একজন নার্স হয়েও প্রিনাটাল কোর্স যেভাবে আমাকে নরমাল ডেলিভারিতে সাহায্য করেছে
প্রথমেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। আল্লাহ তা’লার অশেষ রহমতে আজকে আমি আমার প্রেগ্ন্যাসির জার্নি শেষ করে একজন সুস্থ সন্তানের মা হতে পেরেছি।
আসলে আমার প্রেগন্যান্সি কোনে প্লেইন প্রেগন্যান্সি ছিল না, হঠাৎ করেই একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যাই, হালকা বমি আসত। এগুলো দেখে ইউরিন টেস্ট করে জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। তখন আসলে কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না, যেহেতু এটা প্লেইন প্রেগন্যান্সি ছিল না। আল্লাহ এর দেওয়া উপহার ভেবে মেনে নিয়েছিলাম। তখন আমার ও আমার হাসব্যান্ড এর চাকরির সুবাদে কক্সবাজার ছিলাম।
আমি যেখানে চাকরি করতাম আমার বাসা থেকে প্রায় ১ ঘন্টার রাস্তা ছিল। অনেক জার্নি করা লাগত। বাবুকে পেটে নিয়ে প্রথম এক দেড় মাস জব করেছিলাম। পরে দেখলাম আমার জন্য খুব রিস্ক হয়ে যাচ্ছে, জব ছেড়ে বাবার বাড়ি এসে পড়লাম। প্রথম চেক আপ কক্সবাজার এর একটি হসপিটালে করেছিলাম। যেই ড. দেখিয়েছিলাম উনাকে তেমন ভাল লাগেনি। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি, খালি ওষুধ লিখে দিয়েছেন।আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ ছিল। কিছু খেতে পারতাম না, খালি টক দিয়ে ভাত খেতাম। কোনো রান্নার গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না। যেহেতু প্রথম প্রেগন্যান্সি, প্রেগন্যান্সি নিয়ে তেমন কিছু জানতাম ও না। খুব করে চাচ্ছিলাম অনেক কিছু জানতে।কিন্তু কিভাবে!!!
ঠিক তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার জন্য এটা সহজ করে দিলেন। হঠাৎ একদিন ফেসবুক এ রৌদ্রময়ী স্কুল এর প্রি নাটাল কোর্সটা চোখে পড়ল।সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কোর্সটা করব। আলহামদুলিল্লাহ কোর্স এ ভর্তি হয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আমার জন্য যে প্রেগন্যান্সির জার্নিটা তখন কত সহজ হয়ে গেল!
প্রেগন্যান্সিতে সঠিল ডায়েট মেনে চলা, ফিজিক্যাল চেইঞ্জ, নিউট্রেশন, প্রেগন্যান্সি এক্সারসাইজ, নরমাল লেবার এর প্রিপারেশন, কখন সি-সেকশন দরকার, লেবার পেইন কিভাবে ম্যানেজ করা যায়, গর্ভ পরবর্তী যত্ন, নতুন শিশুকে পরিচর্যা থেকে শুরু করে আরো খুঁটিনাটি অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম।যদিও আমি একজন নার্স, কিছু কিছু বিষয় আগে থেকে জানতাম, কিন্তু এই কোর্স করার পর মনে হল আমি তো এতদিন কিছুই জানতাম না!!
আলহামদুলিল্লাহ, তার পর থেকে শুরু হয় আমার চেষ্টা। মনে প্রানে চাচ্ছিলাম প্রথম থেকেই যেন আমার নরমাল ডেলিভারি হয়, আল্লাহ এর কাছে খুব করে দোয়া করছিলাম।
প্রতিদিন চেষ্টা করতাম এট লিষ্ট ৩ লিটার পানি খেতে, যেই আমি দিনে এক লিটার পানিও খেতাম না। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ইনটেক ঠিক রাখতে চেষ্টা করতাম প্রতিদিন, যদিও সবসময় পারতাম না।
আমার আলহামদুলিল্লাহ প্রথম ২ -৩ মাস বমি হয়েছিল, পরে আর কোনো বমি হয়নি। খালি সমস্যা ছিল সবকিছু খেতে পারতাম না। প্রতিদিন ৪০ মিনিট হাঁটা, সামান্য ব্যায়াম করার চেষ্টা করতাম, যদিও রেগুলার ছিল না।
বাবার বাড়ি এসে একজন নরমাল ডেলিভারি সহায়ক ড. খুঁজছিলাম। পরে একজন ড. এর কাছে গেলাম, ওনাকে আমার তেমন নরমাল ডেলিভারি সহায়ক মনে হয়নি। পরে আমি আরো অনেকের সাথে পরামর্শ করে একজন ড. এর সন্ধান পেলাম, সাথে হসপিটালেরও যেখানে বেশিরভাগ নরমাল ডেলিভারি করানে হয়।
৮ মাস এর সময় আমি ওই ড.এর কাছে ভিজিট এ যাই।
আলহামদুলিল্লাহ উনাকে আমার যথেষ্ট নরমাল ডেলিভারি সহায়ক মনে হয়েছে, উনি আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। যেই হসপিটাল সিলেক্ট করেছিলাম ওইখানের রুলস ছিল ডেলিভারিতে কোনে গার্ডিয়ান এলাও না। বাকি সব ঠিক ছিল, এই জায়গায় এসে আমি আটকে গেলাম। ড. এর সাথে এই বিষয়ে কথা বলার পর উনি আমাকে আশা দিয়ে বললেন আমার গার্ডিয়ান একজন এলাউ করবেন। আমি খুব খুশি হলাম।
দিন যাচ্ছিল আর আমার ডেলিভারি ডেইট আগাচ্ছিল।আমি লাষ্ট মাস পুরাটাই রমাদান পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম রমাদান এ রোজাগুলো রাখতে পারব তো! আবার যদি অসুস্থ হয়ে যাই, এর মধ্যে যদি পেইন উঠে যায়!
আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ এর অশেষ রহমতে আমি সবগুলো রোজা সুস্থভাবেই রাখতে পেরেছি, এদিকে আমার ডেলিভারি ডেইট পার হয়ে যাচ্ছে অথচ কোন পেইন নেই। এই জন্য আরো বেশি টেনশন হচ্ছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে খুব করে দোয়া করছিলাম আমার সবকিছু যেন নেচারালি হয়,দোয়া কবুলের সময়গুলোতে দোয়া করছিলাম।
আল্লাহ এর রহমতে পরের দিনই আমার হালকা হালকা তলপেটে পেইন হয়,আর হালকা ব্লাডি শো দেখা যায়।
আস্তে আস্তে পেইন বাড়ছিল,আর অল্প অল্প পানি যাচ্ছিল। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম আমার আবার পানি ভেঙে গেল কিনা। সেজন্য সকালেই গেলাম ড. এর কাছে এনশিয়র হতে সব ঠিক আছে কিনা।
ড. সব পরীক্ষা করে জানাল আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক আছে, পিভি চেক করে জানাল ডাইলেশন, ইফেসমেনট কিছুই এখনো হয়নি, আমাকে বাসায় পাঠাল, বলল পেইন তীব্র হলে আসতে।
আমি হসপিটালে এডমিট হয়ে বাসায় চলে আসলাম।
তখনো আমার পেইন ছিল বাট সহনীয়। বাসায় এসে ঠিক মত খাওয়াদাওয়া করে নিজেকে লেবারের জন্য তৈরী করছিলাম। হাঁটছিলাম পেইন নিয়েই, ব্যায়াম করছিলাম যতক্ষন পারি। রাত হতে হতে আমার পেইন বাড়তে থাকল, কিন্তু সহনীয়।
আমার ফ্যামেলি মেম্বার সবাই অস্থির হয়ে যাচ্ছিল আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি তো রৌদ্রময়ী প্রি নাটাল কোর্স করে জানতে পেরেছিলাম কখন হসপিটালে যেতে হবে আমার, কী কী করতে হবে আমাকে এই সময় পেইন ম্যানেজ করতে। আমি তাই করছিলাম।
বার বার হাটছিলাম, স্কোয়াট করছিলাম, পেলভিক রক করছিলাম, আর যখন ব্যাথা আসছিল তখন হিপ রোটেশন করছিলাম।
রাত ১ঃ৩০ তখন, আমি দেখলাম ব্যথা খুব তীব্র ভাবে আসছে, আর ফ্রিকোয়েনসি কমে আসছে, ডিউরেশন বাড়ছে। তখন আমি আমার ফ্যামেলি মেম্বারদের বললাম হসপিটালে নিয়ে যেতে। হসপিটালে যাওয়ার পর দেখলাম অন্য কিছু, ওখানে আমার কোনো গার্ডিয়ান আমার সাথে এলাউ করছে না। আমি তো পেইন নিয়েই নার্সদের বলছিলাম যে আমাকে ড. বলেছে আমার গার্ডিয়ান একজন থাকতে পারবে, কিন্তু ওরা আমার কথা শুনলই না।
এই প্রথমবার, প্রথম বারের মতো নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। এই কষ্টের মুহূর্তে আমি একা!!
এদিকে আমার হাসব্যান্ড জব করেন অনেক দূরে, আসতেও পারছেন না এত রাতে। এগুলো ভেবে আরো প্যানিক হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমি হসপিটালে গিয়ে এক মূহুর্তের জন্য শুয়ে থাকিনি। হাঁটাহাঁটি, স্কোয়াট করেছি। আর সব থেকে বেশি আরাম পেয়েছি আমি বার্থ বল এক্সারসাইজ করে আলহামদুলিল্লাহ। আমার পেইন এর সময় এটা খুব সহায়ক ছিল।
নার্সরা পিভি চেক করে জানাল ৩ সেমি ডাইলেট হয়েছে। আরো অনেক সময় লাগবে। এদিকে আমি একা একা খুব অসহায় লাগছিল নিজেকে যে পাশে কেউ নেই, যেই দুইজন রোগী ছিল ওনারা পোষ্ট অপারেটিভ পেশেন্ট ছিল। আমি একমাত্র লেবারের পেশেন্ট ছিলাম। এদিকে একের পর এক কনট্রাকশন আসছিল।
হঠাৎ করে দেখলাম আমার মা আসছে। আমার মাকে দেখে আমার তখন মনে হল আমার প্রান ফিরে আসছে। এত্ত শান্তি লাগছিল। আম্মা কিছুক্ষনই আমার সাথে থাকতে পেরেছিল। একটু পরই নার্সরা আম্মু কে বের করে দিল।
এভাবে রাত পার হল। আমি খুব অল্প সময় এর জন্য শুলেই ঘুমিয়ে যেতাম আর যখন একটু ঘুমের মধ্যে পেইন আসত তখন পেইনটা আরো বেশি তীব্র লাগত।তখন আমাদের প্রি নাটাল কোর্স ইনসট্রাক্টর রাবেয়া আপুর কথা মনে পড়ছিল। আপু বলেছিল পেইনের সময় শুয়ে থাকলে পেইন আরো বেশি ফিল হয়।
তাই আমি শুইনি। সারারাত এভাবে হাঁটাহাঁটি, স্কোয়াট, বার্থ বল এক্সারসাইজ করে কাটিয়েছিলাম।
সকালে পেইন আগের থেকে অনেক বেশি আসছিল। ড. ৮ টায় আসল। পিভি চেক করে জানাল ৬সেমি ডাইলেট। পিটোসিন স্টার্ট করতে বলল। যখন থেকে পিটোসিন দিল আমি মনে হচ্ছিল আর কোনোভাবেই পারছিনা। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি তখন নিজেই স্যালাইন অফ করে দিলাম ব্যাথার সাথে কোপ আপ করতে না পেরে। পরে আবার স্টার্ট করল। আমাকে লেবার টেবিলে ওঠানো হল।
শুরু হল পুশিং স্টেজ। এই সময়টা আমার জন্য এত্ত কঠিন ছিল, আল্লাহ যদি আমাকে সাহায্য না করতেন, ওই সময় আমার দ্বারা কখনো পসিবল ছিল না। এই সময়টা আমার অনেক লং ছিল। পুশ করেই যাচ্ছিলাম, করেই যাচ্ছিলাম কিন্তু কিছুই হচ্ছিল না। ড. আমাকে অনেক সাহস দিচ্ছিলেন আলহামদুলিল্লাহ। আমার ড.খুবই কোঅপারেটিভ ছিলেন। এপিসিওটমি দেওয়া হল। অবশেষে দীর্ঘ সময় পুশিং স্টেজ শেষে আমার বাবু দুনিয়ায় আসল।
ও বের হওয়ার পর আমার এত্ত হালকা লাগছিল নিজেকে, এত্ত রিলিফ পাচ্ছিলাম। প্লাসেনটা আউট, এপিসিওটমি রিপেয়ার করা হল। এর মধ্যে একজন নার্স এসে আমার কাছে বাবুকে দিল। কিন্তু আমি একদম চোখ খুলতে পারছিলাম না কোনো মতেই।শরীর এত দূর্বল লাগছিল। লেবার রুম থেকে পোষ্ট অপারেটিভ বেডে শুয়ানো হল আমাকে। আমার আম্মা বাবুকে নিয়ে আমার কাছে আসল, কিন্তু তখনও আমি তাকাতে পারছিলাম না।
আমার নিজেকে অস্বাভাবিক লাগছিল। মনে হচ্ছিল নরমাল নেই আমি। কী যে বলছিলাম নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। বাবুর দিকে যখন তাকাই তখন অনেকক্ষণ আমি কান্না করছিলাম আর আমার মাকে বলছিলাম এত কষ্ট করেছ তুমি আমাদের জন্ম দিতে গিয়ে আজকে বুঝতে পারছি।
প্রাই ৩-৪ ঘন্টা আমি অস্বাভাবিক ছিলাম। পরে ২-৩ ঘন্টা ঘুমানোর পর সব ঠিক হয় আলহামদুলিল্লাহ। বাবুকে কোলে নিলাম। ওইদিন রাতে হসপিটালে ছিলাম। বাবু সারারাত কান্না করছিল। বুঝতে পারছিলাম সেকেন্ড নাইট সিনড্রোম এটা, প্রথম রাতেও হয়। আমি প্যানিক হইনি। পরেরদিন সকালে ডিসচার্জ নিয়ে বাসায় আসলাম। শুরু হল জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
অবশেষে একটা কথাই বলব, মাতৃত্বের জার্নিটা খুবই চ্যালেঞ্জিং, সাথে খুবই মমতাময়।
আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে সব কষ্ট শেষে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান এর মা হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। মাতৃত্বের এই কঠিন জার্নিটা আমার কাছে এতটা সহজ হত না যদি না আমি প্রি নাটাল কোর্সটা করতাম। এটা আমার কাছে ব্লেসিং আলহামদুলিল্লাহ। আমি প্রত্যেক মা যারা মা হবেন, হতে চাচ্ছেন সবাইকে রিকমেন্ড করব এই কোর্সটা করার জন্য। কারন”যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান হতে পারে না”।
উম্মে আবু উবাইদা,
প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ-৭