সিজারিয়ান অপারেশন যখন ট্রেন্ড
আচ্ছা, যাদের নরমাল ডেলিভারি হয়েছে বা হয়নি.. যাদের যেটুকুই সমস্যা হয়েছে ডাক্তারের কারণে কেউই খুব করে কষাই বলতে ছাড়েননি। অথচ নরমাল ডেলিভারি হয়েছে এমন নারীদেরও ডাক্তারের প্রতি এপ্রিসিয়েশন নেই বললেই চলে। অনেকটা, বাঁচলে কপাল ভালো, মরলে ডাক্তারের দোষ।
কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? দেশে এতো এতো সিজারিয়ানের পেছনে কি শুধু ডাক্তারেরই সকল দায়বদ্ধতা! নাকি একটা বড় সংখ্যক প্রেগনেন্ট মা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের “জ্ঞানের অভাব”ও অনেকাংশে দায়ী!!
আমি আজ আমার ইন্টার্নশীপের কিছু এক্সপেরিয়েন্স আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই৷
১. ম্যাডাম, কাল আমাদের এনিভারসারি। বাবু হওয়ার ডেট আর পাঁচদিন পরই, তাই কালকেই তুলে নিতে চাচ্ছি।
২. দুইটার বেশি তো নিবো না, কষ্ট করে নরমালের কী দরকার? সিজারই করে দেন।
৩. (লেবার পেইন নিয়ে) বাচ্চা বের হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি সিজার করেন!
৪. ম্যাডামকে বলেন নরমালে চেষ্টা করার দরকার নাই, পরে মিলনে সমস্যা হতে পারে, আমি ওটা চাচ্ছি না। (রোগীর হাজব্যান্ড)
৫. নরমালে করালেন কেন? এখন আমার জামাই আমার মেয়েকে নিবে? আমরা কেস করবো আপনাদের নামে! (নরমালে হবার পর রোগীর মা, উনারা পরে বাচ্চা কোলেই নিতে চাচ্ছিলেন না।)
৬. আগামী মাসে আমার পরীক্ষা, তাই এই মাসেই বাচ্চাকে ওষুধ দিয়ে পাকা করে তুলে নিতে চাচ্ছি। (লাংস ম্যাচ্যুরেশন)
৭. বড় হাসপাতালে সিজার না করলে আমার ননদ, জায়েরা হাসাহাসি করবে। নরমালে করলে বলবে টাকা নাই আমাদের।
৮. সিজার করলে ছাড়পত্র দেখালে অফিসে বেশি ছুটি পাবো, নরমালে এত দিবে না।
৯. নরমালে আগেরটা হয়ে পরেরদিন থেকেই সব কাজ করা লেগেছিল, এবার তাই সিজার করতে চাই।
১০. এখন আর নরমালে করার দিন আছে? আমরা পুরনো যুগের মানুষ না।
১১. বাচ্চা পেটে আসা থেকে তো কয় বস্তা টাকা তো ওই ***কেই দিসি (আমার ম্যামের নাম ধরে), আর এখন কষ্ট করে নরমালে চেষ্টা করতে বলছে ***!
এগুলো সব রোগীদের এবং তাদের ফ্যামিলির কাছ থেকে শোনা। এবং এগুলো তখনই শুনেছি যখন দেখেছি সব ঠিকঠাক থাকার পরও তারা সিজার করতে এসেছেন। আরো অসংখ্য অসংখ্য ঘটনা আছে এমন। আমরা তাদের বারবার বুঝিয়েছি, এপিশিওটমি আর সিজারের পার্থক্য বলেছি, সিজারের পরবর্তী কমপ্লিকেশন বলেছি। তবুও, “বাচ্চা তুলে নিতে এসেছি”। জাস্ট এই একটা লাইনেই আমাদের আর বলার কিছু থাকতো না। অসহ্য লাগতো এই লাইনটা শুনতে। কই, সেগুলো তো প্রকাশ পায়না।
কারণ আমরা নিজেদের দোষ ঢেকে রাখতে চাই কিন্ত অন্যদেরটা ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করতে বড় ভালো লাগে!
আমার নিজেরও সিজার লেগেছে। আমি মনেপ্রাণে চাইতাম আমার এবং আমার আশেপাশের সব্বার নরমালে হোক, এজন্য কত বুঝাতাম, কতকিছু পড়তে দিতাম! অথচ আমার কমপ্লিকেশন ছিল সবচেয়ে বেশি।
অথচ আমার চেয়ে কম বা বিনা কমপ্লিকেশনের সবাইকে আমি যতই বুঝাইনা কেন, প্রত্যেকে শখে বা প্যানিকড হয়ে সিজার করেছে। কারণ সিজার করাটা এখন অনেকটা ট্রেন্ড, যেমন ট্রেন্ড কিছু হলেই ডাক্তারকে কষাই বলে দোষ দেয়া।
কেউ যদি আমাকে বলেন আমি বা আমি যাদের সাথে ডিউটি করেছি, যাদের আন্ডারে ডিউটি করেছি তারা ছাড়া নরমালে করাতে ট্রাই করেন বা বোঝান এমন ডাক্তার নাই বা খুবই কম, আমি অবশ্যই বিশ্বাস করবো না। কিছু মানুষ সব পেশায় খারাপ। সব জায়গায়! কিন্ত ভালোর সংখ্যা এখনো বেশি। সেটা খুজে বের করা আহামরি কঠিন না। তবে ফেসবুকে আক্রোশ মেটানোর মত এত সহজও না। তাই সিদ্ধান্ত আপনার। নিজেকে ভিকটিমাইজ করে অন্যকে দোষ দিবেন নাকি আসলেই নিজের জন্য কষ্ট করে প্রপার কোনো স্টেপ নিবেন।
ডা: ইসরাত জাহান প্রমা,
রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স, ব্যাচ ৮