নরমাল ডেলিভারিতে প্রিনাটাল জ্ঞান ভিষন কাজে লেগেছে
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Blog, Doula Service, Others
- Date January 21, 2024
- Comments 0 comment
সময়টা ২০২২ সালের শেষ প্রায়। সন্তান যে একমাত্র আমার রবের পক্ষ থেকে সেজন্য প্রথমে আমার রবের কাছে প্রচুর দোয়া করা শুরু করলাম। সাথে আমরা চেষ্টা করতে লাগলাম আর প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। প্রস্তুতি হিসেবে ছিলো বেসিক কিছু পড়াশোনা ও রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স করা। ব্যাচ ১১তে জয়েন করি আমরা। কোর্সের ক্লাস শুরু হবার পর প্রত্যেকটা ক্লাস থেকে নতুন অনেক কিছু শিখেছি আলহামদুলিল্লাহ।
জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে জানতে পারলাম আল্লাহ তায়ালা আমাদের দোয়া কবুল করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। প্রথম মাসটা আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো গেলো। কোর্স থেকে যেভাবে শিখেছি সেভাবে খাবারের চার্ট করে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু ২য় মাস থেকে তা আর সম্ভব হলো না। এতো পরিমাণে বমি হতো। কিছুই খেতে পারতাম না। ধৈর্য হারালাম না বরং দোয়া করতে থাকলাম আর যা পারি অল্প করে খাওয়ার চেষ্টা করলাম। ৮ সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বললেন বাবুর হার্টবিট এসেছে আলহামদুলিল্লাহ।
২২সপ্তাহে আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে, সব ঠিক ছিলো কিন্তু প্লাসেন্টা লো লাইং। ডাক্তার বলে দিলেন এক্সারসাইজ তো করা যাবেই না প্রয়োজন ছাড়া হাঁটারও দরকার নাই। মন খারাপ হলো কিন্তু সবর করলাম। আমি শুরু থেকেই নরমাল ডেলিভারি সাপোর্টিভ কোনো ডাক্তার পাইনি। আমাদের নওগাঁতে নরমাল ডেলিভারি কোনো ডাক্তার দাঁড়িয়ে থেকে করান আমার জানা ছিলো না। তবুও হাল ছাড়িনি।
আমার শুরু থেকেই তেমন এক্সারসাইজ করা হয়নি৷ তবে আমি প্রচুর দোয়া করতাম। ব্রিদিং, কেগেলটা শুরু থেকেই করতাম। ডাক্তারের কথা শুনে ভয় পেয়ে অন্যান্য এক্সারসাইজ বন্ধ করে দিলাম। পরবর্তী চেকাপে গেলাম, ডাক্তার বললেন পোস্টিরিওর প্লাসেন্টা আল্লাহ চাইলে নরমাল ডেলিভারি হবে। খুশি হলাম। বাড়িতে এসে আবার হাঁটাহাটি অন্যান্য ব্যায়াম শুরু করলাম তবে খুবই অল্প এবং অনিয়মিত কিন্তু দোয়া করা একবারও বন্ধ করিনি আলহামদুলিল্লাহ।
৩২ সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে গেলাম ডাক্তার বললেন সব ঠিক আছে কিন্তু প্লাসেন্টা আবার একটু নিচে চলে গেছে। আর পানির পরিমাণও কম। শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ৩২সপ্তাহ থেকে দৌলা সেবা নিয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। আপুকে জানালে আপু বললেন সিড়ি দিয়ে বেশি উঠা নামা করার কারণে এমনটি হতে পারে। আপু এক্সারসাইজ আর খাবারের কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন। সে অনুযায়ী চলতে থাকলাম।
৩৬ সপ্তাহে আল্ট্রা করানো হলো ডাক্তার বললেন পানি কম, ১২ ছিলো, বাচ্চার মাথাও বড়। কয়েক দিন দেখে সিজার করিয়ে ফেলতে। এতো হতাশ হলাম! বাড়ি এসে দৌলা আপুকে জানালাম। আপু অনেক বোঝালেন। এবং বললেন সব রিপোর্ট আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। এর চেয়েও খারাপ রিপোর্টে মানুষের নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে। সাহস পেলাম। আমার এই জার্নির পুরোটা সময় আমার হ্যাজবেন্ড আমাকে খুব বেশি সার্পোট করেছে আলহামদুলিল্লাহ।
৩৬ সপ্তাহের পর থেকে ডেলিভারির প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। আমরা বাসাতে চেষ্টা করবো দেখে মা সব প্রয়োজনীয় জিনিস এনে রাখলেন। আমার মাঝে মাঝে অক্সিজেনের সমস্যা হচ্ছিল দেখে বাড়িতে অক্সিজেনের সিলিন্ডার এনে রাখলেন। তবুও যদি ইমারজেন্সি হাসপাতালে যেতে হয় এজন্য হাসপাতাল ব্যাগও গুছিয়ে ফেললাম। একদিন রাতে হঠাৎ করে পেট খুব শক্ত হতে লাগলো, হালকা পেইনও ছিলো, ওদিকে আব্বু হাসপাতালে ভর্তি, আম্মুও সেখানে। এর মধ্যে মাঝে মাঝেই ফলস পেইন হতো। একদিন রাতে পেট অনেক শক্ত হয়ে যায় আর বাবুর মুভমেন্ট কম পাচ্ছিলাম। অগত্যা হাসপাতালে যেতে হলো। গিয়ে আল্ট্রা করিয়ে দেখলাম সবই ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ তবে পানি আরো কমে গেছে।
ডাক্তার বললেন বাচ্চার ওজন তো ৩ কেজি, সাথে পানি কম। আজকে রাতে দেখো না হয় সিজার করিয়ে নিও কাল সকালে। আমি আর আমার হ্যাজবেন্ড বললাম, “না”। আল্লাহর নাম নিয়ে আরো কিছু দিন দেখতে লাগলাম। এর মাঝে আম্মু বললেন একটা ডাক্তার আছে হালকা নরমাল ডেলিভারি সাপোর্টিভ। আম্মুকে বললেন ব্যাথা উঠলে অবশ্যই যেনো আমাকে জানায়। একবার এসে দেখে যাবেন। আমার ইডিডি ছিলো ২৭ অক্টোবর। ৭ অক্টোবর আমার ব্লাডি শো দেখা দেয় হালকা। কোর্সে বলেছিলো মিউকাস দেখা দেওয়ার কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর লেবার পেইন উঠতে পারে। এদিকে ৩৯ সপ্তাহ প্রায় চলে আসছে তবুও পেইন এর কোনো নাম গন্ধ নাই, চিন্তা হচ্ছিলো।খুব দোয়া করতে লাগলাম আর সবর করতে থাকলাম।
১৯ অক্টোবর বিকেল থেকে কোমড় ব্যাথা। সন্ধ্যা থেকে খুবই হালকা হালকা ব্যাথা। একটু একটু করে ব্যাথা বাড়তে থাকে। ব্যাথা বাড়ছে খেয়াল করলাম। সব জিনিস আগেই গোছানো ছিলো তাই চেক করে ওযু করে শুয়ে পড়লাম। ব্যাথা ক্রমাগত বাড়ছে ৷ আম্মু আব্বু ফিরলেন রাত বারোটায়। ডপলার মেশিন দিয়ে চেক করলাম। বাবুর হার্টবিট ভালো আছে। আবার শুয়ে পড়লাম। কোনো মতেই ঘুম আসছে না তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ৩টায় আর শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে পড়লাম। হাঁটা হাঁটি করতে থাকলাম। প্রসাব করলাম বারবার। আম্মু স্যুপ করে আনলেন, খেলাম। একটু পর খেজুর খেলাম। আর পানি খাচ্ছিলাম। ব্যাথা ঘন ঘন আসছিলো। ৩৬ সপ্তাহের পর থেকে প্রি ন্যাটালের নোটটা প্রতিদিন একবার করে চোখ বোলাতাম। এ জন্য খুব ভালো ভাবে বুঝছিলাম লেবারের কোন পর্যায়ে আছি। সেভাবে মানিয়ে চলছিলাম।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বমি হলো, শরীর হালকা খারাপ লাগছিলো। কিছুক্ষণ পর শুয়ে পরলাম। ঘুম আসে না, ব্যাথাতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও রেস্ট দরকার বলে শুয়ে ছিলাম। ফজরের আযান হলো। ওযু করে সালাত পড়তে লাগলাম। একেকটা পেইন আসছিলো, সাথে আবার বমি। বমি হয়েছে তবুও শক্তির জন্য খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আম্মু পিভি চেক করলো, ২ আঙ্গুল খুলেছে। কিছুক্ষণ পর মা আবার পিভি চেক করলেন ফুল ডাইলেট আলহামদুলিল্লাহ।
তবে বাবুর মাথা একটু দূরে। একেকটা ব্যাথা আসছে আর কুকরে যাচ্ছি। ১১ টায় পর থেকে হঠাৎ ব্যাথা কমতে থাকে। কেনো এমন হলো বুঝলাম না। আম্মু ডাক্তারকে ফোন দিলেন। ডাক্তার বললেন। অনেক সময় তো পার হয়ে গেছে ক্লিনিকে নিয়ে আসতে। পিটোসিন দিতে বললো। উনি কিছুক্ষণ পরে আসবেন। মাথা না নামলে সিজার করে ফেলবেন। এতো দুঃখ হলো। তবুও আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে সাড়ে ১২টায় হাসপাতালের দিকে গেলাম। একেকটা পেইন আসছে আর আমি দাঁতে দাঁত চেপে রাখি। আর আল্লাহকে ডাকতে থাকি।
হসপিটালে যাবার পরপরই আম্মু এক প্রকার জোর করেই ক্যাথেটার করে দিলেন। আর পিটোসিন দিলেন। তারপর কী যে ব্যাথা উঠলো! এতো বার বমি করায় ও কিছু না খাওয়া শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছিলাম না, আমার হাত পা কাপছিলো। আমার অবস্থা দেখে হ্যাজবেন্ড ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছি। ব্যাথাতে আমার কষ্ট দেখে বাড়ির সকলে সিদ্ধান্ত নিলেন সিজার করিয়ে ফেলবেন। পিটোসিনের স্যালাইন খুলে দেয়া হলো। তখন থেকে আমি একদম চুপ। প্রচুর হতাশা কাজ করছিলো। আমার এতো প্রস্তুতি সবই কী বৃথা!!
পুশিং স্টেজের মতো এই কষ্টের সময় মনে হয় অনুভুতি শূন্য হয়ে গেলাম। আশেপাশে কে কি বলছে আমার ব্রেনে কাজ করছে না। কিছুক্ষণ পর আম্মু ওটিতে নিয়ে গেলেন। হ্যাসবেন্ডও আমার সাথে ছিলেন। সেই দিন জুমাবার থাকায় জুমার সালাতের সময় হয়ে গেলো এনেস্থিসিয়ার ডাক্তার বললেন সালাত পড়ে আসবেন। হ্যাজবেন্ড ও ওটির মধ্যেই পেপারসে সাইন করে চলে গেলেন সালাত পড়তে। হঠাৎ করে তীব্র চাপ অনুভব করলাম। আম্মুকে বললাম একবার চেক করতে। আম্মু দেখে বললো মাথা তো চলে আসছে!
আবার পিটোসিনের স্যালাইন লাগানো হলো। হঠাৎ অদ্ভুত শক্তি অনুভব করলাম। আম্মু বললেন চাপ দাও। আমিও যত শক্তি আছে সেটা দিয়ে চাপ দিলাম। বসে চাপ দিতে না পারায় শুয়ে ২জনকে ধরে ৪,৫ টা চাপ দিলাম। এতো জোরে চিৎকার হয়তো আমি জীবনে কখনো করিনি। আম্মু পানির বলটা ভেঙে দিলেন শেষ একটা চাপ সাথে সাথে আমার কলিজার টুকরা বের হয়ে আসলো। সাথে সাথেই সব ব্যাথা গায়েব আলহামদুলিল্লাহ।
আমার পুত্র আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম কে আমার পেটের উপর রাখলো কিছুক্ষণ। তখন জানা গেলো বাবুর গলায় কর্ড পেচানো ছিলো। এজন্য এতো দেড়ি হচ্ছিলো বাবুর মাথা নামতে। এটা আমরা আগে জানতাম না, আল্ট্রাতে ধরা পরেনি। সাথে সাথে সিজারের ডাক্তারও এসে ওটিতে ঢুকলেন। শুয়ে চাপ দেয়ায় এপিসিওটমি লেগেছিলো সাথে ৩ডিগ্রি টিয়ারও হয়েছিলো। ডাক্তার খুব সুন্দর করে সেটা রিপেয়ার করে দিলেন। এতো দূর্বল লাগছিলো আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম পুরোটা সময়। ৩ ঘন্টা পুশিং স্টেজে থেকে তখন দুনিয়ার কোনো ব্যাথা আর ব্যাথা মনে হচ্ছিলো না। কিছু একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো সাথে সাথে আবার ওটিতেই বমি হয়ে গেলো। তারপর সব ক্লিন করে আমাকে বের করা হলো।
( ডা. রুবাইয়া আপুর একটা পোস্ট আর দৌলা আপুর পরামর্শ উনুযায়ী চলে প্রপার যত্ন নিয়ে এপিসিওটমি আলহামদুলিল্লাহ ৩সপ্তাহে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।)। আমার এই পুরো জার্নিতে আমার এই কোর্সের নলেজ ভীষণ ভাবে কাজে এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। আপুদের বার্থ স্টোরি পড়তাম, বিভিন্ন পোস্ট পরতাম সাথে প্রচুর দোয়া করতাম।আমার পুরো প্রেগনেন্সিটা গেছে দোয়ার উপর আলহামদুলিল্লাহ। সেদিন রাতে থেকে পরেরদিন সকালে বাবুকে নিয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসি আলহামদুলিল্লাহ।
উম্মে ইউসুফ
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স পার্টিসিপ্যান্ট, ব্যাচ ১১
রৌদ্রময়ী দৌলা ক্লায়েন্ট
Other post
You may also like
রংধনু রঙের খেলনাগুলো
ছোটবেলায় আমাদের নিকট প্রকৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি ছিলো, তা হলো সাত রঙের রংধনু। কারণ অধিকাংশ সময় বৃষ্টির দেখা মিললেও, বৃষ্টির পরের রংধনুর দেখা মিলতো খুবই কম। তাই যে জিনিস খুব কম দেখা যায়, সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণও থাকে সবচেয়ে …
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ছোট বাবুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য – আসুন সচেতন হই
খাদিজা তার এক মাস বয়সী মেয়ে আমিনাকে কোলে নিয়ে ঘরের মৃদু আলোয় বসে ছিলেন। রাত বাজে আড়াইটা। জানালা ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো ঘুমের কুয়াশা ভেদ করে তার মুখে এসে পড়ল। হঠাৎ থেমে থেমে আমিনার কান্নার শব্দ বাড়ে এবং কমে। …