অতিরিক্ত ওজন নিয়ে নরমাল ডেলিভারির গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Birth Story, Others
- Date January 8, 2025
- Comments 0 comment
সেপ্টেম্বর এর ১৪ তারিখ আলহামদুলিল্লাহ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে আমার প্রথম রাজকন্যার মা হলাম। আমার বার্থ স্টোরি শুরুর আগে আমি আমার কনসিভ করার আগের কিছু কথা শেয়ার করতে চাই যাতে আমার মতো যারা একটু মোটা তারা কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত হোন ইনশাআল্লাহ।
আমি জন্ম থেকেই মোটা ছিলাম কিন্তু করোনার সময় হঠাৎ আরও মোটা হয়ে যাই। এরপর নিজে নিজে বাসায় ব্যায়াম করি কিন্তু কয়দিন পরই আবার ছেড়ে দেই। খাবার কম করে খেতাম কিন্তু কিছুতেই ওজন কমছিলো না। ২০২২ এর ডিসেম্বরে থায়রয়েডের সমস্যা ধরা পড়ে। আমি একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্টের আন্ডারে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট এ ছিলাম পাশাপাশি এবার মনস্থির করলাম একজন নিউট্রিশনিস্ট দেখাবো। আমি যেহেতু চট্টগ্রামে থাকি এখানে অতো বেশি নিউট্রিশনিস্ট নেই, খোঁজ নিয়ে সার্জিস্কোপ হাসপাতালে একজন নিউট্রিশনিস্ট এর সন্ধান পেলাম। উনি একটি ডায়েট চার্ট করে দেন একমাসের জন্য। টানা ৩ মাস উনার কন্সালটেশনে ছিলাম। ৩ মাসে ৫ কেজি ওজন কমেছিলো। এরপর নিজে নিজে উনার চার্ট ফলো করেছি আর নিয়ম করে ১ ঘন্টা ব্যায়াম করতাম অথবা ১ ঘন্টা টানা হেঁটেছি। এভাবে ৯ মাস চলতে থাকলো। ৭ মাসে আলহামদুলিল্লাহ ১০ কেজি ওজন কমিয়েছি। এরপর আর ওজন কমছিলো না কিন্তু আমি নিয়মিত ব্যায়াম আর হাঁটাহাটি চালিয়ে গিয়েছি।
ডিসেম্বরে আলহামদুলিল্লাহ আমি কনসিভ করি। যেদিন প্রথম টেস্ট করে জানতে পারি সেদিনই প্রিনেটাল কোর্স এ ভর্তি হয়ে যাই। আমি প্রেগ্ন্যাসির পুরোটা সময় নিউট্রিশনিস্ট এর দেয়া ডায়েট চার্ট ফলো করে খাবার খেয়েছি যেহেতু আমি একটু স্বাস্থ্যবান তাই কোনভাবেই যেনো আরও অতিরিক্ত ওজন না বাড়ে এই ব্যাপারে কন্সার্ন ছিলাম, যদিও প্রেগ্ন্যাসির শেষ এর দিকে একটু বেশি ওজন বেড়ে গিয়েছিলো।
প্রথম ট্রাইমেস্টার এ আলহামদুলিল্লাহ বমি ভাব ছাড়া কোন সমস্যা ছিলোনা তাই নিয়মিত হালকা-পাতলা ব্যায়াম করতাম বাকি সময় রেস্ট এ থাকতাম। সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার থেকে ব্যায়ামের পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে দেই আর নিয়মিত ঘরের কাজকর্ম করা শুরু করি। থার্ড ট্রাইমেস্টার এ এসে ৪০ মিনিট করে হাঁটাহাটি আর ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করতাম।
প্রিনেটাল কোর্স এ শেখানো ব্যায়াম সাথে আরও অন্যান্য ব্যায়াম করতাম যেহেতু আমার আগে থেকেই ব্যায়ামের অভ্যাস ছিলো তাই ব্যায়াম করতে আলহামদুলিল্লাহ কখনো সমস্যা হয়নি। ৩৫ সপ্তাহের পর হাটাহাটি ১ ঘন্টা করে আর ব্যায়াম ৩০মিনিট করে করা শুরু করলাম। ৩৫ সপ্তাহে আমার ফ্লুইড লেভেল আসে ৯। পানি, ডাবের পানি খাওয়া বাড়িয়ে দিলাম কিন্তু ৩৮ সপ্তাহে গিয়ে ফ্লুইড লেভেল হয় ৭। বর্ডার লেভেল এ থাকায় একটু চিন্তায় পড়ে যাই যদিও আমার ডাক্তার ম্যাডাম এইটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। আমি ৩৫ সপ্তাহ থেকে ফ্লুইড লেভেল যেনো বাড়ে তাই নিয়ত করে সুরা ফাতিহা পড়ে ফুঁ দিয়ে পানি খেতাম নিয়মিত।
৩৫ সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন ৫-৬টি খেজুর খেতাম।
৩৮ সপ্তাহে চেকাপে গেলে ম্যাম চেক করে বলেন এখনো হেড এনগেজ হয়নি। আমি আরও বেশি বেশি হাঁটাহাটি চালিয়ে গেলাম পাশাপাশি ডিপ ইন দ্যা হিপ, ফরোয়ার্ড লিনিং ইনভারশন, ডিপ স্কোয়াট, হাফ স্কোয়াট, পেলভিক রক, ফ্লায়িং কাউগার্ল, এবডোমিনাল টাক, সোএস মাসেল রিলিস, ডাক ওয়াক বেশি বেশি করে যেতে থাকলাম। ম্যাডাম থেকে চেকাপ করে আসার ৫ দিন পর সকাল ৮:৫০ এ আমার হালকা হালকা পেইন হওয়া শুরু হয়। পেট মোচড় দিয়ে টয়লেট হয়। পেইনের ধরণ অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন মনে হচ্ছিলো তাই তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা করে নিই।
৯:১০ এ আবার ব্যাথা অনুভব হয় আমি পেইন কমানোর জন্য ফ্লোরে বসে সামনে খাট ধরে ছিলাম আর কয় সেকেন্ড কন্ট্রাকশন থাকে কাউন্ট করছিলাম। এরপর ১০ মিনিট পর পর ১০-১৫ সেকেন্ড ধরে কন্ট্রাকশন হচ্ছিলো। মাঝের যেই সময়টা পেইন ছিলোনা ওই সময়টা আমি হাঁটাহাটি আর ব্যায়াম চালিয়ে যাচ্ছিলাম অনবরত। আমার বাসার সবাই ১০টা বাজতেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন যেহেতু প্রথম বাবু সবাই ভয় পাচ্ছিলেন। সবাইকে বুঝিয়ে বাসাতেই পেইন ম্যানেজমেন্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
দুপুর ১২:৩০টায় পেইনের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছে কিন্তু তখনও ১০-২০ মিনিট ব্যবধানেই কন্ট্রাকশন আসছিলো। বাসার সবাই চিন্তায় পড়ে যায় আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায় কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম বাসায় যতোটা সময় থাকা যায় আমি আমার মতো হাঁটতে পারবো, ব্যায়াম করতে পারবো।
দুপুর ১.৩০টার দিকে অনেক তীব্র কন্ট্রাকশন আসছিলো তাই দুপুর ২.৩০এর দিকে হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পর ডিউটি ডাক্তার পিভি করেন আর বলেন জরায়ু মুখ ৪ সে.মি. খুলেছে কিন্তু এখনো হেড এনগেজ হয়নি। একটু পর একজন নার্স এসে ক্যানুলা করে দেন। হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে পেইনের তীব্রতা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছিলো তখন হাসপাতালের বেড শক্ত করে ধরে রাখছিলাম যাতে পেইন একটু হলেও কমে। ৪টার দিকে ব্যাথার তীব্রতা আরও বেড়ে যাওয়ায় ডিউটি ডাক্তার আবার পিভি করেন তখন সারভিক্স ৬ সেমি খুলেছে আর বেবির হেড এনগেজ হয়েছে বললেন। আমি ব্যথা কমে গেলে জমজম পানি আর খেজুর খাচ্ছিলাম।
৪:৫০এর দিকে এতো স্ট্রং কন্ট্রাক্টশন আসছিলো আমি আর ব্যথা সহ্য করতে পারছিলাম না। ব্যথা সইতে না পেরে চিৎকার শুরু করে দেই। আমার এমন অবস্থা দেখে ডিউটি ডাক্তার পিভি চেক করে বলেন সারভিক্স ৮ সেমি খুলে গিয়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ম্যাডাম এসে পানি ভেঙে দেন এরপর পুশ করতে বলেন। আলহামদুলিল্লাহ বিকাল ৫:৩৩ এ আমার রাজকন্যা সাওদাহর আগমন হলো। আমার এপিসিওটোমি লেগেছিলো।
প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে জানার বিকল্প নেই। আমি একজন ডাক্তার হয়েও এমন অনেক কিছুই জানতাম না যেইটা প্রিনেটাল কোর্স করে জানতে পেরেছি। আমানি বার্থ বই আর প্রিনেটাল কোর্স আমার প্রেগ্ন্যাসিতে অনেক বেশি সাহস জুগিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। প্রিনেটাল কোর্স এর ইনস্ট্রাক্টর আপুদের আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিক আমিন।
দু’আ চালিয়ে যাবেন বেশি বেশি। যখন হাঁটবেন নিয়মিত তখন যিকির করবেন। দু’আ কবুলের মুহূর্তগুলো বাদ দিবেন না একদমই। যদি কোন কমপ্লিকেশন না থাকে তাহলে নিজেকে যতোটা সম্ভব একটিভ রাখবেন। নিজের শখের কাজগুলো করবেন। মানুষের নেগেটিভ কথাবার্তা এড়িয়ে চলবেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও যত্নশীল হবেন, খুব বেশি না আবার কমও খাওয়া যাবেনা। প্রতিদিন দুধ, ডিম, ডাল অবশ্যই খাবেন। প্রেগ্ন্যাসিতে অনেকে ভাত বেশি খেয়ে অতিরিক্ত ওজন বাড়িয়ে ফেলেন এইটাও করা যাবেনা, যা খাবেন বুঝেশুনে খাবেন।
আমি চট্টগ্রামে ডাক্তার ফরিদা ইয়াসমিন সুমি ম্যাডামের কাছে ডেলিভারি করিয়েছি। পার্কভিউ হাসপাতালে আমার ডেলিভারি হয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ এই হাসপাতালে খুব সুন্দর পর্দা মেইনটেইন করা হয়। লেবার ওয়ার্ডে কোন পুরুষ এলাউ করা হয়না।
ডা: আফিয়া আয়মান
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স পার্টিসিপ্যান্ট, ব্যাচ ১৬
Other post
You may also like
মা হলাম যেভাবে
January 17, 2025
১.প্রস্রাব করে উঠে দাঁড়াতেই আমার দু পা বেয়ে কলের ধারার মতো হাল্কা গরম পানি নেমে যেতে লাগলো। একটু আগে মিউকাস প্লাগও বেরিয়ে আসতে দেখেছি। সন্দেহের আর অবকাশ রইল না যে পানি ভেঙে গিয়েছে। স্বচ্ছ, সাদা পানি, কোনো স্মেল নেই। পরিমাণে …
আমার চমৎকার ডেলিভারির অভিজ্ঞতার
January 16, 2025
বাচ্চার বয়স ২০মাস এখন। আলহামদুলিল্লাহ বিদেশে একা ১ম মা হওয়ার যাত্রায় রৌদ্রময়ীকে সাথে পেয়েছিলাম। লেবার পেইন উঠেছিল রাত ৯টায়, মিউকাস প্লাগ বের হতে শুরু করে আর ব্যথা বাড়তে থাকে। হিপ রোটেশন করতে থাকি ব্যথা বাড়ার সাথে সাথে। হাজব্যান্ডকে সাথে নিয়ে …
হাসপাতালে ন্যাচারাল বার্থ সম্ভব: একজন মায়ের অনুপ্রেরণামূলক গল্প
January 8, 2025
আমি একজন দৌলা হিসেবে আজ একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প শেয়ার করতে চাই। আমার ক্লায়েন্ট আফরোজা আপুর ডেলিভারির অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, সঠিক প্রস্তুতি ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলে হাসপাতালে ন্যাচারাল বার্থ সম্ভব।আফরোজা আপু ন্যাচারাল বার্থের প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। তার স্বামীও …