উপকারী জ্ঞান অর্জন করা হোক এই কোর্স করার উদ্দেশ্য
নিউজ দুটো মনে গেথে গেল-
১. ট্রাক ড্রাইভার ট্রাকটা নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় লাফ দিয়েছিল। আরেকটি ট্রাক এসে তাকে পিষ্ট করে চলে গেল।
২. ডেংগুর চিকিৎসার জন্য হসপিটালে ভর্তি হলো ছেলেটা। খাবার আনতে ভাই বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসে জানলো বারান্দায় হাটতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে নিচে। মারা গেছে ডেংগু আক্রান্ত ছেলেটা।
অপ্রতিরোধ্য ক্বদরের কথা ভাবছিলাম, মৃত্যু লেখাই ছিল তাদের জন্য। তাই চেষ্টা সত্ত্বেও মালাকুল মউত নিয়ে গেছে তাদের।
ঘুমের মাঝে মারা গেল আমার দেড় মাসের ছেলেটা, ২য় সন্তান। কেউ বলল,
“আপনি ঢেকুর তুলেননি?”
কেউ বলল,
“কাত করে শোয়াতে হয় বাচ্চাকে” (সম্পূর্ণ ভুল তথ্য!)
আর যারা SIDS (Sudden infant death Syndrome) বিষয়ে জানে তারা বললো,
“হার্টে প্রবলেম ছিল কি?”
“প্রিম্যাচিউর ছিল কি? লো বার্থ ওয়েট?”
৩৩ সপ্তাহে জন্মানো ১৮০০ গ্রামের সন্তানকে যখন বাসায় নিয়ে আসলাম তখন ওর ওয়েট আরও কমে গেছে। জন্মের পরপরই ওর বাবা SIDS/ Cot death নিয়ে চিন্তিত ছিল। তাই হোম অফিস করার ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখে রাখতো। কিন্তু যাকে আল্লাহ নিতে চান তাকে কে আটকাবে? নিজেকে দোষারোপ করতে চাইলে অনেকভাবেই করা যায়, শয়তানের কাছে হার মেনে আফসোস করা যায় খুব সহজে, কিন্তু আমি যাকে আদর্শ মানি তাঁকে তো আফসোস করতে দেখলাম না! একের পর এক সন্তান চলে গেল আল্লাহর কাছে, তিনি কাউকে দোষ দিলেন না। দুনিয়াবি চুলচেরা বিশ্লেষণে গেলেন না, মেয়ের সন্তানের মুমূর্ষু অবস্থায় মেয়েকে এই সংবাদ পাঠালেন যে, “সব কিছুর মেয়াদ নির্দিষ্ট!” যখন জীবনসঙ্গীকে জানাই যে কেউ কেউ বলছে,
“আবারও যদি বাচ্চা মারা যায়?”
তখন ও শান্তভাবে জবাব দেয়,
“মারা গেলে যাবে, আল্লাহরই তো, চাইলে নিবেন।”
তখন মনটা স্থির হয়ে যায়। জীবন তো একটাই, সারাক্ষণ দুনিয়া হারানোর ভয় তো মুসলিমদের পাওয়ার কথা না!
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্সটা নেন চার জন আপু। একজন সার্টিফাইড চাইল্ড বার্থ এডুকেটর, একজন অবস. গাইনকোলজি কন্সাল্ট্যান্ট, আরেকজন ডক্টর, অপরজন চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে স্টাডি করেছেন। কোর্সটা করার সুযোগ যখন আসলো কিছু কারণে আগ্রহী হলাম, লেবার, প্রসব পরবর্তী যত্ন, প্রসবকালীন ডায়েট ও ব্যায়াম নিয়ে জানার ইচ্ছা ছিল। প্রতিবার গর্ভকালীন মোবাইল এপ ফোনে ইন্সটল করা থাকলেও এই বিষয়গুলো জানা নিয়ে কিছু ঘাটতি থেকেই যাচ্ছিল। বিশেষ করে লেবারের স্টেপ বাই স্টেপ জ্ঞান ছিল না আমার, যেটা সত্যিই জরুরি। নয়তো লেবার পেইন শুরুর পর ঠিক কোন সময় হসপিটালের জন্য দৌড়াতে হবে বুঝা যায় না৷ প্রসব পরবর্তী সমস্যা ও তার সমাধান না জানা থাকলে সমস্যাগুলোকে ভয়ংকর মনে হতে থাকে! ইস্তিখারা পড়ে তাই রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম।
সত্যি বলতে প্রথম ক্লাসেই মনে হয়েছে আমার রেজিস্ট্রেশন ফি উসুল হয়ে গেছে!
কোর্সটা করে আসলেও উপকৃত হয়েছি, সবচেয়ে উপকারী জ্ঞান মনে হয়েছে কখন সিজার করা জরুরি, কখন সিজার হলেও পরবর্তীতে ন্যাচারাল ডেলিভারি সম্ভব এসবের উপর ক্লাসটা। এখন প্রাকৃতিক প্রসবের প্রতি বেশিরভাগ মা-ই আগ্রহী। কিন্তু আমাদের এইও বুঝা উচিত যে আমাদের মূল লক্ষ্য মা ও শিশু দুইজনের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সিজার হলেই জীবন শেষ না। অনেক সময় আমরা পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে ডাক্তারকে সন্দেহ করতে থাকি সিজার হলে। এই ক্লাসটা অনেক রকম ভুল ধারণার সংশোধন করবে ইন শা আল্লাহ।
না জেনে অনেকেই যেসব খাবার খেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে না, তাও না করে দেয় প্রেগন্যান্সির সময়। এই বিষয়ক কনফিউশনগুলো কোর্সের শুরুতেই কেটে যাবে।
প্রাকৃতিক প্রসবের সব ব্যায়াম সবার জন্য নয়, সব রোগের পথ্য যেমন এক নয়। কারো হয়তো স্কোয়াট করাই নিষেধ, কারো ৩৭ সপ্তাহের আগে নিয়মিত হাটা নিষেধ-প্রতিজনের হিস্ট্রি অনুযায়ী সেটা সাজেস্ট করা বেশ সিনসিয়ারিটির ব্যাপার। আপুরা এই কষ্টের কাজটা বেশ দক্ষতা ও গুরুত্বের সাথে করছেন, মা শা আল্লাহ, বারাকাল্লাহু ফীহুন্না।
বাচ্চা হওয়ার পর সমস্ত ফোকাস পড়ে বাচ্চার উপর, মায়ের যত্নটা হয় খুবই কম। সবাই সেই মা-কে মহিয়সী ভাবে যে নিজের যত্ন না নিয়ে সারাক্ষণ সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত থাকে। অথচ মায়ের এই সময় শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যে কতটা জরুরি বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে চান না। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন রিলেটেড ক্লাসগুলো তাই যতটা না মায়ের শোনা দরকার তার চেয়ে বেশি শোনা উচিত পরিবারের সবার। শুধু এই ক্লাসটা যদি বাচ্চার নানা বাড়ি-দাদাবাড়ি সবার শোনার সুযোগ হতো খুব ভালো হতো মনে হয়!
মায়ের খাদ্যাভাসের জন্য বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চার নানারকম সমস্যার কথা সমাজে প্রচলিত। বাচ্চাকে খাওয়ানোর ক্লাসগুলোতে এসব প্রচলিত ধারণার ভুল-শুদ্ধ খন্ডিত হয়েছে, বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো, শোয়ানোর পদ্ধতি, কখন তাকে জরুরি হাসাপাতালে নিতে হবে তার নির্দেশনা আছে। SIDS নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
দুইজন আপুর দুইটা উক্তি মাথায় গেথে আছে। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে এক আপু বলেছিলেন নিজের যত্নটা নিজেকেই নিতে শিখতে হবে। কথাটা মনে গেথে নিলে কারো প্রতি কোনো আশা কাজ করবে না, সেই সাথে নিজের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া সহজ হবে। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের ক্লাসে ইন্সট্রাক্টর আপু বলেছিলেন, “আল্লাহ নিশ্চয়ই সবথেকে ভালো জানেন!” আমরা কোনো মাকে দেখলেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসি যে তার প্যারেন্টিং এ কোথায় ভুল হচ্ছে। তার আগে আমার বুঝা উচিত যে আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন এই বাচ্চার জন্য উপযুক্ত মা কে! মা’রা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না। যে এই ভার নিতে সক্ষম আল্লাহ তাকেই মা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। তাই আমাদের বিচারের মাপকাঠিতে তাদের না মেপে নিজের দায়িত্বগুলোর বিষয়ে যত্নশীল হওয়াই উত্তম।
বিজ্ঞানের বাইরেও অনেক কিছু আছে যা আমাদের অজানা, বিজ্ঞান কুরআন হাদীসের মতো অপরিবর্তনীয় নয়। বৈজ্ঞানিক বিষয়েও মতভেদ থাকে। তাই আমরা যেন এই লব্ধ জ্ঞানকে পরম (Absolute) কিছু মনে না করি। এই কোর্স শেষে, “I know it all” অনুভূতিটা যেন না আসে। কোর্সের সাথে না মিললেই ডাক্তার পালটানো বা ডাক্তারের দোষ ধরা, লেবার রুমে সংঘাতে না জড়াই। যদি কিছু মনমতো না হয়, যদি সত্যিই ডাক্তার বা হাসপাতাল পাল্টাতে চাই তাহলে যেন ইস্তিখারা করে আল্লাহর ফয়সালার জন্য বাকিটা ছেড়ে দেই। কুরআন হাদীস জানার জন্য যেমন আমরা আলেমদের শরণাপন্ন হই তেমনি মেডিক্যাল ইস্যু পাশের বাড়ির ভাবির থেকে না জেনে যে সত্যিই জানে তার কাছে জানাটাই উত্তম।
উপকারী জ্ঞান অর্জনই যেন এই কোর্স করার উদ্দেশ্য হয়, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা এই কোর্সের সাথে জড়িত সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুক, আমীন।
উম্মে আহমেদ,
৪র্থ ব্যাচ, প্রিনাটাল কোর্স