আমার সন্তানের হিফজ যাত্রা(পর্ব ২)
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Others, Parenting
- Date February 1, 2024
- Comments 0 comment
ফাহীম জন্মের পাঁচ বছর পর দ্বিতীয়বার আবারও এক পবিত্র, নির্মল অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করে গেল। রাব্বে কারীম আমার ছোট্ট পাখি, আমার ছোট্ট সোনা’ আকিল’ কে এনে দিলো আমার কোলজুড়ে। মাতৃত্বের দায়িত্ব তাই এবার স্বাভাবিক ভাবেই আরও দ্বিগুন ভাবে বেড়ে গেল। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার নিঃসন্দেহে অনেকটাই ম্যাচিউর এবার অভিজ্ঞতাও রয়েছে পাঁচ বছরের তাই তেমন একটা বেগ পেতে হলো না।
আলহামদুলিল্লাহ্, আমার দুই সোনামণিই শান্ত স্বভাবের! যেখানে অন্য দশটা বাচ্চার আবদারের মা-বাবা অতিষ্ট, সেখানে ওদের শান্ত স্বভাব দীলে এক ধরনের সুকুন এনে দেয়।
ছোট্ট পাখিটার ছিল চেপে রাখা বুদ্ধি এবং উপস্থিত বুদ্ধি। ওকে যখন ঘুম যাবার দোয়া শিখাতাম সে দুষ্টুমি ভরা মুখে মুচকি, মুচকি হেসে ‘ওয়া আহইয়ার’ পরিবর্তে ‘ওয়া আ’ছিয়া’ বলতো, মানে আমার নামটা দুষ্টামি করে ওখানে বসিয়ে দিত। ও সবার কাছে শুনতে, শুনতেই যত মাসনূন দোয়া, হাদীছ শরীফ এবং মাসয়ালা-মাসায়েল মুখস্থ করে ফেলতো।
ওদেরকে নামাযের সময় সাথে নিয়ে নামায পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে দিতাম এবং কোন ওয়াক্তে কত রাকা’আত সব বলে বলে দিতাম। রামাদ্বান মাস, ওর বয়স চার কি পাঁচ হবে, ওর আব্বু তারাবীহ্ পড়তে যাওয়ার সময় বললেন তারাবীর শেষে একজন মেহমান নিয়ে আসবো।
ওর আব্বুকে বিদায় দিয়ে ঝটপট নামাযে দাঁড়ালাম তাড়াতাড়ি শেষ করার উদ্দেশ্যে, সাথে আকিলও দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পড়েই কলিং বেল বাজলো, আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম এত তাড়াতাড়ি আবার কে এলো? ওর ঝটপট উত্তর- “কে আবার আট রা’কাআতের ভাইজান”।
আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলাম-আট রা’কাআতের ভাইজান মানে কি?
ও বলল-“কে আবার সাঈদ দাদু, সাঈদ দাদু”।
ওর উপস্থিত বুদ্ধি দেখে না হেসে পারলাম না।(উল্লেখ্য, আমাদের পারিবারিক ম্যানেজার চাচা তারাবির নামায আট রা’কাআত পড়তেন)।
ওর খাবারে অনীহা দেখলে চাপা চাপি করে খাওয়াতে চাইতাম, আরেকটু নাও বাবু, এটুকু খেলে হবে…আমি নাছোড় বান্দী অল্প খেয়ে উঠতে দেবোনা! কিন্তু নাছোড় বান্দীকে কিভাবে জব্দ করা যায় তাতো ওর ভলো করেই জানা; তাই বলে- আম্মু, অল্প আহার রাসূলের সুন্নত। আমাদের রাসূল(সাঃ) সবসময় অল্প আহার করতেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বড়টির মত ছোট্ট পাখিটিকেও আল মারকাজুলে পাঠালাম দ্বিতীয় হাফেজের মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই বাঁধা দিতে লাগলো দু’জনকে একই লাইনে না দিতে। কিন্তু ওর আব্বু আর আমি যে নেশাগ্রস্ত দুই হাফেজের মা-বাবা হতে।
সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিলো। ছোট্ট সোনাটা এতদিন আলহামদুলিল্লাহ্ সুস্থও ছিল। কিন্তু, পঁচিশ পারা কুরআন হিফজের সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো! পড়তে বসলেই বা পড়ার কথা বললেই মাথার ভিতর কেমন যেন করে, কিছুই মনে রাখতে পারে না! সেন্সলেস হয়ে যেতো!
পঁচিশ পারা হিফজের পর কি তাহলে আর হবে না সম্পূর্ণ? আমাদের তো মাথায় খারাপ, উদ্ভ্রান্ত হওয়ার মত অবস্থা! নামায, রোযা ও সাদকার পাশাপাশি চললো সব ধরনের চিকিৎসা।
ডাক্তারি মতে ওকে টেনশান ফ্রি রাখতে বলা হলো, যেন কোন রকমের মানসিক চাপ না পড়ে! এভাবে কেটে গেল প্রায় চার/পাঁচ মাস!
আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবানী ধীরে, ধীরে ছোট্ট পাখিটা ঠিক হতে শুরু করলো। তাকে মাদ্রাসায় পাঠানো হলো। একটু, একটু করে সবকও শুরু করলো। কিন্তু গতি যেন ঠিক আগের মত নেই, ওর আব্বু বললো রমযানে শেষ না করতে পারলে, নতুন বছরের শুরুতে কিতাব বিভাগে দিয়ে দেবো।
এতদূর এসে হিফজটা অসমাপ্ত থেকে যাবে! বুকের ভেতরটা অজানা যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো! আবারও সম্পূর্ণ মুতাওয়াজ্জু হয়ে দীল থেকে পরওয়ারদেগারের শানে সপে দিলাম দীলের তীব্র তামান্নার অভিব্যক্তি!
সাথে মানত করে ফেললাম। ওকে উৎসাহিত করার জন্য জানিয়ে ফেললাম রমাদ্বানের আগে তুমি যদি হিফজ শেষ করতে পারো আমি তিনটা রোযা রাখবো তোমার জন্য।
একদিন ওর আব্বু এসে জানালো বাবুর সবকের গতি বেড়েছে আলহামদুলিল্লাহ্! ইনশাআল্লাহ্, রামাদ্বানের আগেই সবক শেষ করে এক দুই বার খতম শুনানী ও হয়ে যেতে পারে৷ শুকরিয়া আদায় করলাম আল্লাহ্র দরবারে।
কিন্তু, ২০২০-সালে করোনার আবির্ভাবে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেলো প্রতিষ্ঠান। স্থিতিশীল অবস্থা যেন উলট-পালট করে দিলো সাজানো মনের আশা! ঘন কালো পাহাড়সম মেঘে যেন ছেয়ে গেল অন্তর।।
কিন্তু, মন থেকে কেউ কিছু চাইলে রাব্বে কারীম কখনোই তাকে বিমুখ করেন না।
আমাদের দোয়ার একনিষ্ঠতা আর ছোট্ট-পাখিটার একাগ্রতা আমাদের মন থেকে কালো মেঘের ঘনঘটা সরিয়ে এনে দিয়েছে শুভ্র-সফেদ রুপালী চাঁদের কিরণ।।
আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্! রাব্বে কারীমের অশেষ মেহেরবানী, ছুটিতে বাড়িতে সবক চালু রেখে ২০২০-সালের রামাদ্বানের আগে ত্রিশ পারা সম্পূর্ণ করার তৌফিক দানে ধন্য করেছেন আমাদের। কুরআনের আলোয় আলোকিত করেছেন আমার ছোট্ট পাখিটাকে।
আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা দু’আর বরকত এত বেশি পরিমাণে দান করেছিলেন যে, সেই রামাদ্বানে বড় ভাইয়ের সাথে বাড়ীতে তারাবীহ্ পড়ানোর পাশাপাশি উর্দু জামাত শুরু করে এবং কুরবানীর মধ্যে সেটা বাড়ীতেই শেষ করে একবারে ফার্সি জামাতে ভর্তি হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ্।
উম্মে ফাহীম
Other post
You may also like
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ডিউ ডেটের পর আমার ৩য় নরমাল ডেলিভারির গল্প
১।আমার এবারের প্রেগন্যান্সিটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি বেশি স্ট্রেস্ফুল ছিল। ৬মাস রেগুলার এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা মেডিক্যাল ডিউটি, বড় দুইটার দেখাশোনা, ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – সব মিলিয়ে একটু কম যত্ন নিয়েছিলাম নিজের৷ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সেসব দিন পার করে দিয়েছেন। আমার ইডিডি ছিল ২২/২/২৪। …
যেভাবে সন্তানকে ভালো রাখা যায়
আমার বাচ্চাটাকে কানাডাতে আলহা’মদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত রব্বুল আ’লামীন হিফাজতে রেখেছেন। আমি সাধারণত আমার বাচ্চাকে নিয়ে কখনও গর্ব করি না, তার ছবি পোস্ট করি না, খুব একটা কিছু লিখিও না। আল্লাহর আমানত, আমার অহংকার করার কিচ্ছু নাই। আজকে লিখছি, একটা বাচ্চা …