উম্মে মাহদের গল্প
১ম পর্ব
বছর দেড়েক আগে জ্ঞান কিভাবে কাজে লাগানো যায় এই প্রসংগে হামিদা মুবাশ্বেরা আপু আমাকে রাবেয়া আপুর কথা বলেন। এরপর হামিদা আপুর ওয়েবিনারে রাবেয়া আপুর গল্প শুনি। পরে এক ছোট বোন প্রেগন্যান্ট শুনে তাকে রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্সের কথা বলি। নিজের তখনও কোন এক্সপেরিয়েন্স নাই।
সেই ছোটবোন যে সত্যিই প্রিন্যাটাল কোর্স করবে বুঝিনি। মানুষ এক কানে কথা ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে ফেলে দেয়, আর এখানে আমি তো নিজে কোর্স করিনি। পরে সেই বোনের সাথে কথা বলার সময় তাকে কেমন যেন এমপাওয়ারড মনে হত। যাই হোক, নিজে প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর চেকলিস্টে প্রথমে ছিল প্রিন্যাটাল কোর্স করব। রেজিস্ট্রেশনও করলাম। এরপর বিদেশে থাকায় দিন রাত উল্টো হওয়ায় লাইভ ক্লাস করতে পারি লনি। আর সারাদিনের জুম মিটিংএ ক্লান্ত হয়ে আমার আর জুম রেকর্ডিং দেখার ইচ্ছা থাকত না।
তখন রোজার মধ্যে মসজিদে যেতাম ইফতারে। মসজিদে চার বোন আর তাদের মা, শ্যারনকে দেখি। এই চার বোন খুবই ইউনিক ছিল। একদম বড়জনের বয়স ২১, আর সর্ব কনিষ্ঠ জনের ১১। এই পিচ্চিরা ইফতার বন্টন করত আর কম হলে নিজেরা না নিয়ে সবাইকে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকত। এদের দেখে এদের অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মায়ের সাথে আমি নিজে থেকে গিয়ে যেচে পড়েই কথা বলতাম। আর আমরা বাংলাদেশীরা তাদের মা’কে নিজেদের মধ্যে রেফার করতাম ‘ভাল মেয়েদের মা’ বলে।
আমি একদিন কথায় কথায় তাকে বললাম আমি প্রেগন্যান্ট। কিছুদিন পরে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোন চাইল্ড বার্থ রিলেটেড পড়াশোনা করছি কিনা। আমি প্রিন্যাটাল কোর্সে রেজিস্ট্রেশন করেছি জানালাম, কথা প্রসঙ্গে আমানি বার্থের কথাও আসল। আমাকে এরপর জিজ্ঞেস করলেন আমি আমানি বার্থ সম্বন্ধে কী জানি। আমার জ্ঞান তখনও ভাসাভাসা ছিল, আমি যা জানতাম তাই বললাম। সেদিন সিস্টার শ্যারন আমাকে আর কিছু বলেননি।
রামাদানের শেষের দিকে একদিন ইফতারে সিস্টার শ্যারন আমাকে বললেন আমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। তিনি যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি ছিলেন আইশা আল হাজ্জার। সুবহানাল্লাহ, দুনিয়া কত ছোট! সিস্টার আইশা আমাকে বারবার বললেন লেবার রুমে আনএডুকেটেড হয়ে যেও না। আমি জানতাম সিস্টার শ্যারন টিচার, সেদিন এটাও জানলাম তিনি চাইল্ড বার্থ এডুকেটর এবং দৌলা।
সিস্টার আইশা আমাকে বললেন যে আল্লাহ আমাকে একজন চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি জানতাম সিস্টার শ্যারন চমৎকার, কিন্তু কতটা তার আন্দাজ ছিল না।
যাই হোক, এর মধ্যে রমাদানেই ১৪ সপ্তাহে আমার জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। প্রচন্ড রকমের হার্ট বার্ন আর গ্যাস হত। রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল লাইভ ক্লাসের সাথে সময় মিলত না, আর রেকর্ডিংও দেখা হত না। আর ছোট বোন তাড়া দিত ক্লাস করি না কেন। আম্মুকে মিস করতাম সেইসময়। একদিন সিস্টার শ্যারনকে জিজ্ঞাস করলাম আমানি বার্থ এর ইন পারসন কোন ক্লাস হয় কিনা। তারপর তিনি বললেন আই উইল টিচ ইউ।
তখন থেকে আলহামদুলিল্লাহ আমি একজন অসাধারন দৌলা পেলাম, যে মায়ের মত মমতাময়ী আর বন্ধুর মত সাপোর্টিভ। আমি আল্লাহর কাছে কখনও কিছু চেয়ে নিরাশ হইনি, বরং আল্লাহ আমাকে সবসময় নিয়ামত উজার করে দিয়েছেন, এমন রিজিক দিয়েছেন যা কখনো আশাও করিনি!
২য় পর্ব
শ্যারন আমাকে বলতেন, “ইউ উইল নেভার ফরগেট ইউর বার্থ এক্সপেরিয়েন্স।” ১৪ সপ্তাহে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ধরা পড়াতে আমার থার্ড ট্রাইমেস্টারে অনেক আল্ট্রাসাউন্ড করানো হত, বাচ্চার ওয়েট দেখার জন্য।
২৭ থেকে ৩২ সপ্তাহ পর্যন্ত সপ্তাহে একটা, আর এরপর সপ্তাহে দুইটা করে আল্ট্রাসাউন্ড করানো হত। প্রতি চার সপ্তাহে বাচ্চার ওয়েট চেক করা হত। আর ১৪ সপ্তাহ থেকেই প্রতিদিন চারবেলা করে সুগার লেভেল কাউন্ট করে লগে লিখে প্রতি সপ্তাহে হসপিটালে পাঠাতাম।আল্ট্রাসাউন্ড করতে গেলে প্রায়ই অনেক এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট আমাকে বলেছে হয়ত আমার এক পর্যায়ে এসে ইন্সুলিন নেয়া লাগবে। আলহামদুলিল্লাহ আমার শেষ পর্যন্ত সুগার লেভেল নরমাল ছিল।
এত লম্বা সময়ে আমি অনেক ট্রায়াল এন্ড এরর করে অনেক কিছু বের করতাম আর আমার গাইনি ডাক্তারকে বলতাম। তিনিও অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। আমার সুগার বাড়ত যখন ডিহাইড্রেটেড থাকতাম, স্ট্রেসড থাকতাম আর ঘুম কম হত। খাওয়ার পরে মোটামুটি সবসময়ই নরমাল ছিল যদি আগের ফ্যাক্টরগুলো ঠিকঠাক থাকত। সুগার কন্ট্রোল করতে প্রোটিন ভয়াবহ হেল্প করত। প্রেগ্ন্যাসির পুরো সময়টাতেই আমার খাবার অসহ্য লাগত, মেজাজ খিটখিটে থাকত। গন্ধ আমার সবসময়ই বেশি লাগে। গাম ব্লিডিং হত। একমাত্র খাবার ভাল লাগত গরুর মাংস। তাও যদি শক্ত আঁশ আঁশ হত তখন চিবিয়ে খেতে ভাল লাগত কিন্তু তাতে গাম ব্লিডিং হত। মশলার গন্ধ অসহ্য লাগত। হার্ট বার্ন ছিল অনেক বেশি। রাতে ঘুমানোর সময় তিতা পিত্তরস মুখে এসে ঘুম ভেংগে যেত।
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের জন্য আমি শুরু থেকেই খুব এক্টিভ ছিলাম। আমি ডেস্কবাইক কিনেছিলাম একটা, টেবিলে বসে সাইকেল চালানোর মত একটা ডিভাইস। আমার ভাত খাওয়াতে সমস্যা হত না, সমস্যা হত যে কোন প্রকারের ডাল খেলে। গ্যাসও হত আর সুগারও বাড়ত। শেষ পর্যন্ত ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে থাকায় ৪১ সপ্তাহ পর্যন্ত ন্যাচারালি পেইন ওঠার জন্য অপেক্ষা করা যাবে বলা হয়েছিল।
আমাকে বেবি এসপিরিন খেতে বলেছিল ডাক্তার, বলেছিল আমার প্রিক্ল্যাম্পশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেন বেশি এই উত্তরটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। আর বিভিন্ন সময় সায়াটিক জয়েন্টে ব্যাথা হত। এক্সারসাইজ করতে বলেছিল। প্র্যাগ্নেন্সিতে আমার ওজন বাড়েনি, বরং অনেক কমে যায়। প্রিপার্টাম ডিপ্রেশন ছিল। আম্মুকে মিস করতাম। আলহামদুলিল্লাহ, এই সময় শ্যারনকে আমার জন্য আল্লাহ একটা এঞ্জেল হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।
আমাকে শুরু থেকেই প্রিটার্ম ডেলিভারির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল। LMP অনুযায়ী EDD দেয়া হয়েছিল অক্টোবরের ১৮ তারিখ। আমার পিরিয়ড স্বাভাবিক ছিল আলহামদুলিল্লাহ। লাস্ট ট্রাইমেস্টারে শুরু হল নতুন প্রশ্ন। EDD এখনো একই কিনা, সবার ডেইট আগায়ে যায়, প্রতিবার আল্ট্রা সাউন্ডে আমার EDD একই কেন। আমি এই প্রশ্নে খুব বিরক্ত হতাম, যখন আল্লাহ দিবে তখন হবে, EDD তো একটা আনুমানিক ডেট!
যাই হোক, আমার জন্য প্র্যাগ্নেন্সির একটা বড় শিক্ষা মানুষকে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা উচিত না। ৩৭ সপ্তাহ পার হওয়ার পর প্রশ্ন বাবু কখন হবে, বাবু কি দেরি করে আসবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার নিজের বাবুর জন্য আমি অপেক্ষা করতাম না এমন তো না। এমনকি EDD ও পার হয়নি। প্র্যাগ্নেন্সির সময় কথা বলতেও অসহ্য লাগত। আল্লাহর সিদ্ধান্ত উত্তম সিদ্ধান্ত, দোয়া করতাম সর্বোত্তম সময়ে সর্বোত্তম ভাবে যেন আল্লাহ আমার বাবুকে দুনিয়ায় পাঠান।
তখন বাইরে ঠান্ডা হওয়ায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতাম আর বাসায় হাঁটতাম। ৩৮ সপ্তাহ ৩ দিনে অনেক হাঁটলাম, সাধারণ এক্সারসাইজ এর সাথে লেবার ইন্ডিউস হওয়ার এক্সারসাইজ করা শুরু করলাম। ৩৮ সপ্তাহ ৩ দিনের বিশেষত্ব ছিল ওইদিন বৃহস্পতিবার ছিল। আমি চাইতাম আমার বাচ্চা জুম্মার দিন হোক।। আমাদের পেরেন্টাল লিভ মাত্র ৬ সপ্তাহ, আর ওই উইকে বাচ্চা হলে থ্যাংক্স গিভিং এর উইকটা আমরা বোনাস ছুটি পেতাম। চাইতাম, কিন্তু এটা মাথায় রাখতাম আল্লাহ যখন পাঠাবেন তখনই সর্বোত্তম সময়। ওইদিন থেকে ভি এরিয়ায় অদ্ভুত একটা ব্যথা শুরু হয়েছিল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এরপরও জোর করে হাঁটাহাঁটি কন্টিনিউ করলাম।
মঙ্গলবারে, ৩৯ সপ্তাহের দিন গাইনী ডাক্তারের কাছে গেলে বলেছিল ৪০ সপ্তাহ হয়ে গেলে রেকমেন্ড করবে ইন্ডিউস করার, আর কোন নির্দিষ্ট দিনে ইন্ডিউস করতে চাইলে আগে ফিক্স করলে বেটার। আমি ফিক্সিং এর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না আসলে। পরে ওইদিনই পিভি চেক করে ডাক্তার বললেন, ৯০% ইফেসমেন্ট হয়েছে আর ৩ সেমি টাইট ডায়ালেশন। বললেন আর ডেইট ফিক্স করা লাগবে না, ওইদিন হয়ত ব্লাডিশো শুরু হতে পারে আর দুই একদিনের ভেতর লেবার শুরু হয়ে যাবে হয়ত।
আমি খুশি হয়ে বাসায় আসলাম। আমি তেমন কাউকে বলিনি লেবার শুরু হওয়ার কথা, মাথায় ছিল লেবার প্রগ্রেস স্লো হতেই পারে। আমি আর কোন প্রশ্ন শুনতে চাচ্ছিলাম না। আমার এডভাইসারকে জানালাম, “আই ক্যান ডিসএপেয়ার এট এনি টাইম।”
এরপর মাঝেমাঝে হালকা কন্ট্রাকশন হত, রিদমিক হওয়াও শুরু হত। কিন্তু প্রগ্রেস হত না। এভাবে শুক্রবার পর্যন্ত গড়ায়। শুক্রবার বিকাল ৪ টার পরে পানি ভাংগে। আমি তো খুশি। ভাবছিলাম আস্তে ধীরে যাব হস্পিটালে। আমার একটা মিটিং ছিল তখন, বার্থ বলে বসে খুশি মনে মিটিং এটেন্ড করলাম। প্রফেসর বলল, সোমবারের আগে কিছু হলে জানাতে, আর না হলেও জানাতে কেমন আছি।
আমাকে হস্পিটাল থেকে বলেছিল স্ট্র্যাপ বি পজেটিভ হলে ওয়াটার ব্রেকের মনে হয় তিন ঘন্টার মধ্যে হসপিটালে যেতে হবে, আর নেগেটিভ হলে ছয় ঘন্টা পর্যন্ত বাসায় থাকা যাবে। ভাবছিলাম পরেই যাব। আমার মাথায় ঘুরছিল আল্লাহ তো আমার জন্য সব সহজ করে দেন, তাহলে মনে হয় অনেকখানি ডায়ালেশন হয়ে গেছে। পরে আমার বেটার হাফ হসপিটালে কল দিলে ওরা তাড়াতাড়ি যেতে বলল।
মাগরিবের পরে আমরা গেলাম। আমাদের ধারনা ছিল ডায়ালেশন প্রগ্রেস না করলে বাসায় চলে আসব। এরপর হসপিটালে যাওয়ার পর পিভি চেক করে বলল এখনও ৩ সেমি, সুবহানাল্লাহ! এরপর ওরা অপশন দেয়নি এটা বলার আমি কী করতে চাই। আর এত পানি বের হচ্ছিল, আমার মাথায় ঘুরছিল বাসায় পানি পড়লে পরিস্কার করতে হবে তাই হস্পিটালেই থাকি। এরপর নার্স হাতে স্যালাইন দিতে চাইলে তখন আমি বললাম আমি হাঁটতে চাই। তারপর আইভি পোল দিল, কিন্তু ওইটা নিয়ে হাঁটা বেশ কষ্টকর ছিল।
পরে আমি ডাক্তারকে বললাম পানি খেলে হবে কিনা। ডাক্তার জানালেন হবে। আইভি পোলের সাথে আরেক যন্ত্রনা ছিল বাচ্চার হার্টরেট মনিটরিং এর জন্য মেশিনের তার। তখন স্যালাইন খুলে হাঁটছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত হাঁটলাম, রাত দুইটার পরে পিভি চেকের পরে জানালেন একই আছে। তখনও আমি পিটোসিন নিতে চাইনি। ডিউটি ডাক্তার বললেন ইনফেকশনের রিস্ক বাড়ার কথা। আমি সকাল পর্যন্ত সময় চাইলাম। তিনি বললেন সকাল সাতটায় তার ডিউটি শেষ, সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত প্রগ্রেস না হলে পিটোসিন দেয়া সাজেস্ট করবেন। দুয়া করতে থাকলাম যেন আল্লাহ যা ভাল হয় তাই করেন। যা হবে আল্লাহর হুকুমে হবে মেনে নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমানোর, যদি রেস্ট নিয়েও লেবার আগায়।
সকাল পর্যন্ত কোন প্রগ্রেস না দেখে পিটোসিন দিল। আমি বলেছিলাম এস লেস এস পসিবল দিতে। লেবার শুরু হল কিছুক্ষন পরেই। সিস্টার শ্যারন বারবার খোঁজ নিচ্ছিলেন। আমি তাকে আসতে বলিনি, কারন আমার মাথায় ছিল অনেকক্ষন সময় লাগবে, বেচারির কষ্ট হবে। শেষে উনাকে বললাম আসতে। কিছুটা অপরাধী লাগছিল কেন পিটোসিন নিলাম। আবার নিজেকে বূঝাচ্ছিলাম, আমরা চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু তাই হবে যা তাকদিরে আছে। এরপর শুরু হল ব্যাথা!
পিটোসিনের সাথে স্যালাইনও দিল। আইভি পোলের সাথে হার্টরেট মনিটর করার জন্য ব্লুটুথ মেশিন চেয়ে নিলাম যা অধিকাংশ সময়ই কাজ করছিল না। এরপর বললাম কিছুক্ষন পর পর দেখতে বাবুর হার্টরেট। সময়ের সাথে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। কন্ট্রাকশনের সময় হাঁটা, স্কোয়াট করা, বার্থ বলে বাউন্সিং, হিপ দোলানো, হিপ রোটেশন সবই করছিলাম। হস্পিটালে আইস প্যাক ছিল, কিন্তু আমি হট থেরাপি পছন্দ করি। কন্ট্রাকশনের ব্যথা বাড়ার একপর্যায়ে বাথরুমে গিয়ে গরম পানির শাওয়ার কোমরের দিকে হরাইজন্টালি ছেড়ে হাঁটছিলাম সামনে পিছে। তখন বেশ আরাম পাচ্ছিলাম।
আর এর মধ্যে পানি ভাংগার সাথে রক্তও পড়ছিল। রক্তের অসহ্য গন্ধ, ব্যথা আর এর সাথে যোগ হল বমি। রাত থেকে লিকুউড, ব্রথ আর জেলো খেতে এলাও করেছিল। পানির সাথে আমি খেজুর, নারকেল পানি, জমজমের পানি খাচ্ছিলাম। জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস থাকায় খেজুর খাচ্ছিলাম খুবই অল্প। আমি এমনি মিষ্টি পছন্দ করি না। এত লম্বা সময় খেজুর আর নারকেলের পানি খেয়ে মুখ কেমন যেন তিতা হয়ে গেল। এর মধ্যে বার্থবলে বাউন্স করার সময় অস্বাভাবিক হার্টরেট দেখে ডাক্তার দৌড়ে আসল কী হচ্ছে দেখার জন্য। নার্স ডাক্তারকে বলেছিল আমি বার্থ বলে বাউন্স করছি দেখে হার্টরেট অনেক বেশি ছিল। কিছু সময় আমাকে কোন কিছু করতে না দিয়ে হার্টবিট চেক করছিল। সেইসময় একজন বয়স্ক নার্স ছিলেন। কন্ট্রাকশনের সময় ছাড়া আমি মোটামুটি হাসি মুখে ছিলাম অনেকক্ষন। নার্স আমাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকবার বলেছিল, “সি ইজ স্টিল স্মাইলিং।”
মনে হয় ছয় সেমি ডায়ালেশনের পর আর হাসিমুখ ছিল না। চিৎকার একদমই করিনি, কন্ট্রাকশন হওয়ার সময় পুরোপুরি কনসেন্ট্রেট করছিলাম, সম্পূর্ণ রিল্যাক্সড থেকে ডিপ ব্রিদীং করছিলাম। সেদিনই আমি প্রথমবার সারাদিন চশমা পড়িনি। এত ব্যথায় শুধু ভাবছিলাম যে মানুষ আসবে তার নেক আমল আমার আমল নামায় যোগ হবে, তাই এই ব্যথা সহ্য করা worthy।
এর মধ্যে সিস্টার শ্যারন নোরেন মোহাম্মদ সিদ্দীকির রিসাইটেশন প্লে করে দিয়েছিলেন। আমি এর আগে কখনো উনার রিসাইটেশন শুনিনি। এত দরদ কন্ঠে! ‘ইয়্যা কানা’ বুদু ওয়া ইয়্যা কানাস্তা ঈন’… মনে হয় এভাবে কখনো অনুভব করিনি। সেই স্বত্তার কাছেই সাহায্য চাই যার প্রার্থনা করি, কঠিন সময়ে বাঁচানোর মালিক আল্লাহ, সুস্থ আর নেক সন্তান দেয়ার মালিক আল্লাহ। দুয়া করছিলাম সহজতার, ভাল ভাবে শেষ হওয়ার আর সাথে নেক সন্তানের, যেই সন্তান চক্ষুশীতলকারী হবে।
এক সময় সলাতের জন্য নাকি চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় রিসাইটেশন বন্ধ ছিল। নার্স এসে বললেন তোমরা মিউজিকটা কেন বন্ধ করলে, “ইট ওয়াজ ভেরি সুদিং!” অনেক ব্যথা যখন হচ্ছিল প্রতিবেশীর একটা কথাও মাথায় ঘুরছিল তখন, ‘দিস টু শেল পাস’। সিস্টার শ্যারন বলতেন লেবার আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার খুব ভাল একটা সময়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাচ্ছিলাম। ব্যাক মাসাজের সময় সিস্টার শ্যারন ‘আল্লাহু আকবার’ তাসবীহ পড়ছিলেন। আমার খুব বেশি অনুভব হচ্ছিল আল্লাহ ছাড়া সাহায্য করার কেউ নাই, আল্লাহ ছাড়া বাঁচানোর মালিক নাই৷ যা আল্লাহ সহজ করে দেন তাই সহজ।
লেবার প্রগ্রেস হওয়ার একটা পর্যায়ে আমি প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। প্রচন্ড টায়ার্ডনেসে মনে হচ্ছিল কিছুক্ষন ঘুমাই। এর আগে পিভি চেক করে ডাক্তার বলেছিল ৬ সেমি ওপেন হয়েছে। এর পরে কিছু সময় বার্থবলে বসে রেস্ট নিয়েছি। বেটার হাফ আর সিস্টার শ্যারন ব্যাক মাসাজ করে দিচ্ছিল। দুপুর মনে হয় তখন, মনে হচ্ছিল টায়ার্ডনেসে মাথা ঘুরে পরে যাব। সিস্টার শ্যারনকে জরিয়ে ধরে কান্না করছিলাম আর বলছিলাম “আই কান্ট টেইক দিস এনিমোর, আই ওয়ান্ট টু স্লিপ ফর সাম টাইম।”
এর মধ্যে ঘন ঘন কন্ট্রাকশন হচ্ছিল। ডাক্তার এসে কথা বলার সময় কন্ট্রাকশন আসলেই আমি ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে ওয়েট করতে বলেছি কয়েকবার। সিস্টার শ্যারন আমাকে পরে বলেছেন আমি নাকি ডাক্তারকে আংগুল উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলাম আর কন্ট্রাকশনে কনসান্ট্রেট করছিলাম। আমার লেবারের পুরো সময় তিনজন ডিউটি ডাক্তার ছিল, এক্টিভ লেবারের সময়ে যিনি ছিলেন, তিনি আলহামদুলিল্লাহ বেশ কোঅপারেটিভ ছিলেন, এমনকি সেই সময়ের নার্সটাও চমৎকার ছিল, উনার জড়িয়ে ধরে সাহস দেয়ার কথা আমি কখনোই ভুলব না। আমার মাথায় ছিল আল্লাহ মারিয়াম আ. কে লেবারের সময় হাঁটতে বলেছেন আর খেজুর গাছ ধরে ঝাঁকাতে বলেছেন। লেবার রুমে ধরে ঝাঁকানোর জন্য পোল ছিল যতদূর জানি। আমি কিছুক্ষন বেড ধরে ঝাঁকাচ্ছিলাম, কিছুক্ষন দেয়াল ধরে ঝাঁকাচ্ছিলাম।
শেষের কন্ট্রাকশনগুলো মারাত্মক ছিল। আমি ব্যথায় বেড ধরে লাফাচ্ছিলাম। ডাক্তার এসে বলে “শি ইনভেনটেড সামথিং নিউ৷” পিভি চেক করে বললেন ৯.৫ সেমি এর মত ডায়ালেশন হয়ে গেছে। এরপর মনে হচ্ছিল পারব, আর অল্প কিছুক্ষন! জানি না এরপর কত সময় পার হয়েছে, হঠাত মনে হচ্ছিল রেস্ট নিতে না পারলে আর হবে না। বেটার হাফ আর সিস্টার শ্যারনকে বললাম আমি আর পারছি না, আমার ঘুমানো দরকার। বার্থবলে রেস্ট নেয়ার মত অবস্থা আর নাই। নার্সকে বললাম পেইন রিলিফের কী কী অপশন আছে। এপিডুরাল দেয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম, এর আগে আমি জানতাম ৭ সেমি এর পরে আর এপিডুরাল দেয়না। নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি এখন কাজ করবে? নার্স বলল অবশ্যই করবে।
এপিডুরাল দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। আল্লাহর সিদ্ধান্ত উত্তম নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম।
৩য় পর্ব
প্রায় দুই ঘন্টা ঘুমানোর পর ডাক্তার এসে পিভি চেক করে বললেন এখন পুশ করার ট্রাই করা যাবে। আমি তখনও টায়ার্ড, বললাম আমি আরো কিছুক্ষন ঘুমাতে চাই। ডাক্তার মনে হয় কিছুটা অবাক হয়েছিলেন, বললেন এই স্টেজে এসে অপেক্ষা করব!
এরপর বললেন কিছু প্র্যাকটিস পুশ ট্রাই করতে। পুশিং স্টেজ ছিল আরো চার ঘন্টা। আমার মনে হয় পুশিং স্টেজ লম্বা হওয়ার কারন আমার জ্ঞানের সাথে ডাক্তারের ইন্সট্রাকশন এই পর্যায়ে আমি মিলাতে পারছিলাম না। আমি জে ব্রিদিং নিয়ে পুশ করার ট্রাই করছিলাম। আর ডাক্তার বলছিলেন জোরে পুশ করতে। আমার মাথায় একটা বেলুনের উদাহরন ঘুরছিল। স্ট্রেচ করার সময় হঠাত জোরে টান দিলে ছিঁড়ে যাবে, আর ধীরে ধীরে টান দিলে স্ট্রেচ করবে কিন্তু ছিড়বে না। ডাক্তার বলছিল লম্বা শ্বাস নিয়ে এমনভাবে আটকে ধরে রাখতে যেন সুইমিং পুলে আছি, এরপর জোরে চাপ দিতে।
আমি আমার অর্জিত জ্ঞান আর ডাক্তারের ইন্সট্রাকশনের কোওর্ডিনেট করার ট্রাই করছিলাম। এপিডুরাল নেয়ার পরও আমি পুশিং আর্জ টের পাচ্ছিলাম। এপিডুরাল দেয়ার সময়ও আমি বলেছিলাম এস লেস এস পসিবল দিতে। আমি শুয়ে থেকে যতরকম পজিশন জানতাম সবভাবে পুশ করার ট্রাই করেছি। বেটার হাফের সাপোর্ট, বার্থবল, পিনাটবল, সাইড লাইং পজিশন আর যা যা মনে ছিল আর যা পায়ের উপর মোটামুটি ভার না দিয়ে করা যায়৷ বাবু হওয়ার দুই ঘন্টা আগে ডিউটি ডাক্তার আর নার্স আবারও চেঞ্জ হল। আগের টিমের নার্স চলে যাওয়ার আগে বারবার বলছিলেন বাচ্চাটা দেখে যেতে পারলেন না।
পরের ডাক্তার কিছুটা রুড ছিল। আমাকে একপর্যায়ে বললেন আর কিছুক্ষনের মধ্যে বাবু বের না হলে হয়ত সি-সেকশন করতে হবে। পরে ডাক্তার পুশ করার জন্য আরও কিছু হেল্প করলেন। পুশ করার আগে আমি বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে বিসমিল্লাহ বলে পুশ করার পর মাহদের চুল বের হয়ে আসল। এর পর আবার থেমে পরের কন্ট্রাকশনের পুশে বাবু বের হয়ে আসল, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহু আকবার!
হালকা একটু মুছে সদ্য ভুমিষ্ঠ আল্লাহর বান্দাকে আমার বুকে দেয়া হল স্কিন টু স্কিন করার জন্য। সমস্ত প্রশংসা মালিকের যিনি বান্দাকে মায়ের চাইতেও অনেক অনেক বেশি ভালবাসেন। ছোট একটা মানুষ, কী প্রচন্ড ভয়ংকর মায়া! আলহামদুলিল্লাহ মাইনর টিয়ার হয়েছিল যেটা তিনচার দিনেই সেরে গেছে। এই যে আল্লাহর সিদ্ধান্তই সর্বোত্তম। এপিডুরাল না নিলে আমি আর চারঘন্টা পুশ করতে পারতাম না কোনভাবেই, অথবা বাজে রকমের টিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সব আমার ইচ্ছা অনুযায়ী হয়নি তবে আলহামদুলিল্লাহ সব ভাল হয়েছে শেষমেশ।
৪র্থ পর্ব
আমি ইনডাকশন আর এপিডুরাল নিতে আগ্রহী ছিলাম না। তখন কিছুটা গিলটি ফীলও হচ্ছিল। সিস্টার শ্যারনকে কয়েকবার সরিও বলেছিলাম আমাকে এত শিখাল পড়াল উপকারীতা, অনুপকারীতা সম্বন্ধে! সিস্টার শ্যারন উত্তর দিয়েছিলেন ‘ইটস ইউর বডি, ইউ নো হোয়াট ইউ আর গোইং থ্রু। সামওয়ান ডাসন্ট নো হোয়াটস হ্যাপেনিং। ইউ শুড মেইক ইউর ওন ডিসিশন।’ উনি আমাকে আগেও এই কথা অনেকবার বলেছিলেন, কিন্তু এখন কথাটার মানে বুঝি।
প্রিন্যাটাল কোর্সের উদ্দেশ্য শুধু ন্যাচারাল ডেলিভারির জন্য হেল্পফুল মেটারিয়াল প্রোভাইড করা না, এর উদ্দেশ্য এটাও যে ইনফরমড ডিসিশন নেয়ার জন্য শিক্ষিত করা। সিস্টার শ্যারন বলতেন অনেকসময়ই ডেলিভারি রুমে ডাক্তার তোমাকে ইনফরমেশন এমনভাবে দেবেন যেন তুমি তা কর যা তাদের জন্য সহায়ক, আবার ডাক্তার যদি ঠিক সেই মুহূর্তে খুব ডিটেইল বলতে যায় সেই জ্ঞান নেয়ার মত অবস্থায়ও সেই মুহূর্তে মা থাকেন না, আবার জ্ঞান দেয়ার মত এত সময়ও ডাক্তারদের থাকে না, থাকার কথাও না। ডেলিভারির পরে একজন বলেছিল এপিডুরাল না নিলেই ভাল করতাম। আমার তখন শুধু মনে হচ্ছিল ভাল করতাম এই স্টেটমেন্টটা কিসের বেসিসে বলা! সিস্টার শ্যারন আর বেটার হাফেরও মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে এপিডুরাল নেয়া দরকার ছিল।
একজন শায়েখকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই যে জ্ঞান অর্জন করা ফরজ, এই জ্ঞান কোন জ্ঞান। শায়েখের উত্তর ছিল যে যেই পরিস্থিতিতে পড়ে তার সেই পরিস্থিতি সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ যে প্রেগন্যান্ট তার প্রেগন্যান্সির বেসিক জ্ঞান অর্জন করা ফরজ, পেরেন্টেসদের প্যারেন্টিং এর বেসিক জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। আমার মনে হয় যদি সামর্থ্য থাকে, সন্তান জন্ম দেয়ার বেসিক ব্যাপারগুলো, অবশ্যই মা-বাবার দায়িত্ব জেনে নেয়া উচিত। আর আগে থেকে ব্যাপারগুলো জানা উচিত ইনফর্মড ডিসিশন নেয়ার জন্য। জ্ঞান না থাকলে যেমন অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশেন এড়ানো যায় না তেমনি নরমাল/ন্যাচারাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করা কখন ঝুঁকিপূর্ন, এমনকি শিশু এবং মাতৃমৃত্যুর কারন হতে পারে তাও বোঝা যায় না। দোয়া করার আগে উট বাঁধার কথা, সাধ্যমত চেষ্টা করার কথা। এরপর তাওয়াক্কুল হল আল্লাহর সিদ্ধান্ত উত্তম সিদ্ধান্ত এটা মেনে নেয়া।
ইদানিং দেখি ন্যাচারাল ডেলিভারির সাথে তাওয়াক্কুলের একটা সম্পর্ক আছে ইন্ডিরেক্টলি প্রকাশ করা হয়। কিছু মানুষ দেখি তাওয়াক্কুল করে ডাক্তার দেখাবে কিনা, আল্ট্রাসাউন্ড করবে কিনা এইসব নিয়ে দ্বিধায় থাকে। এটা দোয়ার আগে উট বাঁধার ব্যাপারটা ইগ্নোর করার মত মনে হয় আমার। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন কোর্স করার কথা বলছি। অনেকে ইউটিউব দেখে নিজে শিখে, কন্টেন্ট পড়ে স্বশিক্ষিত হয়। আমার অভিজ্ঞতায় গুগোল ঘেঁটে স্বশিক্ষিত হওয়ার ব্যাপারটা অনেক বেশি ভয়ংকর। গুগোলে এত মুনি, এত জ্ঞানী! তাই আমি সার্টিফাইড মানুষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট রিলেটেড জ্ঞান নিতে আস্থা বোধ করি। হয়ত কেউ গুগোল ঘেঁটে ইনফরমেশন বের করল, তার ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? তার সাথে ইনফরমেশন এর অথেনটিসিটি জাজ করার মত যোগ্যতা আমার আছে কিনা সেটা যাচাই করাও একটা বড় বিষয়।
একটা বার্থস্টোরি দেখেছিলাম যেখানে মা কোন ডাক্তার এর সুপারভিশনে ছিলেন না, পরিচিত ডাক্তারদের কিছু সময় টেলিহ্যালথ সার্ভিস নিয়েছেন, স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডেলিভারি পেইন নিয়ে এক এক হস্পিটালে দৌঁড়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ নরমালে বাচ্চা প্রসব করেছেন। ব্যাপারটাতে অনেকেই বাহবাহ দিয়েছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা মারাত্মক মনে হয়েছে। একজন ডাক্তারের এটলিস্ট সাত আট বছরের একাডেমিক সুপারভাইজড পড়াশোনা আর কারো কয়েকমাসের স্বশিক্ষার ওজন একই হয় না, হবে না।
আমাদের একটা সাধারন অভ্যাস প্রেক্ষাপট না জেনে তুলনা করা। ইন জেনারেল প্রেগন্যান্সিতে হাঁটা রেকমেন্ডেড, কিন্তু এই রেকমন্ডেশন কেইস টু কেইস ভেরি করে। আমাদের দেশে সবাই একচেটিয়া উপদেশ দিতে ভালবাসে, কিছু কিছু সময় উদাহরনও দেয়। এই অবস্থায় বিভ্রান্ত না হতে জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নেই। আর একটা বিষয় এটা ডিসাইড করা যে আমার কী কী জানতে হবে। আশপাশের হাতুড়ে মানুষদেরও তো বিতরনের জন্য জ্ঞানের অভাব নাই। একটা বাচ্চা দুনিয়ায় আসবে, এই সময়ে অজ্ঞ থাকার ব্যাপারটা কেমন মারাত্মক না? বেবি ডাসন্ট কাম উইথ এ ম্যানুয়াল, কিন্তু আমার যদি কিছু ব্যাসিক জ্ঞান না থাকে তাহলে পুরো সময়টা ভয়ংকর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় না? আমি কোন ক্ষেত্রে কতটা রিস্ক নিতে পারি ডিসাইড করা আমার দায়িত্ব। হতে পারে সব কিছু ঠিক থাকতে পারে, আবার মা আর বাচ্চার মৃত্যুও হতে পারে, মধ্যবর্তীও অনেক কিছু হতে পারে। সুরাহ জুমার এর আয়াত “যে জানে আর যে জানে না তারা কি সমান?” এই পুরো প্র্যাগ্নেন্সির জার্নিতে আমি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি, মানুষ না জেনেই কত কত জ্ঞান দেয়।
আমার মনে হয়েছে রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্স সিসেকশন, ভিব্যাক, পোস্টপার্টাম, নিউবর্ন বেবি কেয়ার এসব বেশ ডিটেইলসে কাভার করেছে। দেশের প্রেক্ষাপটে রৌদ্রময়ীর কোর্স কন্টেন্ট খুবই ভাল। আমার ডেলিভারি হয়েছিল ক্রিসচিয়ানা কেয়ার হসপিটালে। এখানে চাইল্ড বার্থ রিলেটেড বিভিন্ন ক্লাস হয়। আমাকে আমার সুপারভাইজার বলেছিল চাইল্ড বার্থ ক্লাসগুলো বেশ হেল্পফুল হয়। আমার সময় ছিল না হসপিটালে গিয়ে ক্লাসগুলো করার। ডাক্তার সময় নিয়ে দেখত, প্রশ্ন করলেও উত্তর দিত। তবে প্রিন্যাটাল ক্লাসের যেই কন্টেন্ট ছিল তা ডাক্তার চাইলেও কভার করতে পারত না। আর ডাক্তার যার যা সমস্যা তা নিয়ে কথা বলবে। অনেকে দেখি প্রশ্ন করে গ্রুপে ডেলিভারির জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নিবে, কি খাবে, কিভাবে বুঝবে লেবার শুরু হয়েছে, নতুন বাচ্চার কিভাবে যত্ন নেবে। পুরো কোর্সটার রেকর্ডিং ছিল বিশ ঘন্টার বেশি। এই টপিকগুলোতেই ক্লাস ছিল। অল্প কিছু কথায় যদি উত্তর দেয়া যেত তাহলে এত লম্বা ক্লাস হত না অবশ্যই। ক্লাসগুলো নিয়ে আমার প্রথম কষ্ট ছিল এত্ত লম্বা কেন! আসলে লম্বা না হয়ে কোন উপায় নাই, এমন না যে এক কথা বারবার বলে ক্লাস লম্বা হচ্ছে। এত এত তথ্য লম্বা হবেই!
প্রিন্যাটাল কোর্সের প্রতিটা ইন্সট্রাক্টর আপুর জন্য মন থেকে দোয়া করি মা’দের শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য, আল্লাহ তাদের কবুল করে নিক, আখিরাতে তাদের এবং তাদের পরিবারকে সর্বোত্তম প্রতিদান দিক। প্রিন্যাটাল কোর্সের জন্য যেই টাকা নেয়া হয় তা যা শেখানো হয় সেই তুলনায় খুবই কম। কারও যদি নিতান্তই সামর্থ্য না থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সাধ্য থাকলে আমি অবশ্যই কোন বার্থ এডুকেশন কোর্স করা সাজেস্ট করব। কোর্স করার উদ্দেশ্য শুধু মাত্র ন্যাচারাল ডেলিভারি হওয়া না, উদ্দেশ্য ইনফরমড থাকা কোন পরিস্থিতিতে কি হতে পারে আর তখন আমরা কি করতে পারি, আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করা। আর সুযোগ থাকলে আমি রেকমেন্ড করব অবশ্যই দৌলার সাহায্য নিতে। সিস্টার শ্যারন আমাকে যত বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন পরিবারের অন্য কেউ সাথে থাকলেও আমার এত সাহায্য হত না। আমার ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য নেই আমি আমার দৌলার প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ। সিস্টার শ্যারনের প্রতিদান আল্লাহ দিক, আল্লাহর অশেষ ভান্ডার থেকে উজার করে দিক।
ডেলিভারির পরে শুরু হয় আমাদের আর আমাদের ছেলের আরেক যুদ্ধ …
শেষ পর্ব
মেজাজে আমি আগুন, আর বেটার হাফ একদম বরফ শীতল। দোয়া করতাম আমার ছেলে মাহদ যেন মেজাজে ওর আব্বা অথবা ওর মামার মত হয়।
সেকেন্ড নাইটে মাহদ বলতে গেলে একদমই কাঁদে নাই। আমি সারারাত কোলে রেখেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার তো দুই ঘন্টা পরে খাওয়াতে এমনিই ওঠা লাগবে ঘুমিয়ে আর কি করব। কাঁদে নি তাই আমি তো খুব খুশি, এই তো আমার সোনা বাচ্চা! ডেলিভারির ধকল কেন জানি তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি, সম্ভবত ব্যাথার ওষুধের কল্যানে আর মনের খুশিতে। হসপিটালে ছিলাম ৩ দিন। দুইদিন দুইজন নার্স দেখিয়ে দিল কিভাবে খাওয়াব। প্রিন্যাটাল কোর্সে সব বলা হয়েছিল, কিন্তু কিভাবে যেন আমি সব ভুলে গেছি তখন।
নার্স হ্যান্ড এক্সপ্রেশনের ভিডিও দেখিয়ে বললেন বাচ্চা প্রথমে হয়ত সাক করবে না ভালভাবে, যেন হ্যান্ড এক্সপ্রেস করে খাওয়াই। দেখিয়ে দেয়ার পরে নার্স তিন চারবার এসে জিজ্ঞেস করলেন বাচ্চাকে খাইয়েছি কিনা। ল্যাকটেশন ডিপার্টমেন্ট থেকেও একজন এসে বললেন শুরুতেই যেন পাম্প না করি যদি ব্রেস্টফীড করি, নাহয় বডি অনেক বেশি মিল্ক প্রডিউস করবে। তারপর কোন প্রয়োজনে কিভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করব তা বলে গেলেন।
হস্পিটালে জন্মের প্রথম দুপুরে পেডিয়াট্রিশিয়ান দেখেছিলেন, বলেছিলেন মাহদের জন্ডিস ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন বেশি বেশি ব্রেস্টফীড করতে। পরেরদিন জন্ডিস মোটামুটি চলে যায়, আমরা রিলিজ নিয়ে বাসায় আসি৷ ততক্ষণে আমি ভয়ংকর ক্লান্ত, রিলিজ নেয়ার সময়টাতে আমার মনে হচ্ছিল যদি হসপিটালে আরেকদিন থাকতে পারতাম! বাসায় আসার পর শুরু হয় আমাদের আসল পরীক্ষা…
ডাইপার কাউন্ট দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল। বাচ্চাকেও প্রতি দুইঘন্টা পর পর খাওয়াচ্ছিলাম। ডাইপারের কাউন্ট লিখে রাখছিল বেটার হাফ। জন্মের তৃতীয় রাতে আমার স্বপ্ন পুত্র শুরু করল মারাত্মক কান্না। আমরা ভাবলাম ওর সেকেন্ড নাইট সিন্ড্রোম এখন হচ্ছে হয়ত। খাওয়ানো শুরু করি, ১০-১৫ মিনিট পরে বাচ্চা ঘুমিয়ে যায়, এরপর ১৫-২০ মিনিট পরে আবার কান্না শুরু করে, হাংগার কিউ দেয়। খাওয়াই আবার। এমন কয়েক ঘন্টা যাওয়ার পরে পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত পিতার মনে পরে ল্যাকটেশন নার্স তো ২০-৩০ মিনিটের কথা বলেছিলেন। আমি মনে হয় ওভারফীড করছি তাহলে। এরপর মনে হল বাচ্চার গ্যাস। আমরা বেলি মাসাজ করি, সিট আপ করি, হাঁটি, মাহদ বার্প ওঠায়। এরপর হঠাত কান্নার সাউন্ড বদলায়, এরপর আমি আবার খাওয়াই। এমন সারারাত চলল।
সারারাত বাচ্চার গগনবিদারী কান্নায় আমার মনে হচ্ছিল আমি মনে হয় আমার বাচ্চা মেরে ফেলছি না বুঝে। আম্মুর আসতে না পারায় তখন খুব কষ্ট লাগছিল, বুঝতেই পারছি না বাচ্চাকে ওভারফীড করছি (যেহেতু ঘন্টার পর ঘন্টা খাওয়াচ্ছি!)… পরেরদিন বুধবার পেডিয়াট্রিশিয়ানের ভিজিট ছিল। যাওয়ার আগে খাওয়ালাম, খেতে খেতে ঘুম। পেডিয়াট্রিশিয়ান এর চেম্বারে যেতে লাগে ১০ মিনিটের মত। ওখানে গিয়েই আবার সেই গগনবিদারী কান্না। ফীড করালাম, আবার ঘুম। ডাক্তার আসল, সেইসময় আবার মারাত্মক কান্না। ডাক্তার বললেন বাচ্চা অনেক ক্ষুধার্ত, ওজনও অনেক কমে গেছে। চারদিনে প্রায় এক পাউন্ড ওজন কমে গেছে। ডাক্তার বললেন বেশি বেশি ব্রেস্টফীড করানোর চেষ্টা করতে আর সাথে সাপ্লিমেন্ট হিসাবে দুইদিনের জন্য অল্প ফর্মুলা দিতে।
বাসায় আসতে আসতে আমি কাঁদছিলাম, আমার বাচ্চা ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল আর আমি বুঝিনি। অস্থির লাগছিল। ভিডিও দেখে ল্যাকটেশন সাপ্লিমেন্ট যা যা রেকমেন্ড করেছে সব অর্ডার করলাম এমাজানে। হসপিটালের ল্যাকটেশন ডিপার্টমেন্টে ফোন দিলাম। ওরা বলল প্রথম বার মা হলে মিল্কফ্লো আসতে একসপ্তাহ সময় লাগতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ মত ফীড করানোর পরে ফর্মুলা দিতে বলল আর বলল পাম্প করতে। আমি সারারাত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতাম, দুই তিন ঘন্টা খাওয়ানোর পরে ফর্মুলা দিতাম। আমার পিঠে তখন প্রচন্ড ব্যাথা করত।
পরেরদিন সকালে ব্লাড টেস্ট করতে যাব, তখন অল্প ফর্মুলা দিয়ে মাহদের কান্না থামছিল না। ৩০ মিলি ফর্মুলা দেয়ার কথা, ডাক্তারকে ফোন দিলাম ডাক্তার বললেন ৪৫ মিলি দিতে, তাও কান্না যখন থামছিল না আমরা খাওয়াতেই থাকলাম। ৭৫ মিলি দেয়ার পরে কান্না থামল আর বাচ্চা প্রচন্ড গভীর ঘুম দিল। হসপিটালে বলেছিল বাচ্চার ক্ষুধা লাগলে বাচ্চা স্টিফ হয়ে যায়। আমার বাচ্চা বাসায় আসার পর থেকেই শক্ত হয়েছিল৷ আমার মনে হয়েছিল আমার বাচ্চা মনে হয় স্ট্রং৷ ফর্মুলা খাওয়ানোর পরে দেখি আমার বাচ্চা বিড়ালের মত নরম হয়ে গেছে।
প্রথম কয়েকদিন আমার এক টার্কিশ ফ্রেন্ড আসত মাহদকে ঘন্টাখানেক রাখত আর আমরা তখন ঘুমাতাম। সে ঘোরতর ফর্মুলা বিরোধী, বৃহস্পতিবার সে আমাকে বলল পাম্প কর, বাচ্চার ক্ষুধা নিয়ে এত টেনশন না করতে। তারপর আমাকে বলল ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করতে আর রেস্ট নিতে আর বেশি বেশি ফিড করানোর ট্রাই করতে। ফর্মুলা না দেয়া বেটার এটা আমি জানতাম, কিন্তু কিভাবে মানুষ ফর্মুলা ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যায় তা জানতাম না। আমার নেইবারের সাথে কথা বলার সময় তিনিও বললেন ফর্মুলা ডিপেন্ডেন্ট হয়ে তিনি তার বড় ছেলেকে আর ব্রেস্টফীড করাতে পারেননি, পরে আর মিল্ক ফ্লো স্ট্যাবলিশ হয়নি।
আমি সারাদিনে বড়জোর তিনঘন্টা ঘুমাতাম। শুক্রবারে পেডিয়াট্রিশিয়ান দেখে বলল ওর ওজন বেড়েছে আগের চাইতে, আর ফর্মুলা দেয়া লাগবে না। এর মধ্যে সারাদিন ফীড করিয়ে আমি পাম্প করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। সিস্টার শ্যারন বলেছিলেন একসাইডে খাওয়াতে আরেক সাইডে পাম্প করতে। ট্রাই করেছিলাম, একে তো একই সাথে বাচ্চা আর পাম্প ধরা কষ্ট, আর বুঝতাম না, মনে হত এক সাইডে খেয়েই ক্ষিধা মিটে না, পাম্প করলে তো আর খেতে পারবে না (আমার মাথায় নিপল কনফিউশন ও ঘুরত তখন)।
আমি পারতপক্ষে ফর্মুলা দিতে চাইতাম না, অপরাধী লাগত নিজেকে। নিজেকে বোঝাতাম রিজিকের মালিক আমি না, রিজিকের মালিক উত্তম রিজিকদাতা। সারাদিন দোয়া পড়তাম ‘রব্বি ইন্নি লিমা আংজালতা ইলাইয়্যা মিন খইরিং ফাক্বীর’… সারাদিন ১০-১৫ মিনিট খাওয়া আর এরপরে ২০ মিনিট ঘুমের চক্রে ঘুরতাম। ফর্মুলা দিতে আমার প্রচন্ড গিলটি লাগত। আমার বোনের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় বুক ভাসালাম। আমার বোনের বাচ্চারা মিক্সড ফেড। আপু বলল আল্লাহ যা রিজিকে রেখেছে তাই পাবে। ফর্মুলা তো বিষ না। আপু কোথা থেকে শুনেছে জানি না, ও বলেছিল মিল্ক ফ্লো নাকি জেনেটিক, ও আমাকে বারবার বলত যেন ডাইপার কাউন্ট ঠিকভাবে করি।
শুক্রবার ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসার সময় বেটার হাফ কোমড়ে বেশ ব্যাথা পায়, যার কারনে দুইদিন ঠিকভাবে হাঁটতেও পারে নি। ঠিক ওইদিনই আমার টার্কিশ ফ্রেন্ডও অসুস্থ হয়ে যায়। আল্লাহ সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না এটা মনে রেখে আমি সারাদিন না ঘুমিয়ে বাচ্চা রাখলাম। বিকালে মাহদ ঘুমানোর পরে আমি যেই একটু ঘুমাব আবার শুরু করল কান্না। বেটার হাফ বলছিল ফর্মুলা দিতে এত অস্থির না হতে। আমি আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম, একই চক্র। পরেরবার যখন কান্না করল তখন আমার ব্রেকডাউন হল। আমি কান্নাকাটি শুরু করলাম। পরে ফর্মুলা দিলাম আবার।
শনি, রবি যাওয়ার পরে সোমবারে ফোন দিয়ে ল্যাকটেশন কনসালটেন্ট এর এপয়েন্টমেন্ট নিলাম মংগলবার। ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে বলেছিল। ব্রেস্টফীড করানোর পরে প্রায় একঘন্টায় 0.7 oz ট্রান্সফার করেছিল। ল্যাকটেশন কনসালটেন্ট বলে ওর টাং টাইড। মানে জিহবা নিচের তালুর সাথে লাগানো কিছুটা, তাই ও ঠিকভাবে ল্যাচ করতে পারে না। বাচ্চারা জিহবা দিয়ে খায়৷ আর মাহদ খাওয়ার সময় মাথা নাড়াত তাই টায়ার্ড হয়ে কিছুক্ষন পরেই ঘুমিয়ে পড়ত। ল্যাকটেশন কন্সালটেন্ট, মিন্ডির সাজেশন ছিল ও যখন টায়ার্ড হয়ে যায় তখন ওকে ফর্মুলা দিতে আর তখন যেন আমি পাম্প করি। এর আগে আমি পাম্প করার কোন সময়ই পাচ্ছিলাম না৷ আর ওরাল সার্জনের সাথে পরামর্শ করতে বলেছিল, হয়ত সার্জারী করলে বেটার হতে পারে। আরেকটা জিনিস ছিল, আমি ফীড করানোর সময় ব্যথা পেতাম, যেটা নরমালি হওয়ার কথা না। আর আমি যখন পাম্প করতে পারতাম তখন ১৫-৩০ মিলির মত এক্সট্রেক্ট হত।
যাই হোক, পরদিন ওরাল সার্জনের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে গেলাম আর মাহদের একটা সার্জারী করল। এগারদিন বয়স ছিল তখন। ছোট অবস্থায় সার্জারীটা মাইনর। চিনি পানি দিয়ে একটা এনেস্থিসিয়া দেয় এরপর লেজার দিয়ে জিহবার নিচের লিম্বটা কেটে দেয়। কোন ব্লিডিং হয় না সাধারণত। এরপরে ব্রেসটফীড করাতে বলে। সার্জারীর পরে আগের মত এত বেশি ব্যথা লাগে না। আর অল্প কিছু বেশি সময় জেগে থেকে খায় তখন। বাসায় টাং এক্সারসাইজ করাতে বলে।
সার্জারীর প্রথম সপ্তাহ বেটার ছিল। এর পরের সপ্তাহে আবার ব্যথা পাই আমি। এরমধ্যে ফর্মুলা দেয়া আর লাগত না। এক্সপ্রেস করা ব্রেস্ট মিল্ক বোতলে দিতাম। মনে হয় দশ- বার দিনের মত ফর্মুলা দিয়েছিলাম। ২৫ দিন বয়সে ডাক্তারের কাছে ফলোআপে গেলে ডাক্তার বলে কাটা জায়গাটা সারতে গিয়ে প্রায় আগের মত হয়ে গেছে। একই সার্জারী আবার করানো হয়। এইদফায় অবস্থা বেটার হয়। এর মধ্যে আবার জিহবা নতুন করে ব্যবহার করা শেখা, নতুন করে ল্যাচ করতে শেখাও বাচ্চার জন্য একটা বড় কাজ ছিল। মধ্যে মাড়ি দিয়ে কামড় দিত, প্রচুর বমি করত। এরমধ্যে একদিন আমি ডাল খাওয়ার পরে আমার গ্যাস হয়, সাথে বাবুরও গ্যাস হয়। সারা রাত কান্না। ওইদিনের এক্সপ্রেস করা দুধ ফেলে দিতে বলি বেটার হাফকে। টাং সার্জারীর ফলোআপে যাওয়ার পরে ডাক্তার বললেন জিহবা ব্যবহার করা নতুন শিখছে তাই প্রচুর বাতাস খাবে এখন আর তাই গ্যাস হবে। বাসায় আসার পর আমি ঘুমাচ্ছিলাম, গ্যাস হওয়ার দিনের এক্সপ্রেসড মিল্ক বেটার হাফ বাবুকে খাইয়েছে কারন তার আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। আবার সেই কান্না শুরু। পরে ৪ আউন্স দুধ ফেলে দিয়েছিলাম আমরা। আলহামদুলিল্লাহ দিন দিন অবস্থা বেটার হয়।
আমি প্রায় দুইমাস পাম্প করেছি৷ প্রায় প্রতিবার খাওয়ানোর পরে ১৫-২০ মিনিট আর একবার পাওয়ার পাম্প করতাম। মাহদ খুব আস্তে খেত, টাং সার্জারীর পরেও প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগত। শুরুতে আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কখন পাম্প করব তার সময় এবং উপায় বের করা। মিন্ডির সাথে প্রথম এপয়েন্টমেন্ট এর পরে পাম্পিং ব্রা কিনেছিলাম। মিন্ডিকে আমি সাপ্লিমেন্ট এর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তর ছিল পাম্প করাই একমাত্র পরীক্ষিত উপায়।
পাম্প করা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও প্রচন্ড স্ট্রেসফুল। যখন ক্ষুধার কষ্ট গেল মাহদের এরপর শুরু হল ঘুমের জন্য কান্না। মাহদ আব্বার সাথে সারাদিন মোটামুটি থাকত। আমি খালি খাওয়াতাম আর পাম্প করতাম৷ এরপরে হয় আমি নাহয় বেটার হাফ পাম্পের যাবতীয় সরঞ্জাম ধুয়ে রাখতাম। আমি টানা দুই ঘন্টাও ঘুমাতে পারতাম না। পাম্প করার সময় থালাবাটি ধুতাম আর মাঝেমাঝে রান্না করতাম। সপ্তাহ খানেক পরে দুই একদিন আমার ঘুমে মাথা ঘুরত। বাচ্চাকে ঘুমে কোলে নিতে পারতাম না, মনে হত পড়ে যাবে। পরে পাম্পিং এর কিছু খুঁটিনাটি শিখলাম মিন্ডির কাছ থেকে,পাম্পের লেট ডাউন মোড ইউজ করা, মাঝরাতে পাওয়ার পাম্প করা, নাইট ফিডিং স্কিপ না করা, মাত্র ২% মায়েরা ব্রেস্ট ফীড করাতে পারে না, মিক্সড ফীডিংও একটা অপশন, মিল্ক ফ্লো বাড়াতে গেলে ব্রেস্ট এম্পটি হতে হবে পাম্প করার পর…
ডেলিভারির আগে সিস্টার শেরন আমাকে ব্রেস্টফিডিং এর একটা বই দিয়েছিলেন। বইতে বলেছিল ব্রেস্টফিডিং একটা ন্যাচারাল ব্যাপার, এখনকার সময়ে ব্রেস্টফীড করা কঠিন হয়ে গেছে জীবনের স্ট্রেসের কারনে। রেস্ট আর স্ট্রেস যে কি পরিমানে প্রভাব ফেলে এটা আমি নিজেই দেখেছি। আল্লাহ আমার নিজের রিজিকের মালিক,আমার বাচ্চারও মালিক। শুরুতে মন খারাপ ছিল কেন বুঝিনি যে ব্রেস্ট মিল্ক আসেনি, পরে যখন মাহদের টাং টাই এর কথা জানলাম তখন এত বেশি কষ্ট লাগত!
শুরুতে মিল্ক আসলে এসেছিল, হ্যান্ড এক্সপ্রেস করে খাওয়ানোর পরে জন্ডিস সেরেছিল। আমাকে বাচ্চা খেতে পায় কিনা এটা জিজ্ঞেস করলে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হত। বাচ্চাকে তো আমি না খাইয়ে রাখি না। অযাচিত প্রশ্ন এবং উপদেশ দিলে মাথার তালু মনে হয় জ্বলে উঠত। আলহামদুলিল্লাহ যেদিন মিন্ডি আমাকে বলেছিল আর পাম্প করা জরুরি না সেদিন আমি মারাত্মক খুশি ছিলাম।
আমি কিছু ব্রেস্টমিল্ক স্টোর করতে পেরেছি। এখন আবার হালকা পাম্পিং সেশন শুরু করতে হবে এক-দুই বেলার দুধ রেখে কিছুসময় অফিসে যাওয়ার জন্য। এই সময়টাতে বেটার হাফ অনেক বেশি সাহায্য করেছে। তাই মাহদের ব্রেস্টফিডিং জার্নি শুধু ওর মায়ের আর মাহদের ছিল না, ওর বাবারও ছিল। আলহামদুলিল্লাহ মাহদ এখন আগের চেয়ে অনেক বেটার ল্যাচ করতে পারে। এখন আর বোতলে দেই না গ্যাস হচ্ছিল তাই। একমাস পরে একদিন টার্কিশ ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার সময় বলছিলাম এখনও পাম্প করি ও জিজ্ঞেস করল এখনো কেন। আমি বললাম ঠিকভাবে বাচ্চা ল্যাচ করতে পারলে মিল্ক ফ্লো স্ট্যাবলিশ হবে, কিন্তু ঠিকভাবে করতে হবে। মাহদ আগে ঠিকভাবে ল্যাচ করতে পারত না। তখনও শিখছিল, যেহেতু ও আগে অন্যভাবে শিখেছিল এখন পুরনো শিক্ষা ভুলে নতুনভাবে শিখতেও কিছু টাইম লাগবে। পরে সেই ফ্রেন্ড বলল যখন ওকে বলেছিলাম ল্যাকটেশন কন্সালটেন্টের কাছে যাব ওর মনে হয়েছিল গিয়ে কি হবে। কিন্তু ও কিছু বলেনি আমাকে। ওর মতে পাম্প করলেই তো ফ্লো আসবে। পরে পুরো ঘটনার পর ও আমাকে বলেছিল মায়ের একটা ইন্সটিংক্ট থাকে, কিভাবে যেন আল্লাহ মায়েদের বুঝিয়ে দেন… টাং টাই শুধুমাত্র ব্রেস্ট ফীডিং এ ইফেক্ট করে না, সলিড খাওয়ায়, এমনকি কথা বলাতেও ইফেক্ট করতে পারে।
যাই হোক, আমার মনে হয়েছে ল্যাকটেশন কনসালটেন্ট এর সাহায্য নেয়া ওইসময় আমার জন্য লাইফ সেভার ছিল। ইন শা আল্লাহ হয়ত কারো আমার এই দীর্ঘ লিখা কাজে আসবে। আল্লাহ উত্তম রিজিকদাতা এই ভরসা রেখে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেললেও ইন শা আল্লাহ মিল্ক ফ্লো বাড়বে।
– উম্মে মাহদ,
রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ ৮