন পরে হঠাৎ ফজরের দিকে পেটে খুব ব্যথা হচ্ছিলো, ব্যথার পরিমাণ খুব তীব্র ছিলো। আমার ছটফটানিতে সাহেব খুব ঘাবড়ে যায়, দোয়া পড়ে ফু দিতে থাকেন আমাকে। পরেরদিন ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড করে আর মেডিসিন দেয়। আল্ট্রাসাউন্ডে ৪ সপ্তাহ আসে আর তখনো বেবির হার্টবিট আসেনি। লাস্ট lmp অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ ইডিডি আর আল্ট্রাসাউন্ড অনুযায়ী অক্টোবরের ২ তারিখ ইডিডি আসে। ডাক্তার পরবর্তী চেকআপের তারিখ দিয়ে দেয় আর সেদিন যেতে বলে।
হার্টবিট আসেনি শুনে মন খারাপ হয় কিন্তু তখন জানতাম না যে ৮-১২ সপ্তাহে হার্টবিট এসে যায়। পরবর্তী চেকআপের দিন আবার আল্ট্রাসাউন্ড করে আর সেইদিন প্রথম আমি আমার বেবির হার্টবিট শুনতে পাই আলহামদুলিল্লাহ। আমার চোখ থেকে তখন নিজে থেকেই পানি পড়ছিলো আর আমি আস্তে আস্তে আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলেই যাচ্ছিলাম। বাসায় এসেই সাহেবকে জানালাম, তিনিও খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললেন।
এই গ্রুপে যুক্ত কিভাবে হয়েছি মনে করতে পারছি না। গ্রুপ থেকে প্রিনাটাল কোর্স সম্পর্কে জানি আর রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্সের ভলান্টিয়ার লাবনী আপু আমাকে এ বিষয়ে অনেক সাহায্য করেছিলো।
প্রিনাটাল কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরে অনেক উত্তেজিত ছিলাম যে অনেক কিছু জানতে পারবো, শিখতে পারবো কিন্তু প্রেগন্যান্সির শুরুতে কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য আশানুরূপ ভাবে মনোযোগ দিতে পারিনি কারণ তখন অনেক অসুস্থ থাকতাম, বমি হতো প্রচুর, কিছু খেতে পারতাম না আবার বমি হওয়ার ভয়েও খেতাম না। বমির ঔষধ খেতাম তাও বমি হতো। ডেলিভারির আগের দিনেও বমি আমার পিছু ছাড়েনি। পুরো প্রেগন্যান্সিতে বমি আর রাতে ঘুম না হওয়ার সমস্যা ছিলো। সকালের নাস্তা করতে করতে দুপুর হয়ে যেতো। সাহেব দুপুরে বাসায় এসে বকা দিতো কেনো খাইনি। অনেক বুঝাতো, মোটিভেট করতো কিন্তু আমি পারতাম না খেতে। প্রথম তিন মাস তো কেবল জলপাই আচার, পাতলা ডাল আর ঝাল কমের নাগা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছি। মালটা, আমড়া, আমসত্ত্ব খেয়েছি। আস্তে আস্তে খাওয়ার সমস্যা সমাধান হলো। সব কিছুই খেতে পেরেছি তখন আলহামদুলিল্লাহ। ডেইলি একটা ডাব, ডিম আর দুধ সাথে কলা ছাড়াও যেকোনো অন্য একটা ফল ছিলোই খাওয়ার তালিকায়।
ততদিনে কোর্সের সময়ও শেষ। সব কিছু নোট করতে না পারলেও যেগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল সেগুলো নোট করেছিলাম। ব্যায়ামগুলো শিখে রেখেছিলাম। কী কী করতে হবে, না হবে ধারণা পেয়েছিলাম। তখন মনে হতো ইস যদি একটু সুস্থ হয়ে কোর্সে জয়েন হতাম তাহলে আরো ভালো হতো। কিন্তু তবুও এই কোর্স থেকে আমি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম তা আমার প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টাকে অনেক সহজ করেছে আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথম চেকআপেই কতগুলো টেস্ট করতে দেয় যেখানে আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ঠিক ছিলো। ওজন বেশি হওয়ার জন্য আমি ডায়াবেটিসের ভয় পাচ্ছিলাম কিন্তু না আলহামদুলিল্লাহ আমার প্রেগন্যান্সির সময়ও ডায়াবেটিস হয়নি। টেস্টে রক্তে হিমোগ্লোবিন কম আসে, ৯.১১। পরে একটা রক্তের ইনজেকশন দেই আর পাশাপাশি খাবার খেতাম যেগুলোতে আয়রন থাকে।
প্রথম ২ মাসে ওজন তেমন বাড়েনি। পরের মাসে ৮০ কেজি হয়, তারপরের মাসে ৮৪, ৮৭ এভাবে করে ওজন বাড়তে থাকে। ডাক্তারের সাথে আমি শুধু ওজন নিয়েই বেশি কথা বলতাম। একদিন বলায় উনি বললেন ১০০ কেজি নিয়েও নরমাল ডেলিভারি হওয়ার রেকর্ড আছে এতো ভয় কেনো পান। উনি শুধু আমাকে ভাত কম খেতে বলেছিলেন আর তেমন কিছু বলেননি। আমিও প্রিনাটালে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জেনেছি তাই আমিও তেমন প্রশ্ন করতাম না।
৪ মাসের পর থেকে একটু একটু ব্যায়াম করা শুরু করি। প্রথম প্রথম ১০/১৫ মিনিট কী তার-ও কম সময় ব্যায়াম করতাম। রুমের মধ্যেই হাঁটতাম কিছু সময়।আমার মায়ের বাসা আবার আমার বাসা থেকে ৫/৭ মিনিটের দূরত্বে, ডেইলি সেখানে যেতাম। প্রেগন্যান্সিতে কোনো কমপ্লিকেশন না থাকায় আমার বাসার ৬ তলা আর মা’য়ের বাসার ৬ তলা সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করতাম মানে ঐ বাসায় গেলে এমনিতেই ওঠা নামা হয়ে যেতো।
২২ সপ্তাহের সময় ৩য় বার আল্ট্রাসাউন্ড করি তখন ডাক্তার বলে বাবু ব্রিচ পজিশনে আছে। ব্রিচ পজিশনে আছে শুনে একটু ভয় পেয়ে যাই। টেনশন হচ্ছিল কারণ ব্রিচ পজিশনে থাকলে তো সি সেকশন করতে হয়। তবে যেহেতু বেবির পজিশন চেঞ্জ হওয়ার এখনো সময় আছে তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে ছিলাম। তারপর থেকে হাঁটাহাঁটি বাড়িয়ে দিলাম, কোমর উঁচু করে সিজদাহ্ দিয়ে নামাজ আদায় করলাম আর সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা তো ছিলোই সাথে অনেক অনেক দুআ করলাম।
পরের মাসে চেকআপে গেলে ডাক্তার হেসে দিয়ে বলে বাচ্চার পজিশন ঠিক হয়ে গেছে। একথা শুনে চিন্তা মুক্ত হলাম। ৩৩ সপ্তাহে আবার আল্ট্রাসাউন্ড করি তখন সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ আসলো ইডিডি। ডাক্তার বললো সবকিছু ঠিক আছে – বাচ্চার ওজন, fluid লেভেল সব কিছু। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে আবার চেকআপে যেতে বললো আর বলে দিলো কোন সমস্যা মনে হলে আগে আসতে। ডাক্তার দেখিয়ে আমিও খুশি মনে বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে যখন রিপোর্ট নিয়ে বসি রিপোর্ট দেখে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, রিপোর্টে দেখি প্লাসেন্টার পজিশন ঠিক নেই।রিপোর্ট প্লাসেন্টা প্রিভিয়াতে টিক দেয়া। এক মুহুর্তে আমার সব আশা ভরসা শেষ হয়ে গেলো মনে হচ্ছিলো। মাথা কাজ করছিলো না। শুধু এটাই মনে হচ্ছিলো এখন তো সিজারই করতে হবে। বাড়তি ওজন থাকার পরেও শুরু থেকেই নরমালের আশা, নিয়ত ছিলো এক মুহূর্তের জন্যও সি সেকশনের কথা মাথায় আসেনি আর এখন শেষ পর্যন্ত এটাই হবে! কিন্তু এটাও ভাবছিলাম ডাক্তার কেনো আমাকে এটা নিয়ে কিছু বললো না! কেনো বললো সব কিছু ভালো আছে?
যতটুকু জানি, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে তো বেড রেস্ট দেয়, ব্লিডিং হয় কিন্তু আমি তো স্বাভাবিক আছি, কোনো সমস্যা মনে হচ্ছে না। আমার চিন্তা আর অস্থিরতা দেখে সাহেব বললেন এটা হয়তো ভুলে টিক দিয়েছে। কিন্তু আমি আমার মনকে বুঝ দিতে পারছিলাম না। তখন তিনি বললেন ডাক্তার যেদিন বসবে সেদিন আবার যাও।
ডাক্তার বসতে এখনো ৪ দিন বাকি আর আমি কিছুতেই এই ৪ দিন ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে পারবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম অন্য হসপিটালে আল্ট্রা করানোর সেখানে বাঁধলো আরেক ঝামেলা, আল্ট্রা করায় পুরুষ ডাক্তার। রিসিপশনে আল্ট্রাসাউন্ড করার জন্য কথা বললে ভদ্রলোক বললেন আপনি পুরুষকে দিয়ে তো করাবেন না, ৪০ মিনিট পরে মহিলা ডাক্তারের ডিউটি অপেক্ষা করতে হবে। বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম,আমার অস্থিরতা দেখে উনি আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলো যে রিপোর্ট ভালো আসবে এতো চিন্তা করো না। দুআ করো, দুরদ পড়ো কিন্তু আমার ভালোই লাগছিলো না। আমি শুধু উনাকে বলেছিলাম আপনিও আমার সাথে থাকবেন। উনি বললো, হুম থাকবো।
অবশেষে আল্ট্রার রুমে প্রবেশ করলাম। ম্যাম আল্ট্রা করার সময় এক এক করে সবকিছু বলছিলেন তখন আমি শুধু এটাই জিজ্ঞেস করি যে প্লাসেন্টার পজিশন ঠিক আছে? উনি বললেন, সব কিছু ঠিক আছে। ম্যাম বলছিলেন, বাচ্চা তো অনেক নড়াচড়া করছে মাশা-আল্লাহ। তিনি আমার সাহেবকেও দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন দেখতে পাচ্ছেন এটা আপনাদের বাচ্চা। এটা পা, এটা মাথা। আমি তখন দেখছিলাম কেমন করে সাহেবের মুখ চকচক করছিল বাবুকে দেখে মাশা-আল্লাহ। আমিও ম্যামকে বললাম, আমি কি দেখতে পারবো? উনি বললেন, অবশ্যই! পরে স্ক্রিনটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন আর বললেন দেখেন বাবুকে, ঐ যে মুখের সামনে হাত দিয়ে রেখেছে। আমিও তাকিয়ে দেখতে থাকলাম মাশা-আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ বাবুর হাত মুখের কাছে তখন একটু শব্দ করে হেসেও দিয়েছিলাম। এতো ভালো লাগছিলো বলার মতো না। গত দুই দিনের সমস্ত চিন্তা, পেরেশানি সব মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো আমার হুর’কে প্রথম দেখে আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।
হাসি মনে বাসায় আসলাম পেস্ট্রি নিয়ে, ওজনের চিন্তা ভুলে পেস্ট্রি খেলাম। সাহেবও মহা খুশি বাবুকে দেখতে পেরে আর আমিও। কারণ আমি যেই ডাক্তারের আন্ডারে ছিলাম ঐখানের স্ক্রিনটা ঘুরানো যায় না তাই আগে দেখিনি। দেখতে দেখতে ৩৭ সপ্তাহ চলে আসলো, সাহেব ডেইলি আনারস এনে নিজে কেটে দিতো খেতে। আনারস পছন্দ করি না তাও উপকার হবে এই আশায় খেয়েছি। আনারস আর ৮/৯ টা করে খেজুর খেয়েছি, ডেইলি ইন্টিমেট হওয়ার ট্রাই করেছি।
৩৫ সপ্তাহ থেকেই হাঁটতে কষ্ট হতো, এমনিতেই স্বাস্থ্য বেশি তার উপর নিচের দিকে চাপ লাগতো প্রচুর। রেস্ট নিয়ে নিয়ে হাঁটতাম আর দুআ করতে থাকতাম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে বলতাম যে নিয়তে এই সবকিছু করছি আপনি কবুল ও সহজ করে দিয়েন। প্রচুর দুআ করতাম সবসময় বলতাম, ইসা (আঃ) এর জন্মের সময় আপনি যেমন মারিয়াম (আঃ) কে সাহায্য করেছিলেন, তেমনি ভাবে আমাকেও সাহায্য করুন।মারিয়াম (আঃ) এর কথাই মাথায় ঘুরঘুর করতো সবসময়।
আগস্টের ২৯ তারিখে একবার ফলস পেইন হয়, কিছু সময় হাঁটাচলা করলে ঠিক হয়ে যায় এরপর আর সমস্যা হয়নি। এর মাঝে আমার হসপিটালের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম।
সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে মা, বোন ভাবিসহ মার্কেটে যাই কিছু কেনাকাটা করতে, সেদিন মার্কেটে ভালোই হাঁটা হয়। মায়ের বাসা থেকে রাতে সাহেবের সাথে বাসায় চলে আসি ১১:৩০ এর পর। আমার প্রেগন্যান্সির পুরোটা সময় আমি আমার বাসায় ছিলাম। নিয়ত ছিলো বাবু নিয়ে হসপিটাল থেকে মায়ের বাসায় যাবো, এর আগে যাবো না। তো রাতে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে দু’জন কিছু সময় গল্প করি। রাতের খাবার শেষ করতে প্রায় রাত ১ টা বেজে যায়। খাবার খাওয়ার পর থেকেই হালকা হালকা পেটে ব্যথা করছিলো যা খুবই সামান্য। খাওয়া শেষে আমি সাহেবকে বলি আপনি শুয়ে পড়েন আমি পরে ঘুমাবো। উনি জিজ্ঞেস করে, ব্যথা কি বেশি? বলি যে, না। আমরা দুজনে বলাবলি করছিলাম আজকে কেবল ১০ তারিখে পড়লো ডেট তো ২৭ তারিখ অবশ্য আগে পরেও হতে পারে, এই সেই।
উনাকে বলি আমি একটু হাঁটাচলা করি, ফলস পেইন হলে তো চলে যাবে তখন নাহয় শুয়ে পড়বো আর এমনিতেও পুরো প্রেগন্যান্সির সময় আমার রাতে ঘুম হতো না। যাইহোক তারপর হাঁটা শুরু করি তখন রাত ২টা বাজে। আস্তে আস্তে হাঁটি আর এটা সেটা চিন্তা করি। সন্ধ্যায় মার্কেটে যাওয়ার কারণে খেজুরগুলো খাওয়া হয়নি, মনে পড়াতে খেজুরগুলো খাচ্ছিলাম। পাশেই একটা কনস্ট্রাকশানের কাজ হচ্ছিলো তো রাতে ট্রাকে করে সেখানের পাথর আসে আমি আবার উঁকি দিয়ে পাথর নামানো দেখছিলাম। এর মাঝে বেশ কয়েকবার সাহেব উঠে জিজ্ঞেস করে ব্যথা কমে নাই? বলি, না। তারপর দেখতে দেখতে ব্যথাটা পিরিয়ডের ব্যথা যেমন হয় তেমন করে হতে থাকে।
গ্রুপের বার্থ স্টোরি যখন পড়তাম তখন দেখতাম আপুরা কতসময় পরপর ব্যথা হয় এগুলো সব বলে মিনিট হিসাব করে তখন ভাবতাম এমন কিভাবে মনে রাখে আবার কোর্সে যখন টাইম, পানির কালার কখন হসপিটাল যেতে হবে এই সব বলতো ভাবতাম আমার মনে হয় মনে থাকবে না। কিন্তু না, কোর্সে বলা প্রতিটি বিষয়, মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার বিডি’র পেইজে লেবার সংক্রান্ত যতগুলো পোস্ট আমি পড়ে ফোনের নোটপ্যাডে কপি করে রেখেছিলাম প্রতিটা কথাই আমার মেমোরিতে ছিলো সে সময় আলহামদুলিল্লাহ।
যাইহোক প্রসঙ্গে আসি, পিরিয়ডের মতো ব্যথাটা হতেই থাকে। না কমলে আমি ধারণা করি হয়তো এটা লেবার পেইন। এই ভাবনা থেকে ঘড়ি দেখে হিসাব রাখা শুরু করি। দেখি যে ৩-৪ মিনিট পরপর ব্যথা আসে। পেটে কামড় দিয়ে দিয়ে ব্যথাটা হয়। যখন চলে যায় মনে হয় কোনো ব্যথাই ছিলো না আমার। হাঁটাচলার মধ্যে কিছু কিছু ব্যায়ামও করি তখন। হিপ রোটেশন, খাট ধরে হাফ স্কোয়াট ও ডিপ স্কোয়াট করতে থাকি। একটু পরপর শুধু ওয়াশরুমে যাই, অনেক প্রসাব আসছিলো কিছু সময় পরপর।
রাত ৪:২০-এ ফজরের ওয়াক্তে হঠাৎ করেই প্রচুর গরম লাগা শুরু হয়, সাহেবকে ডেকে বলি টেবিল ফ্যান ছেড়ে দিতে কারণ আমার ছাড়তে ইচ্ছা করছিলো না। ফ্যানের বাতাসে অনেক ভালো লাগে। মনে হলো কোনো ব্যাথা নাই, ইচ্ছা করলো একটু ঘুমাই। সাহেব লাইট অফ করে ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিলো আমিও শুয়ে পড়লাম। ঘুমে চোখ বুজে আসলে হঠাৎ মনে হলো পেটের মধ্যে বেলুন মতো কিছু একটা ঠাশ করে ফুটে গেলো সাথে একটু কামড় দিয়ে ব্যথাও করলো,আমি বলে উঠলাম, “কী হলো, কী হলো এটা!”
উনি লাফ দিয়ে উঠে রুমের লাইট অন করলো আমি দেখলাম আমার জায়গায় পানি! বেড ভিজে গেছে, হিসু করলে যেমন হয়। আমি বললাম, আমার তো প্রেশার আসে নাই তাহলে হিসু কেমনে! পরে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে প্রসাব করে আসলাম। ওয়াশরুম থেকে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম ঠিক তখনই হাফ গ্লাসের মতো পানি পা গড়িয়ে পড়ে গেলো। আমি খেয়াল করে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম, পানি ভেঙে গেছে। সাহেবও বুঝতে পারলো, বললো আম্মাকে কল দাও হসপিটাল চলো। আমার মাথায় ঘুরছিলো, আমার ব্যথা তো সহনীয় পর্যায়ে আছে, আগে আগে হসপিটাল গেলে তো জরায়ুমুখ খুলে নাই বলে সিজার করতে চাইবে, (মানে যেমনটা অন্যদের থেকে শুনতাম যে এমন হয় অনেক ক্ষেত্রে) তাই আমি বললাম সকাল পর্যন্ত দেখি।
সাহেব রাজি হলেন না আর আমিও দেখলাম ঐটুকু পানি ভাঙার পরে ব্যথাটা মনে হয় বাড়ছে। মাকে কল দিয়ে বললাম। মা বললো ব্যাগ নিয়ে নিচে নামতে, ওনারা আসছে। ব্যাগ আগেই গোছানো ছিলো তাই ঝামেলা হলো না। নতুন করে শুধু ব্যাগে খেজুর নিলাম, পুশিং স্টেজে অনেক শক্তি লাগবে তাই আরো খাবো এই ভেবে আবার বাবুর তাহনিকও করাতে হবে, তারপর ফোনের চার্জার নিলাম। জমজমের পানি নিতে ভুলে গিয়েছিলাম তখন।
বাসার নিচে গেলাম সাহেব আর আমি। দেখলাম বড় ভাইয়া আর মা রিক্সা নিয়ে আসছে। ক্লিনিক যেহেতু কাছেই তাই রিক্সা নিয়েই চলে গেলাম। ততক্ষণে ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে আমরা বাসায় থাকতেই। ভোর ৫ টার পরে ক্লিনিকে গেলাম। একজন আয়া আন্টি আর একজন নার্স আসলো। নার্স আপু এসে জিজ্ঞেস করলো কী কী হয়েছে, আমি বললাম। উনি জানতে চাইলো হার্টে সমস্যা আছে কিনা, ডায়াবেটিস আছে কিনা। বললাম, না নেই। রিপোর্টগুলো দেখলো পরে বাবুর হার্টবিট চেক করলো। আমাকে বললো চেক করবে জরায়ুর মুখ খুলেছে কিনা।
চেক করতে করতে বললো আমরা নরমালের আশা করছি না হলে সিজারে। উনার অনেক স্বাস্থ্য। আমার ওজন বেশি হওয়াতে উরু অনেক ভারী। চেক করে বললো জরায়ুর মুখ খুলতে শুরু করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কতটুকু পরিমাণে? উনি বললেন তুমি বুঝবে? আমি বললাম, জ্বি আমি জানি। আয়া আন্টি এসে আমাকে হাঁটতে বললেন। খাট ধরে কোমর দোলাতে দেখিয়ে গেলেন আমিও সেগুলো করতে থাকলাম।
গলা শুকিয়ে আসছিলো দুরদ পড়তে পড়তে। একসময় মনে হলো ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে পটির প্রেশার আসছে খুব। আয়া আন্টিকে বললাম, উনি বললেন এটা পটির প্রেসার না, যেতে হবে না ওয়াশরুমে। আমি তাও গেলাম আর কিছু সময় অপেক্ষা করে আসলাম। পরে আমাকে উনারা লেবার রুমে নিয়ে গেলো সকাল ৬টার পরে । এতো পরিমাণ পেইন হচ্ছিলো সুবহানাল্লাহ যা বর্ণনা করার ভাষা জানা নেই। ডিপ ব্রিদিং করছিলাম আর আল্লাহকে বলছিলাম সহজ করে দেন, সাহায্য করেন। কান্না করছিলাম গোঙানির মতো শব্দ করে আমার পা কাঁপছিলো খুব। আয়া আন্টি আর নার্স আপু অনেক সাপোর্টিভ ছিলো। উনারা আমার পা ধরে ছিলো পা কাঁপছিল দেখে আর বলছিলো বাচ্চাটা বের হলেই শান্তি পাবা।
পুশিং স্টেজে অনেক শক্তি প্রয়োজন হয়, এই সময়টাতেই আমার কষ্ট হয়েছিল। বাবুর মাথা দেখা যাচ্ছিলো আমাকে উনারা বলছিলো প্রেশার আসলে পুশ করবা। আমি করছিলাম কিন্তু পেরে উঠছিলাম না।এর মধ্যে আমার বড় বোন চলে আসে লেবার রুমে। পরিবার থেকে একজন থাকার অনুমতি ছিলো তাই বোন ছিলো আমার কাছে। আমি না পেরে কাঁদছিলাম আর বলছিলাম আর পারি না। উনারা সবাই বলছিলো, সবাই পারে তুমিও পারবা আর অল্প একটু, জলদি করো বাবু নিয়ে বাসায় যাবা না! পরে আমাকে বলছিলো দুআ পড়ো আমি বললাম আসছে না মুখে তারপর তারাই জোরে জোরে দোআ ইউনুস পড়েছিলো। পরে তিন/ চার বার চোখ বন্ধ করে পুশ করলাম, আলহামদুলিল্লাহ বাবু বের হলো।
সকাল ৭:৫০ মিনিটে আমার জান্নাতি হুরের আগমন ঘটলো দুনিয়াতে আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। হুরকে নিয়ে ঐ ভাবেই আমার বুকে দিলো আমি একটু ধরে দেখলাম চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো আর মনে মনে ভাবছিলাম এটা আমার বাবু! আমার পুরো খেয়াল ছিলো। উনারা দেখলাম বাবুকে পরিষ্কার করছিলো, তখন আমার পিচ্চিটা খুব চিল্লায় চিল্লায় কান্না করছিলো। পরে বাবুকে আমার বোনের কোলে দেয়, ও অনেক খুশি হয়ে বাবুকে নিয়ে বাহিরে গেলো ওর নানু মনি আর বাবাকে দেখাতে।
লাস্ট স্টেজে আমার এপিশিওটোমি লেগেছিলো। বাবুর ওজন ছিলো ২.৮ কেজি। বাবুকে ওর বাবার কোলে দেয়া হলে উনি নিজেই বাবুকে তাহনিক করায়, কানে আযান দেয় আলহামদুলিল্লাহ। খুশিতে উনি কান্না করেছিলো ফোনে বাবু হওয়ার খবর জানাতে গিয়ে কথাই বলতে পারছিলোনা খুশি আর কান্নাতে। এসব আমি অবশ্য পরে জেনেছিলাম। সবাই খুব বেশি খুশি ছিলো যে অল্প সময়ে বাবু হয়ে গেছে। আমার স্বাস্থ্য, ওজন নিয়ে ওনারা চিন্তিত ছিলো যে সি-সেকশন করতে হয় কিনা। লাস্ট স্টেজে মা অন্য হসপিটালে যেতেও চেয়েছিলো যদি সিজার করতে হয় তাই। কিন্তু আমি যেতে রাজি হইনি আমার ভেতর থেকেই একটা বিশ্বাস ছিলো বাবু নরমালেই হবে আর আমার পুরো প্রেগন্যান্সির সময় সিজারের চিন্তা আমার মাথায়ও আসেনি।
কোর্সে জেনেছিলাম নতুন মায়েদের লেবার পেইন ১৮-৩০ ঘন্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। আর সেখানে আলহামদুলিল্লাহ আমার লেবার টাইম ছিলো অনেক কম, সকাল ৫:১৫ মিনিটে ক্লিনিকে গেলাম আর ৭:৫০ মিনিটে আমার মেয়ের জন্ম হলো। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট যেমন চেয়েছিলাম তিনি তার থেকেও উত্তমভাবে আমার দুআ কবুল করে আমাকে দয়া করেছেন।
ওজন বেশি আর উরু ভারি হওয়ার জন্য একটু সময় লেগেছে সেলাই শুকাতে। ১১ দিনের সময় সুতা পড়ে যায়, ১৪ দিনের চেক-আপে ডাক্তার বলেন যে সমস্যা নেই আর। ২১ দিনের বাবু নিয়ে মায়ের বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে এসেছি, বাবুর দেখাশুনা ওকে সামলানো সব একাই করছি আলহামদুলিল্লাহ। আমিও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আমার মেয়ের আজ ৪২ দিন আলহামদুলিল্লাহ। আমার মেয়ের জন্য সবাই দুআ করবেন ইনশাআল্লাহ আল্লাহ যেনো ওকে নেক দীর্ঘ হায়াত দান করেন আর দ্বীনের জন্য কবুল করেন।
উম্মে বারাকাহ
রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ ১২
Other post
You may also like
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …
যেভাবে সন্তানকে ভালো রাখা যায়
আমার বাচ্চাটাকে কানাডাতে আলহা’মদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত রব্বুল আ’লামীন হিফাজতে রেখেছেন। আমি সাধারণত আমার বাচ্চাকে নিয়ে কখনও গর্ব করি না, তার ছবি পোস্ট করি না, খুব একটা কিছু লিখিও না। আল্লাহর আমানত, আমার অহংকার করার কিচ্ছু নাই। আজকে লিখছি, একটা বাচ্চা …