ভিব্যাক ও রিপিট সিজারের গল্প
- Posted by MNCC Moderator
- Categories Blog, Doula Service, Rabeya Rowshin
- Date October 20, 2023
- Comments 0 comment
জুন ২০২৩
১।
জুনের শুরুর দিকে ইডিডি ছিল ব্যাচ ১১ এর আকলিমা আকতার আখি আপুর। আপু নোয়াখালীর একটি গ্রামে থাকেন। ভিব্যাকের আশা করছিলেন।
আগের বার পেইন উঠেছিল, অনেকক্ষণ ট্রায়ালের পর সিজার করা হয়। আপুর মতে ওই সময় নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে নলেজ ছিল না, লেবার প্রগ্রেস করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি তাই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
গ্রামের বউ হিসেবে বাচ্চার দেখাশোনা, ঘরের কাজ সবমিলিয়ে মোটামুটি একটিভ ছিলেন। ব্যায়াম, ম্যাসাজ সবকিছু ঠিকঠাক করা হচ্ছিল না যেহেতু সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না, হাজব্যান্ডও দূরে থাকেন।
আপু কয়েকটা হাসপাতালে ও একজন মিডওয়াইফের সাথে কথা বলেন ডেলিভারি নিয়ে। এর মাঝে মিডওয়াইফের কাছে ডেলিভারি করাবেন ঠিক করেন, কোন ইমার্জেন্সিতে কাছাকাছি হাসপাতালের ব্যবস্থা আছে আমাকে জানালেন। শেষ দিকে বিভিন্ন শারীরিক ব্যাথা, পেইনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গোণার টেনশন ছিল। হিমোগ্লোবিন কম ছিল বলে বাসার মানুষ নিরুৎসাহিত করছিল ভিব্যাকের জন্য। আপু হিমোগ্লোবিন বাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
আল্লাহর রহমতে সময়মতো উনার ন্যাচারালি পেইন ওঠে রাতে। পানি ভেংগেছিল ঘরে থাকতেই। পরদিন হাসপাতালে যান। মিডওয়াইফ একটা হাসপাতালে নিয়ে যান উনাকে এবং সেখানেই ডেলিভারি হয়। আপু জানিয়েছেন স্টাফরা উনাকে এক্সারসাইজ করতে ও মুভমেন্ট করতে সহযোগিতা করেছেন। উনি ডিপ ব্রিদিং ও অন্যান্য একটিভিটির মাধ্যমে যেভাবে পেইন ম্যানেজ করছিলেন তাতে উনারা অনেক প্রশংসা করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। উনারা আপুর পর্দার প্রতিও সহযোগিতা করেছেন।
তবে আপুর পুশিং স্টেজ অনেক লং হয়, প্রায় ২ ঘন্টা। দু:খজনকভাবে শুয়ে পুশ করতে বলা হয় আপুকে, তাই হয়ত আরো দেরী হচ্ছিল। সাপোর্টেড স্কোয়াট বা পাশ ফিরে শোয়া পজিশনগুলো ট্রাই করার সুযোগ আমাদের দেশের মায়েদের জন্য সব জায়গায় তৈরি হলে খুব ভালো হতো!
এই সময় মেডিকেল স্টাফ ও আপুর পরিবারের মানুষদের মাঝে অনেক টেনশন তৈরি হয়। আপু সর্বোচ্চ চেষ্টা করে পুশ করছিলেন কিন্তু বাচ্চা একটু বের হয়ে আবার ঢুকে যাচ্ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বেবি নরমালভাবে ডেলিভারি হয় আলহামদুলিল্লাহ। দেখা যায় বাচ্চার গলায় ৪-৫টা কর্ড পেচানো ছিল তাই হয়ত পুশিং এত লং হচ্ছিল! আল্লাহর রহমতে বাবু জন্মের পর সুস্থ ছিল, কোন বিশেষ ট্রিটমেন্ট লাগেনি।
প্রায় ৩ বছরের গ্যাপে আপুর ভিব্যাক হয়, আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ধরনের প্রতিকূলতার পরও আল্লাহ সম্ভব করেছেন। এত দিনের দৌলা সার্ভিস দেয়ার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, আল্লাহ যখন সহজ করেন তখন অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও তা করতে পারেন। আবার যার জন্য আল্লাহ নরমাল ডেলিভারি বা ভিব্যাক নির্ধারণ করেননি তার হয়ত অনেক চেষ্টাতেও তা হয় না। কিন্তু চেষ্টা করার দায়িত্বটা তারপরও আমাদের অবশ্যই থাকে। তার উত্তম প্রতিদানও আল্লাহর কাছেই রয়েছে।
এবার তেমনই আরেকটি গল্প বলব।
২।
জান্নাতুল ফেরদৌস রুমি – মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার বিডির ফেসবুক group ও টেলিগ্রাম group একটি পরিচিত নাম। আপু ১ম প্রেগন্যান্সিতে রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স করেন ৩য় ব্যাচের সাথে। ব্যাচের অন্যতম একটিভ student ছিলেন, মাশাল্লাহ। নরমাল ডেলিভারির প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। আপুর জেস্টেশনাল ডায়বেটিস ছিল, ৩৮ সপ্তাহের পর আর ডাক্তার অপেক্ষা করতে চাননি।
পেইন ইনিডিউস করা হয়। আপু বলেন, একা একাই পেইন মেনেজমেন্টের চেষ্টা করেন। হাসপাতাল স্টাফরা তেমন সহযোগী ছিল না, সাথে থাকা হাজব্যান্ডও নিজের অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল। অনেকক্ষণ ট্রায়ালের পর শেষ দিকে বাচ্চা উপরে উঠে যায়, হার্ট রেট কমে যায়। ডাক্তার সিজার করে ফেলতে বলেন।
পরবর্তী প্রেগন্যান্সিতে আপু ভিব্যাক ট্রাই করতে চান। এবার নতুন করে হাজব্যান্ডসহ রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্সে জয়েন করেন ১১তম ব্যাচে। আলহামদুলিল্লাহ কাপল হিসেবে কোর্স করার পর আপু হাজব্যান্ডের মাঝে অনেকটাই পরিবর্তন লক্ষ করেন। কিছু বিষয়ে বাড়তি কেয়ার নেয়া শুরু করেন যা প্রথম প্রেগন্যান্সিতে আপু পাননি।
এরপর প্রেগন্যান্সি আরো প্রগ্রেস করলে ১৩তম ব্যাচের সাথে আবারও কোর্সে জয়েন করেন। মূলত কোর্সের বিষয়গুলো রিভিউ করতে, নতুন যোগ হওয়া কন্টেন্ট জানতে ও টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে ইন্সট্রাক্টর ও ডাক্তার মডারেটরের সংস্পর্শে থাকার জন্য অনেক প্রাক্তন স্টুডেন্টই রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স রিপিট করেন এবং তাদের জন্য কোর্স ফি-টাও অনেক কম রাখা হয়।
যাই হোক, আপুর বিষয়ে একটু বলি – আপু নিজে শেফ কোর্স করেছেন। পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে বেশ ভালো জ্ঞান রাখেন। রৌদ্রময়ীর বেবী সলিড কোর্সটাও করেছেন। নিজের বাচ্চাকে ঘরে নানা রকম মজাদার পুষ্টিকর খাবার বানিয়ে দেন, বারাকাল্লাহু ফীহা। তো, ২য় প্রেগন্যান্সিতেও আপুর জেস্টেশনাল ডায়বেটিস ধরা পড়ে। একজন নিউট্রিশনিস্টের দেয়া ডায়েট চার্ট ফলো করেন আপু। উচ্চ মাত্রার প্রোটিন গ্রহণ করেন নিয়মিত। পর্যাপ্ত পানি খান। ব্যায়ামের প্রতি খুব সচেতন। আলহামদুলিল্লাহ হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলেন।
আপুর ২৯ সপ্তাহে টেস্ট রিপোর্ট এ ফ্লুইড ছিলো ১১ সেমি। হঠাৎ একদিন বাচ্চার নড়াচড়া খুব মাইল্ড ছিলো। নরমালি শুরু থেকেই বাচ্চা খুব স্ট্রংলি নড়ে যেমন ২০-২৫ বার। তারপর ইমার্জেন্সি কালার ডপলার স্টাডি করে দেখা গেলো মাত্র ২ সপ্তাহে ফ্লুইড কমে ৯ সেমি হয়ে গেছে। ডাক্তার আপুকে বেশি বেশি রেস্ট নিতে বলেন, কিন্তু পরবর্তী ২ সপ্তাহে আপুর একটুও রেস্ট হয়নি। মেয়ের জ্বর ছিলো, যার কারণে রাতেও রেস্ট হয়নি। এরপর আবার ৩ দিন ধরে বাচ্চার নড়াচড়া খুব ধীর হয়ে যায়। আপু প্রতিদিন ১ টা করে প্রেগকেয়ার খান, সাথে হাই প্রোটিন ডায়েট তো ফলো করছেনই।
এরপর ৩৩ সপ্তাহের আল্ট্রায় পানি কমে ৬ সেমিতে চলে আসে। ডাক্তার আপুকে হাসপাতালে ভর্তি থেকে স্যালাইন ও অক্সিজেন দেন। এভাবে ১ দিন পর আল্ট্রা করে দেখা যায় পানি বর্ডার লাইনে মানে ৮ সেমিতে আসে। ১ সপ্তাহ ফুল বেড রেস্টে থেকে আল্ট্রা করতে বলে।
৩৫ সপ্তাহে পরের আল্ট্রায় হঠাত দেখা যায় পানি কমে ৩ সেমিতে চলে এসেছে!! ডাক্তার সিজারের জন্য দ্রুত এডমিশন নিতে বলেন। আমি জেন্টেল সিজারের বিষয়গুলো আপুকে মনে করিয়ে দিয়ে ডাক্তারকে জানাতে বলি।
জন্মের পর বাবুর নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। বাবুকে NICU তে রাখে। আপুর থেকে ব্রেস্ট মিল্ক নিয়ে বাবুকে খাওয়ানো হয়। একদিন পর বাবুকে সরাসরি খাওয়ানোর জন্য আপুর কোলে দেয়া হয়। আলহামদুলিল্লাহ বাবু নিজে সাক করে খেতে পারে আর তাই কেবিনে দেয়া হয়।
রুমি আপুই এখন পর্যন্ত একমাত্র পার্টিসিপ্যান্ট যিনি ৩ বার রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্সে এনরোল করেছেন। আপুর হেলদি লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা, নরমাল ডেলিভারির প্রতি প্রবল অনুরাগের কথা জানি বলে আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে। আপুর কথাই তুলে ধরছি, “ভিব্যাকের ইচ্ছা ছিলো, দুয়াও করেছি অনেক। হয়নি ভিব্যাক, তাতে আফসোস নাই। এর মধ্যেই আল্লাহ উত্তম কিছু রেখেছেন। এখন আমার একটাই চাওয়া আল্লাহ আমার বাবুকে সুস্থ করে দিক, সুন্দরভাবে যেন বাসায় নিয়ে যেতে পারি, ঘরটা যেন আলোকিত থাকে।”
শারীরিকভাবে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করায় আপু বলেন, “হসপিটালে আমি আর বাবুর বাবাই আছি।
আলহামদুলিল্লাহ নিজে নিজে উঠাবসা ২য় দিন থেকেই করছি। বাবুকেও ২ দিন ধরে একাই কোলে নেয়া, ডায়পার চেঞ্জ, বার্পিং করানো সব করছি। আপাতত কোনো ব্যাথার ঔষধও খাচ্ছি না।”
৩।
উপরের দু’জন মায়ের মাঝে কে জিতেছেন? কেউ কি হেরেছেন?
হার-জিতের প্রসংগ কি তোলা যায় এখানে?
নাহ!
দু’জনই সাধ্যানুযায়ী নিজের যত্ন নিয়েছেন। আল্লাহ দু’জনকেই উনার নির্ধারিত উপায়ে তাদের এর প্রতিদান দিয়েছেন। যদি এই মায়েরা প্রেগন্যান্সি নিয়ে নিজেদের শিক্ষিত না করতেন তাহলে প্রথম গল্পের মা কি পারতেন এত সুন্দরভাবে লেবার পেইন মেনেজ করতে? দ্বিতীয় গল্পের মা কি পারতেন সঠিক ডায়েট ও এক্সারসাইজ মেইনটেইন করে নিজেকে ফিট রাখতে যা উনাকে সিজারের পর দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করছে?
কিছু বিষয় আল্লাহর হাতে থাকে। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু যে বিষয়গুলো আমাদের হাতে আছে সেসবে আমরা যদি অবহেলা করি তাহলে নিজেদের প্রতিই অযত্ন হবে, অযথা জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠবে!
রাবেয়া রওশীন
ভার্চুয়াল দৌলা, রৌদ্রময়ী স্কুল
Other post
You may also like
যৌথ পরিবারে নতুন মায়ের জন্য টিপস
১।অনেকগুলো একক পরিবার যখন একসঙ্গে থাকে তখন সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে যায়, সেখানে সবার আলাদা কিছু দায়িত্ব থাকে এবং ছকে বাঁধা কিছু নিয়মও থাকে। একক পরিবারে আমরা নিজের মত কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি পাই যা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ে পাওয়া যায় …
ছোট বাবুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য – আসুন সচেতন হই
খাদিজা তার এক মাস বয়সী মেয়ে আমিনাকে কোলে নিয়ে ঘরের মৃদু আলোয় বসে ছিলেন। রাত বাজে আড়াইটা। জানালা ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো ঘুমের কুয়াশা ভেদ করে তার মুখে এসে পড়ল। হঠাৎ থেমে থেমে আমিনার কান্নার শব্দ বাড়ে এবং কমে। …
যেভাবে সন্তানকে ভালো রাখা যায়
আমার বাচ্চাটাকে কানাডাতে আলহা’মদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত রব্বুল আ’লামীন হিফাজতে রেখেছেন। আমি সাধারণত আমার বাচ্চাকে নিয়ে কখনও গর্ব করি না, তার ছবি পোস্ট করি না, খুব একটা কিছু লিখিও না। আল্লাহর আমানত, আমার অহংকার করার কিচ্ছু নাই। আজকে লিখছি, একটা বাচ্চা …