
আগের দিনে বাচ্চাকাচ্চারা অনেক ভাইবোন, জয়েন্ট ফ্যামিলির মানুষজন আর পাড়া পড়শীদের সান্নিধ্যে কোলে পিঠে খেলাধুলা করে বড় হয়ে যেত। আর এখন পাশের বাসার বাচ্চা পর্যন্ত অন্য ফ্ল্যাটে আসে না, তার হাতেও গেমস, ইউটিউব। এখন সবার এত বেশি ব্যস্ত জীবন ইভেন জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকলেও যে যে যার যার মত জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে, আর এখনকার মানুষের কাজের ফাঁক আর অবসর তো পুরোই খেয়ে নিয়েছে স্মার্টফোন। একলা একা শুধু মা আর শিশু।
আগের যুগের বাচ্চাদের চারপাশে কত্ত খোলা জায়গা ছিলো। বাচ্চারা শেখেই খেলতে খেলতে চারপাশের বিভিন্ন জিনিস এক্সপ্লোর করে করে। এখন শহুরে বাচ্চার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতো ছোট জায়গাতেই মেটাতে হবে। ছোট ফ্ল্যাটে সারাদিন এটা ধরে, সেটা ভাংগে, ওটায় ব্যাথা পায়। এগুলা গোছাতে , থামাতে , সামলাতে মায়ের জীবন শেষ। এর জন্য স্বাভাবিক বাচ্চাকেও অতি চঞ্চল মনে হয়। আসলে দোষ বাচ্চার না, দোষ এনভায়রমেন্টের।
এদিকে মায়ের প্রতি মিনিট বাচ্চার পিছনে দেয়া যায়না। তার কাজ করতে হয়, খেতে হয়, গোসল করতে হয়, প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয় ।একা বাসায় থাকলে মা বাধ্য হয়ে ওই সময় বাচ্চাকে দেয় স্মার্টফোন। সেই থেকে বাচ্চার নেশা হয়ে যায়। পরে শুরু হয় স্পিচ ডিলে, অতিরিক্ত জেদি হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ব্লু লাইটের প্রভাবে ব্রেইন হাইপার এক্টিভ হয়ে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা।
ভাবুনতো একটা ছোট্ট শিশু যার কোন খেলার সাথী নাই, সারাদিন একটা বড় মানুষের সাথে চার দেয়ালে বন্দী। সেই বড় মানুষটা আবার সব কাজ সামলে আর টানা সারাদিনের একটা বাচ্চার পিছনে দোড়াতে দোড়াতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। যার কাছে বাচ্চার শিশু সুলভ আচরন গুলা খুবি বিরক্তিকর। বাচ্চাটা তার নতুন দুনিয়ার কৌতুহল মিটাতে যাই করতে যাচ্ছে তাতেই বাধা পাচ্ছে। ছোট্ট একটা বাবু লোনলি ফিল করে ,ভাবা যায়!
এখনকার শিক্ষিত মায়েদের আছে পড়ার চাপ, ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পরার চাপ । একদিকে তার বাচ্চা দেখার কেউ নেই, অন্যদিকে তার চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, চাকরি না করলে আবার আপনারা সামাজিকভাবে তাকে প্রচুর হেয় করেন, মেরুদন্ডহীন টাইপ ট্যাগও দিয়ে ফেলেন। আরেকদিকে যাদের চাকরি আছে তাদের অফিসগুলোতে নাই একটা ডে কেয়ার, পাওয়া যায় না বাচ্চা পালার কাজের লোক। এই কূল ঐ কূল দুই কূলে নাকানিচুবানি খেয়ে খুবই করুণ অবস্থা।
যাদের বাসায় মা/বোন আছে অথবা বার/পনের হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চার জন্য গভার্নেস/ন্যানী রাখার ক্ষমতা আছে তাদের কথা আলাদা।
আগের যুগে নারীর শুধু সংসার ছিলো। পারিপার্শ্বিক এতো চাপ ছিলোনা।
এতো ধকলের মধ্যে এ যুগে আবার আছে মায়ের ছিমছাম সুন্দরি থাকার প্রেশার। এই চাপে ডায়েট করতে গিয়ে অনেক মা আরো দূর্বল হয়ে যায়। এমন মানসিক প্রেশারও আগের নারীদের পোহাতে হয়নি।
এই পুঁজিবাদ নারীর শ্রম চায়। কিন্তু নারী মাত্রই যে মা হবে, তার সন্তান তার একার না, সে ভবিষ্যত মানব সম্পদ, যার সুবিধা দেশ ও সমাজ ভোগ করবে। তার দায় তারা এড়াতে চায়। গর্ভকালীন, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়ার বেলায় তাদের কৃপণতার শেষ নাই।
যৌথ পরিবারেরও সবার আগে চাই মায়ের কাজ, তা সে রাতে ঘুমাতে পারুক কী না পারুক, তার বাচ্চা কাঁদুক, কী জ্বালাক। সব ম্যানেজ করে যেভাবেই হোক সার্ভিস দিয়ে যেতে হবে।
না ঘর না পর, কেউ মাকে বলেনা, একটু জিরাও।
মায়েরও ক্লান্তি আসে।
একালের মায়েরা ক্লান্তির কথা বললেই শুনতে হবে আগের দিনের নারীরা ১০টা বাচ্চা সামলেছে আর তোমাদের একটা পালতেই অবস্থা খারাপ। কিন্তু কোন কিছুই যে আর আগের মতো নেই এটা তারা দেখেও দেখেনা।
আগে তো বাচ্চার খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়া, প্যারেন্টিং- এও এতো মনযোগ দেয়া লাগতোনা। এখন মায়েদের সিস্টেমের মধ্যে পরে অনেক দিক খেয়াল রাখা লাগে।
আসলে অসম্ভব তুলনা মানুষ শুধু নারী ও শিশুর ক্ষেত্রেই করতে পারে। কোন পুরুষকে কেউ কখনো বলে না যে বাপ দাদারা এত কষ্ট করে ক্ষেতে খামারে কাজ করেছে, তোমরা এসিতে কাজ করেই এত ক্লান্ত হয়ে যাও কেন।
অথচ মেয়েদের ঠিকই বলে আগে তো মেয়েদের প্রেগনেন্সিতে এতো ভালো খাওয়া, এতো যত্ন লাগতো না, সিজার লাগতো না, তোমাদের লাগে কেন। এতো অবহেলা অযত্নেই তো আগের মহিলারা কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যেত। আর এখন তো ছেলের বউয়ের চল্লিশেও ক্যাট্রিনার মত দেখতে লাগা চাই, যা আগের দিনের মানুষ চাইতো না।
আগের যুগে উনাদের অল্প বয়সের অবহেলার ফল বয়স্ক মহিলারা এখন ঠিকই ফেইস করছে। ঘরে ঘরে দেখবেন বয়ষ্ক নারী সদস্যের জরায়ু অপারেশন লাগছে, হাটু ব্যাথাসহ আরো নানা ব্যাথা, ক্যালসিয়ামের সমস্যা জনিত রোগ, গাইনী রোগ লেগেই আছে। আগে যদি সমস্যা না-ই হতো তাহলে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় বা এর কিছুদিন পরেই মাতৃমৃত্যু এতো বেশি ছিলো কেন?
একে তো নতুন মা এত্তো কিছু সামলিয়ে নাজেহাল, তার উপর কেউ এমন তুলনা করলে এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। যদি আমাদের পরিবারের কোন সিনিয়র সিটিজেন পরিবারের নতুন মাটিকে এগুলো বলেন আমাদের উচিত তাকে বুঝিয়ে বলা। তাকে অন্যের মনে আঘাত দেয়ার পাপ থেকে বাঁচিয়ে দেয়া।
যে কোন নতুন পরিস্থিতিতেই সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল সিচুয়েশনে থাকে মা ও শিশু৷ সেটা যুদ্ধ, মহামারী বা যে কোন অবস্থাই হোক না কেন। এই একুশ শতকের চ্যালেঞ্জিং পরিবর্তনের ধকলটাও তাদেরই সামলাতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
এখন সবার ব্যাস্ত জীবন, সামাজিক দূরত্ব, খাবারে ভেজাল, বদ্ধ ঘর, খেলার জায়গা ও খেলার সাথীহীন শৈশব, স্ক্রিনে আসক্তি এই সব মিলিয়ে মা ও শিশুরা একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
শিশুরাই আগামী। মা ভাল না থাকলে ভাল থাকেনা শিশুরা। আর ওরা খারাপ থাকলে খারাপ হবে আগামী দিন। শুধু আগের দিনের সাথে তুলনায় না গিয়ে আসুন মা ও শিশুর প্রতি সহানুভুতিশীল হই। সমাধানের পথ খুঁজি।
তামান্না তাবাসসুম
লেখক ও শিক্ষক
রৌদ্রময়ী প্রিনেটাল কোর্স পার্টিসিপ্যান্ট, ব্যাচ ২