আমার সন্তানের হিফজ যাত্রা
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Others, Parenting
- Date February 1, 2024
- Comments 0 comment
আমি যখন ষোল বছরে পদার্পণ করলাম, প্রথমবার মাতৃত্বের একরাশ নির্মল অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করে গেল!
“ফাহীম” আমার বড় সোনামণির যেদিন আমার কোলজুড়ে আগমণ হলো সেদিন মনে হলো যেন রাজ্যের সমস্ত সুখ আমার হাতের মুঠোয় রাব্বে কারীম আলতো করে ধরিয়ে দিয়ে বললেন তোমার জিম্মাদারি এখন থেকে দ্বিগুণ ভাবে বেড়ে গেল।
এরপর রাব্বে কারীম একের পর এক উপহার দিতে লাগলেন ওর নরম হাতের ছোঁয়া! নিষ্পাপ চাহনী! ছোট্ট, ছোট্ট পায়ের ছাপ! আধো,আধো কথা! দুষ্ট, মিষ্টি হাসি! এ-যেন এক জান্নাতী অনুভূতি। ওর শিশুকালের সমস্ত স্মৃতি যেন আমার মনের পাতায়, পাতায় লিপিবদ্ধ হতে লাগলো।
ওর আব্বুর তখনও ছাত্রজীবন শেষ হয়নি বলে লেখাপড়া জন্য আমাদের ছেড়ে বাইরে থাকতেন আর তাই আমার সোনামানিক ওর আব্বুর অনুপস্থিতিতেই ধীরে, ধীরে বড় হতে লাগলো আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতই।
সে যখন প্রথম কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলো ওর আধো, আধো মুখে আল্লাহর নাম শুনতে ব্যাকুল আমি যতক্ষণ কাছে থাকতো ততক্ষণ আল্লাহ্, আল্লাহ্ বলতাম। সাথে সেও আন্না, আন্না জিকির করতো। কিন্তু, পরবর্তী ধাপগুলো আমার বড় সোনামুণীর জন্য মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা। বছর না ঘুরতেই প্রচন্ড নিউমোনিয়া থেকে শুরু হয় অসুস্থতা, যা একসময় এ্যাজমার রুপ নেয়। যদিও আমি তখন ছিলাম আন ম্যাচিউড় কিন্তু হিম্মত হারালাম না। শাশুড়ী আম্মু এবং শ্বশুর আব্বুর সহযোগীতায় মনকে শক্ত করে ওর যত্ন আর তরবিয়াতে মনোযোগী হলাম!
সে দিনে একটু ভালো থাকলেও রাতে যে কি অবস্থা হতো ভাবতেই এখনও শিউরে উঠি। মাঝে, মধ্যে তো দিন, রাত এক সমান হয়ে যেতো।
আলহামদুলিল্লাহ্! এতো অসুস্থতা আমার সোনামণির মনোবল ছিল ভাঙ্গতে পারেনি বিন্দুমাত্র, তার তরবিয়াতের পথেও হতে পারেনি বাঁধা।
আমার নানী শাশুড়ী বয়সের কারণে কানে খুব কম শুনতে পেতেন, তাই আযান হওয়া মাত্রই সে তার ছোট্ট জায়নামাজ নিয়ে ওর বড় আম্মুর কাছে দৌড়ে চলে যেতো এবং কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ভাঙা, ভাঙা আওয়াজে আযান শুনাতো, অতঃপর বড় আম্মুর পাশাপাশি ওর ছোট্ট জায়নামাজে বিছিয়ে একসাথে নামায আদায় করতো।
সারাদিন মুখে, মুখে মাসনূন দোয়া, ক্বলানাবিঊ সাঃ-বলে হাদীস শরীফ গুলো যখন বলে বেড়াতো কিছুক্ষণের জন্য রাতের বিভীষিকা ভুলে ওকে তালীম দিতাম মুগ্ধ উৎসাহে।
পুরাতন আমলের কাঠের বড় বাক্সটা জুড়ে চলতো ওর আরবী হরফ লিখা (শ্লেটে খুব কম লিখতো কারণ, মাদ্রাসার হুজুর বোর্ডে লিখে তাই বাক্সটি ছিল তার বোর্ড)।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ। একদিকে সোনামণিটার অসুস্থতা, অন্যদিকে কুরআনে হাফেজের মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সমস্ত মনোবল এক করে আবাসিক ভাবে থাকার জন্য পাঠিয়ে দিলাম আল মারকাজুল মাদ্রাসায়, যদিও এটা ছিলো প্রায় অসম্ভবের মত! কেননা, রাতে ওকে তিন, চার বার নেবু লাইজার এবং দিনে, রাতে বেশ কয়েকবার ইনহেলার ইউজ করতে হতো।
কিছুদিন পরপরই অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে তাকে বাড়ীতে চলে আসতে হতো। এভাবে লেখাপড়ায় অনেক গ্যাপ পড়ে যেতো, তখন চরম নিরাশা ভর করতো মনে। মনে হতো আমার বড় সোনামণিটার বোধহয় হিফজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
আকুল হয়ে তখন পরওয়ারদেগারের কাছে চাইতাম। কেননা, তিনি চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব বানাতে পারবেন নিমিষেই।
আসলে আল্লাহ তায়ালার উপর বান্দা/বান্দী যদি পূর্ণ ভরসা করে তার মুতাওয়াজ্জু হয়, তাহলে তিনি কখনই তাকে নিরাশ করেন না।
আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্!
অনেক নামায, রোযা, সাদকা এবং দু’আর বরকতে সমস্ত অসুস্থতা, সমস্ত অপারগতা পিছনে ফেলে সব কিছুর উর্ধ্বে আমার সোনামানিক হয়ে উঠেছে একজন কুরআনের পাখি।
যেদিন সে হিফজ শেষ করেছিল সেদিন ওর মাথায় হাত রেখে দু’চোখ বেয়ে নেমেছিল আনন্দ এবং গর্বের তপ্ত বারিধারা।। শোকরগুজার বান্দী হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলাম মহান রবের সেজদায়॥
মহান রাব্বুল আ’লামীন আমার সোনামানিককে অসুস্থতা দিয়েছেন কিন্তু, তার ইলম থেকে বঞ্চিত করেননি। আমি শোকরগুজার তার শানে কেননা, উর্দু বিভাগ থেকে শুরু করে হেদায়া পর্যন্ত আমার ফাহীম প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দু’আর বরকতে আমার চাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছেন।। ওর কিতাবের প্রতি এতটাই নেশা যে ঈদ উপলক্ষে একটা নতুন কাপড় নেওয়ার পরিবর্তে সে কিতাব সংগ্রহ করতে আনন্দ বোধ করে। শুধু আনন্দ বললে ভুল হবে, রীতিমত কিতাব কেনার জন্য, কাপড় কিনতে বাধা দেয়।
কাছের কেউ হাদিয়া দিতে চাইলে, সে অন্য কিছু না দিয়ে কিতাব দেওয়ার কথা বলে। আমার ‘ননদ বলে ফাহীম গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে দুগ্ধপান করা অবধি আপনি অনেক বেশি বই পাগল ছিলেন এটা তারই নেক প্রতিফলন।
উম্মে ফাহীম
Other post
You may also like
রংধনু রঙের খেলনাগুলো
ছোটবেলায় আমাদের নিকট প্রকৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি ছিলো, তা হলো সাত রঙের রংধনু। কারণ অধিকাংশ সময় বৃষ্টির দেখা মিললেও, বৃষ্টির পরের রংধনুর দেখা মিলতো খুবই কম। তাই যে জিনিস খুব কম দেখা যায়, সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণও থাকে সবচেয়ে …
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …